নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একটি পথ, আপনি চাইলে হেঁটে দেখতে পারেন....

জীয়ন আমাঞ্জা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !

জীয়ন আমাঞ্জা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গান এবং আমি

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪৮

দাদার বাড়ি হতে নানার বাড়ি ছিল দেড় ক্রোশ পথ। তখন গরুর গাড়ির চল উঠে গিয়েছিল, সে অঞ্চলে তখন মাধ্যম ছিল নৌকা, নুতবা পদব্রজ। মায়ের সঙ্গে পদব্রজে আসছিলাম, বয়স তখন কত ঠিক মনে পড়ে না, তবে বিদ্যালয়ে যাওয়া তখনও শুরু করিনি।
আমাদের সে অঞ্চল ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। প্রতাপশালী সম্ভ্রান্ত পরিবার বলতে হিন্দুদেরই বোঝানো হত, শেখদের মধ্যে বংশীয় প্রতাপ থাকলেও শিক্ষা সংস্কৃতিতে তাঁরা বেশ পিছিয়ে ছিলেন। আমার নানার বংশ এদিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ছিলেন বেশ এগিয়ে।

মূলকথা, তখনকার জীবনযাত্রায় হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি এত ভালো ছিল যে সেই বীজের দরুন হিন্দু মুসলিমের মধ্যে লঘিষ্ঠ গরীষ্ঠ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলতে যে কিছু থাকতে পারে, তা তখনও বোধ করিনি, এখনও ভাবতে পারি না। আসল কথা বলার আগে একটু সামাজিক পরিবেশের ভূমিকা টানতেই হল।

আমাদের জীবনযাপনের পরতে পরতে হিন্দু আচারের খুব সাযুজ্য ছিল, এখনও আছে। কাঁসা-পেতলের আসবাব হতে শুরু করে কৃষিকাজে হিন্দু পঞ্জিকা অনুকরণ, এমনকি কোন কোন মুসলিম ঘরে সিঁদুর পর্যন্ত পাওয়া যেত (সিঁদুরের জীবাণুনাশক গুণ আছে, সে উদ্দেশ্যেই সিঁদুর রাখা হত; যেমন এখন স্যাভলন রাখা হয় ঘরে ঘরে!) আমরা চাচাদের কাকু বলে সম্বোধন করি, চাচিদের ডাকি কাকিমা বলে! কারো সাথে দেখা হলে সম্বোধন করা হয়, কী মোশায়, খবর কী!

আমাদের গ্রামে প্রতাপশালী হিন্দু ছিলেন চাটুজ্যেগণ। গ্রামের নামগুলোও হিন্দু নামে। বিশাল এক পরিসীমা নিয়ে ছিল চাটুজ্যে বাড়ি। সে বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। আমরা সেটাকে বলি চাডিজ্যা বাড়ি: আঞ্চলিক উচ্চারণ আর কি!

চাটুজ্জেগণ সবাই ভারত চলে গেছেন। গ্রামের খোলস ছেড়ে বের হবারও অনেক পরে যখন প্রগতিবাদী বই লিখিয়েদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখন জানতে পারলাম, মুসলিমদের অত্যাচারে হিন্দুরা দেশ ছেড়ে ভারত যেতে বাধ্য হয়েছে!

কিন্তু আমি আমার জীবনে যা দেখেছি তা ওই লেখকদের বক্তব্যের সাথে কেন জানি মেলে না! চাটুজ্জেগণ চলে গেলেও তাঁদের বাড়ি এখনও আছে; কোন মুসলিম দখল করেনি, মহাদেব আর সুবোধ চাটুজ্জে তা ভোগ করেন। দীলিপ চাটুজ্জে এখন ঢাকার সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেট।

রাম চাটুজ্জের নামে গ্রামটির নাম। তিনি ভারত চলে যান পুণ্যভূমিতে জীবনাতিপাত করার উদ্দেশ্যে। প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, মুসলমানের নারী, হিন্দুদের বাড়ি, আর খ্রিস্টানদের গাড়ি!

