নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সকালবেলা বসেছিলাম ফুপুর গায়ে হেলান দিয়ে। কত বয়স হবে ছয় সাত। হঠাৎ গানের আওয়াজ আসল আমরা বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, রাস্তা দিয়ে কিছু ছেলে খালি পায়ে গান গেয়ে যাচ্ছে, তাদের হাতে কিছু ফুল। ফুপু বললেন, এখনের ছেলেরা অলস হয়ে গেছে। ভাইরা আগে অন্ধকার থাকতে প্রভাত ফেরী করত। শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেত।
ঢাকার হোস্টেলে থাকি, সুপার জানালেন, মেয়েরা কাল খুব ভোর বেলা তৈরী হবে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবো। একুশে ফেব্রুয়ারি বকসিবাজার থেকে শহীদমিনার খালি পায়ে হেঁটে গেলাম ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সারিবদ্ধ দলবদ্ধ অনেক মানুষ ধীর এবং শ্রদ্ধাশীল একটাই শব্দ মুখে আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।
সময়টা নব্বইয়ের শুরুর দিকে। বিশ ফেব্রুয়ারির রাত, টিএসসি তে কবিতা পরিষদের উৎসব কমিটির রুমে অনেক কবির ভিড়। সবাই গল্প করছেন। রাত বারোটায় শহীদমিনারে ফুল দিয়ে আজ বাড়ি ফেরা হবে। মেয়েরা অনেকেই চলে গেলেন।
আনোয়ারা সৈয়দা হক, মারিয়া মান্নান, আমরা তিন বোন, সুমি, আরো দু চারজন মেয়ে ছিলেন, দুঃখিত নাম মনে নেই। এবং প্রবীন এবং তরুণ পুরুষ কবিরা। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা শহীদ মিনারের দিকে হাঁটছি। ফুলের বিশাল রীদ কবিতা পরিষদের নাম লেখা ব্যানার।
মাইকে তুমুল আওয়াজ হচ্ছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। আবৃত্তিকার কেউ কবিতা পরেছেন। কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আসার বারতা ঘোষনা করছেন। ফ্লাড লাইটের আলোয় চারপাশ দিনের মতন আলোকিত। আমাদের দল শহীদমিনারের শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছি। সরকার প্রধানদের ফুল দেয়া শেষ হলে লাইন মতন সবাই শ্রদ্ধা জানাবে।
কিন্তু সরকার দল চলে যাওয়ার সাথে সাথে পিছনের সবাই তুমুল ধাক্কাধাকি শুরু করল যেন এক সেকেণ্ডের মধ্যে তাদের শহীদ মিনারে পৌঁছাতে হবে। কে কোথায় যাচ্ছে তাদের ধাক্কায়, তারা কার উপরে পরছে এ সবে ভ্রক্ষেপ নেই। পিছনের দীর্ঘ লম্বা মানুষের সারি যেন আমাদের উপর এসে উঠে পরবে। এমন অবস্থা হলো।
আমাদের দলের ছেলেরা হাত ধরাধরি করে একটা ঘের তৈরি করে মেয়েদের মাঝখানে রেখে একটা আলাদা বৃত্ত তৈরি করে সবাইকে এক সাথে রাখার চেষ্টা করছিল। নিজেরা ধাক্কা খেয়ে উল্টে পাল্টে পরে যেতে যেতেও দেয়াল টাকে মজবুত রাখল সেখানে নারী আছেন, সেখানে সম্মানিত বয়স্ক কবিরা আছেন।
সামনে শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদ, নিমেলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক সবাই উল্টে পরে যাচ্ছিলেন ধাক্কার সাথে।আনোয়ারা সৈয়দা হক, আমরা তিন বোন এবং অন্য মেয়েরা মিলে মনে হলো আমাদের একদেহ হয়ে গেল। টের পেলাম আমার স্যান্ডেলে কারো পা পরেছে। পটাস করে ছিড়ে গেল ফিতা। অন্য স্যান্ডেলটাও খুলে দিলাম রাস্তায়। আমার ছোট ভাই বকুল, সেটা কুড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি বললাম বাদদে। পরে গেলে পায়ের নিচে তুই চ্যাপ্ট হয়ে যাবি।
