নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মামুন ইসলাম

মামুন ইসলাম

মামুন ইসলাম

হ্যাপী নিউইয়ার

মামুন ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের বিষয়ে কিছু কথা ।

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:০৩

১াবীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।



বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহীউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহীউদ্দীন জাহাঙ্গীর যুদ্ধরত অবস্থায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচর নামক স্থানে শহীদ হয়েছিলেন।



তিনি ১৯৪৫ সালের ৬ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তার বিশাল বাহিনীকে ৩ ভাগে ভাগ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য আক্রমণ শুরু করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে তিনি একটি ছোট নৌকা নিয়ে মহনন্দা নদী পার হয়ে এসে রেহাইচর গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে শত্রুদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে করতে সামনের দিকে এগুতে থাকেন। রাতের আঁধার পুরোপুরি কেটে যাওয়ার আগেই পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ির জানালা থেকে রাজাকার- আলবদর বাহিনীর নিক্ষিপ্ত একটি বুলেট ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কপালে বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন।

২। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল



বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি সেনা বাহিনীর হাবিলদার ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন একজন গৃহিনী। তাঁরা কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকরী করার সময়ই কিশোর মোস্তফা সেনাবাহিনীর নিয়ম শৃংখলা দেখে মুগ্ধ হন ও বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার স্বপ্ন দেখেন। তিনি ছিলেন খুব সাহসী ও ডানপিটে। তাই লেখাপড়া বেশী দুর হয়নি। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। তারপর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

খান সেনারা ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে বাঙালি যোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁরা ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে গ্রামের দিকে গিয়ে ট্রেনিং নেন ও ক্যাম্প গড়ে তোলেন এবং এপ্রিল মাস থেকে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে খান সেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কুমিল্লা আখাউড়া সীমান্তের গঙ্গাসাগর এলাকায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন।সিপাহী মোস্তফা কামাল তারই একজন সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।কাছেই ব্রাক্ষণবাড়িয়া। একে ঘিরে উজানীস্বর , আশুগঞ্জ, এবং এন্ডারসন খালের পাশে তিনটি এলাকায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে।

১৮ এপ্রিলের ঘটনা। বেলা ১২ টা দিকে খান সেনারা গোলাবর্ষণ করতে করতে মোগরা ও গঙ্গাসাগর এলাকা দখল করে নেয়। সীমান্তের কাছে ’দরুইন’ গ্রামে ছিল মুক্তি যোদ্ধাদের ডিফেন্স। এসময় ঘাটিতে মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাহারা দিচ্ছিলেন। মোস্তফা কামালের হাতে ছিল একটি এল. এম. জি। খান সেনাদের আক্রমনের জবাব দিচ্ছিলেন মোস্তফা। খানসেনারা আস্তে আস্তে দরুইন ঘাটির তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে তাদের। মোস্তফা উপায় না দেখে কভারিং ফায়ার দিয়ে অন্য সাথীদের সরে যাবার সুযোগ করে দিলেন এবং বললেন ,তোমরা নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নাও।সাবাই বাচঁতে চাইলে কেউ বাচতে পারবেনা, আমার আশা তোমরা ছেড়ে দিও। মোস্তফার এল.এম.জির গুলি শেষ হয়ে গেলে একসময় খান সেনারা তাকে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে। তার মুতদেহ পরিখার পাশে রেখে প্রাণ ভয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় খানসেনারা। এভাবেই একজন বীর যোদ্ধা দেশমাতাকে স্বাধীন করতে জীবন দিলেন।খানসেনারা যেভাবে তিনদিক খেকে এগিয়ে আসছিলো তাতে যদি মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে আশ্রয় না নিতেন তবে সবাই মারা পড়তেন। অন্যের জীবন বাচাতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন মোস্তফা কামাল। আজ আমরা শ্রদ্ধা ভরে তাদের কথা স্মরণ করি। দরুইন গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে সবুজ ধানক্ষেতের পাশে গাছ গাছালীর ছায়ায় মোস্তফা চিরতরে শুয়ে আছেন ।