মুসলমানদের একটু ধনসম্পত্তি হলেই তারা আরেকটি বিয়ের জন্য উদগ্রীব হয়, হিন্দুরা টাকা পয়সা হলেই ভারতে গিয়ে একটি বাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখে, আর খ্রিস্টান টাকার সমাগম হলেই একটি গাড়ি কেনার জন্য উতলা হয়।

আমি কেবল প্রবাদটির ব্যাখ্যা বললাম, এটিকে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি কটাক্ষ ভাবার কোন কারণ নেই। গরিষ্ঠতা লঘিষ্ঠতা নিয়ে খুব মাতম শুনি, কিন্তু আমাদের অঞ্চলে কোন শালিস যদি হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে হয়, তবে দোষ যারই থাক রায়টা সবসময় হিন্দুর পক্ষেই হয় কেবল এই ভয়ে যে, ওই হিন্দু ভাই যেন বলতে না পারে যে হিন্দু বলে তাকে বিচারে ঠকানো হয়েছে! এই কথাগুলো আমি কেবল আমাদের দেশের সম্প্রীতি বোঝাবার জন্য প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করলাম। এবার মূল গল্পে আসি-

দেড় ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে আসতে কম সময় লাগে না, তাও যদি আমার মত একটি নাবালককে নিয়ে আসতে হয়! সকালে রওনা দিলে সন্ধ্যা হয় পৌঁছতে। মা কোন এক বিষয়ে রাগ করে আসছিলেন বলে আমাদের সাথে কোন কাকাবর্গীয় পুরুষ লোক ছিল না। দিনের বেলাতেও সারাপথে ভুতুরে বিভীষিকা! পথিমধ্যে চারটিটি নামকরা জায়গা আছে, মালবাড়ি, কালীখোলা, নৈলতলা আর শিবের আমগাছ! ভুতের গল্প আজ নয়, এ নিয়ে অন্যদিন বলা যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত মা-ছেলে এসে পৌঁছলাম পাগলবাড়ির রাস্তায়। পানির তৃষ্ণা পাওয়াতে আমরা মায়ের এক বান্ধবীর বাড়িতে ঢুকলাম। সেখানে আমরা ইলিশ মাছ আর শাপলা দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। খাবার পরে আমি সে ঘরে একটি হারমোনিয়াম দেখে খুব কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। তখন মায়ের সেই বান্ধবী হারমোনিয়ামটি বাজিয়ে একটি গান শুনিয়েছিলেন। মায়ের কাছে কাল জানলাম, সে মাসীর নাম আরতী! আরতী মাসী জানলেন না সেদিন তিনি কী যে বিশাল এক মোহাবিষ্টতার রোগ ধরিয়ে দিয়েছেন এই ছোট্ট শিশুটিকে! কী যে এক ভালো লাগার নাম গান হয়ে গেল তা কেউ জানল না।

তারপর থেকে বীণা, বেহালা বা হারমোনিয়ামের মিঠে সুর যখনই কানে আসে, তখনই আমার ভেতরে আলোড়ন জাগে; যখন শুনি,

প্রভাতের পথিক স'বে
এলো কী কলরবে
গেলো কী গান গেয়ে
ওই সারে সারে...

বুকটা আনচান করে ওঠে! কী গান যে গেয়েছিল সেদিন আরতী নামের কিশোরী মেয়েটি- তা আজ আর কারো জানার উপায় নেই। যখন কোন নারী শিল্পী গলা দুলিয়ে গেয়ে ওঠে, ওই মালতী লতা দোলে- তখনই মনে হয়, ঠিক যেন এরকমই একটা গান সেদিন আরতী মাসী গেয়েছিল!

যখন পাপিয়া সারোয়ার গাইতে থাকেন, না, সজনী, না... আমি জানি, জানি, সে আসিবে না...
আমি অমনি হারিয়ে যাই স্মৃতির জগতে, আহা, কিছুই যে ফিরে আসবে না আর!

সেই হতে গান গেঁথে গেল আমার অস্তিত্বে! গান হয়ে উঠল ABCD, গান হয়ে উঠল গাণিতিক সূত্র, গান হয়ে উঠল ইতিহাস, ভূগোল, জীবনের একেকটি ঘটনার সঙ্গে জুড়ে গেল একেকটি গান! একেকটি মানুষ হয়ে উঠল গান, একেকটি পরিচয় হয়ে উঠল গান, একেকটি স্মৃতি হয়ে উঠল গান!

