নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগৈলঝাড়া থেকে বরিশাল আসা হয়েছে দূর্গা পুজার পর। আগইলঝাড়ার অতি সাধারন গ্রাম্য জীবনে কয়েকদিন বসবাস, আমার জীবনে এই প্রথম। সেই সাথে দেখ হলো আগইলঝাড়া গ্রামের দূর্গাপুজা। পুজার ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে বন্ধুর সাথে ওর বাড়ি চলে গেলাম। ইচ্ছা হলো এবং বন্ধু অনেক জোড়াজুড়ি করছিল বলে।
আমার জীবনটা এই স্বাধীনতায় পূর্ণ ছিল। ইচ্ছা হলে তা পূরণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারতাম। বাড়িতে ফোন করে বলে দিলাম বন্ধুর সাথে ওর বাড়ি যাচ্ছি পুজার সময়। পুজার পর বন্ধুসহ বাড়ি আসব। বাবার যদিও মন খারাপ হলো তবু মেনে নিলেন। বাবার ইচ্ছা মেয়ে সব সময় বাসায় তাঁর পাশে থাকুক। কিন্তু পড়ালেখার জন্য আমি তখন ঢাকায় থাকি। সেটাতেও বারণ করতে পারেন না। তবে ছুটিছাটার সবগুলো দিন আগে পিছে আরো কটাদিন মিলিয়ে যেন বেশ কিছুদিন বাড়ি থাকি, বাবা এই ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ডানা মেলে এক একা উড়তে পারার সে বয়সে বাড়ি না গিয়ে, কত কিছু দেখতে ইচ্ছে করে। যদিও বাড়ির জন্যও মন পুড়ে।বাড়ির আদর সবার সঙ্গ অনেক মিস করি সাথে অন্য জগৎ দেখার আগ্রহও কম না। ছুটি হলে বড়িই তো ফিরে যাই সব সময়; এবার না হয় একটু ঘুরে দেখে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেই যাই।
আমাদের যাওয়ার ইচ্ছা ছিল স্টিমারে চড়ে। কিন্তু শেষ মূহুর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে বাসে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। স্টিমারে সারারাতের জার্নি আর বাসে সারাদিনের। বাস রুট তখন নতুন হয়েছে বরিশাল পর্যন্ত। এর আগে নদী পথ ছাড়া বরিশাল যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। বেশ সুন্দর রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে, দুই বন্ধু মিলে উঠে বসলাম বিআরটিসির বাসে। ধামরাই, মানিকগঞ্জ, গোয়ালন্দ হয়ে ফেরীতে পদ্মা নদী পারি দিয়ে ফরিদপুর, মাদারীপুর কালকিনি হয়ে গৌরনদী যখন পৌঁছালাম তখন বিকাল সন্ধ্যাকে ছূঁবে বলে রঙ্গিন হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এবার আমাদের যতটুকু পথ যেতে হবে। তার জন্য রিকসা ছাড়া আর কোন বাহন ছিল না সে সময়।
রিকসা গৌরনদীর পিচঢালা পথ ছাড়িয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলছে। রিকসার পাদানীতে আমাদের দুজনের সুটকেস রেখে তার মাঝে আঁটসাাট হয়ে বসে আছি আমরা। মেঠো পথে নামতেই রিকসার ঝাঁকুনিতে আমাদের লাফঝাপ শুরু হলো, বসে থাকা অবস্থায়। কখনো কোথাও খোয়া বিছানো কিছু পথ। যখন ভাঙ্গা ইটের খোয়ার উপর দিয়ে রিকসা চলা শুরু করল তখন দুপাশের খোলা সবুজ মাঠ আর অস্তগামী সূর্যের আলোয় রঙ্গিন হয়ে আমরা