৩।বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান



বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্ম ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩, ঝিনাইদহ জেলা শহরের অদুরে কালিগঞ্জের খদ্দখালিশপুর গ্রামে। পিতা আক্কাস আলী মন্ডল ছিলেন ভূমিহীন কৃষক এবং মা কায়েদুননেসা ছিলেন গৃহিণী। সবার পরামর্শে বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন গ্রামের পাঠশালায়। দারিদ্রের কষাঘাতের মধ্যেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ৫ম শ্রেণী পাশ করে ভর্তি হলেন স্থানীয় নৈশ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। কিন্তু এবার তাকে হার মানতে হলো দারিদ্রের কাছে, পড়াশোনা ছেড়ে লেগে গেলেন বাবাকে সাহায্যের কাজে। সততা, কঠোর পরিশ্রম ও কাজের প্রতি আন্তরিকতার কারণে অল্প দিনেই অর্জন করলেন সবার আস্থা। ১৯৭০ সালে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন তিনি। কর্মস্থলের আশেপাশে প্রশিক্ষণরত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের চৌকসতা ও সুশৃঙ্খলতা মুগ্ধ করে তাকে। ১৯৭১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি যোগদান করেন পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে। প্রশিক্ষণের জন্য গমন করেন চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে। ২৫শে মার্চ বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা হামলা চালায় সেখানে। তার চোখের সামনেই হত্যা করে অসহায় ২৫০০ রিক্রুট এবং অন্যান্য বাঙালী সৈনিকদের বেশিরভাগকে। সেখান থেকে পালিয়ে পায়ে হৈটে গমন করেন নিজ গ্রামে। মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে যোগ দেন যশোরের কাছে অবস্থানরত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে। সিপাহী হিসেবে রেজিমেন্ট থেকে তার সৈনিক নাম্বার দেওয়া হয় ৩৯৪৩০১৪। নিযুক্ত হন রান্নার কাজে। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের প্রতি অদম্য আগ্রহের কারণে তাকে লেঃ কাইয়ুমের রানার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেবার সুযোগ দেওয়া হয়। বীরত্ব প্রদর্শন করেন কোদালকাঠি পাকিস্তানী অবস্থান আক্রমণে। ২৮শে অক্টোবর ১৯৭১, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ধলই আক্রমণে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার্থে শত্রুর বাঙ্কার ধ্বংস করতে গিয়ে শত্রুর মেশিনগান বাস্টের আঘাতে শাহাদত বরণ করেন। পরবর্তীতে সহযোদ্ধারা তার মৃতদেহ উদ্ধার করে আম্বাসার হাতিমারাছড়া গ্রামে দাফন করে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ তাকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করে। শাহাদাতের ৩৬ বছর পর ১১ ডিসেম্বর ২০০৭ বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তার দেহাবশেষ স্থানান্তর করে রাষ্ট্রীয় সম্মানে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে পুনঃ সমাহিত করা হয়।

৪।বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের জন্ম ১৯৩৫ সালের জুন মাসের কোনো এক বর্ষণমুখর রাতে নোয়াখালীর বাঘচাপড়া গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারি ছিলেন মোটামুটি স্বচ্ছল গৃহস্থ এবং মাতা জোলেখা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।



ছোটবেলায় তার পড়াশোনা শুরু হয় পাড়ার মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে, পরে বাঘচাপড়া প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল পাশ করে ভর্তি হন আমিষা পাড়া হাইস্কুলে। এসময় তার পিতার আর্থিক স্বচ্ছলতা কমতে থাকে। রুহুল আমিনকে এবার জীবিকা নিয়ে ভাবতে হয়। হাইস্কুল পাশ করে ১৯৫৩ সালে তিনি নৌ বাহিনীতে জুনিয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য গমন করেন করাচীর অদূরে মানোরা দ্বীপে পি. এন. এস. কারসাজ-এ (নৌ বাহিনীর কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)। ১৯৫৮ সালে তিনি সফলভাবে পেশাগত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। সফলভাবে কোর্স সমাপনান্তে তিনি ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি পি. এন. এস. বখতিয়ার নৌ-ঘাটি, চট্টগ্রামে বদলি হন।



