নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একটি পথ, আপনি চাইলে হেঁটে দেখতে পারেন....

জীয়ন আমাঞ্জা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !

জীয়ন আমাঞ্জা › বিস্তারিত পোস্টঃ

জামিল সাহেবের রিটায়ারমেন্ট

০৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:২৩

সন্ধ্যে সাতটার দিকে জামিল সাহেব অফিসের ম্যানেজারের কামরা থেকে সোজা রাস্তায় নেমে এলেন; চোখে মুখে তাঁর খুনের তৃপ্তি, যেন একটু আগেই চরম একটা প্রতিশোধ নিতে পারলেন তিনি। ঠিক কত বছর পর মনে করতে পারছেন না, যেন সেই শৈশবের ছোট্ট কিশোরের চোখ নিয়ে আজ একবার খোলা আকাশটার দিকে তাকালেন, বুকটা টলমল করে উঠল তাঁর। আহ্ এই আকাশটা এতদিন কোথায় ছিল?

একটা রিকশা নিতে ইচ্ছে করল আজ, টাকা বাঁচাতে গিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ পথ তাঁর হেঁটে পার করার অভ্যাস, আজ তার নিকুচি করা যাক! বয়স্কমতো এক রিকশাওয়ালাকে সামনেই পাওয়া গেল, উঠে পড়লেন জামিল সাহেব। রিকশাওয়ালাটা কেমন অসহায় ভঙ্গিতে প্যাডেল ভেঙে এগুচ্ছে, তাড়া নেই, কেমন নিরাসক্ত যান্ত্রিক ভাব রিকশার চালকের। জামিল সাহেব আকাশটার দিকে আরেকবার তাকালেন, আকাশে তারাও উঠেছে বেশ কয়েকটা! ছেলেবেলাটা আবার তাঁর ভেতরে দোলা দিয়ে উঠল, চোখ নামিয়ে রাস্তার দুধারের অন্ধকারের দিকে পালাক্রমে তাকালেন, মুগ্ধ চোখে যে আঁধারের রূপ দেখা যেতে পারে জীবনে এই প্রথমবার তিনি উপলব্ধি করলেন। সামনেই রোজকার কাঁচা বাজার, প্রতিদিনই ফেরার পথে এই বাজারে ঘুরে যান তিনি, সস্তায় টুকটাক কেনাকাটা করে নিয়ে যান বাসায়। আজ আর নামলেন না ওখানটায়, মরুক গে কাঁচা বাজার! মুচকি হাসলেন একটু বাজারটা পেরিয়ে যেতেই। যাক গে, মরুক গে!

সামনেই একটা মিষ্টির দোকানের কাছে পৌঁছতেই রিকশা থামালেন জামিল সাহেব, এরা খুব ভাল রসমালাই বানায় নাকি। পকেটে বারো'শ ছাব্বিশ টাকা আছে, এক মাসের হাতখরচ এটা। এই টাকাটার আর কোন প্রয়োজন নেই। আজ খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করল, নেমে দাঁড়ালেন তিনি দোকানটার মুখে, রসমালাই খেতে হবে। ভাড়া দিতে গিয়ে কী মনে করে রিকশাওয়ালাকেও ডেকে নিলেন ভেতরে। রিকশাওয়ালাটা পরম তৃপ্তিতে রসমালাই গিলছে, জামিল সাহেবের চোখ দুটো চকচক করছে তা দেখে খুশিতে, এই প্রথম নিজেকে খুব উদার মনে হল তাঁর।

স্যার, আপনে খাইতেন না? রিকশাওয়ালা লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
হাঁ, খাব তো, খাচ্ছি। এই বলে একটা মুখে তুলতে গিয়ে রসে দাড়ি মাখামাখি হয়ে গেল তাঁর। হো হো করে হেসে উঠলেন, জামিল সাহেব, সাধারণ ব্যক্তিত্বের বয়স্ক রিকশাওয়ালাটাও অবুঝ শিশুর মত খিলখিল করে হাসল তাঁর সাথে। এই হাসির উৎস কোথায় তারা কেই জানে না!