গলা সাধতে শুরু করলাম। গলা সাধার যে ভাঁজ গুলো খুব কঠিন লাগে কিছুতেই স্বর উঠা নামা করে না। খোয়ার উপর চলা রিকসায় বসে কণ্ঠের আপস ডাউনের কারুকাজ বড় সুন্দর ভাবে ঝংকৃত হতে থাকল আমাদের গলায়। বেলা শেষের পথিক আমাদের গলা সাধা তানে, গানে মুগ্ধ হয়ে খানিক থেমে যেতে থাকল। রাখালের গরুগুলোও সোজা পথ ছেড়ে মাঠে নেমে গেল ভয় পেয়ে। শেষ ধানের আঁটিটি মাথায় তোলার আগে আমাদের দিকে এক পলক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকল কৃষক।
আমাদের সাধনা তাও থামল না। এমন সুযোগ সহজে পাওয়া যায় না গলা সাধার।
উঠোনের চারপাশ ঘিরে ঘরগুলো। প্রদিপের আলোয় যত না আলোকিত বাইরে পঞ্চমির চাঁদের আলো তার চেয়ে বেশী দেখা গেল।
রাতের মতন ছায়া ছায়া গাছপালায় ঘেরা বাড়ি তেমন আর দেখা হলো না। তোলা পানিতে স্নান সেরে হিন্দু বাড়ির অদ্ভুত নতুন স্বাদের মাছ নিরামিশ, ডালের খাবার খেয়ে গল্প বেশী জমার আগেই ক্লান্ত শরীরে ঘুম নামল।
সারারাতের টুপটাপ শিশিরের শব্দ ঘুমে তেমন ব্যাঘাত করল না। কিন্তু সকাল বেলা পাখিরা ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। চোখ মেলে জানলাম নতুন পরিবেশে নতুন ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম।
গ্রামের বাড়িতে মুড়ি মুড়কি, চিড়া, খই নারিকেল, ছাতু, নাড়ু নানা রকম নাস্তা শহুরে পরটা রুটি নয়।
গ্রাম্য জীবনের মানুষের জীবনের অতি সাধারন জীবন যাপন দেখে কেটে গেল সারা দিন। সন্ধ্যা বেলা পুজা দেখতে যাওয়া। সারাদিনের কাজ শেষে গ্রামের নারী পুরুষ শিশু সবাই পুজা দেখতে আসছে। পরম ভক্তিতে অনেকে বসে আছে দেবীর সামনে। সাধ্য মতন আয়োজন শহরের মতন অত জাকজমক নেই। তবে ভক্তি এবং ভালোবাসা একই রকম।
দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন আমরা ঘুরলাম গ্রাম জুড়ে মাঠ, শষ্য ক্ষেত, হলুদ, সবুজ, বেগুনী ফুলের মায়া গায়ে মেখে বাছুর, ছাগল হাঁস পায়রা, মোরগের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে বন্য অরন্যময়ী হয়ে। কখনো গাছে চড়ছি ফল পেরে খাচ্ছি, কখনো শুধুই ছবি উঠানোর জন্য গাছে চড়ছি। হাসি আনন্দে ভাঙ্গছি, দৌড়াচ্ছি মাঠ জুড়ে বাচ্চা শিশুটি হয়ে। প্রতি সন্ধ্যায় একটা না একটা আয়োজন পুজার মন্ডপে। কখনো স্থানীয় শিল্পীর গান, কখনো নাচ। সে দিন হবে যাত্রা। যাত্রা নিয়ে অনেক বেশী আগ্রহ সবার মনে।
সময় মতন আমরাও পৌঁছে গেলাম প্যান্ডেলে। আমাদের জন্য সামনে, চেয়ার পেতে দেয়া হলো বসার জন্য।
খুব ছোটবেলায় প্রতি শীতে আমাদের শহরে মেলা হতো। মেলায় যাত্রা হতো। প্রায় রাতে আমরা যাত্রা দেখতে যেতাম। যাত্রা শুরু হওয়ার আগে মঞ্চের পাশে বসে কয়েকজন বাদ্যি বাজিয়ে যেত। কি মদকতাময় সে সুর। এখন হয় তো ভালোলাগবে না শুনতে কিন্তু ছোটবেলা সে বাজনার জন্যই যেন যাত্রা পালা দেখতে যেতাম। একজন মঞ্চের পাশে বাজনাদারের পাশে বসে বই দেখে ডায়লগ পাঠ করে,
