নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্রোতের অজানা টানে সমুদ্র বালিয়াড়ি বেয়ে বোহেমিয়ান- গৃহকোন, জীবন যাপন ফেলে চলে যায়। তুমি দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনে বাঁধতে চাও জোছনা গলে হারিয়ে যায় সুখ । আছড়ে পরা ঘূর্ণিজল মনে বাজায় অচেনা সবুজ দিগন্ত ..

রোকসানা লেইস

প্রকৃতি আমার হৃদয়

রোকসানা লেইস › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিছু স্বপ্ন কিছু গল্প

৩০ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:৪৩

আমাদের বাড়িতে খেলাধূলার আসর ছিল অবারিত। ঘরের খেলা আর বাইরের খেলা সব খেলাই চলত সমান তালে। খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কেউ কখনো মানা করত না। বরঞ্চ উৎসাহ প্রদান করা হতো যথা সম্ভব।
স্কুল থেকে ফিরেই পিসিমার বাসার মাঠে পাড়ার সব ছেলে মেয়ে মিলে বন্দী, গোল্লাছুট, হাডুডু, দৌড়, রীলে রেইস, ব্যাডমিন্টন থেকে আরো কত ধরনের খেলা যে খেলতাম আমরা তার সব নাম ও নিয়ম কানুন এখন মনে নেই। কিন্তু অবারিত খোলা আকাশের নীচে নিটোল ভালোলাগায় খেলায় মাতার কথা মনে আছে। বন্ধুদের উপস্থিতি অনুযায়ি বিভিন্ন খেলা শুরু হতো। মাঠের খেলা ঘুমের মাঝে স্বপ্নেও মাঠে খেলায় নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে জাতীয় দিবস, অনুযায়ী বিশেষ খেলার আয়োজনও আমরা করতাম। সেখানে পুরস্কার বিতরণ হতো। মাইক ভাড়া করে এ্যনাউন্স করা আর মাঝে মধ্যে সুরে বেসুরে প্রাণ ভরে গান গাইতাম আমরা সবাই মিলে। উৎসাহ আনন্দে কোন ভাটা পরত না। বড়রা হাজির হতেন খেলা দেখতেন আর পুরস্কার বিতরণ করতেন। শাসন ছিল না কোন ছিল ভরপুর উৎসাহ। পাড়ার আর মা বাবারা সবাই আসতে না পারলেও আমার মা বাবা সব সময়ই থাকতেন আমাদের পাশে।