১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরিবারের মায়া ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং এপ্রিল মাসে ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২নং সেক্টরে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি বহু সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এ বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে সকল সেক্টর থেকে প্রাক্তন নৌসেনাদের আগরতলায় সংগঠিত করে নৌ বাহিনীর প্রাথমিক কাঠামো গঠন করা হয়। পরে তাদের কোলকাতায় আনা হয়। সেখানে সবার সাথে রুহুল আমিনও ছিলেন।



ভারত সরকার বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে দুইটি টাগবোট উপহার দেয়। এগুলোকে কোলকাতার গার্ডেনরীচ নৌ ওয়ার্কসপে দুইটি বাফার গান ও মাইন পড লাগিয়ে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। গানবোট দুটির নামকরণ করা হয় 'পদ্মা' ও 'পলাশ'। রুহুল আমিন নিয়োগ পান 'পলাশের' ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশার হিসেবে। ৬ই ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পাকিস্তানী নৌ ঘাটি পি. এন. এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে 'পদ্মা', 'পলাশ' ও মিত্র বাহিনীর গানবোট 'পানভেল' ভারতের হলদিয়া নৌ ঘাটি থেকে রওনা হয়। ৮ই ডিসেম্বর সুন্দরবনের আড়াই বানকিতে বিএসএফের পেট্রোল ক্রাফট 'চিত্রাঙ্গদা' তাদের বহরে যোগ দেয়। ৯ই ডিসেম্বর কোন বাধা ছাড়াই তারা হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করেন। পরদিন ১০ই ডিসেম্বর ভোর ৪টায় তারা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ৭টায় কোন বাধা ছাড়াই তারা মংলায় পৌছান। পেট্রোল ক্রাফট চিত্রাঙ্গদা মংলাতেই অবস্থান নেয় এবং পানভেল, পদ্মা ও পলাশ সামনে অগ্রসর হওয়া আরম্ভ করে। দুপুর ১২টায় তারা খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছান। এমন সময় তাদের অনেক উপরে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা যায়। পদ্মা-পলাশ থেকে বিমানের উপর গুলিবর্ষণ করার অনুমতি চাইলে বহরের কমান্ডার বিমানগুলো ভারতীয় বলে জানান। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে বিমানগুলো পদ্মা ও পলাশের উপর গুলি ও ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। পলাশের কমান্ডার সবাইকে গানবোট ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু রুহুল আমিন পলাশেই অবস্থান নেন এবং আপ্রান চেষ্টা চালান গানবোটকে সচল রাখতে। হঠাৎ একটি গোলা পলাশের ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ মুহুর্তে রুহুল আমিন নদীতে লাফিয়ে পড়েন এবং আহত অবস্থায় কোনক্রমে পাড়ে উঠতে সক্ষম হন। দুর্ভাগ্যক্রমে পাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকাররা তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যা করে। পরে তার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি|

৫।বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জন্ম ২৯শে অক্টোবর ১৯৪১, ঢাকার পৈত্রিক নিবাসে। পিতা মৌলভী আব্দুস সামাদ ছিলেন সরকারী চাকুরে এবং মা মোবারকুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী। নয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মতিউর ছিলেন অষ্টম। ১৯৫২ সালে মতিউরকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সাধারন কিন্তু রুচি সম্মত জীবন যাপন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবার থেকে আলাদা করে উপস্থাপন করে মতিউরকে। ১৯৫৬ সালে ভর্তি হন পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্কুল, সারগোদায়। ১৯৬০ সালে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করে।