অভিনেতা তা শুনে অভিনয় করে বলে যাচ্ছে তীব্র কণ্ঠে। কি তীব্র উচ্চ কণ্ঠস্বর তাদের, মাইক ছাড়াই পেণ্ডেলের শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে তাদের কথা। কি সুন্দর চাকচিক্যময়, ঝলমলে তাদের পোষাক। অদ্ভুত ভালোলাগত, যাত্রা পালার অভিনেতাদের পোশাক। মাঝে মাঝে ঘাগরা পরা মেয়েরা ঘুরে ঘুরে নাচত।
পুজার যাত্রা তেমন চাকচিক্যময় ছিল না। স্থানীয়দের আয়োজনে হচ্ছে পেশাদারীদের আমন্ত্রণ করার সামর্থ ছিল না।
আমাদের বয়স তখন যাত্রা পালা থেকে নাটক দেখার দিকে ঘুরে গেছে। তাই খানিক দেখার পর, আমরা মাঠে ঘুরতে গেলাম। দশমীর চাঁদনী রাত পিছলে যাচ্ছে ক্ষেতে, ঘাসের বনে, সবুজ পাতায়। দিগন্ত জুড়ে অপূর্ব রূপালী আলো জড়িয়ে আছে। তার মায়ায় জড়িয়ে আমরা গল্প করছি। দূরে একজন গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, মধুর বাঁশরি বাজে। কি মায়াময় সুর কণ্ঠে। পাগলা ধরনের উড়নচণ্ডি একক এই মানুষটি আর কোন কাজ না পারলেও গান গেয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। কিন্তু এ গানের কণ্ঠকে পেশা করে বাঁচারও তার কোন ইচ্ছে নেই।
উনাকে ডেকে আমরা অনেকগুলো গান শুনলাম পূর্ণিমার আলোয় বসে। রাত যত বেশী হচ্ছে মাটির তাপে জলীয়বাষ্প বাড়ছে তত মাঠ জুড়ে। আমাদের ছূঁয়ে ছূঁয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের পানে কুয়াশার মতন মেঘদল।। চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা কিছুটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে । ছায়াছায়া একটা ভাব, তার মাঝে দাদার উদাত্ত কণ্ঠ ভেসে যাচ্ছে বাতাসে ঢেউ তুলে।
দুই
পরদিন আমরা দিদির বাড়ি বরিশালে চলে আসলাম। আবার সেই খোয়া বিছানো লাল ইটের পথ ধরে রিকসায় চলতে চলতে গলা সাধতে সাধতে। গৌরনদী পর্যন্ত এসে বাসে করে বরিশাল। বরিশাল পলিটেক্যানিকালে শিক্ষক, দিদির বর। তাদের সাজানো ছিমছাম জীবন। ছোট দুটো বাচ্চাসহ সুন্দর সংসার। এখানে বাইরে ঘোরাফেরার তেমন সুযোগ নাই। বিস্তির্ণ খোলা মাঠের খোলা রোদ ও হাওয়া, চারদেয়ালের সংসারে বন্দী। কোয়াটারের বাইরে ক্যাম্পাস। এখন ছুটি চলছে তাই শিক্ষার্থির পদচারনা তেমন নেই।
সন্ধ্যাবেলা টেলিভিশন দেখা গল্প আর খেলাধূলা করা। শহরে মার্কেটে, পার্কে আর নদীর পারে ঘুরতে গিয়ে জাহাজ দেখা।
পাঁচদিন পর কোজাগরী রাত লক্ষী পূর্ণিমা। সারাদিন আমার বন্ধু, দিদির সাথে মহাব্যাস্ত। লক্ষীর পা আঁকল দরজার বাইরে থেকে ঘরে প্রতিমার আসন পর্যন্ত। নানা রকম সবজী মিলিয়ে খিচুরি রান্না পায়েস লুচি সন্দেশ কত কিছু বানানো হচ্ছে। ব্যাস্ততার শেষ নেই তার মাঝে বাচ্চারা এসে মাসীর কাছে কত রকমের আবদার করে যাচ্ছে। নানান রকম মজার খাওয়া দাওয়ার সাথে ঘরে বসে পুজার আয়োজন সরাসরি দেখছি। ঘটি বাটি তেল ফুল পাতা পানি ধুপ ধূনো কলা সিঁদুর আলপনা কত কিছু সাজানো সুন্দর করে। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে সাজিয়ে রাখার।