আমরা বেরিয়ে গেলাম, শহীদ মিনারে না যেয়ে। যাদের শহীদ মিনারে পৌঁছানোর তাগদা তাদের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে। প্রবীণ কবিরা চিরে চ্যাপ্টা হয়ে কোন মতনে ফুল দিয়ে বেরিয়ে এলেন নাস্তানাবুদ হয়ে। নিয়ম রক্ষা হলো। কিন্ত অন্তরের শ্রদ্ধাবোধ কতটা রক্ষিত হলো।এই হলো শহীদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নমুনা। ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার ইচ্ছা আর কখনো হয়নি।এরপর থেকে আমরা পরিবারের লোকজন মিলে, শহীদমিনার অঞ্চলের সব রাস্তায় আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গনো একুশে ফেব্রুয়ারি গান গেয়ে ঘুরতাম নিজেদের মতন বিশে ফেব্রুয়ারির রাতে। বই মেলা থেকে ফেরার পথে বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু শুনতে পেতাম জোড় হিন্দি গান চলছে মেড়ে মেড়ে ঢাকার পথে। ছুটির দিনের আমেজে মানুষ একুশ উজ্জাপন করছে মাইকে হিন্দি গান বাজিয়ে।
সময়টা নব্বয়ের মাঝামাঝি। বিশে ফেব্রুয়ারি বই মেলায় প্রচণ্ড ভিড়। ধুলায় ধুষর। মানুষে মানুষে সয়লাব মেলা প্রাঙ্গন। এক চিলতে হাঁটার পথ নেই মানুষের গায়ে ধাক্কা না খেয়ে। সব্যসাচী স্টলে বসে আছি আমরা অনেকে। রাত দশটা বাজে রূপা বলল, এখন চলো যাই মানুষ কমেছে। ভিড় নাই একদমই। আমরা বেরিয়ে এলাম মেলার গেট থেকে হাঁটতে হবে শাহবাগ পর্যন্ত। গেট থেকে দশপা দূরে আসতেই পেছন থেকে একটা স্পর্শ পেলাম শরীরে। কেউ আমার নিতম্বে হাত ছোঁয়ানোর চেষ্টা করছে। একবার দুবার হওয়ার সাথে ঘুরে ঠাস করে একটা থাপ্পর কসালাম গালে । অন্য লোকজন আচ্ছা মতন ধূলাই দিল তাকে।
আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের কু চিন্তা চেতনা আমাদের সব সৌন্দর্য নষ্ট করে দেওয়ার জন্য আঠার মতন লেপটে আছে। আমরা সেটা পরিস্কার না করে আরো বেশী করে সেঁটে দেয়ার চেষ্টা করি।
আমি অনেক শিক্ষিত মানুষদের দেখেছি তারা মেয়েদের দোষ দেন তুমি গেলে কেন। বা তুমি এমন করে সেজেছো কেন। কিন্তু তারা ঠাস করে চড় কসাতে পারেন না নোংরা বদগুলোকে।
বাড়তে বাড়তে সমাজে চারপাশে এখন এই অসুস্থতা কিলবিল করছে। মেয়েদের রক্ষা করার নামে তাদের দরজা এঁটে ঘরে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কোথাও যাওয়ার অনুমতি নাই। কেউ জোড় করে বের হলে আর কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে সারা জনমের জন্য সে মেয়ের সব বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ অসভ্যতা করার মনোভাব নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের এই মনোভাব দূর করার জন্য ছোট বয়স থেকে তাদের শিক্ষিত করে তোলার কার্যক্রম চালু করা হয়না। যাতে অন্যের গায়ে চুরি করে হাত দেয়ার মতন অশিক্ষা বন্ধ হয়। নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হয়।
দু হাজার পনেরোয় অনেক বছর বাদে হাঁটছিলাম আমার মেয়েকে সাথে করে বই মেলায়। আমার চোখ ছিল চারপাশে অসভ্য বখাটেদের উপর। তারা আমাদের পরখ করে কিছু বলার আগে আমি যেন অ্যাকশন যেতে পারি তার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। আমি আমার চোখ সেঁটে রাখি ওদের উপর। হাত তৈরি রাখি প্রয়োজনে ব্যবহার করব বলে। যদিও হাতাহাতি মারামরি পছন্দ নয়। কিন্তু এমন ীনাকাঙ্খিত পুরস্থিতিতে এই ব্যবহারই ওদের শিক্ষা দিতে পারে। ওরা আমাদের কাছাকাছি এসে মাথা নিচু করে চলে যায় তাড়াতাড়ি। মেয়ে বলে, তোমার চাহুনি দেখে, ভয় পাইছে। আমি বলি তোর চাহুনি দেখেও ওদের পিলে কাঁপা দরকার। সে ভাবেই চলতে হবে। আমরা কয়েকদিন আপন মনে ঘুরেছি মজা পেয়েছি ওদের ভয় পাওয়া দেখে। এই ভয়টা উল্টা মেয়েদের পাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে সমাজ এবং চুপ হয়ে থাকারও। মেয়েরাও যদি একসাথে প্রতিবাদ করত সময় তাদের পক্ষে কথা বলত। একজন দুজনের প্রতিবাদে কিছু হবে না।
মেয়েকে নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম ওর বয়স যখন ছয়। মহা আনন্দে ফুল দিয়ে এক সুখি মুখ করে নেমে এসেছিল উপর থেকে। সে আনন্দময় মূহুর্ত উপভোগ করতে চাই জাতিয় ভাবে।