নানাবাড়িতে গ্রামোফোন ছিল না, শেখবাড়িতে রেডিওও এসেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। একটু আগে যে আমার নানাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার কথা বললাম, তা প্রযোজ্য বড়ো নানার ক্ষেত্রে। তিনি মোড়ল ছিলেন। তার বাড়িতে হৈ হুল্লোড় ইত্যাদি লেগেই থাকত। ওই অঞ্চলের প্রথম টেলিভিশনটাও তাঁর বাড়িতে আসে! যাইহোক, সেকালে তখনও টেলিভিশন পরিচিতি লাভ না করলেও সব ঘরেই ছিল রেডিও। একটা রেডিও ছাড়া ঘর কল্পনা করাও অসম্ভব। তার অব্যবহিত পরেই রেডিও কেনার হিড়িক পড়ল যুবকদের মাঝে। একজন রুচিবান যুবক মানেই বুক পকেটে কলম, একটি হিরো সাইকেল, আর একটি রেডিও। সাইকেল কেনার সামর্থ্য সবার না থাকলেও রেডিও প্রত্যেক যুবকেরই ছিল। পথে হেঁটের যাবার সময় তারা রেডিও বাজিয়ে শুনতে শুনতে পথ চলত, মাঠে কাজ করার সময় আইলের ওপর রেডিও বাজতে থাকত, একটি কান সবসময় খাঁড়া থাকত রেডিওর দিকে। অনুরোধের আসর, গানের ডালি লেগেই থাকত সারাদিন। একটির পর একটি চমকপ্রদ পরিবেশনা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি ছিল সন্ধ্যাবেলায় সৈনিক ভাইদের উৎসর্গে অনুষ্ঠিত দুর্বার সঙ্গীতানুষ্ঠান। আজ এত বছর পর আমি সেই ফোর ব্যান্ডের একটি রেডিও খুঁজে ফিরি। দুইটি কারণে, এক হচ্ছে তার মার্জিত বাংলা উচ্চারণ, দুই - তার গানের আওয়াজ।

আপনারা সবাই জানেন, গান বাজানোর সময় মিউজিক সেটিংএ পপ, ফোক, রক, ঝাজ, মেটাল ইত্যাদি অসংখ্য মুড আছে। একেকটি মুডে একই গান একেক রকম শোনায়, রেডিওর মিউজিকেও তেমনি একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, যা কোন রেকর্ডারে পাওয়া যায় না। মনে হয় যেন, কোন দূর হতে কথা সুর ও সঙ্গীত ভেসে আসছে! খুব যতনে কান পেতে নিবিড় মনোযোগে সে সঙ্গীত শ্রবণ করতে হয়! আমি সেই রেডিও ভারশন খুব মিস করি! যুগ যত পাল্টায়, টেকনোলজি তত সংকুচিত হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে। কিন্তু গুণগত মান কেন সস্তা হয়ে যাচ্ছে আমি বুঝি না। পুরনো সময়কার জিনিসগুলো দীর্ঘদিন টিকত, আর এখনকার জিনিস টেকে না। তাহলে এটা কেমন উন্নতি হল আমার মাথায় আসে না! আমাদের বাড়িতে একটা রেডিও আছে, তার বয়স ষাট বছরের বেশি। রেডিওটি প্যানাসনিকের। ইলেক্ট্রনিক্সের পণ্যে আমি প্যানাসনিকের মত টেকসই আর কোন ব্র্যান্ড দেখিনি! আমাদের এফডিসিতে ব্যবহৃত পুরনো ক্যামেরাগুলোরও অধিকাংশ ছিল প্যানাসনিকের।

আমি গানের পোকা, গান ছাড়া আমার চলেনি কখনও। রেডিও যাবার পরে গানের সেই দূরাগত আমেজ আর পাই না, সিডি মিউজিকে পরবর্তীতে কেবল কিচকিচ কিচকিচ করা কিচিরমিচির শব্দই যোগ হয়েছে, কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে সঙ্গীত, কমে গেল শ্রুতিমাধুর্য!