এর মাঝে আমার ফোন আসল। বরগুনায় ফুপা তখন এস পি। উনাকে জানিয়েছিলাম বরিশালে আছি আমি। উনি ফোন করে জানালেন। আজ সন্ধ্যায় রওনা হলে কাল সকালে বরগুনা পৌঁছে যাব। লঞ্চে ওদের পুলিশের একটা টিম যাচ্ছে আজ রাতে। আমাদের নিরাপত্তর জন্য আজই যদি যাই তা হলে ভালো হয়। বিকাল নাগাদ ফোন পেয়ে সন্ধ্যার মধ্যে তৈরি হয়ে লঞ্চঘাটে পৌঁছে গেলাম দুজন। যদিও পুজোর অনুসঙ্গ আরো কিছু করার ইচ্ছে ছিল বন্ধুর তা রেখে সে আমার সাথে বেরিয়ে পরল।
পুলিশের লোকজনের সাথে দেখা হলো ঘাটে পৌঁছানোর সাথে সাথেই। তারাই আমাদের লাগেজ বহন করে আমাদের সাথে করে নিয়ে গেল লঞ্চের কেবিনে। একটা কেবিন শুধু আমাদের দুজনের জন্য বরাদ্দ আজ রাতের জন্য।
পাশে আরো একটি কেবিনে আরো মানুষজন। আর কিছু মানুষ লঞ্চের নিচতলায়।
আমারা দুখানা সিটে নিজেদের শোয়ার জায়গা করে সব গুছিয়ে, বসে গল্প করে কাটালাম কিছু সময়। ধীরে সন্ধ্যা নামছে নদীর উপর। লঞ্চ সিটি বাজিয়ে চলতে শুরু করল। এসময় কেবিনের মধ্যে বসে থাকার কোন ইচ্ছা আমাদের নাই। আমরা বাইরে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে নদীর রূপ, আকাশেরর রূপ সূর্যাস্তের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। ছোটছোট কিছু নৌকা ভাসছে নদীতে। নীড়ে ফেরা পাখিরা উড়ছে নদী পার হয়ে নীড়ের ঠিকানায়। সব কিছুই আমাদের মুগ্ধ করছে। মুগ্ধ হতে হতে বাতাসের আদর খাই। জল কেটে কেটে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে। ঠিক কোন পথে জানি না। সেদিকে চোখ রেখে তীরের দূরে সরে যাওয়া দেখতে লাগলাম। শহর ঘরবাড়ি দোকান রাস্তা আলো সব ছেড়ে আমাদের চারপাশে এখন শুধু জল নদীর বয়ে চলা। বাতাসের শব্দ।
বরিশাল ঘিরে আছে কত নদী সুন্দর সুন্দর নামের নদী। আড়িয়াল খা নদী, কীর্তনখোলা নদী, পায়রা নদী, সন্ধ্যা নদী, কালিজিরা নদী, ইলিশা নদী, বরিশালের নদীর নামগুলো সব মনে করার সাথে জীবননান্দের রূপসি বাংলার রূপ দেখি প্রাণ ভরে।
চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন নদী সুগন্ধার সাথে কালী ও শিবের উপাখ্যানের গল্প করি আমরা। কি ভাবে ঘটনা প্রবাহ এক একটা নাম হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করি।
