somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহীদ কাদরী বললেন : 'দুর, লিখে কী হবে!' (পর্ব ১)

০৭ ই জুন, ২০০৭ সকাল ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

জ্যামাইকা। না, ভ্রমণবিলাসীদের তীর্থস্থান ক্যারিবীয় দ্বীপ জ্যামাইকা নয়। এখানে উন্মুক্ত সমুদ্রতট ও তার বালুকারাশি, সমুদ্রের বিস্তার ও উদার নীল আকাশ নেই। এই জ্যামাইকা ইট ও কংক্রিটের অরণ্য নিউ ইয়র্ক শহরের একটি অঞ্চল। এই জ্যামাইকা আকাশ আড়াল-করা উঁচু দালানকোঠায় পরিপূর্ণ, পথ আকীর্ণ ছুটন্ত জন ও যানে। এখানে পারসন্স বুলেভার্ড-এর বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একটিতে বসত করেন বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি।

জীবনযাপনে এবং মননে নাগরিক তিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক মধ্যভাগে ১৯৪২-এ জন্ম কলকাতায়, অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তম নগরীতে। প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় আসা ১৯৫২ সালে, বয়স তখন দশ। আজন্ম নগরের বাসিন্দা আমাদের এই কবির নাম যদি হয় শহীদ কাদরী, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কসমোপলিটন নগরী নিউ ইয়র্কে এক হিসেবে তাঁকে খুবই মানিয়ে যায়:

”আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।
আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ ...।” (এবার আমি)

এক সাক্ষাৎকারে কবি এই বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন: “... আপাদমস্তক শহুরে আমার কবিতা। আমার দুর্ভাগ্য এই যে গ্রামবাংলার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই। ... জীবনানন্দ বা জসীমউদ্দিনের অথবা ‘পথের পাঁচালী’-র যে গ্রামবাংলা, তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনও অবকাশ আমার জীবনে আসেনি।”

পুরোদস্তুর নাগরিক হলেও যে ভাষায় তাঁর কবিতা লেখা, যে অঞ্চলের মাটি, আবহ ও পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা, যে সাহিত্য-ঐতিহ্যে তাঁর ‘উত্তরাধিকার’ (এটি যে শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম, তাতে আর আশ্চর্যের কি!), সেই কবিকে নিঃসঙ্গ পরবাসে মানতে মন চায় না। অথচ প্রথম কাব্যগ্রন্থে কিন্তু তাঁর ঘোষণা ছিলো একেবারে বিপরীত:

“... মানুষের বাসনার মতো ঊর্ধ্বগামী
স্কাইস্ক্রেপারের কাতার Ñ
কিন্তু তবু
চুরুট ধরিয়ে মুখে
তিন বোতামের চেক-কাটা ব্রাউনরঙা সুট প’রে,
বাতাসে উড়িয়ে টাই
ব্রিফকেস হাতে ‘গুডবাই’ বলে দাঁড়াবো না
টিকিট কেনার কাউন্টারে কোনোদিন Ñ
ভুলেও যাবো না আমি এয়ারপোর্টের দিকে
দৌড়–তে দৌড়–তে, জানি, ধরবো না
মেঘ-ছোঁয়া ভিন্নদেশগামী কোনো প্লেন।” (একুশের স্বীকারোক্তি)

মানুষের জীবন অবশ্য এইসব প্রতিজ্ঞা বা ছক মেনে চলে না। চারপাশের পরিচিত পৃথিবী ও পরিবেশ বদলায়, মানুষ পরিবর্তিত হয়, বদলে যায় রাজনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের ধারণা, জীবন-বাস্তবতার বাধ্যবাধকতা একজন মানুষকে বদলে দেয়। গতকালের মানুষটি তখন অন্য জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে।

একজন কবিও তার ব্যতিক্রম হন না। পার্থক্য অবশ্য একটি থাকে। সাধারণ মানুষদের জীবনে এই ধরনের পরিবর্তনের পেছনে সচরাচর থাকে একটি মোটা দাগের গল্প। কবিরা অতি সংবেদনশীল ও অনুভূতিপ্রবণ, তাঁদের গল্পটি সবসময় জানাও যায় না। আপাত-সুখী কোনো গৃহস্থের অকস্মাৎ আত্মহণের মতোই তা অনিশ্চিত রহস্যে আবৃত থাকে।


২.