১৯৬১ সালের ১৫আগস্ট ৩৬তম জিডি (পি) কোর্সে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমি, রিসালপুরে। একাডেমিক বিষয়ে এবং খেলাধূলাতে মতির দক্ষতার ছিলো উল্লেখ করার মতো। ১৯৬৩ সালের ২৩ জুন তিনি ফ্লাইট ব্রাঞ্চে কমিশন লাভ করেন। তার সার্ভিস নাম্বার দেওয়া হয়, পিএকে-৪৩৬৭। বিমান বাহিনীতে তিনি ২ নং ট্রেনিং স্কোয়াড্রন-মৌরিপুর, ফাইটার লিডারশীপ স্কুল-করাচী এবং ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর স্কুল-এ সফল ভাবে প্রশিক্ষন সম্পন্ন করেন। চাকুরী জীবনে তিনি এফ-৮৬ জঙ্গী বিমানের পাইলট হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ১৯নং ফাইটার স্কোয়াড্রন ও ২৫ নং স্কোয়াড্রনে। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিমান বাহিনী একাডেমি, রিসালপুরে ও ২ নং স্কোয়াড্রনে। এছাড়া তিনি কিছুকাল অন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সদর দফতর, ইসলামাবাদেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে এক পাঞ্জাবী পাইলটের সাথে প্রশিক্ষন কামান আকাশ যুদ্ধে লিপ্ত হলে দূর্ভাগ্যজনকভাবে তার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তিনি বেইল আউট করেন। এতে তাদের উভয়কেই কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হয়। বিচারে পাঞ্জাবী পাইলটের শাস্তি না হলেও তাকে এক বছরের জন্য গ্রাউন্ডেড করা হয়।



১৯৬৮ সালের ১৯শে এপ্রিল তিনি মিলি খানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৯সালের ২৩ এপ্রিল তাদের প্রথম কন্যা সন্তান মাহিন ও ১৯৭০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দ্বিতীয় কন্যা সন্তান তুহিনের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাৎসরিক ছুটিতে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন। এসময় তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১লা মার্চ কর্মস্থলে ফিরে যাবার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি। ২৫শে মার্চ গ্রামের বাড়ি নরসিংদী গমন করেন এবং সেখানকার স্বাধীনতাকামী জনতার প্রশিক্ষনের বন্দোবস্ত করেন। ৪ঠা এপ্রিল পাকিস্তান বিমান বাহিনী নরসিংদীর উপর বিমান হামলা চালালে তিনি ভৈরব হয়ে নানার বাড়ি গোকুল নগরে গমন করেন। পাকিস্তান থেকে বিমান সংগ্রহের মানসে ৯ই মে ১৯৭১, তিনি সপরিবারে কর্মস্থলে ফিরে যান। কর্তৃপক্ষের কাছে দেরিতে যোগদানের কারন দর্শানোর পর তাকে ফ্লাইং সেফটি অফিসারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নিয়মিত কাজের আড়ালে তিনি একটি বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। এনিয়ে তিনি কয়েকজন দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসারের সাথে আলোচনা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ২০শে আগস্ট ১৯৭১ সকাল ১১.১৫ মিনিটে পাঞ্জাবী পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজসহ টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান (কল সাইন ব্লু-বার্ড-১৬৬) ছিনতাই করে ভারত অভিমূখে উড্ডয়ন করেন। অপর পাইলটের সাথে কন্ট্রোল নিয়ে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হলে উভয়েই শাহাদত বরণ করেন। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে মশরুর বিমান ঘাটির ৪র্থ শ্রেণীর কবরস্তানে অত্যন্ত অমর্যাদার সাথে দাফন করে।



বাংলাদেশ সরকার তাকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করে। শাহাদতের ৩৫ বছর পর ২৪শে জুন ২০০৬ মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়।

৬।বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ



বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের জন্ম ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬, যশোর জেলার অর্ন্তঃগত নড়াইল মহকুমার মহিষখোলা গ্রামে। পিতা আমানত শেখ ছিলেন কৃষক এবং মাতা জেন্নাতুন নেসা ছিলেন গৃহিণী। শৈশবেই বাবা-মা হারিয়ে অনেকটা সংসার বিরাগী জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। সংসারের প্রতি মন ফিরিয়ে আনতে অবিভাবকরা তাকে ১৯৫২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করান। স্ত্রী তোতা বিবির বয়স তখন ১২ বছর।



