নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বছর দশেক আগে এক গ্রীষ্মের দিনে ওন্টারিয় প্রভিন্সের টরন্টো শহরের ওন্টারিয় প্লেসে ঘুরছিলাম। সবুজের মায়া, নিবিড় ঘনপাতায়া ছাওয়া গাছের ছায়ায় বসে আছে অনেক মানুষ আপন মনে। আর কেউ ঘুরছে এদিক থেকে ওদিক। আমি ও আমার দলও ঘুরছি আর বসে থাকছি মাঝে মধ্যে পার্কে পাতা বেঞ্চে। পাশে ওন্টারিয় লেকের নীল জলে বোট নিয়ে ভেসেছে অনেকে। নীল জলে অদ্ভুত সুন্দর সব পাল তোলা নৌকা। মায়াময় করেছে দৃশ্যপট। সে দিকে দেখতে দেখতে অনেক বছর পরে, হাতের সুভিনূয়রের পাতায় আঁকতে শুরু করলাম চোখের সামনের দৃশ্য।
জীবনের একটা সুচারু বিষয় নিরবে কতকাল শুয়েছিল গহীন অন্ধকার ঘরে। হঠাৎ করে খোলা আকাশের তলে বিস্ফুরণ হলো। জমাট বরফ গলে জল গড়াল, নদী হলো। সেই নদীর ধারায় মাঝে মাঝে কিছু ক্যানভাসে রঙের ছোপ পরতে লাগল। জীবনটা নিজের মতন হয়ে উঠল। থাক সে কথা।
খানিক জিরায়ে খানিক হেঁটে যেতে যেতে দেখা পাওয়া গেলো এক যুদ্ধ জাহাজের। রঙিন কাগজের পতাকায় সেজে দাঁড়িয়ে আছে লেকের জলে। পাশে ছোট্ট একটা টিকেট বুথ। সেখানে টিকেট কেটে তার ভিতরে ঢুকে দেখা যাবে। জাহাজটাকে জনসাধারনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই রাখা হয়েছে। তো আমরাও ভিতরে গিয়ে ঘুরে ফিরে এলাম। সময়টা ছিল অনেক আগের। এমন সহজ প্রযুক্তি হাতে ছিল না তখন। হাতে একটা ক্যামেরা ছিল। তার ভিতর গনাগুনতি হিসাবের স্ন্যাপ। তাই জাহাজের বিশেষ কোন ছবি উঠানো হলোনা। সময়টা ছিল বড়ই হিসাবের। চোখের মনিতে গেঁথে রেখেছিলাম ছবিগুলো।
তবে জাহাজে উঠে একটা অনুভূতি হয়েছিল। এই বিশাল জাহাজটা যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। অগনিত গোলা বারুদের ছোটাছোটির সাথে লবন জলের ঢেউয়ে সাঁতার কেটে চলেছে এই জাহাজ। আর তার মাঝে কত অসংখ্য প্রাণ। যুদ্ধে নিয়োজিত থেকেছে। কত রক্ত লেগে আছে এই জাহাজের শরীরে। ভাবতে অস্থির লাগে। কেমন ছিল তাদের জীবন। কেউ কেউ হয়ত সাগরের জলেই পেয়েছে সলীল সমাধি। ফিরে যেতে পারেনি প্রিয়জনের কাছে। যারা ফিরে গেছে তাদের কাছে কেমন এই জাহাজে কাটানো সময়গুলো এত বছর পরে? কেউ কি বেঁচে আছে? কেউ কি এখনও ভাবে জাহাজের দিনগুলি, যুদ্ধের সময়?