রিকশাওয়ালাকে বিদেয় করার পরও ঘরে ফিরলেন না তিনি, রাস্তাময় রাত দশটা পর্যন্ত হাঁটলেন। কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে তাঁর রাত দশটাই বাজে রোজ, আজ ইচ্ছে করছিল একটু জলদি বাসায় যেতে, কিন্তু হঠাত সেটা অর্থহীন মনে হল। ওই ঘরটা স্রেফ একটু মাথা গোঁজার স্থান বিশেষ, ঘুমুতে যাবার একটা ঠিকানা মাত্র। জীবনের খাটুনিতে খাটুনিতে গৃহস্থালির হাসি আনন্দ সব অভাবের পেষ্টনে উবে গেছে সেই যৌবনেই। ঘরে ফিরে প্রতিদিনই এই ওই অভিযোগ আর ফরমায়েশ নিত্যকার যন্ত্রণা হয়ে গেছে। অভাবের সংসার, কেবলই বেঁচে থাকার চেষ্টা এতটা দিন। স্ত্রীর প্রেমিকা রূপ বিয়ের মাসখানেকের মাথায়ই খসে পরতে বাধ্য হয়েছিল, তার পরের এই তিরিশটি বছর কেবলই ভরণপোষণ আর খাবার যোগানোর দ্বৈত প্রচেষ্টা। এতদিন পরে আজ একটু জলদি করে স্ত্রীর কাছে ফেরা নিতান্ত নির্লজ্জ ন্যাকামোকেও হার মানাবে।

বরাবর সোয়া দশটায় ঘরে ঢুকলেন তিনি। আজ কেউ আগে খেয়ে শুয়ে পড়েনি, আজ ছেলেটা বেকারত্বের লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখেনি। আজ ছেলেটার চাকরি হয়েছে, সরকারী চাকরি। ভাবতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে জামিল সাহেবের। আহ্ ছেলেটাকে খুব মায়া লাগছে দেখতে, বেকারত্বের লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখা ছেলেটাকে এই প্রথম আজ ব্যক্তিত্ববান মনে হচ্ছে, দায়িত্ববান সমর্থ পুরুষের ছাপ আজ হঠাত ছেলেটাকে একদম সুদর্শন করে দিয়েছে যেন! আহ্ আমার সেই সেদিনের ছোট্ট খোকাটা! কখনও ভাল করে আদরও করা হয়নি ওকে!

ফ্যাশফ্যাশে গলায় জামিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা খাওনি এখনও?
ছেলেটা হাসল, পরম ভরসা যোগান সে হাসি। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে জামিল সাহেব বললেন, আজ আমি খাব না। খুব লজ্জা লাগল এটা বলতে যে, আমি বাইরে খেয়ে এসেছি।

কেউ কিছু বলল না, সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জামিল সাহেবের দিকে। মা ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে তাঁর লজ্জা করতে লাগল। কখনও ছেলেটাকে আদর করা হয়নি, কখনও একটা ভাল কথাও বলা হয়নি ছেলেটার সাথে। পয়সা রোজগারের তাড়না আর অভাবের কষাঘাত এই পরিবারের স্নেহ মায়া মমতা ইত্যাদি প্রকাশের পথকে আজীবন রুদ্ধ করে রেখেছিল। জামিল সাহেবের মনে পড়ে, একটা সাধারণ কথাও তিনি কখনও ঘরের মধ্যে খেঁকিয়ে ওঠা ছাড়া বলতে পারেননি।

গলা কেমন খাঁদে নেমে এসেছে, ভাঙা ভাঙা গলায় জামিল সাহেব ছেলেকে বললেন, হাসান, আমার কাছে এসে বস।
ঊনত্রিশ বছরের ছেলেটি যেন সেই শৈশবের ছোট্ট খোকাটির মতই সঙ্কোচভরে এসে বাবার পাশে বসল। জামিল সাহের ওর পিঠে একটি হাত রাখলেন।

একজন দৌড়িবদেরও ক্লান্তি আছে, ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে আরম্ভ করলেন তিনি, একজন বিশ্বসেরা দৌড়বিদও একনাগাড়ে কতক্ষণ আর দৌড়াতে পারে? ক্লান্ত হয়ে যায়! থামতে হয় তাকে একটা পর্যায়ে। থামতেই হয়। অথচ মানুষ, সেই যে জীবীকার পেছনে ছুটতে আরম্ভ করেছে, তার আর থামা কই? সে থামতে পারে কই, বাপ?
আমার তখন পনের বছর বয়স, যখন আমি সংসারের হাল ধরেছি। একটা নিতান্ত বাচ্চা তখন আমি। সেই যে খাটতে লেগেছি বাপ, আর তো থামতে পারিনি। মানুষের জীবনে কত শখ আহ্লাদ থাকে বাপ, আমার কোন কিছুই ছিল না, শুধু সকাল হলেই জানতাম, কাজে বের হতে হবে, মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য খাবার আনতে হবে, খাটতে হবে। এই কেবল খাবার জোটানোর এক চিন্তা ছাড়া আর কোন চিন্তা মাথায় ছিল না বাপ। কেন সাধ আহ্লাদ ছিল না। এরপর তোমার মা এল, সেই একই চাপ, একই দায়িত্ব, একই খাবারের পেছনে ছোটা, কদিন পরে তুমি এলে, আরো দায়িত্ব বাড়ল, আরো খাবারের দরকার, আরো টাকার দরকার, খাটতেই লাগলাম, খাটতেই লাগলাম, জীবনটা কী, বাবা, বুঝতেই পারলাম না। মানুষ স্বাধীনতা কোনটারে বলে বাপ, মানুষ তো পরাধীন; পয়সার কাছে পরাধীন, অভাবের কাছে পরাধীন, দায়ত্বের কাছে পরাধীন! স্বাধীনতা কোথায়, বাপ?
আমি একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, স্বাধীনতা দেখেছি, কিন্তু স্বাধীনতা যে কোনটা তখনও বুঝি নাই, এখনও বুঝতে পারলাম না!

