জীবনানন্দ দাশ নিঃসন্দেহে সর্বকালের সর্বোৎকৃষ্ট নিঃসঙ্গতার কবি। বিশ্ব ইতিহাসে ক্ষণজন্মা প্রতিভাশীল প্রচার বিমুখ অন্যতম এক কবির নাম। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় তার নামের প্রতি কোন সুবিচার হয়নি বললেই চলে।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের জেলাশহর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগ সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯১৭সালে একই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়ও প্রথম বিভাগ সহ পাশ করেন।
এর পর তিনি কলকাতার নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে তিনি এ কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগ সহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ছেড়ে দেন।
১৯৩০ সালের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩১ সালে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়।
তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণা নিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৯৩৮-৮৫) বিক্রমপুরথেঁকে স্থানান্তরিত হয়ে বরিশালে আবাস গাড়েন। সর্বানন্দ জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন ; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানহিতৈষী কাজের জন্যে সমাদৃত ছিলেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্তের সর্বাসন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।
তিনি যে কত বড় মাপের কবি, এটা তাঁর জীবদ্দশায় খুব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রোজ বিকালে হাঁটতেন। হাঁটতে হাঁটতেই লেখক সঙ্গীর হাতটা ধরে বলেছিলেন, আমার লেখা কি কিছু হয়েছে?
মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ট্রামের সঙ্গে একসিডেন্ট করে তিনি মারা যান।
তাঁর মৃত্যুর পর বুদ্ধদেব বসু গিয়েছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে। একটা স্মরণসংখ্যা বের করা হবে। তার জন্য লেখা চাইতে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, যে কবি নয়, তার জন্য স্মরণসংখ্যা করবার দরকার কী?
১৯৫৪ সালে মারা যান জীবনানন্দ। তার মৃত্যুর ৬০ বছর পর আজ আমরা জানি, তাঁর মতো বড়ো কবি পৃথিবীতেই খুব কম এসেছেন।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন কবি, তার সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে” যা আজও শিশুশ্রেণীর পাঠ্য।
কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসে ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তার কিংবদন্তিতুল্য “বনলতা সেন” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। বইটি ১৯৫৫ খৃস্টাব্দে ভারত সরকারের "সাহিত্য একাডেমি" পুরষ্কার লাভ করে।
১৯৩৪ সালে তিনি একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন যা পরবর্তীতে তার রূপসী বাংলা কাব্যের প্রধান অংশ নির্মাণ করে।
১৯৫৭ সালে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তার কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না। চাকুরী তথা জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে ১৪ই অক্টোবর ট্রাম এক্সিডেন্ট হওয়াকালীন থেকে ২২শে অক্টোবর, অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন।
জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। ঠিক ট্রামেই তার মৃত্যু হল। ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ৮দিন মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করে তাঁর মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য যে ট্রাম দুর্ঘটনায় গত ১০০ বছরে একমাত্র এই মহান কবিই মৃত্যু বরন করেন। একাকি নিঃসঙ্গ এই কবির আত্মাও যেন একাকি অনেক অনেক শান্তিতে থাকে এই শুভ কামনা রইল। ভালো থাকুন কবি। আপনার আত্মা শান্তি পাক।
ইংরেজিতে তার ওপর লিখেছেন ক্লিনটন বি সিলি, আ পোয়েট আর্পাট নামের একটি গ্রন্থে। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে।
গ্রন্থতালিকা
কাব্যগ্রন্থ
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত। মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ তারকা চিহ্নিত।
• ঝরা পালক (১৯২৭)
• ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)
• বনলতা সেন (১৯৪২, কবিতাভবন সংস্করণ)
• মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
• সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
• বনলতা সেন (১৯৫২, সিগনেট প্রেস সংস্করণ)
• জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)
• রূপসী বাংলা (১৯৫৭)*
• বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)
• সুদর্শনা (১৯৭৪)*
• আলো পৃথিবী (১৯৮১) *
• মনোবিহঙ্গম*
• অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) *
প্রবন্ধগ্রন্থ
• কবিতার কথা (১৯৫৫)
• জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র (১৯৯০, সম্পাদকঃ ফয়জুল লতিফ চেৌধুরী)*
উপন্যাস
• মাল্যবান (১৯৭৩)*
• সুতীর্থ (১৯৭৭)
• চারজন (২০০৪: সম্পাদকঃ ভূমেন্দ্র গুহ ও ফয়সাল শাহরিয়ার)*
গল্পগ্রন্থ
• জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২, সম্পাদনা: সুকুমার ঘোষ ও সুবিনয় মুস্তাফী)
• জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ)
পত্রসংকলন
• জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (বাংলা ১৩৮৫, সম্পাদকঃ দীপেনকুমার রায়)
• জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (১৯৮৬, সম্পাদকঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ) )
বিঃদ্রঃ অনেকেই তাঁর জন্মদিন ১৮তারিখ ও পালন করেন ১৭কিংবা ১৮ যেটাই হোক ভালো থাকুন কবি। আপনার আত্মা শান্তি পাক।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২১