বাইরের খেলা ছাড়াও আমাদের বাড়িতে সারাক্ষন লুডু, ক্যারাম, বাগাডুলু, দাবার ছক বিছানো থাকত। স্কুল না থাকলে। খেলার সময়ের হিসাবও থাকত না। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা বারোটা চলছে খেলা।
দুজন বা চার জন খেলছে কিন্তু দর্শক সংখ্যা এক থেকে দশ ছাড়িয়ে যেত। কাজের লোকরাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে দেখে যেত কে হারছে কে জিতছে। শুধুই আনন্দ উপচে পরা নির্মল ভালোলাগা।
একাত্তরের উত্তল মার্চে ভাই আর তার বন্ধুরা মিলে, বারান্দায় উঁচু টুলে ক্যারাম বোর্ড পেতে সকাল থেকে কম্পিটিশন করে যেতো। এক সময় ভাইর এক বন্ধু বলত, দুপুর বেজে গেছে এখন বাড়ি যেতে হবে। ওর নামই পরে গেলে দুপুর বেজে গেছে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের বাসায় খেলার জোয়ার চলছে। বস্তায় ঢুকে ব্যাঙের মতন লাফানো খেলাটা তখন নতুন শেখা হয়েছে। তো সারাক্ষণ বস্ত বন্দী হয়ে লাফ দিয়ে যাচ্ছি। সুতায় বাঁধা লজেন্স হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে মুখে করে নিয়ে আসার নাম লজেন্স দৌড়। সে সময় নতুন দালান বাড়ি তৈরি হয়েছে আমাদের। পুরানো কাঠের দোতালা ভাঙ্গা হয়েছে কেবল, চারপাশের উঠান দখল করে আছে ইট পাথর বালি, কাঠ। খেলার জায়গার অভাব। দুপুর বেলা টানা লম্বা বারান্দায় লজেন্স দৌড়ের আয়োজন করা হলো। লজেন্স সুতায় ঝুলানোর উপায় নাই বিকল্প বেঞ্চে পেতে দেয়া হলো বিস্কট। হাত বেঁেধ সব খেলোয়ার তৈরী। আমি হলাম আয়োজক, রেফারী পরিচালক সব। তিনজন প্রতিযোগীর দুইজন অনায়াসে দৌড়ে গিয়ে বিস্কুট মুখে নিয়ে চলে আসল আর একজন উপুর হয়ে পাকা বারান্দায় পরে গেলো দৌড়র শুরুতেই। বিরক্ত হয়ে ওকে টেনে উঠিয়ে দেখলাম ওর থুতনিতে রক্ত। হাতের বাঁধন না খুলেই ওর থুতনি হাতে চেপে ধরে চিল চিৎকার করতে লাগলাম, মা মা। সে বেচারা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কি হয়েছে। মা রান্না ফেলে দৌড়ে এলেন।
সমস্যা মা আবার রক্ত দেখে অস্থির হয়ে যান। অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। ভাগ্য ভালো দোকান থেকে দুপুরে ভাত খেতে আসা কাজিন ঠিক সে সময়ে বাসায় ঢুকেছেন। তার কোলে তুলে দিয়ে ওকে বাজারে র্ফামাসিতে পাঠানো হলো। যেখানে আব্বা কাজ করছেন।