১৯৫৪ সালের শেষভাগে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন। সংসারে অভাবের ছোঁয়া লাগায় দিশেহারা হয়ে যোগ দেন মুজাহিদ বাহিনীতে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯, তদানিন্তন ইপিআর-এ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তার ই পি আর ক্রমিক নম্বর ছিল ৯৪৫৯। ১৫ ই নভেম্বর ১৯৬৪, জন্মগ্রহণ করে তার দ্বিতীয় সন্তান শেখ মোঃ গোলাম মোস্তফা কামাল। কিছুদিন পরেই আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধে বিয়ে করেন মৃত শ্যালকের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসাকে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে দিনাজপুর সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় আহত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি 'তকমা-ই-জং' ও 'সিতারা-ই-হারব' মেডেল লাভ করেন। মার্চ ১৯৭১এ তিনি ছুটি ভোগরত ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর-এর ৪নং উইং এ নিজ কোম্পানির সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেক্টর গঠন হলে তাদের উপর ন্যস্ত হয় ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব। তিনি নিয়োগ পান বয়রা সাব-সেক্টরে। এই সাব-সেক্টরের অধীনে গোয়ালহাটি, ছুটিপুর ঘাট, ছুটিপুর সেনাক্যাম্প, বরনী আক্রমণে অংশ নেন এবং বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বরনীতে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার জীবন রক্ষা করেন। ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১, সুতিপুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে ষ্ট্যান্ডিং পেট্রোলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ নস্যাৎ করে দেন প্রায় একাই। আহত অবস্থায় অধীনস্থ সৈনিকদের নিরাপদে পিছনে পাঠিয়ে দেন এবং শত্রুর মোকাবেলা অব্যাহত রাখার সময় শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীতে সহযোদ্ধারা তার মৃতদেহ উদ্ধার করে সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র কাশীপুরে সমাহিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ তাকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করে

৭।বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ



বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ জন্মেছিলেন ১লা মে, ১৯৪৯ সালে ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে৷ বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন৷ ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে তাঁর বসতি৷ তিনি এই গায়ের মসজিদের ইমাম৷ মা মুকিদুন্নেছা ৷ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এক স্ত্রী মুকিদুন্নেছা, এক ছেলে মুন্সি আব্দুর রউফ এবং দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মুন্সি মেহেদী হোসেনের সংসার৷ বাবার কাছেই মুন্সি আব্দুর রউফের লেখাপড়ার হাতেখড়ি৷ বাবা তাঁকে ডাকতেন রব বলে৷ অসম্ভব সাহসী ও মেধাবী রউফের লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিলো না মোটেই৷ অথচ বাবা মায়ের অক্লান্ত চেষ্টা ছিলো তাঁকে পড়াশুনায় মনযোগী করে তুলতে৷ কিন্তু বইয়ের পাঠ তাঁর ভালো লাগতো না৷ ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেনের সঙ্গই বরং তাঁর অধিক প্রিয় ছিলো৷ চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেন ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার৷ চাচা যখনই বাড়ি ফিরতেন তখনি তিনি তাঁকে শোনাতেন সৈনিকদের সুশৃঙ্খল ও রোমাঞ্চিত জীবনের গল্প৷ সৈনিকদের লেফ্ট রাইট শব্দ তাঁর কানে মধুর ঝংকার তুলতো৷ তাই বাবার চেষ্টা মায়ের চোখ রাঙানো এড়িয়ে বালক রউফ মধুমতি নদীর তীর ধরে ঘুরে বেড়ায়৷ দিনে দিনে প্রিয় সন্তানটির এরকম দুরন্তপনা দেখে তাঁদের উদ্বেগের অন্ত নেই৷ একদিকে আর্থিক অনটন অন্যদিকে ছেলের স্কুলে অমনোযোগিতা দেখে মা মুকিদুন্নেছা একদিন রউফের উপরে রেগে গেলেন৷ মা একদিন তাঁকে পড়তে বসার জন্য বললেন৷ কিন্তু ছেলে রউফ পড়তে না বসে গাছের পাখিদের সাথে মিতালিতে ব্যস্ত, এই দেখে মা ছেলেকে দিলেন বকা৷ ছেলেও অভিমানে ঘর থেকে বের হয়ে দিলেন দৌড়৷ ছেলে ছুটছে, মা-ও পেছন পেছন ছুটছেন ছেলেকে ধরার জন্য৷ ছুটতে ছুটতে একেবারে মধুমতি নদীর কিনারে৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে মাকে দৃঢ় স্বরে বললেন, আমাকে ধরতে এলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ব কিন্তু৷ মায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো৷ ছেলের এই জেদী রূপ মা এর আগে দেখেননি কখনো৷ এরপর মা গলার স্বর নরম করে ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন৷ আর কোনদিন তাঁকে তিনি বকাঝকা করেননি৷ এরপর থেকে ছেলেও অবশ্য কিছুটা মনোযোগী হয়েছিলেন লেখাপড়ার প্রতি৷



