নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যুর ছায়ায় জীবনের লক্ষ্য: ‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ সিরিজের দর্শন ও অনুপ্রেরণা

২৫ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১:১৭



মৃত্যুর ভয় বা জীবিত থাকার অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মৃত্যুচিন্তায় মানুষের জীবন ক্ষীণ হিসেবে উদীয়মান হয় এবং খুব সম্ভবত এতে করে ব্যক্তির ‘ফোকাস (Focus)’ ঠিক করে দেয় বা বেশি স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।

আমাদের হাজারো চিন্তার ও স্বপ্নের মধ্যে ছোট্ট জীবনে সম্ভাব্য যেসকল সফলতা বা অর্জন সম্ভব তার একটি বাকেট লিস্ট তৈরি করা সহজেই সম্ভব হয়। একইসাথে ঐ বাকেট লিস্টের সুনির্দিষ্ট প্রায়োরিটিও নির্ধারণ করে দেয়। কারণ আমি যদি বুঝতে পারি আমার হাতে সময় মাত্র একদিন বা একসপ্তাহ তাহলে আমাকে নিশ্চয় এমন জীবন নিয়ে ভাবতে হতে পারে যেখানে ঐ একদিন বা একসপ্তাহে আমি সর্বোচ্চ কি কি করতে পারবো? বা আমার পক্ষে ঐ একদিন বা একসপ্তাহে কি কি করা সম্ভব?

এই দর্শন নিয়ে খ্যাতিমান তিনজন দার্শনিক খুব দারুণ কাজ করেছেন। ‘বৈরাগ্যবাদ (Stoicism)’ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা মার্কাস অরেলিয়াস তিনি তাঁর বই ‘মেডিটেশনস Meditations (AD 161 to 180)’ এ স্পষ্ট বলার চেষ্টা করেছেন, যে, মৃত্যুর অনিবার্যতা আমাদের জীবনের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। ‘বৈরাগ্যবাদ (Stoicism)’ দর্শনের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা সেনেকা জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে মৃত্যুর সচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তিনি বলতেন যে, মৃত্যুর সচেতনতা আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করতে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার তাঁর বিখ্যাত ‘বিইং অ্যান্ড টাইম (Being and Time – 1927)’ গ্রন্থে মৃত্যুকে জীবনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আবার ইসলামিক দর্শনও প্রায় একই কথা বলছে। পবিত্র আল-কোরআনে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫) এবং “তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান” (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৬)।

এই দর্শনের ভিজ্যুয়াল প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া একটি জাপানীজ অ্যানিমেশন সিরিজে। সাধারণ গল্পেও অসাধারণ দর্শন নিয়ে কাজ করেছে জাপানীজ অ্যানিমেশন ‘Zom 100: Bucket List of the Dead (মাঙ্গা সিরিজ)’ -এ। ২০১৮ সালে জাপানীজ অ্যানিমেশন বেশ সাড়া ফেলার পর ২০২৩ সালে কোরিয়ান একটি ড্রামা সিরিজ চলে আসে নেটফ্লিক্সে; একই নাম, একই দর্শন কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে। মানে অ্যানিমেশনের রিমেক হিসেবে তবে চরিত্রগুলো বাস্তব ক্যানভাসে।

হর’র, অ্যাকশন ও কমেডি ধাঁচের এই কোরিয়ান ড্রামাও দর্শকমহলে বেশ প্রশংসিত হয়। ‘My Drama List’ -এ এর রেটিং বর্তমানে ১০ এর মধ্যে ৭+, সুতরাং একবার দেখা যেতেই পারে। এখানে ব্যক্তি ‘নাইন টু ফাইভ পিএম’ চাকুরী পাওয়ার জন্য অস্থির, একইসাথে স্বপ্ন যখন অনেক বড় কোম্পানি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি যখন তার কাঙ্খিত চাকুরীও পেয়ে গেলেন তারপর ঠিক কি কি ঘটলো? জম্বির (মৃতদেহ যা বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। হাইতিয়ান লোককাহিনী তে পাওয়া যায়।) শহরে মানুষের অস্তিত্ব অসহায় হয়ে পড়ে সেখানে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান স্রেফ উক্ত গল্পের প্রোটাগনিস্ট।