গ্রীষ্মের দুপুরে হেঁটে এতটা পথ এসে খেতে না পেয়ে, সাথে সাথেই আবার কোলে একজনকে নিয়ে বাজারে দৌড়ালেন। সে সময় শহরে রিকসাও ছিল হাতে গোনা। আর বৈশাখ মাসে রিকসা পাওয়াও ছিল কঠিন কারণ সবাই ধান কাটতে চলে যেত রিকসা চালানো বাদ দিয়ে।
যে দুজন বিস্কুট মুখে নিয়ে ফিরেছিল তাদের কে প্রথম হয়েছিল সেটা আর সে দিন পরখ করা হয়নি। ওরাও দাবী তুলেনি। প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার। এত বড় একটা অঘটন ঘটে গেলো খেলতে গিয়ে অথচ কেউ কিছুই শাসন করলেন না। শুধু আমার বোনটার থুতনি জুড়ে রয়ে গেলো কাটা দাগ আজীবনের জন্য।
একবার আমরা ঢাকা থেকে ঘুরে আসার পর পেলাম নতুন ধরনের এক খেলা। বোর্ডে সাদা কালো ছক আর ষোল ষোল বত্রিশটা গুটি সাজিয়ে মা বাবা খেলেন। রাজা, রানী, হাতি ঘোড়া নৌকা বুড়িয়ার দল, পাশে বসে আমরা খেলা দেখি আর কাটা পরা গুটিটি নিজের করে নিয়ে আমরাও কি সব আজগুবি খেলা খেরতাম সে সেময় জানি না। কিন্তু যখন বাবা মা কাজে আর আমাদের অবসর তখন ভাই আর আমি দাবার বোর্ড বিছিয়ে নিজেদের মতন খেলতাম। সবগুলো চাল ঠিকঠাক মতন শেখা হয়নি । বুড়িয়াগুলো পাশে পাশে ঠেলে দিতাম। অবশ্য এটা ভাইর আমাকে হারানোর জন্য নিজের ইচ্ছা মতন আবিস্কার ছিল কিনা জানি না। একদিন আব্বা দেখতে পেয়ে ঠিক করে দিলেন। এভাবে যাবে না।
এভাবেই একটু একটু করে সবগুলো গুটির চালচলন। এবং তাদের দক্ষতা সম্পর্কে জানলাম। আমরা যখন খেলছি। আব্বা রুগী দেখার ফাঁকে ঘরে এসে পানে খিলি বানাতে বানাতে আমার দিতে চাওয়া চালটাকে বানচাল করে দিতেন। না বাবা, এটা দিও না। ওটা এভাবে দাও। আমার মাথায় যে সব চাল আসত সব তখন আব্বার উপর নির্ভরশীল হয়ে পরত। দু চারটা চাল দেখিয়ে আব্বা আবার ফিরে যেতেন রোগী দেখতে। আর ভাই আমাকে সহজেই হারিয়ে দিত।
আব্বা মা রাত জেগে খেলছেন। আব্বার কাছে খেলা শিখা কিন্তু আম্মা আব্বাকে হারোনোর জন্য উঠে পরে লেগে গেলেন। কখনো আবার জোড় তর্ক শুনতে পেতাম। তুমি এই চাল ফিরিয়েছো। এটা হবে না।

