নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !
পৌষের সকাল। পেঁচানো চাদর খুলে নিয়ে এক বৃদ্ধা হাঁপাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপরই দূর থেকে হৈ হৈ শব্দ ভেসে আসছে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে বৃদ্ধার। হা রে, বাবা, কালিয়ারা আর কদ্দূর?
খেড়ুইও না গো, আগগাইতে থাহ, আরো অনেক দূর।
মানুষের ঢল নেমেছে পথে। কারও দাঁড়াবার সময় নেই। বৃ্দ্ধা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কিছুক্ষণ, পরে তাকিয়েই থাকে। বসে পরে একসময়। বিড়বিড় করে বলে, কালিয়ারা আর কত দূর। গালের দু পাশ অশ্রুসিক্ত হয় তার!
মানুষগুলো ছুটে চলেছে। নিজ ঠিকানায় পৌঁছাবার তাড়া সবার। বৃদ্ধা কাঁদছে, গায়ে আর জোর নেই চলার মত।
এক যুবক এসে থামল এমন সময়। বৃদ্ধার কান্না দেখে দয়া হল হয়ত, অনুচ্চ গলায় জিজ্ঞেস করল, কই যাইবেন গো আম্মা?
বুড়ি দিকভ্রান্তের মত মাথা ঘোরাল মানুষটার দিকে, হাঁ? আমার রাসু রে? আইছত বাপধন?
আমি রাসু না গো আম্মা, আমি জয়নাল। কান্দেন ক্যা আপনে? কই যাইবেন?
অহ, রাসু না! আমি ত ভাবছিলাম.. বৃদ্ধা আবার কাঁদতে শুরু করল।
অগত্যা, জয়নাল তাকে কোলে তুলে নিল। তার নিজেরই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। বাঁ পায়ে সেলাই আছে একটা। এই পা'টাতে আর হয়ত পুরোপুরি বল পাবে না কোনদিন। বৃদ্ধা সম্ভবত মুর্ছা গিয়েছে বা ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনে ব্রিজ ভেঙে গেছে, একটি ভ্যানও পাওয়া গেল না পথে। বৃদ্ধা কোথায় যাবে, সেটাও জানা গেল না। জয়নাল এগিয়ে যাচ্ছে পায়ের পর পা টেনে।
সবাই নিজের ঠিকানায় ছুটে যাবার জন্য ব্যস্ত। জয়নালের তাড়া নেই। ও জানে, বাড়িতে কেউ নেই। বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে, সে খবর ও জানে। বোন দুটোকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে খবরও ও জানে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ফোঁস করে বুকের মধ্যখান থেকে। যদি বাঁইচ্যা থাহস, আহিস না তরা আর।
জয়নালের দীর্ঘশ্বাসে বৃদ্ধার বুঝি হুঁশ ফেরে, হাত বাড়িয়ে জয়নালের বুক ছোঁয়, গলাটা জড়িয়ে ধরে শীর্ণ হাতে। তা পর একটু হাসার চেষ্টা করে। মায়া হয় জয়নালের, কই যাইবেন গো আম্মা?
কালিয়ারা যামু গো, বাপধন। ম্যালা দূর নি?
জয়নাল আর জবাব দেয় না। অনেক দূর, ও জানে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়, বৃদ্ধাকে নিয়েই বাড়ি ফেরে জয়নাল। বাড়িতে তখন অন্য গৃহস্থ সংসার পেতেছে। খুবই অচেনা লাগছে বাড়িটা। সংসার পাতা গৃহস্থরাও বেজার মুখে ওদের বারান্দায় উঠতে দিল। বারান্দায় বৃদ্ধাকে বসিয়ে রেখে পুকুরপাড়ে গেল জয়নাল। গৃহস্থদের ছোট্ট ছেলেটি জয়নালের সাথে সাথে এল। জয়নাল জিজ্ঞেস করল একবার, তোঙ্গো বাড়ি কইনো? ছেলেটি একবার হুঁ বলে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, আর কোন জবাব দিল না। বৃদ্ধার জন্য ঘটিতে পানি এনে বারান্দায় বসলে ভেতর থেকে নারীকণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, ভাইজান কি খাইছেন কিছু সারা দিনে?
না, খাইছি না। আমার জন্য ভাবতে হবে না, আপনে এই বুড়িমারে পারলে একটু খাবার দেবার ব্যবস্থা করেন।
রাইতের রান্ধা চড়াইছি একটু আগে, বসেন, বিরাম করেন।
বৃদ্ধা ঘুমে অচেতন, জয়নালেরও ঘুম পাচ্ছে খুব। কখন ঘুমিয়ে পড়ল হুঁশ নেই। ঘুম ভাঙল শোরগোল শুনে। গ্রামের হিসেবে তখন ভালোই রাত হয়েছে বলা যায়। হারিকেন উঁচিয়ে বেশ কয়েকটি মুখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধা তখন জবুথবু হয়ে বসে আছে। জয়নাল চিনতে পারল, হারুন কাকা, তবারক মুনশি, আর বেলায়েত খাঁকে। এক এক করে সবাইকেই চেনা গেল, একজন শুধু নতুন মুখ, এই বাড়ির নয়া গৃহস্থ।
কী খবর জয়নাল? কই আছিলা?