এফএম রেডিওর কথা আর বললাম না। ইন্টারনেট আসার পরে একটি সুবিধে হল গুগলের কাছ থেকে দুষ্প্রাপ্য গান আদায় করা যায়। এমনও গান আছে যা আমি একটানা দুই বছর ধরে নিয়মিত সার্চ করতে করতে গুগল বাধ্য হয়েছে ব্যবস্থা করে দিতে। আমার কাছে ১৯০৪ সালের গান পর্যন্তও এখন আছে! আরেকটি সুবিধা হল, একই গানের অসংখ্য ভেরিয়েশন পাওয়া যায়। একেক শিল্পীর একেক সময়ের পরিবেশনায় গানের তাল ও বাজনা একেক রকম হয়েছে। আমি যতগুলো পাই সংগ্রহ করি, খুটিয়ে খুটিয়ে শুনি; কিছু বাদ দেই, কিছু রেখে দেই। এই গানের ক্ষেত্রে আমার সবার আগে মুখস্ত হয়ে যায় তার বাজনা। কখন কোন বাজনা, কী তার সুর এগুলো মুখস্ত হবার পরেই গানের কথার সন্নিবেশটা মুখস্ত হয়। সেই কারণে কেউ যখন ভুল বাজনা আর সুরে গান গায় আমি খুব বিরক্ত হই।

আমার কাছে দুনিয়ার বিরক্তিকর অত্যাচারগুলোর মধ্যে একটি হল গায়ে হলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে উদীয়মান শিল্পীদের একোস্টিক সঙ্গীত! না ঠিক থাকে কণ্ঠ, না সুর, না তাদের বাজনার কোন তাল মিল, না তাদের সাউন্ড সিস্টেম! বাড়ির আশে পাশে এমন শেয়াল ডাকা অনুষ্ঠান হলে আমার ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়। এরকম এক অনুষ্ঠানে একবার উপস্থিত থেকে দেখলাম গায়িকা মেয়েটি ফ্যাসফ্যাসে গলায় ভাণ্ডারি গানের নামে একটু পরপর 'হক্ব মওলা' করে উঠছে আর জোয়ানবুড়ো সবাই হৈ হৈ করে নাচছে। আমাকেও কয়েকজন টানাটানি করাতে আমি বললাম, ধুর ভাই, গানের কোন আগামাথা নাই, কী গায় এগুলা!

তখন একজন বলল, টাকা দিয়ে আনছি যখন নাইচা লাফাইয়া এনজয় কইরা সেইটা উশুল তো করতে হইব, গান কী গাইল হেইডা বিষয় না!

আমি বাসায় চলে এলাম। গিন্নী বলল, এটা তো কোন শিল্পী নির্বাচনী অডিশন না, যে এত খুঁৎ ধরতে হবে!
বললাম, তা নয়, কিন্তু এই গানের বিকৃতিটা আমার সহ্য হয় না।

আপনারা এতক্ষণে ভাবছেন, আমি হয়ত কোলাহল বিমুখ সফট গান পছন্দ করি। সেটা ঠিক নয়, আমার সংগ্রহে অসংখ্য পাগলাটে গান আছে। আমি গানের ক্ষেত্রে দুইটি জিনিসকে গুরুত্ব দিই, এক. গলার কাজ, দুই. মিউজিক সিকোয়েন্স। হিমেশের Teri galion se গানটি কেউ শুনে দেখবেন, গলার কাজ কাকে বলে, ক্লিনটন শেরেজা এবং সাওয়ান মানইয়ারের saathi salam da শুনে দেখবেন গলা আর কথার আবেদন কাকে বলে!

ইয়ো ইয়ো যুগের ছেলেপলেরা কী সব ম্যাশআপ, চেঁচামেচি শোনে! খেয়াল করেছি, পিটবুল, বনজভি কিংবা জাস্টিন বেইবার না শুনলে ব্যাকডেইটেড বলা হয়! এই গানগুলোতে হাউ মাউ কাউ ছাড়া আমি কিছুই পাই না। গান তো নয় যেন কী এক ভীষণ অস্থিরতা!
কেন, স্টারশিপের Nothing's gonna stop us এর ধারে কাছে পড়ে ওইসব গান? কিংবা No mercy ব্যান্ড এর Hello, how are yo?

গানের কথায় কিছু একটা মেসেজ তো থাকতে হবে! আসিফের একটি গান ছিল, তুমি অপরূপা, মায়াভরা জোছনাতেও, তুমি অপরূপা!!

এটা কেমন কথা! শুনলেই গা জ্বলে ওঠে! মায়া ভরা জোছনাতেও আবার অপরূপা হবার কী আছে? ঘুটঘুটে অন্ধকারে অপরূপা হলে নাহয় একটা কথা ছিল! জোছনাতে তো একটা পেত্নীকেও অপরূপাই লাগবে! এটা নিয়ে হৈ হৈ করার কী আছে! কী উদ্ভট সব গানের কথা!