আমাদের বাসার চারজন দাবা খেলোয়াড়ের মধ্যে আমি হলাম সবচেয়ে লাড্ডু খেলোয়াড়। সব সময় হারি। কখনো জিতি যখন আব্বা পাশে থেকে হিসাব করে চাল গুলো বলে দিতেন। তখনই কেবল ভাইকে হারানোর আনন্দে আমি হাসি।
পরবর্তিতে আরো তিনজন খেলোয়াড় যোগ হলো আমাদের সংসারে। তারা বেশ খেলত। তবে আমি তাদের হারাতে পারতাম। দাবা খেলায়। ওরা আবার শহরের নানা রকম কম্পিটিশনে যোগ দিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসত। দাবা, ব্যাটমিন্টন, সাঁতার যেমন খুশি তেমন সাজো। আরো অনেক কিছু। ঘর ভর্তি তাদের পুরস্কারে। তবে আমার কখনো কোন কম্পিটশনে যাওয়া হয়নি।
সে সময়ে নিয়াজ মোর্শেদ নামের এক ছেলে ক্রমাগত দাবা খেলা জিতছে দেশে বিদেশে। রানী হামিদ নামের এক নারীও খুব ভালো দাবা খেলেন বাংলাদেশে। তাদের নাম শুনি। কিন্তু আমাদের খেলা ঘরে, আনন্দের জন্য, সময় কাটানোর জন্য প্রতিযোগীতায় যাওয়ার জন্য নিজেকে কখনো তৈরী করিনি। আমাদের বাসায় আব্বা ছিলেন খেলার চ্যাম্পিয়ান। সব ধরনের খেলা আব্বার পছন্দ। শহরের ক্লাবে ব্রীজ প্রতিযোগীতায় ভাই খেলবে; কিভাবে খেললে জেতা যাবে তার তামিল দিয়ে দিতেন। ক্রিকেট খেলা দেখতেন সময় পেলেই। আর এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম একটা ডিনার সেট উপহার হিসাবে আব্বা পেয়েছিলেন। দুহাজার দুইয়ের বিশ^কাপ প্রতিযোগীতায় কারা বিজয়ি হবে তার কুইজ আয়োজন করে ছিল স্কয়ার । আব্বা ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে কুইজের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। খেলা এবং খেলা সম্পর্কে অনেক ভালো ধারনা রাখতেন।
আমার মাও ছিলেন খেলায় সেরা। বিভিন্ন প্রতিযোগীতা হোক মিউজিক্যাল চেয়ার বা দৌড় নয় তো হাড়ি মাথায় হাঁটা বা চোখ বেঁধে হাড়ি ভাঙ্গা আম্মা ঠিক প্রথম পুরস্কারটা নিয়ে বাসায় ফিরতেন।
আমি চলে গেলাম ঢাকা। খেলাময় জীবন নাই। গল্প উপন্যাস পড়া আর খাবার দাবারের সব মজা কেমন হারিয়ে গেলো হোস্টেলের বন্দীত্বের মধ্যে। ছোট বেলা থেকে কোন শাসন নিয়ম দেখলাম না। সে আমি পরে গেলাম কঠিন নিয়ম আচারের মধ্যে। বন্দীদশা আর একাডেমিক বই এর বাইরে এক চিলতে আকাশ চার দেয়ালের মাঝ খানে। এ জীবনে নতুনের সাথে পরিচয়। ভিন্ন শহর থেকে আসা বন্ধুদের সাথে বসবাস আর তাদের গল্পে অন্যরকম পরিবারের গল্প জানার সুযোগ হলো। কোথাও যাওয়া না হলে বন্ধের দিনে কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ইগলু আইসক্রিম কিনে খাওয়াই জীবনের সব আনন্দ ছিল।
বন্ধের দুদিন যদি ভিজিটার এসে নিয়ে যেতেন তাহলে যে কি ভালো লাগত। খালা থাকতেন তখন ক্যান্টেনমেন্টের রূপসাতে। ময়নুল রোডের বিশাল এরিয়ার অফিসার কোর্য়টারের পাশেই সার দেয়া টিন সেড বাড়ি। সেখানে দেশের ক্যাপ্টেন মেজররা পরিবার নিয়ে থাকেন। ছোট এক রুমের ব্যাচেলর বাড়িটিকে কি যতেœ সুন্দর বাড়ি করে তুলেছেন খালা। সেখানে দুজন মানুষের জায়গা হয় না ভালো মতে। তার উপর উনাদের বাচ্চা কাচ্চা। তার উপর প্রতি সময় আত্মিয় স্বজন কেউ পারমানেন্ট আছেন। আর তার উপর আমরা হা করে তাকিয়ে থাকতাম কখন খালা এসে নিয়ে যাবেন এই বন্দী দশা থেকে। এবং কখনো মন খারাপ করে নয় হাসি খুশি আনন্দেন সাথে খালা ছোট ঐ বাসাতে নিয়ে যেতেন, রাখতেন এবং আনন্দ করতাম। বাড়ি ছেড়ে এসে হোস্টেলের খাবার খেতে না পারার সোধ উসল করে নিতাম দুদিন খালার বাড়িতে খেয়ে দেয়ে। সেই সাথে এখানে সেখানে ঘোরা ফেরা গ্যারিসনে ইংলিশ সিনেমা দেখতে যাওয়া জীবনে ভিন্ন মাত্র যোগ হতে থাকল।
আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে একটা কথা খুব মনে হচ্ছে । মানুষের যৌবনের সুন্দর সময়গুলো মানুষের বড় কষ্টে কাটে। এই যেমন। আমি যতদিন বাড়ি ছিলাম ততদিন আমাদের বাড়িটা সম্পূর্ণ বানানো শেষ হয়ে উঠেনি। যখন শেষ হলো প্রত্যেকের জন্য একটা ঘর হলো সে ঘর গুলো খালি পরে থাকত। আমার ঘর খালি পরে আছে বাড়িতে আর আমি এক দঙ্গল মেয়ের সাথে হোস্টেলের রুম ভাগাভাগি করে থাকছি। শুধু আমি নই আমার ভাই বোনরাও।
খালা যখন সংসারটা শুরু করলেন। সুন্দর মতন নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকবেন। নিজেদের থাকার পর্যাপ্ত রুম নেই অথচ প্রতিদিন সেখানে মেহমান। যাদের উপেক্ষা করা যায় না। অনেকে করেন। কিন্তু খালা করেননি। এমন বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার নিজেদের বিছানা ছেড়ে মাটিতে বিছানা পেতে কাটিয়েছে। বিশেষত ঢাকার বাসিন্দারা। কারো লেখা পড়া, কারো চিকিৎসা, কারো বিদেশ যাত্রা, কোন না কোন সুত্র ধরে সব সময় আত্মিয় অনাত্মিয় বাসায় উপস্থিত।
সে সময় খালার বাড়ি যাওয়াটা বিশাল আনন্দের একটা বিষয় ছিল। কিন্তু খালার কতটা অসুবিধা হয়েছে থাকতে দিতে, খেতে দিতে একবারও মাথায় আসেনি এসব ভাবনা। বরঞ্চ মনে হয়েছে অধিকার। খালার বাড়ি যাবোই তো।
এখন খালার সাজানো গোছানো বিশাল বাড়ি আর খালা একা। আমার গিয়ে থাকা হয় না। খালার বাচ্চারাও নিজেদের বাড়িতে। টানাপোড়েনের সেই ছোট ঘরে জনারণ্য হয়ে জীবনে অন্যরকম আনন্দ হয়ে আছে।
হোস্টেলে একদিন একটি মেয়ে আমাকে খুঁজতে এলো। কি ব্যাপার আমাকে খোঁজে কেনো। আমি তো কোন সাতে পাঁচে নাই। কথা বলে জানা গেলো সে জেনেছে আমি দাবা খেলা জানি। ঢাকা শহর জুড়ে সব কলেজের এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দাবা খেলার প্রতিযোগীতা চলেছে। আমাদের কলেজে থেকে প্রতিযোগীর নাম দেয়া হবে। কোন খেলা জানা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে জানিয়ে আমার নাম চালান করে দিল। বলে গেলো কাল দুপুরে কলেজে মদিনা আপার সাথে দেখা করো। আরে আমি কি ভালো খেলোযাড় যে প্রতিযোগীতায় যাবো। শুধু খেলতে জানি এ টুকুই।
আমার কোন কিছু বলার সুযোগ থাকল না। কত দিন না কত বছর দাবার ছকের চেহারা দেখি না। সেই আমি যাচ্ছি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে। পরদিন দুপুরে মদিনা আপার সাথে দেখা হলো। বলালাম, আপা আমি যাবো কি ভাবে আর আসব কিভাবে খেলা শেষে সন্ধ্যা হয়ে গেলো হোস্টেলের গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। আপা বললেন। চিন্তা নাই আমি ব্যাবস্থা করব। তাও আমাকে যেতে হবে।
তৈরী হয়ে আসো একটু পরে রওনা দিব।
দুপুরের দিকে আপার গাড়িতে ধানমন্ডিতে প্রতিযোগীতার ক্রীড়া ভবনে পৌঁছালাম। অনেক মহিলা প্রতিযোগী, টেবিলে সারি সারি দাবা খেলার বোর্ড বিছানো। দুই দিকের চেয়ারে বসা প্রতিযোগী গভীর মনোযোগে খেলছে। শুনশান নিরবতা। বিচারক এবং প্রতিবেদকরা ঘোরাফেরা করছেন।
ঠিক কিসের ভিত্তিতে কার সাথে কে খেলবে নির্ধারিত হলো মনে নেই। আমাকে একটা টেবিল দেখিয়ে বসিয়ে দেয়া হলো একজন প্রতিযোগীর সাথে।
