নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
২নং সেক্টর, আমরা তখন কসবায়। ৭ তারিখ হতেই আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন, পাকিস্তানিদের দম শেষ, ওই দিন রাতের মধ্যেই ওরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে পালায়। আর ৮ তারিখ সকালেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। তবে ১০ তারিখে আমরা একদম নিঃসংশয় হতে পেরেছিলাম যে বিজয়ের আর বাকি কিছু নেই।
আজ আমাদের ক্যাম্প রিলিজ হতে যাচ্ছে। বিদায় নিয়ে ফেরার আগে আমরা একটি বিশেষ ফয়সালা নিয়ে বসেছিলাম। ফয়সালাটা মোখলেছকে নিয়ে। মোখলেছের বিচার আছে। মোখলেছ আমাদেরই সহযোদ্ধা। তবে আর দশজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে সে ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রম এবং ভয়ঙ্কর।
আমরা আশা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপুরুষ প্রিয় হায়দার স্যার (মেজর এটিএম হায়দার, খালেদ মোশারফ স্যার আহত হবার পর তিনি সেক্টর কমান্ডারের স্থলাভিষিক্ত হন) উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু যুদ্ধ তো তখনও বাকি, তিনি অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে তখন ঢাকায়।
খালেদ স্যারকে আমি পাইনি, হায়দার স্যারকে পেয়েছিলাম, কথা প্রসঙ্গে তাঁর সম্পর্কে একটু না বলে পারছি না। চিকন চেহারার এই মহান যোদ্ধার গম্ভীর মুখের ওপর একজোড়া ঝলমল চোখ সারাক্ষণ নাচানাচি করত, যেন সারাক্ষণ তিনি ভেতরে ভেতরে কৌতুক আওড়াচ্ছেন আর ঠোঁট টিপে হাসছেন! হ্যাঁ, তাঁর চোখ, চোখ দুটি মানেই গভীর বুদ্ধিমত্তা। সেক্টরের দায়িত্ব পাবার পর হতেই তাঁর মনে একটাই অভিসন্ধি, রাজধানী ঢাকাকে কীভাবে অচল করা যায়! তাই ঢাকার জন্য তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন, আর নারায়ণগঞ্জে শহীদ গেরিলা কোম্পানি। বিভিন্ন অফিস সংস্থা ইত্যাদি হতে তথ্য যোগাড় এবং একেকটিকে টার্গেট করে উড়িয়ে দেয়াতে তাঁর গেরিলাদের ছিল কিংবদন্তিতুল্য কৃতিত্ব। এক পাকিস্তানি অফিসারের বাড়িতে আমরা হামলা করেছিলাম, মোখলেছের কাহিনীটা নাহয় সেখান থেকেই শুরু করি।
মোখলেছ ছিল কুচকুচে কালো, প্রায় দৈত্যের মতো এক তরুণ। হাত পা সব গাট্টা গাট্টা, কেবলই ঘোঁতঘোঁত করত যেন সারাক্ষণই ক্ষেপে আছে, কথাবার্তা বিশেষ বলত না, কখনও আমরা ওকে হাসতে দেখিনি। কোত্থেকে এসেছে, কী পরিচয় কিছুই জানি না।
ওর গায়ে যে কী পরিমাণ জোর ছিল তার একটা নমুনা দিই, এক ছয় ফুট উচ্চতার তাগড়া সেপাইকে ও কেবল দুই হাতেই দুমড়ে মুচড়ে গুড়ো করে দিয়েছিল। আনআর্মড কমব্যাটে ওর ছিল অসামান্য ক্ষিপ্রতা। একদম বুনো ষাঁড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত। অনেককেই অনেকবার ও সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ২২শে নভেম্বর চন্দ্রপুরের হামলায় আমাদের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল, সে সময়ে ওই মোখলেছ না থাকলে আমাদের দল জীবিত ফিরে আসতে পারত না, আমিও আজ এই ঘটনা বলার জন্যে বেঁচে থাকতাম না। ওস্তাদ আইন উদ্দিন কমান্ডারের অধীনে ও ছিল একটা খাটি রত্ন! আজ ওর বিচার নিয়ে বসলেও, আমরা প্রত্যেকেই ওর কাছে ঋণী ছিলাম, কিন্তু যেসব অসংগত আচরণ ও করেছে, তার জবাবদিহি করারও গত্যন্তর নেই।
যে অফিসারের বাড়িতে আমরা হামলা করেছিলাম, মোখলেছ সেই অফিসারের স্ত্রীকে বেপর্দা করতে উদ্যত হয়েছিল! আমরা পাঁচজন মিলে অনেক কষ্টে ওকে বিরত রেখেছিলাম। ওর সেই উম্মাদ অগ্নিচক্ষু আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়!
একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে নিজের মায়ের বোনের ইজ্জত রক্ষা করতেই আজ লড়াইয়ে নেমেছে, তার কি সাজে অন্য এক নারীর ইজ্জতের ওপর হামলা করা? ও কেবল আক্রোশে ঘোঁতঘোঁত করছিল। আজ সেই অপরাধের বিচার বা ফয়সালা করতেই আমরা বসেছি।
আমরা মোখলেছের উম্মাদনা অন্যান্য ক্ষেত্রেও খেয়াল করেছি, পাকিস্তানি শত্রু কাউকে পেলে মারার পরও ও স্বস্তি পেত না, ২৬শে আগস্ট নিয়ামতপুরের হামলাকালে ফেরার সময় ও এক গুলিবিদ্ধ পাকিস্তানি সেপাইকে বয়ে এনেছিল। এনে সেই সেপাইয়ের উপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে ঘণ্টাখানেক ধরে, তা দেখার পর আমাদের কারো আর ওকে ঘাটাতে সাহস হয়নি। যেন এক ক্ষুধার্ত সিংহ একটি ছাগল ভোজে মগ্ন। পালাতে হবে, জানের নিরাপত্তা ইত্যাদি কিছুই ওর খেয়ালে নেই। আমরাও পারছিলাম না ওকে ফেলে যেতে। কেবল দূর হতে শিকার আর শিকারীকে দেখছিলাম। হাত দিয়ে ও সেই সেপাইয়ের পুরুষাঙ্গ ছিঁড়ে নিয়েছিল। অত্যাচার সইতে না পেরে সেপাইটা মরে যাবার পরও মোখলেছ অন্ধ আক্রোশে ছুরি দিয়ে তার শরীর ফালাফালা করে চলছিল।
আজ আমরা মোখলেছকে নিয়ে বসেছি। বিশেষ করে তার নারীর প্রতি আক্রমণের অপরাধটা ছেড়ে দেয়া যায় না। তার মধ্যে যদি এই পাশবিকতা থেকেই থাকে তবে জনসমাজের জন্যে সে তো নিরাপদ নয়।
হায়দার স্যার নেই, ক্যাপ্টেন মাহবুব স্যার আছেন। তিনিই জবাব চাইলেন। বেপরোয়া মোখলেছকে এই প্রথম আমরা অসহায় দেখলাম।
মোখলেছ হাতজোর করে বলতে শুরু করল, স্যার, আমি একজন ডোম। আমি ডোম স্যার, এক পাতে খেয়েছি, দোষ নেবেন না, আমি আসলে একজন ডোম।
ওর ডোম বলাতে আমরা চমকালাম ঠিকই, তবে সেখানে কোন ঘৃণা ছিল না। শুধু অবাক হলাম, এই অদ্ভুত আবিষ্কারে।
স্যার, মোখলেছ আমার আসল নাম না। আমার নাম চুন্নু ডোম। পঁচিশ মার্চের পরদিন আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় গত রাতের লাশ বাওয়ার (বহন করার) জন্য। লাশ জীবনে এমনিতেও কম দেখি নাই স্যার। কিন্তু সেই সময় যে কয়টা ডোম লাশ তুলতে গেছিল স্যার, তারা কেউ কয়েক সপ্তা ঠিক মতো ভাত খাইতে পারে নাই অভক্তিতে।
স্যার, কত যে মাসুম বাচ্চা, কত যে নিরীহ পুরুষ আর কত যে মা বোনের ইজ্জত, আমি দেখছি স্যার আমি দেখছি একেকটা ক্ষতবিক্ষত শরীর!
আর এই সব লাশের মধ্যে একটা লাশ দেখছি স্যার। একটা ধবধবে পরীর মতো মেয়ে। মানুষের যে এত রূপ হয়, কোন মুখ যে এত নিষ্পাপ হতে পারে তারে না দেখলে আমার জানা হত না!
এই নিষ্পাপ মুখটারে ওরা এইভাবে অত্যাচার কীভাবে করতে পারল আমি স্যার এইটা মানতে পারছি না। ট্রাকে সারাটা পথ আমি মেয়েটার মাথা কোলে নিয়া বসে ছিলাম। সারাটা দিন আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে স্যার। আমি সেই নিষ্পাপ মেয়েটারে ভালোবাসছি স্যার। আমি সেই লাশটারে ভালোবাসছি। তার প্রতিশোধ নেবার জন্যই আমি যুদ্ধে আসছি।
চুন্নু চিৎকার করে কাঁদছিল আর হাউমাউ করে কথাগুলো বলছিল।
স্যার, কেবল বাঙালি হওয়ার কারণে ওরা আমাদের মা বোনের উপরে যে অত্যাচার করছে, একটা দুইটা বুলেটে সে শোধ উসুল হয় না স্যার। এই যুদ্ধ শেষ হয় নাই স্যার! প্রতিশোধ শেষ হয় নাই।
আমরা চুপ ছিলাম সবাই
২| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:২৫
কুতুবুদ্দিন আইবেক বলেছেন: পড়ে খুব ভালো লাগলো
৩| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৮
ডট কম ০০৯ বলেছেন: এটা কি বাস্তব ঘটনা না গল্প। আমার পড়ে মনে হল বাস্তব। দারুন লেখনী।
৪| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০৫
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: কি বলবো বুঝতে পারছি না। ছুঁয়ে গেলো।
++++++
ভালো থাকবেন ।
মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। আনন্দের। বিষাদের।।
১১ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৫
জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: ধন্যবাদ রায়হান ।
আনন্দটা হোক গৌরবের, আর বিষাদটা হোক প্রত্যয়ের, উপলব্ধির । যে জাতি অতীতকে লালন ও মূল্যায়ন করতে জানে না সে জাতির অধঃপতন সুনিশ্চিত । আমরা অধঃপতন নয়, উজ্জীবন চাই ।
৫| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৮
জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: আমার উপস্থিতি বাদে সবই বাস্তব ।
৬| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০০
ওয়্যারউলফ বলেছেন: কোন মন্তব্য করা আমার সাধ্যের বাইরে শুধু মনের ভিতর অসহ্য এক যন্ত্রনা অনুভব করলাম মোখলেছের মত।
১১ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫২
জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: এতেই আমার সার্থকতা বা আত্মতৃপ্তি ।
৭| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৮
সুমন কর বলেছেন: বাস্তবমিশ্রিত গল্পে ভাল লাগা রইল।
মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
১১ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৫
জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: শুভেচ্ছা আপনাকেও, সুমন ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:০৯
ঢাকাবাসী বলেছেন: খুব ভাল লাগল।