পাগলবাড়ির ফাল্গুন মাসের মেলা বেশ জমজমাট হত সেকালে। কোলকাতা হতে বাইজী বাদক পর্যন্ত আনানো হত। তো একবার এক বাইজী কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে গাইতে লাগল - হায় মেরে পাতলি কামার, হায় মেরে পাতলি কামার! এ নিয়ে বেশ সোরগোল হয়েছিল তখন। গানের মাঝখানে এক বেরসিক থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমার পাতলা কোমর হেতে আমাগো কী? আর এইডা নিয়া এত ঢুলাইয়া ঢুলাইয়া হায় হায় করার কী আছে! তুমি অইন্য কিছু গাও না কেন?

তাহসানের বিখ্যাত গান, দুমি আর থো কারও নও ষুধু আমার.. আলো আলো আমি কখনও খুঁজে পাবো না, চাঁদের আলো তুমি কখনও আমার হবে না...!!
এই গান নিয়ে বলতে গেলে আপনারা আপনাদের ভালো লাগার জায়গায় নিশ্চিত আঘাত পাবেন, কিন্তু আমাকে কেউ বোঝাতে পারেন, এই আলো খুঁজে না পাওয়ার কারণটা কী? আলো দিয়ে যদি প্রেয়সীকে কল্পনা করা হয়, সে দূরে আছে বুঝলাম, কিন্তু মাঝখানে আবার চাঁদের আলো কোত্থেকে এলো!!

আমি তাহসানকে পছন্দ করি না এমন মোটেও নয়। তাহসানের ব্ল্যাক ব্যান্ডের ভলোবাসি, শুধু তোমায় ভালোবাসি গানটা অবশ্যই অসাধারণ।

সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর একটি হিসেবে স্থান করেছে শিরোনামহীনের পাশাপাশি আর্টসেলের অনিকেত প্রান্তর।
এই গানটির প্রথমদিকে এমনই জাদু আছে যে ষোল মিনিট অবধি গানের শেষদিকটা ম্লান হয়ে যায়। কজন শ্রোতা শেষ পর্যন্ত শোনে, আমার জানা নেই। বাংলা গানের মাধুর্য আর সাফল্যের তালিকা বলতে গেলে বিরাট সময় লাগবে, অসংখ্য বিশ্বমানের লিজেন্ড আমাদের আছে। তবে আফসোস, আমাদের বাংলা সঙ্গীতের অসামান্য ক্ষতি হয়েছে সেই বহু আগে একজন শিল্পীর অকাল মৃত্যুতে! তিনি হ্যাপি আখন্দ! এই প্রতিভার সমতুল্য আমরা আর পাইনি এতকালেও।

শেষ করব একটি ব্যান্ডের নাম দিয়ে, আমি এটাকে হেরিটেজ ব্যান্ড বলি। ব্যান্ডটির নাম Boney M. এটি একমাত্র ব্যান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে, যার প্রত্যেকটি গানই সঙ্গীত জগতে প্রবাদের মতো, একেকটি মাইল ফলকের মত। তাদের খ্রিসমাস এ্যালবামের গানগুলো ছাড়া এখনও বড়দিন চলে না। ফেলিঝ নাবিদাদ কিংবা মেরী'জ বয় চাইল্ড জেসাস খ্রাইস্ট ওয়জ বর্ন অন খ্রিসমাসডেই এখনও বড়দিন উদযাপনের মূল সঙ্গীত।

বনি এম এর একেকটি গানই যেন একেকটি সিনেমা, একেকটি গল্প! Elutte গানটি শুনে দেখবেন, একজন নিরক্ষর মানুষের জীবন যুদ্ধে সাফল্যের গল্প সেখানে আছে। No woman no cry গানটিতে নারীদের শক্তি আর উৎসাহ যোগানো হয়েছে, Painter man গানটিতে জীবনের হতাশার কথা উঠে এসেছে, গান, স্বর, সুর, সঙ্গীত, মেসেজ- কী নেই এদের গানে? I see a boat on the river গানটি যেকোন বয়সের মানুষকেই কোমল কল্পনায় নিয়ে যায়! তাছাড়া, Maa Baker, Rasputin, Rivers of Babylon, My friend Jack ইত্যাদি তো আছেই। কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে গানটিও বনি এম এর Still I'm sad গানটির অনুকরণ। এদের গান অনেক ইংরেজ গায়ক গায়িকাও অনুকরণ করেছে!