মুন্সি আব্দুর রউফের বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করেন৷ মুন্সি আব্দুর রউফের বয়স তখন খুবই অল্প৷ স্বামীর মৃত্যুর পর এক ছেলে আর দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মা মুকিদুন্নেছা অকূলপাথারে পড়েন৷ নিত্য অভাবের মধ্য দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি৷ বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়ির কাঁথা সেলাই, শিকে তৈরি করার কাজ নেন৷ এমনিভাবে মুকিদুন্নেছা দুঃখের দীর্ঘতম দিনগুলি একটি একটি করে পাড়ি দেন৷ সাথে থাকে ছেলেমেয়েকে বড় মানুষ করার স্বপ্ন৷



বাবার মৃত্যুর পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আব্দুর রউফের জীবনাচারেও৷ আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে তাঁর দুরন্তপনা৷ লেখাপড়ার প্রতি মনযোগ বাড়ে৷ এর ফলে মেধাবী বলে তাঁর সুনামও হয়৷ গাঁয়ের প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর ভর্তি হন থানা শহরের হাইস্কুলে৷ এই সময়ে প্রায়ই মায়ের দুঃখ কষ্ট দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন৷ ভাবতেন কী করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা যায়৷ এতটুকুন ছোট ছেলে কী আর করতে পারেন তিনি? তবে চাচার কাছে শুনেছেন সপ্তম শ্রেণী পাশ করতে পারলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন৷ অষ্টম পড়া অবস্থায় এলো সেই সুযোগ৷ ১৯৬৩ সালের মে মাসে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ৷



সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েও রউফের মন ছিলো বাড়ির দিকে৷ নিয়মিত মাকে টাকা পাঠাতেন চিঠি লিখতেন৷ ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়ি চলে আসতেন৷ ১৯৭১ সালে রউফ এক চিঠির উত্তরে মাকে লিখেছিলেন, এখন একটু কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না৷ তার জন্য তুমি চিন্তা করো না মা, ছুটি পেলেই বাড়ী আসবো তখন ছোট বোনের বিয়ে দিবো৷



১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মুন্সি আব্দুর রউফ চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকরিরত ছিলেন৷ তিনি ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন৷ তখন সবে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব৷ মাঝে মাঝে গড়ে তোলা হচ্ছে ছোটখাটো প্রতিরোধ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ৷ শান্ত হ্রদের পাশে আকাশ ছুঁয়ে থাকা মাথা উঁচু মৌন পাহাড়ের সারি৷ এমন নির্জন পরিবেশের জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির উপর৷ কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুললো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি৷ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ ছিলেন সেই কোম্পানিরই একজন মুক্তিযোদ্ধা৷