প্রথম দুজনকে হারালাম এবং তৃতীয় জনের সাথে খেলতে গিয়ে নিজে হেরে গেলাম। এইটুকু মনে আছে। আর মনে আছে প্রথম হওয়া মহিলাটির নাম পরে বেশ কয়েক বছর প্রত্রিকায় দেখেছিলাম। আমার খেলা শেষ। কলেজের বারোটা বাজিয়ে আমি হেরেছি। শুধু প্রতিযোগী হিসাবে অংশ গ্রহণের একটা নাম হয়ে আমি থেকেছি কলেজের পক্ষে। সন্ধ্যার দিকে একজন মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মদিনা আপা চলে গেলেন। বলে গেলেন উনি ক্যান্টনমেন্ট যাবেন তোমাকে তোমার গার্জিয়ানের বাসায় পৌঁছে দিবেন।
উনি ছিলেন বাংলাদেশের মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ান রানী হামিদ। রাত দশটার দিকে নিজে গাড়ি চালিয়ে খালার রূপসার বাসায় রানী হামিদ আমাকে নামিয়ে দিলেন। দরজা নক করতে দরজা খুলে খালা অবাক তুই এত রাতে। কাহিনী শুনে বললেন নে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পর। যেন আমি আসব এটা জানা কথা। সে সময় যাই বাজুক তাতে ক্ষতি নাই।
সেই একবারই আমার প্রতিযোগীতায় যাওয়া। পরদিন দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আমার নাম ছবি ছাপা হওয়ায় বন্ধুদের কি খুশি। আমি যে হেরেছি সেটা কোন বিষয়ই মনে হলো না। মনে হলো আমার ছবি পত্রিকায় এটাই হলো বিজয় এবং পুরস্কার পাওয়া। পত্রিকার কাটিং অনেক দিন আমার কাছে ছিল। বিদেশে আসার সময় একজনের কাছে জমা রেখে এলাম। তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
না চাহিতে পাওয়ার মতন জাতীয় পর্যায়ে নিজের নামটা যে লেখা হয়ে গেলো এর গুরুত্ব আমার কাছে থাকল না। পরের বার যে আরেকটু ভালো শিখে খেলতে যাবো সে চেষ্টাও করলাম না। বরঞ্চ পরের বার খবর পেয়েও আপার সাথে আর দেখাও করলাম না।
খেলাটা আনন্দের জন্যই থাক প্রতিযোগীতার জন্য নয়। তবে স্পোর্টস কারের দূরন্ত চলাটা আমাকে দারুণ টানে যদি কোনদিন একটা স্পোর্টস কার নিয়ে নামতে পারতাম তাহলে ভালোলাগত খুব। যদিও খেলাটা ভয়াবহ। গতকালই দেখলাম মিলিয়ন ডলারের ল্যাম্বোরগিনি আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেছে দৌড়ানোর সময় ধাক্কা খেয়ে। আর আমেরিকার কার রেইসে একটা কার টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে ছিটকে পরছে আর আগুনও লেগেছে এত সবের ভিতর চালক বেঁচে গেছে। তারপরও এই ভয়াবহ দূরন্তপনাটা আমাকে দারুণ টানে।
আশির দশকে এ্যাডিকটেট হয়ে গিয়েছিলাম কম্পিউটারের কার রেইস আর চেস খেলায় । এক দুপুরে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম খেলা। আমার সুপুত্র স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর জানলাম তিনি ডিলিট করে দিয়েছেন তার কম্পিউটার থেকে আমার খেলা। মাকে এডিকসন থেকে বাঁচাতে আর নিজের কম্পিটারকে খেলা থেকে রক্ষা করতে। মোটে দশ বছর বয়সে তিনি আমাকে শাসন করতে শুরু করে দিলেন। আহা কি আমার মন খারাপ গেলো কিছু দিন। তাকে বললাম আমার বাপ কোন দিন বাঁধা দেয় নাই খেলা ধূলায় তুমি কোথাকার গার্জিয়ান আসলে আমার খেলা বন্ধ করার। পরে সুযোগ পেলেও খেলাটা আর তেমন জমেনি কখনো। তবু ইচ্ছেরা হাত ছানী দিয়ে ডাকে সব সময় স্পোর্টস কার নিয়ে রাস্তায় ছুটে চলার প্রতিযোগিতার জন্য নয় দূরন্তপনার জন্য




মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:০৫

শামছুল ইসলাম বলেছেন: এত সুন্দর স্মৃতিময় একটা লেখার মন্তব্য করার উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।

আপনার খালার জন্য খুব খারাপ লাগছেঃ

//এখন খালার সাজানো গোছানো বিশাল বাড়ি আর খালা একা। আমার গিয়ে থাকা হয় না। খালার বাচ্চারাও নিজেদের বাড়িতে। টানাপোড়েনের সেই ছোট ঘরে জনারণ্য হয়ে জীবনে অন্যরকম আনন্দ হয়ে আছে। //

//খেলাটা আনন্দের জন্যই থাক প্রতিযোগীতার জন্য নয়। // - চমৎকার স্পিরিট।

//আশির দশকে এ্যাডিকটেট হয়ে গিয়েছিলাম কম্পিউটারের কার রেইস আর চেস খেলায় । এক দুপুরে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম খেলা। আমার সুপুত্র স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর জানলাম তিনি ডিলিট করে দিয়েছেন তার কম্পিউটার থেকে আমার খেলা। মাকে এডিকসন থেকে বাঁচাতে আর নিজের কম্পিটারকে খেলা থেকে রক্ষা করতে। মোটে দশ বছর বয়সে তিনি আমাকে শাসন করতে শুরু করে দিলেন। আহা কি আমার মন খারাপ গেলো কিছু দিন। তাকে বললাম আমার বাপ কোন দিন বাঁধা দেয় নাই খেলা ধূলায় তুমি কোথাকার গার্জিয়ান আসলে আমার খেলা বন্ধ করার। // - ছেলের শাসনটা ভাললেগেছে ।

পড়া শেষ, কিন্তু ভাললাগার অনুভূতিটা পিছু ছাড়ছেনা।

ভাল থাকুন। সবসময়।

৩১ শে মে, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭

রোকসানা লেইস বলেছেন: এত মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন খুব ভালোলাগছে। এবং খুব সুন্দর মন্তব্য।
খালা বাড়িতে একা তবে উনি খুব ভালো আছেন। হাসি খুশি এবং আনন্দে চলে যাচ্ছে দিন। সময় বদলে যায় আর সেটা মেনে নিতে পারলেই ভালো থাকা যায়।
ধন্যবাদ খেলা নিয়ে বাড়াবাড়ি কখনোই আমার পছন্দ নয় কিন্তু আমরা খুব খেলা ধূলা করি।
সে সময় অনেক খারাপ লেগে ছিল।
ভালোলাগায় সাথে থাকুন শুভেচ্ছা রইল ভালো থাকুন অনেক

২| ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:৫৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: কত কী মনে পড়ে গেলো! কত কিছু মিলে গেলো! আগে বাবা, মা, ভাই মিলে নিজেদের দাবা টুর্নামেন্ট খেলতাম। পেশাদার দাবা টুর্নামেন্টের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না সে উত্তেজনা। ভাবছি আবার চালু করতে হবে এটা। অনেক ধন্যবাদ!

০১ লা জুন, ২০১৬ রাত ৯:১১

রোকসানা লেইস বলেছেন: যাক মনে পড়ে বেশ ভালো হলো আবার শুরু হোক। পরিবারের এই আনন্দ সময় গুলো অন্য রকম। কাছে থাকার এবং সম্পর্ক গাড় করার জন্য খুব জরুরী। আজ কাল আমরা নিজস্ব একটা জগতে নিজের ভাবনায় সবাই ডুবে থাকছি। পরিবারের সদস্যদের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক বাজে কিছু ঘটার সুযোগ এসে যাচ্ছে।
পরিবার তৈরী হচ্ছে কিন্তু পরিবারের বন্ধনটা তৈরী হচ্ছে না।
ধন্যবাদ

৩| ০৮ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৭:১১

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: বেশ লম্বা গল্প এবার এ সময়ে ঘুমে ডুলু ডুলু চোখে পড়ে শেষ করতে পারলাম না পরে সময় করে আবার অাসব । যতটুকু পড়েছি ইনটারেসটেড হয়েছি ,গল্পটিতে , খুব সুন্দর হয়েছে । ভাল থাকার শুভ কামনা থাকল ।

০৯ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৫১

রোকসানা লেইস বলেছেন: ধন্যবাদ আশা করি শেষ পর্যন্ত যাবেন।
শুভেচ্ছা রইল

৪| ০৮ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:৩০

চাঁদগাজী বলেছেন:




অনেক স্মৃতি, অনেক ভালো অনুভুতি

০৯ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:০১

রোকসানা লেইস বলেছেন: আসলে তাই অনেক সুখের স্মৃতি জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সুন্দর পাথেয়। শুভেচ্ছা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.