কালী বা তারা পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর তার পিতা স্বামী শিবকে নিন্দা করে। এ সংবাদে শিব বা মহাদেব শোকে উন্মাদ হয়ে যায় এবং স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নৃত্য করতে থাকে। এ নৃত্য পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এ দেখে মহাভাগ বিষ্ণুর চক্র দ্বারা তারার দেহ বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত করে এবং সে খন্ডগুলো যে সব স্থানে পরে, সে স্থানগুলো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। পাবনী, হলদিনী ও নলিনীর মিলিত মোহনায় তারা দেবীর নাসিকা পড়েছিল। সেজন্য ত্রিধারার মোহনার নাম সুগন্ধা হয়েছে। নাসিকা দিয়ে সুঘ্রাণ নেয়া হয়, তাই সুগন্ধা নাম। কালিকা পুরাণে সুগন্ধার উল্লেখ আছে- “সুগন্ধায়াং নাসিকা মেদেব স্ত্র্যম্বক ভৈরব।সুন্দরীসা মহাদেবী সুনন্দাতত্রৎ দেবতা” -কালিকাপুরাণ।
সুগন্ধা নদীর পলিমাটি থেকে চন্দ্রদ্বীপ ভূগঠন হয়েছে।
সুগন্ধার পূর্ব পারে ছিল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এবং পশ্চিম পারে ছিল সেলিমাবাদ। সুগন্ধার সংক্ষিপ্ত নাম সন্ধ্যা। সুগন্ধা নামের উত্তরাধিকারী রূপে নলছিটি থানার কাছে সুন্দরকুল নামে একটি গ্রাম এখনও রয়েছে। বর্তমানে বরিশালের কালিজিরা নদীটিকে সুগন্ধার উত্তরাধিকারী নদী বিবেচনা করা হয় এবং সে হিসাবে, কালিজিরা যেখানে কীর্তনখোলার সাথে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে শুরু করে বিষখালী পর্যন্ত জলধারাটি সুগন্ধা । এখন সুগন্ধা মানচিত্র, থেকে হারিয়ে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় অবস্থান নেয়া একটি নদী। কিন্তু ঘটনা এবং গল্পগুলো মিথ হয়ে আছে। আমাদের ভালোলাগে এসব আলোচনা করতে। লঞ্চের বিশাল চাকায় জল কেটে যাওয়া দেখতে দেখতে।
সন্ধ্যা নদীর গল্প করতে করতে আমরা আবৃত্তি করি ,
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
না আমাদের এখনও কোন ক্লান্তি, নেই, নেই কোন ভয় ভীতিও। আমারা সঙ্গী দুজন খুব মজা করেই চলেছি। আমাদের উচ্চ হাসির কলরোল,আমাদের উচ্ছাস বয়ে যায় নদীর ঢেউ বেয়ে সাগরে মিশবে বলে ।
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে, আমরা কোন আশঙ্কায় অবশ্যই আশংকিত নই বরং আনন্দিত ভালোলাগায়।
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা--পরছে রঙগুলো মুছে যাচ্ছে অদ্ভুত ভাবে অবগুণ্ঠনের আড়ালে, আমরা কবিতার সাথে, মিলাই আর চিল্লাই---
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা.. উড়ে যাওয়া নীড়ে ফেরা পাখিদের দেখে জোড়ে জোড়ে বলতে থাকি, তখন আর অাবৃত্তি থাকে না। সাথে অকারণ হাসি মনে হয় সেই বয়সের দোষ।
বাতাস আমাদের চুল উড়ায়, কাপড় উড়ায়। আমাদেরও উড়িয়ে নিয়ে মাঝ নদীতে ফেলে দিলে কেমন হবে তার গল্প ফেঁদে আমরা স্বপ্নের দেশে ভাসি, ভালোবেসে। এ পাশের বারান্দায় কেউ আসতে পারছে না। কেবিনের দু পাশে দুজন পুলিশ বন্দুক হাতে আমাদের পাহাড়া দিচ্ছে। আমরা মহা আনন্দে নিরাপদ স্বাধীনতা ভোগ করে প্রাণ খুলে হাসি। পাহারাদার পুলিশদের নিয়েও হাসি। বেচারারা সারাক্ষণ কর্তব্য পালন করতে থাকবে দাঁড়িয়ে। কি ভয়াবহ দায়িত্ব!
