নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
১।
২০২০ সালের জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি মাস। পৃথিবীজুড়ে সবচে প্রাসঙ্গিক দুটো শব্দ তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট 'ডোনাল্ড ট্রাম্প', এবং চীনের উহান হতে ছড়িয়ে পড়া 'করোনা ভাইরাস'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার হালের নেমেসিস চায়না আরও একদফা মুখোমুখি, কিন্তু তার প্রেক্ষাপট অভূতপূর্ব। ট্রাম্প ততোদিনে করোনাকে 'চায়নিজ ভাইরাস' নামকরন করে একদফা তোপ দাগিয়ে ফেলেছেন। আমরা, আমজনতারা, উৎকণ্ঠার সঙ্গে তখন তাকিয়ে আছি বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারকৃত করোনা সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যের জন্য। নিজের অজান্তে শিখে চলেছি 'সোশ্যাল ডিসটেন্সিং', বা সামাজিক দূরত্বের মতো নতুন শব্দগুচ্ছ। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের শতবর্ষবাদে পুনরায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে 'কোয়ারেন্টাইন' বা 'সঙ্গরোধ' শব্দটি। বাংলাদেশে আমরা তখনও উৎকণ্ঠিত, কিন্তু স্থবির হয়ে পড়েনি জনজীবন। অফিস আদালত - শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - ব্যাংক - মসজিদ, খোলা আছে সবই। পেশাগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের হালকা সিরিয়াস টোনে বলি 'সোশ্যাল ডিসটেন্সিং' বজায় রাখতে, নইলে জায়গা বদলে 'কোয়ারেন্টাইনে' পাঠিয়ে দেবো। শুনে শিক্ষার্থীরাও হাসে, সঙ্গে কখনোসখনো আমিও। গতবছরের মার্চ মাসের প্রায় মাঝামাঝিতে যখন সরকারিভাবে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, ধারণা ছিল - এ হয়তো এক সাময়িক স্থবিরতা। একসপ্তাহ কি সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ। তারপর যে অভূতপূর্ব এক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাই, তার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অতীতকালীন কোন অভিজ্ঞতা মেলে না। আজ এ লেখা যখন লিখছি, এরমধ্যে কেটে গেছে একবছর একমাসেরও বেশী সময়। ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন আর আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু করোনা ভাইরাস রয়ে গেছে আমাদের জনজীবন ও শিক্ষাব্যবস্থায় এক চরম দুর্ভোগ হিসেবে।
২।
গতবছর সরকারিভাবে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, প্রথম একটা মাস বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত আমাদের সকলের সময় কাটে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায়। সহৃদয় মালিকপক্ষের তরফ থেকে বেতনভাতার নিশ্চয়তা প্রদানের পর সে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি মেলে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তরফ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার অনুমতি দিলে আপাতস্থায়ী এক স্বস্তি নেমে আসে আমাদের মনে।
প্রাথমিকভাবে এক দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা লক্ষ্য করি স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মধ্যে, যারা করোনাকালে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি ব্যবসায়ী - বেনিয়াবৃত্তিক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করেন। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তার শিক্ষক - স্টাফদের সঙ্গে যে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগী সম্পর্ক তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে চিহ্নিত করতে চাইলে নিজেকেও যে মনের অজান্তেই সে ব্যবসার অংশীদার বলা হয়ে যায়, তা তাদের কেউ অনুধাবন করেছিলেন বলে মনে হয় না। তদুপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে করোনা উপদ্রুতকাল বিবেচনায়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মূল টিউশন ফি'র ওপর ১০% থেকে সর্বোচ্চ ২০% পর্যন্ত ছাড়, শিক্ষক - স্টাফদের বেতন থেকে স্বেচ্ছায় একদিনের বেতন করোনার শিকার দুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্যে ডোনেশনের মানবিক প্রয়াসগুলোকেও খাটো করে দেখা হয়। অবশ্য অনলাইন কার্যক্রম একবার পুরোদমে শুরু হয়ে যাবার পর তার প্রায়োগিক বাস্তবতা বুঝে যখন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অনলাইন সেমিস্টারে রেজিস্ট্রেশন করা আরম্ভ করে, উপর্যুক্ত অভিযোগ আপনাতেই স্তিমিত হয়ে যায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত প্রজন্মের শিক্ষক - শিক্ষার্থীদের কারো মনে হয় না এক সপ্তাহের বেশী সময় লাগে - অনলাইন ক্লাসের পুরো প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে। যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আগেই গুগোল হতে ডোমেইন ক্রয় করা ছিল, তাদের গুগোল ক্লাসরুম - মিট লিঙ্ক তৈরি করতে কোন সমস্যাই হয় না। তবে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পুরো প্রক্রিয়াটির ওপর বিশ্বাসস্থাপন করাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয় শিক্ষক - শিক্ষার্থী উভয় দৃষ্টিকোন থেকেই। করোনাক্রান্ত সময়ের কষ্টোপার্জিত অর্থে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে কতটুকু শেখা যাবে, এটাই ছিল শিক্ষার্থী - অভিভাবকদের মনে মূল প্রশ্ন। অপরদিকে, আমরা শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের যে অ্যাসাইনমেন্ট অনলাইনে দিচ্ছি এবং তা মূল্যায়ন করছি - তাতে শিক্ষার্থীর তরফ থেকে কতটুকু সততা অবলম্বন করা হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল আমাদের তরফ থেকে। দু'একটি ঘটনা শেয়ার করলে হয়তো আমাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলোর ধরন বুঝতে সুবিধে হবে।
অনলাইন ক্লাসের একদম শুরুর দিকের ঘটনা। ইংলিশ ওরাল কমিউনিকেশন স্কিলের চূড়ান্ত প্রেজেন্টেশন দিচ্ছেন আমার একজন শিক্ষার্থী, ফর্মাল পোশাকে, ল্যাপটপের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে। বেচারি খেয়াল করার আগেই হয়তো তার পিতৃস্থানীয় কেউ উঁকি দিলেন, পরিবারের শান্ত ভদ্র কন্যাটি ল্যাপটপের সামনে সেজেগুজে বসে কার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছে - তা পরীক্ষা করতে!