ছবি:- বাংলাদেশের গৌরব ৭ বীরশ্রেষ্ঠ।



সেদিন, ৮ এপ্রিল ১৯৭১৷ গনগনে মধ্যদুপুরের এক বিশেষ মুহূর্ত৷ সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ নীরব-নির্জন হ্রদের বুক চিরে শান্ত পানিতে অস্থির ঢেউ তুলে এগিয়ে আসতে লাগলো সাতটি স্পিডবোট এবং দুটো লঞ্চ৷ এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য৷ তাদের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ৷ এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের কোম্পানি৷ লক্ষ্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি৷



লক্ষ্যের দিকে তীব্রগতিতে ছুটে আসছে দুটি স্পিড বোট এবং দুটি লঞ্চ৷ এগুলোতে রয়েছে ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার আর অনেক মেশিনগান ও অনেক রাইফেল৷ অন্যদিকে এই জলপথ পাহারা দিচ্ছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে কোম্পানিটি, সেই কোম্পানিটি মাত্র কয়েকদিন আগে পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করে আসা৷



মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করলো আক্রমণ ৷ স্পিড বোট থেকে ক্রমাগত চালাতে লাগলো মেশিনগানের গুলি আর লঞ্চ দুটো থেকে ছুটে আসছে অবিরাম তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল৷ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগলো গুলির পর গুলি৷ গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো৷ পানির ভেতর অদ্ভূত আলোড়ন উঠলো৷ শব্দগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়ি খেয়ে এক মহাধ্বণিযজ্ঞের সূচনা করলো৷ শীতল সবুজে হঠাৎ যেন লেগে গেল শব্দের আগুন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর একটাই উদ্দেশ্য, রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা৷ আক্রমণের আশংকা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আগেই ছিলো৷ তাঁদের লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র নেই বললেই চলে৷ কিন্তু মনের ভেতর দেশের জন্য জমানো আছে অসীম সাহস, তেজ ও দৃপ্ত অঙ্গীকার৷ দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশকে বর্বরদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য৷ মুক্তিযোদ্ধারা খুব দ্রুতই পজিশন নিয়ে নিল পরিখায়৷ কিন্তু শত্রুপক্ষের গোলাগুলির তীব্রতা এত বেশি ছিলো যে, ভেঙে যেতে লাগলো প্রতিরোধ ব্যবস্থা৷ শত্রুদের মর্টার চিহ্নিত করে ফেলল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান৷ আর তাই তীব্র গুলিবর্ষণে ভেঙে পড়লো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷



যুদ্ধের এই পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন যে, এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলেই মারা পড়বেন৷ তিনি তখন কৌশলগত কারণেই পশ্চাদপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেন৷ এই সিদ্ধান্তের কথা সৈন্যদের জানানো মাত্র সৈন্যরা যে যেভাবে পারে পিছু হটতে লাগল৷ মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন, শত্রু এগিয়ে এসেছে খুব কাছে আর এভাবে সকলে একযোগে পিছু হটতে চাইলে একযোগে সকলেই মারা পড়বে৷ কাভার দেওয়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ যেই ভাবা সেই কাজ৷ তিনি পিছু হটলেন না৷ কাভার দেওয়ার জন্য নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন মুন্সি আব্দুর রউফ স্বয়ং৷ অসম্ভব সাহসে, দৃঢ়চিত্তে মেশিনগানটি উঁচুতে তুলে ফেললেন৷ অনবরত গুলি করতে লাগলেন পাকিস্তানি স্পিড বোটগুলোকে লক্ষ্য করে৷ প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গেই তিনি কাজে লাগালেন পাকিস্তান রাইফেলসে কাজ করার অভিজ্ঞতা৷ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তিনি যোগই দিয়েছেন দেশকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে৷ পাকিস্তানি হানাদারদের তিনি পথ ছেড়ে দিতে রাজি নন৷ শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে একাই লড়তে লাগলেন এই অকুতোভয় বীর৷