সেই বয়সে এই বিষয়টা নিয়ে গর্ব বোধ করি। যদিও নিজেদের একটা খাঁচায় বন্দী মনে হচ্ছিল। সবার থেকে একটু আলাদা আলাদা লাগছিল।
বাতাসের স্পর্শে শীতল হয়ে আমরা কেবিনে ফিরলাম। মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের দুপাশে বসে তাস খেললাম অনেকক্ষণ।
এর আগেরবার স্টিমারে করে এসেছিলাম বরিশাল। মেঘনার মোহনার বিস্তৃতি দেখে কি যে ভালো লেগেছিল। ঠিক সন্ধ্যাবেলা তখন সূর্য ডুবছিল। মনে হয়েছিল সাগরের মাঝে চলছি যেন। পশ্চিম আকাশ, দিগন্ত জল সব বর্ণিল সোনালি রঙে এমন রাঙ্গা হয়ে মনে কেড়ে ছিল। এখনও চোখে ভাসে। আহা কি সুন্দর। সেবার চন্দ্রদ্বীপ রাজ বংশের স্মৃতিময় জমিদার বাড়ি (মাধপ পাশা) দুর্গাসাগর দিঘী ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেবার চক্করটা ছিল সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, কুমিল্লা, ময়নামতি, কক্সবাজার রাঙ্গামাটি হয়ে কুমিল্লা ময়নামতি ফিরে বগুড়া হয়ে নীলফামারী পর্যন্ত অনেক দিনের লম্বা অন্য রকম ভ্রমণ। বারবার ময়নামতি ফিরে আবার অন্য জায়গায় যাওয়া হচ্ছিল কারন খালাদের সাথে ঘোরাটা হচ্ছিল আর খালাদের পোষ্টিং তখন ছিল ময়নামতি।
খেলা শেষে আলো নিভাতেই বাইরে আলো ডাকতে লাগল নেশার মতন। বাইরে এলাম আবার। সুন্দর একটা কেবিন ঘুমানোর ব্যবস্থা রেখে, মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে নদীর উপর ভরা পূর্ণিমার রূপ দেখে সারারাত রেলিং ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলাম। কোজাগরী রাত মায়াবতী রূপের নেশায় পাগল করে দিয়েছিল, যেন আমাদের। আমাদের ঘুম, কথা হারিয়ে গিয়েছিল মন্ত্র মুগ্ধ মৌনতায় আমরা রূপালি চাঁদের আলোর সাথে মিশে ছিলাম কীর্তনখোলার জলের সাথে । নীল জলে রূপালি জোছনার নেশায় বুদ হয়ে কখনো আকাশ ভরা আলো কখনো জলতরঙ্গে ভাঙ্গা চকচকে আলোর সুখ কনা হয়ে ভাসছিলাম আমরা। সময়গুলো হারিয়ে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেলেও, সেই জোছনা ভরা রাতের স্মৃতি মন জুড়ে এখনও তেমনি রয়ে গেছে।
যখন আকাশ ফিকে হয়ে আছে রূপালি আলো ম্লান করে। শুকতারা জেগে উঠেছে পুব আকাশে তখন কিছুটা ক্লান্তি আমাদের ঠিক ছেঁকে ধরল। আমরা ঘুমাতে গেলাম অবশেষে।
ঘুমাতে না ঘুমাতেই জাগতে হলো। সে বয়সে ঘুম কি গভীর ছিল। একবার ঘুমিয়ে পরলে আর জাগতে ইচ্ছা করত না। অথচ যাত্রীর হৈ চৈ শব্দ, লঞ্চের থেমে থাকা আমাদের উঠিয়ে দিল। রাত শেষ হয়ে গেছে। ভোর এখন আমাদের কোজগরী রাতের পথ চলা শেষ। পৌঁছে গেছি বরগুনা। ধীরে সুস্থে নেমে এলাম লঞ্চ থেকে। লঞ্চ চলার এটা শেষ ঠিকানা এখান থেকে আর কোথাও যাবে না। আমাদের নেয়ার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।সারা রাতের পাহারা পুলিশ আমাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে স্যালুট দিয়ে বিদায় নিল। এবার ড্রাইভার সাহেব আমাদের বাড়ি নিয়ে এলেন। পুরাতন বিশাল একটা বাড়ি । চারপাশে অনেক গাছপালায় ছায়া ছায় হয়ে আছে এই ভোরবেলা।
তবে বাড়ি টারি দেখার চেয়ে সবার সাথে কথা বলার চেয়ে তখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। কোন মতনে দুচার কথা সেরে বিছানা খুঁজে শুয়ে পরলাম।
আজ তবে এইটুকু থাক বাকি কথা পরে হবে..........