অনেক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এই সেদিন আবার সেই জাহাজে যাওয়ার সুযোগ হলো। জাহাজটা এখন সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্য একটি শহরে। আমার সাথে ছিল একজন সত্যিকারের সেইলর। যার মনে সারাক্ষণ সাগরের স্বপ্ন ঘুরে। সাগর পারি দেয়ার স্বপ্ন যার মনে, ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে নয়, পালতোলা নৌকায় করে। একবার আটলান্টিক পারি দেয়ার দুঃসাহসিক সময়টা মাঝে মাঝেই আনমনা করে দেয় তাকে আর নৌকা কিনে ভেসে পরার চিন্তা করে। একটি জাহাজে এমন একজন অভিজ্ঞ মানুষের সাথে যাওয়ার সুযোগটা অন্য রকম। প্রতি পদে পরিচয় হচ্ছিল বিভিন্ন অচেনা বস্তুর ব্যবহার সম্পর্কে, অভিজ্ঞ মানুষের কাছ থেকে। আরো একজন মানুষ ছিলেন। যার জন্ম হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়। বড় হওয়ার বোঝার সময় যুদ্ধ দেখে বড় হওয়া। আর যুদ্ধে পরিবারের মানুষ হারানো থেকে বাড়িঘর সয় সম্পত্তির নানা রকম ক্ষতির গল্পগুলো জীবনের একটা অংশ হয়ে; অনেক সহজ জীবনকে দুঃসহ করে তুলে ছিল। পদে পদে যুদ্ধের যন্ত্রনা মাথা চারা দিয়ে উঠেছে শিশু থেকে যৌবনের সময় টুকু। পরিবার, গ্রাম, দেশের নানা রকম প্রতিকুলতা, বিদ্ধস্ত অবস্থা আর মানুষের জীবনটাকেই বিষিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধের ভয়াবহতার টুকরো গল্প উঠে আসছিল স্মৃতি কথায়। এমন জানা শোনা অভিজ্ঞ দুজন মানুষের সাথে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের জাহাজ দেখতে যাওয়ার ভ্রমণটা হয়ে উঠেছিল সোনায় সোহাগা।
একদিকে জাহাজের চলাচলের অজানা বিষয়গুলো, সেইলর গাইড হয়ে বর্নণা করে যাচ্ছেন। এক বাও মিলে না দুই বাও মিলে, এইটুকু জ্ঞান সমৃদ্ধ আমাকে জাহাজ চলায় পুরোই অভিজ্ঞ করে দিলেন একবেলায়। ছোটখাট যন্ত্রপাতি কখন কি ভাবে ব্যবহার করতে হয়। কার কি প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহার সব শিখলাম একটু একটু করে। রাস্তায় গাড়ি চালান আর সাগরে জাহাজ চালানোয় যে অনেক তথাত এটুকু অত্যন্ত বুঝতে পেরেছি। এখন মনে হয় হাতে একটা জাহাজ পেলে আমি ঠিক চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আর অন্যদিকে, যুদ্ধের গল্প যেন ছবির মতন তুলে ধরছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জন্ম নেয়া শিশু, এখন যিনি বয়স্ক শিশু।
প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের এই ভ্রমণটা হলো অনক বেশী আকর্ষনিয়। অনেক বেশী অর্থবহ এবং শিক্ষনীয়। আর আমার হাতে ছিল ডিজিটাল ক্যামেরার অফূরন্ত ক্লিক। প্রতিটা অংশ যেন আমি ছবিতে তুলে নিতে পারলাম এবার আর যুদ্ধের সময়ের সাথে অবগাহন করলাম একই সাথে।
কতরকম সরঞ্জামে সাজানো সয়ংক্রিয় জাহাজ। প্রায় সত্তর বছর আগে কত সুন্দর এবং মজবুত করে তৈরী করা হয়েছির এই যুদ্ধ দেবীকে। দুইশত সৈন্য যাদের অনেকের বয়স আঠারো হয়নি অথচ তাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে সাগরের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। কাটাতে হয়েছে জাহাজের খোলের ভিতর, দিন এবং রাতের পর রাত, ছোট কেবিনে গাদাগাদি করে, এছাড়া ছিল শত্রুর মুখোমুখি হওয়া ভাড়ি ভাড়ি অস্ত্র নিয়ে শীত বর্ষা বরফের তোয়াক্কা না করে। জলে ডুবে থেকে আক্রমণকারী সাবমেরিনকে শায়েস্তা করতে হয়েছে সময় মতন। শান্ত পরিবেশে বেশ কিছু পর্যটকের সাথে ঘুরছিলাম আমরা।
কেবিন থেকে প্যাসেজ, পেরিয়ে একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে, উপরতলা, নীচতলা, ডেক ধরে করিডোর পেরিয়ে দেখছিলাম সারিসারি সাজানো পুরানো জীবন যাপন। দূর থেকে এবং জাহাজে হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল যেন দুই ভাগে ভাগ করা একটা জাহাজ। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে একটার পর একটা গোলক ধাঁ ধাঁর পথ পেরিয়ে ঠিক এক অংশ থেকে অন্য অংশে পৌঁছে গেলাম কী ভাবে যেন। আর আবিস্কার করলাম অজানা অদেখা নানা রকম বিষয় বস্তু।