আব্বা, এগুলা ক্যান বলতেছেন, আব্বা! ছেলেটা কাঁদোকাঁদো হয়ে উঠল, ছেলের মাও আঁচলে মুখ চেপে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। জামিল সাহেব বললেন, তোমার মাকে দেখ, সারাটা জীবন কিছুই পায়নি। একটা জীবন পুরাই পার হয়ে গেল, জীবনের সাধ কী তা আমরা জানলাম না!

হইছে আব্বা, থামেন। আমার চাকরী হয়ে গেছে, আর আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। এখন থামেন।

না, বাপ, আমারে আরেকটু বলতে দাও। প্রথম চাকরি শুরু করি তিন'শ টাকা বেতনে, সংসার চলে না। অভাব আর অভাব। সঞ্চয়ের সুযোগ নাই, নুন আনতেই পান্তা শেষ। দিন বাড়ে, অভাব বাড়ে, চাহিদা বাড়ে। আমি শুধু খাটতে থাকি, শুধু খাটতে থাকি। পনের বছরের একটা বাচ্চার চাওয়াগুলো সেই বাচ্চা পর্যায়েই থেকে যায়, বয়স চলে যায়, চুল দাড়ি পেকে যায়, সেই চাওয়াগুলো আর পূরণ হয় না বাপ। একটা ভাল কাপড় কোনদিন পরা হয় নাই, একটা ভাল খাবার কোনদিন মুখে দিয়ে দেখতে পারি নাই। ভাল কিছু কিনলে সেটা তোমাদের জন্য কিনেছি, নিজের জন্য না। সেই যে পনের বছরের ছোট্ট বাচ্চার দাবীটা সেটা আজও রয়ে গেছে ভেতরে। খুুব স্বার্থপর হয়ে উঠতে ইচ্ছে করত বাপ, কখনও পারি নাই।
আজ কী করছি জানো? মিষ্টির দোকানে গিয়ে এক কেজি রসমালাই কিনে খেয়ে ফেলেছি বাপ, তোমাদের জন্য আনি নাই, স্বর্থপরের মত সব একা খেয়ে ফেলেছি আজ!!
এই যে দেখ আমার দাড়িতে এখনও রস মেখে আছে, দেখ!

জামিল সাহেব হাউমাউ করে কাঁদছেন এবার। ছেলে হাসান কী বলবে বুঝতে পারছে না। বাবাকে জড়িয়ে ধরল সে। ছেলের বুকে মাথা রেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে লাগলেন তিনি, আজ আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি বাপ, আজ আমি স্বাধীন হয়ে এসেছি বাপ, যে স্বাধীনতা আমি সারাটা জীবনে পাইনি। তোমার চাকরি হয়ে গেছে, এখন আমি একটু অবসর চাই বাপ, আমি আর খাটতে পারি না বাপ, উসাইন বোল্টও এক নাগাড়ে এতটা পা চালিয়ে পরিশ্রম করতে পারবে না বাপ। আজ আমি মুক্তি নিয়ে এসেছি বাপ, জীবনের সব খাটুনি থেকে। আমাকে এবার একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও!

জামিল সাহেব অনেক রাত পর্যন্ত বিলাপ করলেন, একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। রিটায়ারমেন্টের জঞ্জালমুক্ত, খাটুনিমুক্ত স্বাধীন একটি সকালের তরে ঘুমিয়ে পড়লেন শেষমেষ।

সকালটায় আর তিনি জাগতে পারলেন না।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.