( ছবি দুটোই আমার সম্পত্তি প্রথম ছবিটি আমার আঁকা শেষটি নিজের তোলা ফটো )
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:০১
রোকসানা লেইস বলেছেন: শুভেচ্ছা নূর মোহাম্মদ নূরু
লেখাটা আবার পড়লে বুঝতে পারবেন। আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম
আগৈলঝাড়া
আমার বাড়ি ওখানে না। বলা যায় সারা বাংলাদেশ
ভালো থাকবেন
২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৩১
খায়রুল আহসান বলেছেন: গলা সাধার যে ভাঁজ গুলো খুব কঠিন লাগে কিছুতেই স্বর উঠা নামা করে না। খোয়ার উপর চলা রিকসায় বসে কণ্ঠের আপস ডাউনের কারুকাজ বড় সুন্দর ভাবে ঝংকৃত হতে থাকল আমাদের গলায়। বেলা শেষের পথিক আমাদের গলা সাধা তানে, গানে মুগ্ধ হয়ে খানিক থেমে যেতে থাকল। রাখালের গরুগুলোও সোজা পথ ছেড়ে মাঠে নেমে গেল ভয় পেয়ে। শেষ ধানের আঁটিটি মাথায় তোলার আগে আমাদের দিকে এক পলক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকল কৃষক - হা হা হা, বড়ই চমৎকার করে বলেছেন!
উঠোনের চারপাশ ঘিরে ঘরগুলো। প্রদিপের আলোয় যত না আলোকিত বাইরে পঞ্চমির চাঁদের আলো তার চেয়ে বেশী দেখা গেল - এমন স্নিগ্ধ বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হ'লাম।
সাথে অকারণ হাসি মনে হয় সেই বয়সের দোষ --
কোজাগরী রাত মায়াবতী রূপের নেশায় পাগল করে দিয়েছিল, যেন আমাদের। আমাদের ঘুম, কথা হারিয়ে গিয়েছিল মন্ত্র মুগ্ধ মৌনতায় আমরা রূপালি চাঁদের আলোর সাথে মিশে ছিলাম কীর্তনখোলার জলের সাথে । নীল জলে রূপালি জোছনার নেশায় বুদ হয়ে কখনো আকাশ ভরা আলো কখনো জলতরঙ্গে ভাঙ্গা চকচকে আলোর সুখ কনা হয়ে ভাসছিলাম আমরা। সময়গুলো হারিয়ে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেলেও, সেই জোছনা ভরা রাতের স্মৃতি মন জুড়ে এখনও তেমনি রয়ে গেছে - পোস্টের এ অংশটুকু পাঠককে মন্ত্র মুগ্ধ মৌনতায় আচ্ছন্ন করে দেয়!
সুন্দর পোস্ট। কোজাগরী পূর্নিমার তিথিতে যথার্থ এবং সময়ানুগ। পোস্টে প্রথম ভাল লাগা + +
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:১৯
রোকসানা লেইস বলেছেন: ধন্যবাদ খায়রুল আহসান
আপনার লেখায় নিজের লেখা দেখে নিজের কাছেই একটু অন্য রকম লাগছিল নতুন করে আবার লেখাটা উপলব্ধি করলাম।
এবার কোজগরী বড় সুন্দর হয়ে জেগেছে পৃথিবী জুড়ে।
পৃথিবীর কত জায়গা থেকে কতজনা চাঁদের ছবি দিচ্ছে সবার মনে চাঁদ পুলক লাগিয়েছে। ছবিতে যদি জোছনা তুলে দেয়া যেত তবে তাই করতো মনে হচ্ছে।নিজেও দেখছিলাম জোছনা আর তা মনে করিয়ে দিল পুরানো স্মৃতি কিন্তু এখনও অক্ষত উজ্জ্বল। তাই লিখে ফেললাম।
প্লাস আর ভালোলাগা পেয়ে ভেসে গেলাম আবার হাওয়ায়
অনেক ভালো থাকুন
৩| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:১১
মলাসইলমুইনা বলেছেন: আপনার লেখাটা খুবই ভালো লাগলো | জানিনা অনেক দিন আগে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি রিসার্চের কাজে বরিশাল গিয়েছিলাম সেই স্মৃতি মনে হয়েই কিনা | তখন আগৈলঝড়াও যেতে হয়েছিল | বরিশাল থেকে একটা জিপে | তারপর একটা বোটে করে ছবির মতন একটা সুন্দর গ্রামে কেয়ার (CARE) -এর কাজগুলো দেখতে হয়েছিল আগৈলঝাড়ায় | আপনার বর্ণনার সাথে মিল আছে সেই গ্রামের | জাহাজে করে ফিরে এসেছিলাম ঢাকায় | রাতে ঝড় | অনেক কাব্য করে আমাদের সেবার ঢাকায় ফেরা | আপনার ভ্রমণের সাথে অনেক মিল | ও, আপনি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন সত্যি কিন্তু আপনার লেখার শিরোনামটা হয়ে গেছে যেন কোনো অপূর্ব কবিতার ছান্দসিক কোনো চরণ ! বিউটিফুল ! ধন্যবাদ নেবেন |