প্রোটাগনিস্ট কাজ করতে করতে নিজেই কবে জীবিত এক জম্বি হয়ে গেছেন তিনি জানেন না। তার স্বপ্ন ছিলো একদিন এতবড় কোম্পানীতে চাকুরী করা যেখানে মাইনে ভালো, পরিবেশ ভালো এবং কাজে প্রচুর প্রশংসা পাওয়া যায়। আরো বড় যে সুবিধে এই কোম্পানিতে পাওয়া যায় সেটা হলো, সহকর্মীদের আচরণ খুবই বন্ধুসুলভ। সুতরাং কে চাইবেনা এমন কোন এক জায়গায় চাকুরী মিলে যাক!

খুব সম্ভবত আমরা সবাই এমনটাই চাই। সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধার কথাও জীবনে আমাদের ভাবা উচিত। তবে আমার একটি স্বীকারোক্তি দরকার, সেটা হলো, ‘নাইন টু ফাইভ পিএম’ চাকুরী নিয়ে সারাক্ষণ সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ বর্তমান বা বাস্তব প্রেক্ষাপটে যে ব্যক্তি কিছুই করছেন না তার চেয়ে ভালো ঐ ব্যক্তি যিনি অন্তত কিছু করছেন এবং আমরা আশা রাখতেই পারি তিনি সামনে গিয়ে একজন উদ্যোক্তা হলে হতেও পারেন এবং নিজের জীবনের স্বাধীনতা সহ অন্যের জীবনেও মুক্তি দেবার রাস্তা বের করতে পারেন।

কিন্তু এই গল্পে দেখা যায় কোম্পানি যত বড় হয় দায়িত্ব বা কাজের চাপ তত বেশি হয়। একইসাথে কোম্পানি যত বড় সেখানের কর্মীদের মধ্যে ‘কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি (Workplace Politics)’ তত বেশি দেখা যায়। অবশ্য এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ে তেমন ভাবেন না। তিনি শুধু চান কীভাবে কাজ করে সবার মন জয় করা যায় এবং যে-কোনো ভাবে তার প্রমোশন দরকার।

তার এত কাজ দেখে বাকিরাও তাকে আরো বেশি অতিরিক্ত কাজ চেপে দেয় এবং লঘু মানের ‘যাজকতন্ত্র (Hierarchy)’ স্পষ্টরুপে প্রকাশ পায়। এই যাজকতন্ত্রের ফলে প্রোটাগনিস্টের নিজেকে ছোট মনে হতে শুরু করে তবুও তিনি হাল ছাড়ার মত মানুষ নন। তিনি এই শহরে রোজ সকালে উঠে রাত অবধি কাজ করতে থাকেন। গল্পের এক পর্যায়ে কৌতুকপূর্ণ একটি দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে তার পছন্দের মেয়েটি তার বসের সাথে একটু বেশি-ই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকে। ঠিক এই পর্যায়ে এসে প্রোটাগনিস্ট তিনি তার জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেন।

কারণ, একেতো আকিরা টেন্ডো (প্রোটাগনিস্ট/মুখ্যচরিত্র) অজানা কারণে কোনোভাবেই তিনি তার প্রোমোশন পাচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তার পরিবার ছেড়েই একটি ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন; একা। তৃতীয়ত, যে মেয়েকে তিনি পছন্দ করেন সে মেয়েটিও তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। চতুর্থত, অতিরিক্ত কাজের চাপ এক পর্যায়ে তার কাছে অত্যাচারের মত মনে হতে শুরু হয়; গল্প অনুযায়ী যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এরপরেও একদিন সকালবেলা কিছু দেরিতে অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে বের হোন অফিসের উদ্দেশ্যে আর দেখতে পান পুরো শহর জম্বিতে ভরপুর, বাদ যায় নি নিজের অ্যাপার্টমেন্টের কোনো কোণা পর্যন্ত। মূল গল্প মূলত এখান থেকেই শুরু হয় সুতরাং বাকি অংশ আর না বলে দিই।