এতো গেলো শিক্ষার্থী - অভিভাবকদের তরফ থেকে সন্দিঘ্নতার এক মজার অভিজ্ঞতা। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যে - ক্লাসে হয়তো রচনা লিখতে দিয়েছি - 'অ্যান ইন্সপায়ারিং পারসোনালিটি' , আমার এক শিক্ষার্থী রচনা লিখে জমা দিয়েছে রাসুল (সঃ) কে অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করে। আমি তো শিক্ষার্থীর ইংরেজি পড়ে হয়রান! এর তো বাংলাদেশের যেকোনো প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিকে নিয়মিত বেসিসে ফিচার লেখার কথা! পরে লেখার কিয়দাংশ গুগোল করে দেখা গেলো লেখাটি আর একটি অনলাইন প্রবন্ধের জেরক্স কপি। বোঝা গেলো, লেখাটি তার নিজের তো নয়ই, রাসুল (সঃ)ও তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব নয়। কেননা, রাসুল (সঃ) এর আদর্শে বিশ্বাসী কারো পক্ষে কপি করা উত্তর লেখার কথা না। যা হোক, এগুলো ছিল একদম প্রথম কিছুদিনের সমস্যা। ধীরে ধীরে উভয় পক্ষ থেকেই পারস্পারিক অবিশ্বাসের জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে আসে। পেশাদার মনোভাব, আর সততা ছাড়া অর্জিত কোনকিছুই জীবনে দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনতে পারে না - এ উপলব্ধিই, বোধ করি, আমাদের পারস্পারিক বোঝাপড়াকে শক্তিশালী করেছে।
ফলিত বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টসমূহের ব্যাবহারিক ক্লাসগুলো হাতেকলমে করতে না পারাটা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের একটি সমস্যা ছিল। আশা করি বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত কোর্সগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা পর্যন্ত রহিত করে রেখেছে। একইসঙ্গে সামনা সামনি ক্লাস নিলে শিক্ষার্থীদের মুখ দেখে যেমন বলে দেয়া যায় বক্তৃতা কে বুঝেছে আর কে বোঝে নি - অনলাইনে এটাও আন্দাজ করা মুশকিল। তবুও, সেশন জটে, বা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে শিক্ষা কার্যক্রম মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বন্ধ করে বসে থাকার চে' অনলাইনে যে উপায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, তাতে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত অংশীদার, সরকার, এবং ইউজিসির বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।
৩।
লেখাটি শেষ করবো একটি গল্প দিয়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন সেমিস্টার শেষ করে সস্ত্রীক বেড়াতে গেছি সিলেট। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে যে তরুণ ছেলেটি আমাদের নৌকার মাঝি ছিল - তাকে প্রশ্ন করলাম, সে কোথায় থাকে, এই ট্রিপের পর সে কি করবে। উত্তর এলো, সে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে থাকে। নৌকার এই ট্রিপ শেষ করে সে স্থানীয় বাজারে যাবে মোবাইল নিয়ে, অনলাইন ক্লাস করতে। সে ঢাকাস্থ এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন দুর্বল। বাজারে একটিমাত্র দোকানে ওয়াইফাই আছে, যারা সাশ্রয়ী মুল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয় শিক্ষার্থীদের। রাতারগুলের সে নিস্তব্ধ পরিবেশে জলে ভাসতে ভাসতে নৌকার মাঝির এ উত্তর একদম অকল্পনীয় লাগলেও পরক্ষনেই বুঝি - এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান বাস্তবতা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষক - শিক্ষার্থীবৃন্দ এক প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধ স্রোতে সাতার কাটতে কাটতে এগিয়ে চলছে এক আলোকিত ভবিষ্যতের পানে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে, উচ্চশিক্ষার বৈতরণী পেরিয়ে জীবন গড়ার লড়াইয়ে লিপ্ত আমাদের শিক্ষার্থীদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমী মুখগুলোই আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে রইবে!
(ঈষৎ সম্পাদিত আকারে এ লেখাটি আজ ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় পাতায় মতামত বিভাগে ছাপা হয়েছে - করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার বাস্তবতা )
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৮:৩৫
উম্মে সায়মা বলেছেন: নিজের অবস্থার সাথে খুব রিলেট করতে পারছি৷ প্রথম দিকে অনলাইন ক্লাস নেয়া একেবারে চ্যালেঞ্জ ছিল। স্টুডেন্টদের দোনোমোনো, পরবর্তীতে গুরুত্ব বুঝতে পেরে ছাদে, মাঠে যেয়ে ক্লাস এটেন্ড করা। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাদের এসেস করা।
যাই হোক, এতদিনে শিক্ষক-ছাত্র সবাই-ই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে নিউ নরমাল শিক্ষা জীবনের সাথে।
ধন্যবাদ আবীর ভাই সুন্দর একটা আর্টিকেল শেয়ার করার জন্য।