আমার মেয়ের যখন তিন বছর বয়স তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়েছিলাম এক দুপুরে। ভাষা শহীদদের গল্প বলে কেন এই মিনার তা চিনিয়ে দিয়েছিলাম। ঘুরে দেখে কথা বলে যখন তাকে বললাম চলো যাই। সে তুমুল প্রতিবাদ করল। ফুল দিলাম না এখনি যাবো কি। তাই তো শহীদদের যে কোন দিন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যায় ওর কাছেই শিখলাম।
২| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৪২
রোকসানা লেইস বলেছেন: আমরা একদিনের জন্য সব সীমাবদ্ধ করে চেতনাগুলোকেও হারিয়ে ফেলছি। অথচ বিষয়গুলো প্রতিদিন আমাদের হৃদয়ে রাখার। এই প্রচেষ্টা চালু হোক সর্বস্তরে
শুভেচ্ছা নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন
৩| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:২১
টুনটুনি০৪ বলেছেন: পোষ্ট অনেক ভালো লাগল । আপনার জন্য শুভ কামনা রইল।
২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৪:৩৯
রোকসানা লেইস বলেছেন: অনেক শুভেচ্ছা টুনটুনি০৪
৪| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৪:১২
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
হৃদয় নিঙরানো ভালোবাসা ও পরম মমতায় ভাষা শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর কথা সুন্দর ভাবে ভেসে উঠেছে লিখাটিতে । একুশের প্রথম প্রহরে বাংলা বর্ণমালার সৈনিকদের অবদান ও সংগ্রামের দিনগুলোকে স্মরণ করলেন সাথে নিয়ে সকল সব্যসাচী কবিদেরে । রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নাগরিকের পদভারে সেদিন জেগে ওঠেছিল স্মৃতির মিনার, এরপর এক সময়ে জনতার ঠেলাঠেলিতে শহীদের বেদীমুলের কাছে হয়ে উঠেনি যাওয়া, তারও করুন গাথা উঠেছে ফুটে লিখাটিতে । রক্ত দিয়ে যে মিনার গড়েছেন ভাষা শহিদ-সংগ্রামীরা, ভালোবাসার অর্ঘ্যে তা ভরিয়ে তুললেন আপনার তিন বছরের মেয়টা পরে সুবিধামত এক সময়ে , শিখিয়ে দিল যে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যায় যে কোন প্রহড়ে ।সোনামনির জন্য রইল শুভেচ্ছা সাথে তার জননীর জন্যও ।
উত্তরের যাত্রার ৩য় পর্ব হয়েছে প্রকাশ আজ বিকেলে , কথামত জানান দিয়ে গেলাম হেথায় ।
শুভ কামনা রইল সকলের জন্য ।
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:১৭
রোকসানা লেইস বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। এ পর্যন্ত দেখা সময় আর পরিবর্তনটা আঁকার চেষ্টা করলাম। আমি যা কিছু ভালো মনে হয় তা সবার থেকে শেখার চেষ্টা করি। ছোট বড় ভেদাভেদ না করে।
সেই সুন্দর কথাটা সবার মাঝে ছড়াক। আরো কেউ এ ভাবে ভাবতে শিখুক। এই আশা।
এখনও অনেক দূর যেতে হবে আমাদের জাতিগত ভাবে সব কিছু আন্তরিকতায় ধারন করার জন্য।
শুভেচ্ছা অাপনাকে আবারও সন্তানের শুভ কামনা জানানোর জন্য।অনেক ভালো থাকুন।
এসে যাবো
৫| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৩১
ভাবুক কবি বলেছেন: ভাল লিখেন আপনিও
২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩৫
রোকসানা লেইস বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
শুভেচ্ছা ভাবুক কবি
৬| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:১৩
নজরুলবিডি বলেছেন: খুব ভালো লাগলো
৭| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:০৭
রোকসানা লেইস বলেছেন: ধন্যবাদ নজরুলবিডি
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:২৪
নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: ভালো লাগলো, পড়ে মুগ্ধ।
সারাবছর শহীদ মিনারের প্রতি ভালোবাসা জেগে থাকুক এই প্রত্যাশা।