প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো গত বছর জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের এক সন্ধ্যায়। তাঁর নিউ ইয়র্কের বাসস্থানে। বস্তুত এই চার দেয়ালের বাইরে তাঁর বড়ো একটা যাওয়া হয় না চলৎশক্তি সীমিত বলে। যা-ও হয়, কিছু সামাজিকতার বাধ্যবাধকতা বাদ দিলে, তার বেশির ভাগই চিকিৎসা ও চিকিৎসকঘটিত।

এর বাইরে বিভিন্ন উপলক্ষে-অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হয় তাঁকে। এড়াতে চান প্রাণপণে, সবসময় সফল হন না। উদ্যোক্তারা হয়তো ভালোবেসে তাঁকে ডাকেন, কিন্তু ভালোবাসাও কখনো কখনো যন্ত্রণাদায়ক হয়।

শহীদ কাদরীর শারীরিক সমস্যা অনেকগুলি, তার মধ্যে প্রধানতম হলো, তাঁর কিডনি অকেজো। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্যে নাম লিখিয়ে অপেক্ষায় আছেন বছর চারেক। যে কোনোদিন ডাক আসতে পারে, এলে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে উপস্থিত হতে হবে। ফলে, শহরের বাইরে কোথাও যাওয়ার সুযোগও নেই। তার ওপরে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করাতে হয়। ২০০১ থেকে শুরু হয়েছে। হাসপাতালের লোকজন এসে দুপুরে বাসা থেকে তাঁকে তুলে নেয়, ডায়ালিসিস-এর পরে নামিয়ে দিয়ে যায় সন্ধ্যায়।

ভুক্তভোগীরা জানেন, কী কষ্টদায়ক এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া। ঘরে ফিরে আসতে হয় যন্ত্রণায় কাতর প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায়, শরীর-মন তখন সম্পূর্ণ বিস্রস্ত ও বিধ্বস্ত। ডায়ালিসিস-এর ধকল কাটতে লেগে যায় পুরো একটা দিন, ততোক্ষণে আরেকবার যাওয়ার প্রায় সময় হয়ে আসছে। কিন্তু উপায় কি, জীবনরক্ষার জন্যে আপাতত এর বাইরে আর কোনো ব্যবস্থা নেই।

কবির একমাত্র যুবক পুত্র নিজের একটি কিডনি দিতে ইচ্ছুক পিতার এই দুর্বিসহ যন্ত্রণার উপশমের জন্যে। কিন্তু পিতা প্রবল অনিচ্ছুক। শহীদ ভাই ছেলেকে বলে দিয়েছেন, "আমার এই জীবনের আর কী মূল্য আছে? তোমার সামনে একটি সম্পূর্ণ জীবন, আমার জন্যে তোমার অঙ্গহানি আমি ঘটাতে পারি না।"

পুত্রকে বলা এই সিদ্ধান্ত শহীদ কাদরীর কবিতার মতোই স্পষ্ট ও ঋজু। দিনের পর দিন শারীরিক যন্ত্রণার সম্ভাব্য উপশম প্রত্যাখ্যান করতে দরকার হয় সন্তপুরুষের সাহস ও সহিষ্ণুতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০০৭ রাত ৮:৩৩
১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনার ‘আমি’ কি প্রতিদিন মরে যায়? অভিশপ্ত রহস্য নাকি দার্শনিক যুদ্ধ?

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৬ ই মে, ২০২৫ রাত ২:১২



আমার মত ‘পাইরেটস্‌ অব ক্যারিবিয়ান (Pirates of the Caribbean)’ সিনেমা সিরিজ ভক্ত কে কে আছেন? বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত, বোকা কিংবা চতুর ক্যাপ্টেন ‘জ্যাক স্প্যারো’ কে ভুলে যাওয়া কি এত সহজেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৭৫

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৬ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১:৩৩



প্রিয় কন্যা আমার-
আজ শুক্রবার। তোমার স্কুল নেই। অথচ আজ তুমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বসে আছো। বলছো, মেকাপ বক্স দাও। মাকে মেকাপ করে দিবো। যেদিন তোমার স্কুল থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে ইসলামের হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২০

এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে ইসলামের হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান

ক্যালিগ্রাফি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

প্রিয় যামিনী সুধা,

আপনার নাম আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক অমলিন আলো জ্বালায়। একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আপনি শুধু জীবনের অভিজ্ঞতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তদ্বির বানিজ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও এনসিপির নেতা

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭

জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট জুলকারনাই সায়েরের এক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে গতকাল যেখানে রেলভবনে, রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) এর একান্ত সচিবের কক্ষে তদ্বির বানিজ্যে দেখা গেছে এনসিপির সংগঠক (হবিগঞ্জ) নাহিদ উদ্দিন তারেক ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাল ১৯৭১ !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৬ ই মে, ২০২৫ রাত ৮:৩২


বাংলাদেশে গত বছর ৫ই আগস্ট একটা বড়ো ধরণের অভ্যুত্থান হয়েছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার খুনে প্রশাসনের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র জনতা অভ্যুত্থানে যোগ দেয়। যে কোনো ধরণের বড়ো অভ্যুত্থানে পলিটিক্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×