নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
আগের পর্বের লিংক : আকাশযাত্রা - প্রথম পর্ব - অবতারণা
রামালা স্কুলজীবন থেকেই গানে নাম করেছিল। স্কুলের যে-কোনো কালচারাল ফাংশানে ওর গান ছিল মূল আকর্ষণ। শুধু আমাদের স্কুলেই না, অন্যান্য স্কুলেও ওকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হতো, আর থানা সদরে সম্মিলিত ফাংশনগুলোতে ওর জন্য শুধু আমরা সহপাঠীরা না, আমাদের পুরো স্কুলই গৌরব বোধ করতো।
স্কুল সেকশন পেরিয়ে যখন কলেজে উঠলো রামালা, ওর নামডাক আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। স্থানীয় ক্লাবগুলোতে মাঝে মাঝে শহর থেকে বড়ো শিল্পী এনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে অবধারিতভাবে রামালার ডাক পড়তো। মজার বিষয় হলো, আমন্ত্রিত শহুরে শিল্পীদের দু-চারটা গানের পরই দর্শক সারি থেকে সমস্বরে ‘রামালা’ ধ্বনি উঠতো। রামালা একবার স্টেজে উঠলে সেদিন অন্য শিল্পীরা ফ্লপ হতো।
সে সময়ে আমরা আজকের মতো ‘সেলিব্রেটি’ শব্দটার সাথে বহুল পরিচিত ছিলাম না, আমরা ‘তুমুল নামডাক’ শব্দটা ব্যবহার করতাম, যার সাথে আজকের ‘সুপার সেলিব্রেটি’ শব্দটাই প্রযোজ্য।
যে-কোনো গানের আসরে রামালা আমাকে সঙ্গে নিত। ওর পাশে আমাকে বসিয়ে গান গাইত। বলাই বাহুল্য, রামালার পাশে বসতে পারা আমার জন্য অজস্র সুখ ও আনন্দের ছিল, ভালো লাগতো খুব, এবং এই ভেবে গর্ব হতো যে রামালার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার সখ্য বা ঘনিষ্ঠতা আছে। এ নিয়ে আমার অন্য বন্ধুরা ঠাট্টা-মশকরা কম করতো না; কেউ কেউ গোপনে গোপনে হিংসাও করতো, তা ওদের চোখ ও আচরণ দেখেই বোঝা যেত।
২
একদিন রামালা ক্লাসে এলো শাড়ি পরে। ছাত্ররা মুগ্ধ হলো, খুব করে রামালার দিকে তাকালো, প্রকাশ্যে বা চোরা চোখে। মেয়েরাও কম তাকালো না ওর দিকে, এবং আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওর খুব প্রশংসা করলো ওরা। মেয়েদের এরূপ তীর্যক রসালো ঠাট্টাবাক্যে আমি অবাক হলাম। তাহলে কি ওরা জানে, আমি রামালার প্রেমাসক্ত? আশ্চর্য তো! আমার কোনো আচরণে আমি নিজেও টের পাই নি রামালার প্রতি আমার কিছু দুর্বলতা আছে। যতটুকু আছে, তা যে-কোনো ছেলের যে-কোনো মেয়ের প্রতিই আছে। তাহলে? তাহলে রামালাই হয়ত সখীদের সাথে তার প্রেমের কথাটি আলোচনা করে থাকবে।
ক্লাস ছুটি হলে হইচইকরে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাড়ি উত্তর দিকে, রামালারা দক্ষিণ দিকে যায়। আমি হই-হুল্লোড়ের ভিড়ে বন্ধুদের সাথে গলাগলি করে, হেলেদুলে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন হতে লম্বা স্বরে ‘সোনারু’ বলে দুটো ডাক শোনা গেলে আমি ঘুরে তাকাই, দেখি রামালা হাত উঁচু করে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে ছুটে আসছে। বাতাসে ওর ক’গোছা চুল মাথার দু’পাশে দুলছে। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি অবাক হই না, কারণ, রামালা আমাকে এভাবেই হঠাৎ হঠাৎ ডেকে থাকে; অবাক হলো না আমার সহপাঠীরাও; ওরা এরকম প্রায়শ দেখে থাকে, তাই ওরা যথারীতি দু’পাশে সরে গিয়ে গালিচা-অভ্যর্থনার পথের মতো মাঝখানে রামালার আসার পথ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আমার হাত ধরে রামালা বললো, ‘যাবি? যাবি না? চল যাই।’ বলেই রামালা আমাকে হনহন করে টেনে নিয়ে চললো। আমার সহপাঠীরা এবার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেভাবে প্রতিবার ওরা অবাক হয় আর আমার চোখ বরাবর কিছু ঈর্ষার ধারালো তীর ছুঁড়ে মারতে থাকে; কারণ, আমি রামালার মতো সুন্দরী গায়িকার ভাগ্যবান পাণিগ্রাহী।
আমরা চলতে চলতে, চলতে চলতে, দ্রুত চলতে চলতে বাড়িমুখো তামাম ছাত্রছাত্রীকে পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলাম! আমাকে টেনে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে রামালা, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, কিংবা নির্বোধ কিংবা অন্ধের মতো আমি ওর পেছনে ছুটছি। এতক্ষণ চেনা পথ ধরেই হাঁটছিলাম; সে পথ ছাড়িয়ে হঠাৎ অচেনা পথের শুরু। আমরা ছুটছি, কোথায় কোন গৃহের পানে রামালা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আমি জানি না। রামালাকে সে-কথা জিজ্ঞাসা করি, সে-ফুরসৎ হয় না। বড়ো আলোখেলা রাস্তা থেকে আমরা গাছঢাকা অন্ধকার সরু একটা রাস্তায় নেমে পড়েছি। হ্যাঁ, অন্ধকার! আবছা অন্ধকার থেকে আমরা ঘন অন্ধকারের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমরা ছুটছি। কী নেশায়, কার হাতছানিতে ছুটছি এখনো জানি না। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে সরু রাস্তা পার হয়ে সামনে আলোর প্রান্তর। এ আমরা কোথায় এলাম! আশ্চর্য সুন্দর দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমরা দাঁড়ালাম। আমাকে ছেড়ে দিয়ে রামালা অবাক হয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! কী সুন্দর হৃদয়গলানো নিসর্গ! এতবড়ো মাঠ আগে দেখি নি কোথাও। আমাদের দু’পাশে গ্রামের সারি লম্বা হয়ে বহুদূর চলে গেছে। সামনে ঘাসবিছানো মাঠ ধু-ধু দূরান্তে আকাশের ছাউনি যেখানে মাটিতে মিশেছে, সেখানে গিয়ে ডুবে গেছে। উপরে আকাশ সাঁঝের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। রামালা দু’হাত মেলে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বুক ভরে যাচ্ছে ঠান্ডায়, তাই না সোনা?’ ঝিরঝিরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, রামালা ঠিকই বলেছে। ‘আয়। আয় না সোনা’। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে ডাকে রামালা।
হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরে পড়লো। আসমানে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। কোথা থেকে কখন মেঘ জমলো আকাশে? আকাশ কালো হয়ে গেছে। তাই তো পথের ভেতরটা এত অন্ধকার ছিল, আমি মোটেও বুঝতে পারি নি।
দু’দিকে ডানা মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে রামালা। ভালো লাগছে আমার। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমিও দু’দিকে ডানা মেলে দিই। এই বৃষ্টিতে পাখিরা যেভাবে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায় আকাশে, আমারও তেমনি উড়তে সাধ হচ্ছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাটির প্রান্তর আর বৃক্ষ-বনানি দেখতে কত সুন্দর, আমার তা দেখতে তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। বৃষ্টিতে রামালা ভিজছে।
নৃত্যের ছন্দে চারদিকে পাক খাচ্ছে রামালা। ধীরে ধীরে দুলছে রামালা। ওর চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিবিধৌত চুলগুলো অনন্য সুন্দর।
আমি রামালাকে দেখি। খুব গভীরভাবে, ঘন হয়ে দেখি। রামালা আপ্লুত। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। সমগ্র প্রকৃতি মূর্ত হয়েছে রামালার অবয়বে। যুবতী রামালা রমণী হয়ে উঠেছে কখন যেন; আমিও যেন থইথই যৌবনে পড়ে আছি কবে থেকে। এই যে গোধূলির আলো-আঁধারীময় বাংলা, আর স্নিগ্ধ কবিতামাখানো রামালা, ওর চুল, চুলের সিঁথি, ঠোঁটের স্মিতহাসি- একাকার হয়ে মিশে আছে। বৃষ্টিস্নাত শাড়ি-পরিহিতা রমণীর চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু নেই। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। একধ্যানে দেখি বাংলার মুখ, আর দেখি রামালাকে।
‘সোনা!’ অস্ফুট স্বরে রামালা ডাকে। আমার সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামালা। ওর চাঞ্চল্য মুহূর্তে স্তিমিত। ওর দৃষ্টি দূর সমুদ্রের তরঙ্গতুফানে স্থির।
‘হুমম’। আমি অল্প শব্দে সারা দিই।
‘সামনে আয় তো সোনা’।
আমি এগিয়ে রামালার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়া। আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়া।‘
আমি রামালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওর চোখে তীব্র আগুনের ফলা।
‘আমার চোখের দিকে তাকা, একদম মণি বরাবর চোখ রাখ।’ তারপর রামালা নিজেই একটু সামনে এগিয়ে আসে, একটু ঝুঁকে আমার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে, বুকে বুক ঠেসে একদম আমার চোখের মণি বরাবর ওর চোখের মণি ছুঁড়ে মারলো।
হঠাৎ কী যেন ঘটতে থাকলো।
২৩ জুন ২০২০
চলতে থাকবে---------
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমরা যে সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি, আমাদের চোখ শাড়ি-পরা রমণিদের দেখলে যতখানি সৌন্দর্য বোধ ও পুলক অনুভব করে, অন্য কোনো পোশাকে সেটা হয় না বলেই মনে করি আমি।
কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ প্রিয় জলদস্যু ভাই।
২| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৪২
জুল ভার্ন বলেছেন: খুব ভালো লিখেছেন প্রিয় সোনা ভাই।
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ প্রিয় জুল ভার্ন ভাই।
৩| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: গল্পটা কি আপনার জীবন থেকে নেওয়া না শুধুই গল্প? সে যেটাই হোক সুন্দর হয়েছে।
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
এর সাথে আমার জীবনের কোনো ঘটনা জড়িত নাই, প্রিয় মশিউর ভাই। ধন্যবাদ পাঠ ও কমেন্টের জন্য। শুভেচ্ছা।
৪| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৪
আজব লিংকন বলেছেন: ওয়াও। সো রোমান্টিক। গল্পের শেষে এসে আমার মনে উথাল পাথাল ঢেউ খেলে গেল।
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৭
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
গল্পের শেষে এসে আমার মনে উথাল পাথাল ঢেউ খেলে গেল। আপনার কমেন্ট পেয়ে আমিও খুব উৎফুল্ল বোধ করছি।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আজব লিংকন ভাই। শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১:০৩
মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন:
একদিন রামালা ক্লাসে এলো শাড়ি পরে।
- যেকোনো অল্প বয়সী মেয়ে শাড়ি পরলে হট করে অচেনার মতো লাগে, সৌন্দর্য যেনো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।