U2 ব্যান্ডের With or without yo পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গানগুলোর অন্যতম একটি।
Alexei'র There's a heart like mine, somewhere in this world গানটি একজনকে সাজেস্ট করার পর বেচারি সারাটি দিন ওই একটি গানই শুনেছে, লিরিকগুলো বারবার মেসেজে লিখে পাঠিয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে, শেষে ফেইসবুকেও পুরো গানটি পোস্ট করেছে। এমনই শক্তি গানটির!

অতি সুন্দর জিনিসের ঘাতক শক্তি থাকে, এটা কি আপনারা জানেন? Tonight I celebrate my love গানটি সেই ভয়ানক সুন্দর গান যা শোনার অধিকার আমার নেই। আমি যখনই শুনেছি, আমার কোন না কোন বিপদ হয়েছে। এখন আর তাই ওই ঝুঁকিটা নিই না।

গানের ক্ষেত্রে আমি দেশ কাল পাত্র বিভেদ করার কখনই পক্ষপাতী নই। সঙ্গীত শিখতে রাগ ও খেয়ালের কোন বিকল্প নেই। কেউ যদি নিজেকে হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারে বলে দাবি করে, আমি প্রথমেই প্রশ্ন করি, কাওয়ালি বাজাতে পার?

উস্তাদ নুসরাত ফাতেহ আলী খান কাওয়ালিতে যে আন্দাজ রেখে গেছেন রাহাত ফাতেহ আলি খান সে তুলনায় কিছুই নয়, চাচার গান গেয়ে তিনি দীর্ঘদিন টিকে ছিলেন মার্কেটে। তাঁর মৌলিক গানের সংখ্যা এখনও অত বেশি নয়।

উস্তাদ বড় গোলাম আলীকে নিয়ে কিছু বলার নেই, উনি এক ভিন্ন জ্যোতিষ্ক। মেহেদী হাসান প্রেমকে আর আবেগকে তুলে ধরে গেছেন তাঁর গজলে, গুলাম আলী খাঁ ছলাকলা দেখিয়েছেন তাঁর কণ্ঠের জাদুতে। পঙ্কজ দেখিয়েছেন মেলোডি, আর মেঘনাদ শুনিয়ে গেছেন জগজিৎ সিং। যা-ই গেয়ে গেছেন তিনি সবই লা-জওয়াব। কিন্তু জগজিৎ সিংএর বড় কৌশল তাঁর মিউজিকে। হুবহু মিউজিক ছাড়া তাঁর গান কেউ গাইতে পারবেন না সেই চালাকি তিনি করে গেছেন।

এবারে বাংলাদেশের কথা বলি, বাংলাদেশের একটি বিশেষ গান আছে, যদি সে গান বাজে, যেই বয়সের, যত গোমড়া মুখেরই ব্যক্তি হোক, গুনগুন করে উঠবেই। বলতে পারেন সেই গানটি কী?

ও রে নীল দরিয়া....

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৪৫

আখেনাটেন বলেছেন: বেশ লিখেছেন। একটানা পড়তে বাধ্য হলাম।

২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫০

মেঘনা পাড়ের ছেলে বলেছেন: আপনার লেখনী যথেষ্ট ভালমানের, কালেকশনে রাখার মত পোস্ট, খুব ভাল লাগলো

৩| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৩৪

মেমননীয় বলেছেন: চমৎকার!

Where have you been?

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১৩

জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: I was in the commonalty... Hardly like to step on the dais!

৪| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৫৮

জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: আপনারা ধৈর্য ধরে এই দীর্ঘ একঘেয়ে লেখা পড়েছেন, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।

৫| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৩৬

অনন্য দায়িত্বশীল আমি বলেছেন: সুন্দর।

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৪

জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫০

নীল আকাশ বলেছেন: Guns N’ Roses এর Patience এবং Don’t Cry শুনেছেন ? কেমন লাগে ? কিংবা Dire Straits এর Romeo And Juliet এবং Money For Nothing ? দুঃখজনক হলেও এখন আর এই ধরনের গান গুলি আর গাওয়া হয় না।

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:১৯

জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: ঠিক বলেছেন!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.