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:২৫
রোকসানা লেইস বলেছেন: বেশ আপনি ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় গিয়েছিলেন। আর আমিও ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই গিয়েছিলাম। আপনার সাথে এই জায়গায় মিল হয়ে গেল।
অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও পরিবর্তন খুব হয়নি বুঝতে পারলাম।
প্রতিটা জায়গার একটা বিচিত্র বৈশিষ্ট আছে। দূর থেকে একই রকম মনে হলেও।
পরের অংশটুকুও দিয়ে দিব লেখা শেষ হলে।
কাব্য তো মনে থাকে তাই ছন্দময় হয়ে গেছে শিরোনাম।
শুভেচ্ছা ও ভালোথাকার কামনা
৪| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:২৭
দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: চমৎকার লেখা। ভালো লেগেছে।
ভালো থাকুন নিরন্তর। ধন্যবাদ।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:১৫
রোকসানা লেইস বলেছেন: শুভেচ্ছা দেশ প্রেমিক বাঙালী
আপনিও অনেক ভালো থাকুন
৫| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫২
আহমেদ জী এস বলেছেন: রোকসানা লেইস ,
বরিশাল আমার নিজের শহর । সেই বরিশালকে কোজাগরী রাতের মাতাল জোছনায় মেখে সাজিয়েছেন বলে কথারা হারিয়ে গেছে খোয়া ভাঙা লাল ইটের পথে ।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৯
রোকসানা লেইস বলেছেন: নিজের বলে একটু বেশী আবেগ প্রবন হয়ে গেলেন আহমেদ জী এস।
আমার খুব ভালো সময় কেটেছিল।
শুভেচ্ছা জানবেন
৬| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৭
বাবুরাম সাপুড়ে১ বলেছেন: লেখাটি তো বেশ !
০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:২৬
রোকসানা লেইস বলেছেন: শুভেচ্ছা বাবুরাম সাপুড়ে১
৭| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৫
বিলিয়ার রহমান বলেছেন: সময় গড়ানোর সাথে সাথে স্টোরিটা আরো পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে!
+
৮| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:০২
রোকসানা লেইস বলেছেন: সময় গড়ানোর পরও সব ঠিক আগের মতন যে উজ্জ্বল মনে রাখার জন্য নিজেকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে নিলাম
অনেক শুভেচ্ছা বিলিয়ার রহমান
৯| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:০৪
মনিরা সুলতানা বলেছেন: কি মমতায় স্মরণ করেছেন বিশ্ব বিদ্যালয়ের জীবন !!!
মন ছোঁয়া হয়ে রইলো আপু ।
১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩০
রোকসানা লেইস বলেছেন: দারুণ সময় ছিল যে।
সে সময়ের সব কিছুই একটু বাড়তি আবেগের ছিল। জীবনটাকে নতুন ভাবে চেনার সময়।
অনেক ভালোবাসা প্রিয় মনিরা সুলতানা
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:১১
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন: যে দেখেনাই বরিশাল
বৃথাই তার জীবনকাল।
বরিশালের রূপ বর্ণনা করেছেন
জীবনানন্দ, বরিশালের রূপে মুগ্ধ কাজী নজরুল,
তার মতে প্রাচ্যের ভেনিস এই বরিশাল।
আপনার বর্ণনায় বরিশালের রূপমাধুরী
মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আবার।
আপনার বাড়িযে আগৈলঝাড়া তা
জানতাম না। ভালো থাকবেন।