ভাল আছি, মুনশি কাহা। আপনেরা কেমন আছেন?
হাঁ, আমরা আর বাঁইচ্যা আছি কোন রম'তে। মিলিটারিরা তো কিচ্ছু রাখল না বাজান।
"হুঁ" বলে মাথা দোলায় জয়নাল। চোখ ভিজে আসে ওর।
তা কই আছিলা এতদিন, জয়নাল?
আছিলাম বিভিন্ন জায়গায় কাহা। আব্বার কবরডা কই কইতে পারেন?
তার কবর তো এইখানে না, সকালে দেইখ।
এর মাঝে নতুন গৃহস্থ একবার গলা খাকাড়ি দিল।
বেলায়েত খাঁ তাগিদটা বুঝল, সেও একবার গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, শুনলাম ইন্ডিয়ায় নাকি চাকরি বাকরি পাইছ, তা কেমন সেই দ্যাশ?
চোখ দুটো জ্বলে উঠল জয়নালের। চাকরি মানে? আমি যুদ্ধে গেছিলাম, আপনে জানেন না? আপনে তো রাজাকার ছিলেন, আপনের জানার কথা না?
কী কইলি ছ্যাড়া? দাঁত বেবাক ভাইঙ্গা ফালামু কইলাম! কত্তবড় সাহস, আমারে চউখ রাঙাস!
ভীড়ের বেশ কয়েকজনেরর মধ্যেও বেলায়েত খাঁর সমর্থনে ক্ষোভ দেখা যায়!
হারুন কাকা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেন, জয়নাল, রাজাকার মানেই খারাপ কিছু না, বেলায়েত মিয়াভাই না থাকলে এই গ্রামডা আর টিকত না। মিলিটারিগো হাতে রাইখা হ্যারাই আঙ্গো গ্রামডারে বাঁচাইছে।
ভীরের মধ্য থেকে আরেক যুবক চেঁচিয়ে বলল, বেলায়েত চাচাই আঙ্গোরে সময় সময় মত মিলিটারির খবর দিয়া মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করছে!
মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করছে? কারে? তরে? তুই মুক্তিযোদ্ধা?
যুবকটি রাইফেল উঁচিয়ে দেখাল, এই যে। হইছে নি?
কোন সেক্টরে যুদ্ধ করছত তুই?
সেক্টর মানে? আমি এই এলাকাতই যুদ্ধ করছি।
এলাকাত করছত? রাইফেল পাইলি কই?
হেইডা তোমারে কইতে হইব? মুক্তিরা রাইফেল কই পায় জানো না?
তুই ট্রেনিং নিছত কই?
যুবকটি এবার আমতা আমতা করে পিছিয়ে গেল।
হারুন কাকা তখন বললেন, থাহুক বাবা, দ্যাশ স্বাধীন হইছে, অনকা আঙ্গো মিল্যা মিশ্যা থাহন লাগব। কারও দোষ ধইরা তো লাভ নাই।
এসময়, বৃদ্ধা তখন গুমরে কেঁদে উঠল।
সবার চোখ তখন সেদিকে গেল। বেলায়েত খাঁ জিজ্ঞেস করল, এই হিন্দু বুড়ি ক্যাডা? অই তোঙ্গো বাড়ী কই?
বৃদ্ধা কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, আঙ্গো বাড়ী কালিয়ারি বাবু। শরণার্থী ছিলাম।
অ, ইন্ডিয়া থেইকা আসছ? তা আইলা ক্যা আর? মাতুল দ্যাশে গেছিলা, রাখল না হ্যারা?
বাবু, পুত, পুতের বৌ হারাইয়া গ্যাছে। আমি কই যামু? নিজের বাড়িত গিয়া মরতে চাই।
আহা রে দ্যাশপ্রেম! যুদ্ধের সময় তো ঠিকই ভাগছিলা। অনকা নি আইছে দ্যাশপ্রেম! দ্যাশপ্রেমের কথা তগো মুখে মানায়? তরা তো যুদ্ধই করস নাই। সব চইল্যা গেছত ইন্ডিয়ায়। স্বার্থপরের দল!
জয়নাল এবার চেঁচিয়ে উঠল, বাইর হন আমার বাড়িত থেইকা। আপনার দ্যশপ্রেম বিচার করন লাগত না!
তোমার বাড়ি? তোমার বাড়ি তো নাই আর এইডা। তোমার বাপে তো এই বাড়ি মরার আগে এই কালাম শেখরে দিয়া গেছে লেইখ্যা। কাগজপাতিও আছে।
জয়নাল এবার উঠে দাঁড়াল সরোষে। লেইখা দিছে মানে? আমি খবর পাই নাই? আমার বাপেরে তুই মারাইছত মিলিটারি দিয়া। আমার বইন দুইডারে তরা তুইলা দিছত মিলিটারি গো হাতে! আর তুই অনকা গেরামের মোড়ল?