গোলাবারুদ, মাইন, পাখা এ্যাঙ্কর,কম্পাস, চিঠির বক্স আরো নানা রকম অস্ত্রর সাথে প্রতিদিনের জীবন যাপনের ঘর গৃহস্তালী যেন সাজান থরে থরে। বিছানা আর তার নীচে তাদের যুদ্ধ পোষাক রাখার জায়গা চেয়ারগুলোতে ওরা বসত, এই টেলিফোনে কথা বলত, মুখ দেখত আয়নায়।
চারপাশ শুনসান থাকার পরও আমার মাথার ভিতর যেন বাজছিল। অনেক বুটের অস্থির চলাচল। আতংকিত গোলাগুলির মুহুর্ত, সাগরের গর্জন, ঢেউ। তার মধ্যে হাসি আনন্দ, কোরাস, সঙ্গীত। অথবা কোন এক কোনে যেন চলছিল গোপন কোন ভালাবাসার কথপোকথন, নিভৃতে দুই বন্ধুর মাঝে। অথবা একদমই অচেনা দুই দেশের সম বয়সি দুইজন বন্ধু হয়ে উঠছে,বলছে হৃদয়ের গোপন কথা উজাড় করে, ভরষাহীন জীবনে অচেনা আপনজনকে। আবেগে অভিমানে বারবার পড়ছিল কেউ কোন চিঠি আধো অন্ধকারে,বালিশের নীচ থেকে বের করে। ছোট্ট রান্না ঘরে তিনজন মানুষ ক্রমাগত ব্যাস্ত ঘর্মাক্ত দুইশ মানুষের খাবার তৈরী করতে।
অথবা যুদ্ধ ভুলে পরিবার এবং স্বপ্ন ভুলে, নাচের ফ্লোরে ব্যাস্ত ঘূর্ণিপাকে মুহূর্ত উপভোগে।
হাইডা নামের জাহাজটি ১৯৪০ সনে তৈরী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশার হয়ে জার্মানির সাবমেরিনকে, টোর্পেডো আক্রমণে ধ্বংস করা, মিত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ ছিল ওর প্রথম বিজয়। চারবার যুদ্ধে গিয়েছে হাইডা। সর্বশেষ কোরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ আর্টিক্ ১৯৪৪ ইংলিশ চ্যানেল, ১৯৪৪ নর্মান্ডি ১৮৫২ থেকে ১৯৫৩ কোরিয়া।
সফল যুদ্ধ জাহাজের সম্মাননা ও পেয়েছে চারবার।
সব চেয়ে বেশী শত্রু ধ্বংসকারী ক্যানেডিয়ান এই বিজয়ি জাহাজ। নীল সোনালী রঙের যুদ্ধ জাহাজটি এখন জাতীয় ঐতিহাসিক যাদুঘর জাহাজ হয়ে, হ্যামিলটনের জলে দাঁড়িয়ে আছে।
একরাশ ভাবনার সাথে ঘুরা হলো স্মৃতিময় ইতিহাস। অলিগলি ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা আবার কখনও নীচে নামতে হচ্ছিল। উঠতে নামতে বারবার মনে হচ্ছিল কী ভাবে দ্রুততম সময়ে এই ছোট চিকন সিঁড়ির ধাপগুলো পেরুত সৈন্যরা। বার বার চারপাশে যেন অস্থির ছুটাছুটি, অনুভব করছিলাম অনেক আগের মানুষের চলাফেরা নিঃশ্বাস, কথাবার্তা। বয়লার রুমে, যুদ্ধ সময়ের আকর্ষনিয় গাইডের কথা আর জ্বলন্ত অঙ্গারের আঁচ অনুভব করছিলাম ছোট কুটুরিতে ঢুকে। অতঃপর আরো ছোট্ট একটি খোলা মুখ দিয়ে জাহাজের পেটের ভিতর থেকে খোলা হাওয়ায় উঠে এলাম।
অনুভূতিটা একই রকম হয়েছিল। কেন এই রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ। কেন এমন করে যুদ্ধের জন্য সাগরে ভাসা। ঠিক একই অনুভব জড়িয়ে ছিল যখন আয়রন টাওয়ারের ভিতর গিয়েছিলাম।
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:৪৬
রোকসানা লেইস বলেছেন: অনেক ছবি উঠিয়েছি। দিতে চেয়েছিলাম অনেক ছবি। কিন্তু রি সাইজ না করে দেয়া যাচ্ছে না। সময় হলো না্ রি সাইজ সেভ করে, আপলোড করার। সামুর যদি একটা সিস্টেম থাকত অটো রি সাইজ করার আপলোডের সময় বেশ ভালো হতো।
দেখি দু একটা যোগ করতে পারি কি না। সময় পেলে করব।
২| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৩
খাটাস বলেছেন: বাহ বেশ লাগল যুদ্ধের নিদর্শন দর্শন। সুন্দর।
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
রোকসানা লেইস বলেছেন: কিছুটা আভাষ মাত্র দিতে পারলাম লেখায়।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ .....খাটাস
৩| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১২
যাযাবর বেদুঈন বলেছেন: হাইডা ভ্রমণ কাহিনী পড়ে অনেক কিছু জানা হল। কিছু ছবি দেখার ইচ্ছে করছে। শেয়ার করলে ভাল লাগত।
১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০৩
রোকসানা লেইস বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ। যাযাবর বেদুঈন
ছবি দেয়ার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হলো। চার বার ছয়টা ছবি আপলোড করার পর সব মুছে গেলো।
আরো ছবি দিতে চাইলেও আর দিলাম না।
এখন আবার মন্তব্য বাংলায় লিখতে পারছি না।
সামুতে একটা না একটা ঝামেলা দেখা যাচ্ছে এখন প্রায় সময়।
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:২১
স্বপ্নবাজ অভি বলেছেন: ছবি উঠান নাই ?