জম্বিতে ভরপুর শহরে নিজেকে একা খুঁজে পান কিন্তু তিনি দীর্ঘসময় একা থাকায় আর একাকীত্ব তেমন করে অনুভূত হয় না। হাতে অনেক সময় পান, যেটা প্রায় তার জন্য সবসময় অসম্ভব মনে হয়। বিশেষ করে চাকুরীতে থাকার সময় ছুটি মিলতো না। কিন্তু তিনি একটি বিষয়ে অনেক স্পষ্ট হতে পারেন যে, যেহেতু সবাই জম্বিতে রুপান্তর হয়েছে সুতরাং তিনিও একদিন নিশ্চয় জম্বিতে রুপান্তরিত হবেন।

চারপাশে এই মৃতলাশগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আকিরা টেন্ডো বেঁচে থাকার নতুন অর্থ খুঁজে বেড়াতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হোন যে, জম্বিতে রুপান্তরিত হওয়ার পূর্বে তিনি অন্তত ১০০টি কাজ সম্পন্ন করতে চান, যা তিনি সবসময় মনে মনে করতে চাইতেন। তিনি অন্তত তার গল্পের নায়ক হতে চান, সুপারহিরো।

ফ্রেডরিখ নীটশের ‘অতিমানব (Übermensch)’ হওয়ার কনসেপ্ট এবং ‘বৈরাগ্যবাদ (Stoicism)’ দর্শনের প্রয়োজনীয় মিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায় এই দুই সিরিজে, যেখানে মূল থিম ‘মৃত্যু’ কে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মৃত্যু যেখানে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। মৃত্যু যেখানে জীবনের লক্ষ্য পূরণের নির্দেশ বা টাইমলাইন। কারণ আমাদের জীবন তো কিছু সময়েরই সমষ্টি মাত্র। কিন্তু আকিরা টেন্ডোর জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেসব পূরণের ধরণ ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। প্রথমত, তিনি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কি কি কাজ/স্বপ্ন সম্পন্ন করতে পারেন সেটা এবং দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ তিনি কি কি কাজ করতে পারেন সেসব কাজ/স্বপ্নের এক বালতি তালিকা; মোট ১০০টি নির্ধারণ করেন।

আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা জীবনে ঝুঁকি নিতে চান না। এক জীবনে আমি জীবিত আছি বিষয়টিকে অর্জন হিসেবে মনে করেন তাদের মতন কিন্তু আকিরা নন। আকিরা টেন্ডোর মতে, জীবনে শুধু জীবিত থাকা একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। আমরা যদি কর্ম করি তাহলে ফল মিলবেই। আমাদের জীবনের লক্ষ্য/উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে এবং সেটা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

বৈরাগ্যবাদ দর্শন নিয়ে কোরিয়ান সিরিজ ও জাপানীজ অ্যানিমেশন এত এত বেশি কাজ করছেন যা তাদের সিনেমা, সিরিজ ও নাটকগুলোকে উঁচু মাত্রায় আজ নিয়ে গেছে। ঠিক তেমন করে ‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ একইসাথে আপনাকে বিনোদন দেবে, জানতে চাইলে কিছু জানাবে, শিখতে চাইলে কিছু শেখাবে, হাসতে বা কাঁদতে চাইলে সেটাও করবে… নির্ভর করবে আপনি কেমন দর্শক? তাই জাপানীজ অ্যানিমেশন এবং কোরিয়ান ড্রামা দুটোই রেকোমেন্ডেড রইলো। রাখুন ওয়াচলিস্ট এ আপনার মৃত্যুর পূর্বে বাকেট লিস্ট তৈরির জন্য। হ্যাপি ওয়াচিং!

Also Read It On: মৃত্যুর ছায়ায় জীবনের লক্ষ্য: ‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ সিরিজের দর্শন ও অনুপ্রেরণা

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.