মুখ সামলাইয়া কথা কবি জয়নাল। বেলায়েত খাওঁ তেড়ে ওঠে এইবার। তুই মুক্তিতে যোগ দিছত শুইনাই মিলিটারিরা তর বাড়িত আইছে, আমাগো করনের কী আছে? এই আমিই এই গ্রামের মানুষগুলারে যতটা পারছি রক্ষা করছি। তুই কী জানস? আর এই বাড়ি অহন এই কালাম শেখের নামে। তুই চাইলে একপাশে ঘর তুইলা থাকতে পারস। তুই এই গ্রামের পোলা, তরে আমরা ফেলাইতাম না।
গ্রামের সমাজ এই বলে চলে গেল শেষমেষ। জয়নাল আর রাতে কিছু খেল না। সারারাত ধরে ভাবতে লাগল, এ কোথায় ফিরলাম আমি? এই কি আমার দেশ? এখানে দেশের গাদ্দাররাই আবার হর্তাকর্তা? না, যুদ্ধ তো শেষ হয়নি তাহলে। আমার মুক্তিবাহিনী কোথায়। বাইরের শত্রু আমরা মেরেছি, কিন্তু ভেতরের শত্রু তো সব রয়ে গেছে! দেশের গাদ্দাররাই এখন আবার মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে গেছে, আমিই এখন দলছাড়া একা! না, যুদ্ধ তো শেষ হয়নি! কাশেম ভাইয়ের কথা মনে পড়ল, দেবিদ্বারে বাড়ি। তার কাছে যেতে হবে। সংঘবদ্ধ হয়ে এদেরকে ধরতে হবে। এই গ্রামে জানামতে আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল আনোয়ার। সে শহীদ হয়েছে। এছাড়া জানামতে আর কেউ নেই। দেবিদ্বারেই যেতে হবে। কাশেম ভাইদের খুঁজে বের করতে হবে। সাথে রাইফেলটাও নেই। আহত হবার পর এতদিন চিকিৎসাধীন ছিল ও। সুস্থ হতে হতেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় স্বাধীনতা?
দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তৈরি হয়নি এখনও। গ্রামের মানুষগুলোরও মেরুদণ্ড নেই, যুদ্ধ শেষ, তারা মরেনি, বেঁচে গেছে, বেঁচে আছে এতেই তারা খুশি। বিচার, ন্যায় এসব তাদের মাথায় নেই। এদেশে সরকার গঠন হবে, দেশের মধ্যে থাকা এইসব নেমকহারামের বিচার হবে এবার, বিচার ব্যবস্থা তৈরি হবে। মানুষগুলো তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে, থাকার জায়গা ফেরত পাবে, এখনও স্বাধীনের অনেক পথ বাকি। রাইফেল ছাড়া মোটেও উচিত হয়নি। যুদ্ধ এখনও বাকি!
পরিশিষ্ট ১:
জয়নালের আর দেবিদ্বার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ওই রাতেই জয়নাল খুন হয়। আর কাশেম ভাইয়ের কথা জানি, তিনি অস্ত্র জমা দেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কিছু করবে কি না এই নিয়ে তার মনে সংশয় ছিল, জীবিকার তাগিদে পরে তিনি কিছুদিন ডাকাতি করেন এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
পরিশিষ্ট ২:
মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। আরো অসংখ্য জয়নালকে আমরা এখনও মাঝেমধ্যে পথে ঘাটে ভিক্ষা করতে দেখি, হকারি করতে দেখি, রিকশা চালাতে দেখি। খুব কম মুক্তিযোদ্ধাই স্বাধীন দেশের সুখ উপভোগ করতে পেরেছেন। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ না করেও বেশ ঢোল পিটিয়ে নিজেকে যোদ্ধা প্রচার করে বেদীতে বসেছেন। আর অনেকে গোপনে রয়ে গেছেন, লোক দেখানো দেশপ্রেমকে পছন্দ করতে পারেননি বলে। তাঁরা সহজে বলেনও না যে, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁরা জবাবে বলেন, নামের জন্য তো করি নাই, দেশকে ভালোবেসেছি বলেই করেছি।
পরিশিষ্ট ৩:
দেশ এখন উন্নতি করছে, স্বয়ংসম্পূর্ণও হয়ে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাগণ হয়ত এমন একটি দেশেরই স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁরা অধিকাংশই এর স্বাদ পেলেন না। আর আমরা যারা স্বাদ পাচ্ছি, আমরা এর মর্মও বুঝতে ব্যর্থ হই; কারণ আমরা বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীন এই দেশটাকে পেয়েছি, অর্জন করতে হয়নি।
©somewhere in net ltd.