ল্যান্স নায়েক আব্দুর রউফ এক একটা স্পিড বোটকে লক্ষ্য স্থির করে মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকেন৷ তাঁর প্রচণ্ড গুলিবৃষ্টিতে থমকে গেল শত্রুরা৷ তারা প্রত্যাশাও করেনি এমন পাল্টা আক্রমণ হতে পারে৷ রউফের গুলি খেয়ে একের পর এক শত্রুসেনা লুটিয়ে পড়তে লাগলো৷ একটি একটি করে সাতটি স্পিড বোটই ডুবে গেল৷ এমন পর্যায়ে শত্রু সেনারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো৷ পিছু হটতে হটতে দুটো লঞ্চই চলে গেল রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দুরত্বে৷ হানাদার বাহিনী এবার তাদের লঞ্চ থেকে শুরু করলো মর্টারের গোলা বর্ষণ৷ তারা লক্ষ্য স্থির করল, যেভাবেই হোক থামিয়ে দিতে হবে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানটাকে৷

একের পর এক ক্রমাগত মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না৷ শত্রুর একটি মর্টারের গোলা হঠাৎ এসে পড়ে তার বাঙ্কারে৷ মৃত্যুশেলে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তাঁর সমস্ত শরীর৷ থেমে গেলেন তিনি৷ হাত থেকে পাশে ছিটকে পড়ল মেশিনগান৷ ততক্ষণে তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা সবাই পৌঁছে যেতে পেরেছে নিরাপদ দুরত্বে৷ প্রকৃত বন্ধুর মতো একটি মাত্র মেশিনগান দিয়ে একই সঙ্গে শত্রুদের ঘায়েল করলেন এবং সহযোদ্ধাদের রক্ষা করলেন৷



তিনি বাংলার শোণিতাক্ত সূর্যের সঙ্গে মিশে গেলেন৷ মায়ের বুক খালি হলো, বোনের জন্য বিয়ের শাড়ি নেওয়া হলো না, অথচ নিজের বুকের আলো দিয়ে উজ্জ্বল করলেন তিনি স্বাধীনতার পথ৷ হয়ে গেলেন অমর, বীর, শহীদ, বীরশ্রেষ্ঠ ৷



চির রুদ্রের প্রতীক এই বীরকে সমাহিত করা হয়েছিলো রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে৷ ১৯৯৬ সালে রাঙামাটিবাসী প্রথম জানতে পারে, এ চিরসবুজ পাহাড়ের মাঝেই ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ৷ ঐ সময় দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক আদিবাসী বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল শনাক্ত করেন৷ শনাক্ত করার পর তাঁর সমাধিস্থলটি সরকার নতুনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে৷







সংক্ষিপ্ত জীবনী



নাম : মুন্সি আব্দুর রউফ ।

জন্ম : ১ মে, ১৯৪৯ ইং ৷

জন্মস্থান : ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে ৷

পিতা : মুন্সি মেহেদী হোসেন ৷

মা : মোছাঃ মুকিদুন্নেছা ৷

কর্মস্থল : ই পি আর ( ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)৷

যোগদান : ৮ মে ১৯৬৩ সাল৷

পদবী : ল্যান্স নায়েক ৷

মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১ নং সেক্টর ৷

মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল ৷

সমাধি স্থল : রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে ৷





মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:০৮

আলম দীপ্র বলেছেন: জানা অজানা অনেক তথ্যের গুচ্ছ একসাথে করেছেন ।
ধন্যবাদ আপনাকে :)

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২০

মামুন ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে আলম দীপ্র ভাইয়া

২| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:০০

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: তথ্যের গুচ্ছ পোষ্ট । ভালো লাগা থাকলো

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১৬

মামুন ইসলাম বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

৩| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১৩

কালের সময় বলেছেন: বাহ বাহ অসাধারন পোষ্ট করেছেন মামাুন ভাই +++++++

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১৬

মামুন ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

৪| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৫৯

কোলড বলেছেন: Everyone of them deserve it but I always wonder about Mr. Motiur Rahman? What was his contribution?
Was it only because he tried? But then many people tried to do something but we hardly recognized them let alone the highest award!
I think his award was just an effort to represent BAF.

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১৬

মামুন ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

৫| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:২১

এমএম মিন্টু বলেছেন: গুড পোষ্ট

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৮

মামুন ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.