হাই কোর্ট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না ? তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। তত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের বেলায় হাই কোর্ট এর দোহায় দেয়া হয়, অথচ রামপাল বিদুৎ কেন্দ্রের বেলায় তা আমলে নেয়া হয় না।
রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারি হয় ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি’র সাথে বাংলাদেশের পিডিবি’র জয়েন্ট ভেঞ্চার বা যৌথ বিনিয়োগ। সেই চুক্তি হয় ২৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে তথ্য সুত্রঃ আর ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশগত ছাড় পত্র ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে; যা ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখে ভারতের দ্যা হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত NTPC’s coal-based project in MP turned down বা ‘মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসির কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বাতিল’ শীর্ষক খবরে বলা হয়: জনবসতি সম্পন্ন এলাকায় কৃষিজমির উপর তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহনযোগ্য হতে পারে না বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গ্রীন প্যানেল মধ্যপ্রদেশে ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন(এনটিপিসি) এর ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি ।
তথ্য সূত্রঃ
NTPC’রএকই ধরণের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের প্রস্তাব গাজমারা উড়িষ্যা থেকে পরিবেশ বিভাগ থেকে ছাড়পত্র না দিয়ে ফেরত দেয়া হয়, অথচ বাংলাদেশে সেই এনটিপিসিকে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে । তথ্য সূত্রঃ
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয়েছে ‘খুলনা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থাকবে। সরকারি তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালের মধ্যে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। গত ২০ ডিসেম্বর ওরিয়ন গ্রুপের সাথে পিডিবির চুক্তির সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে কয়লাভত্তিকি কন্দ্রেগুলোর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ৫২২ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা এবং খুলনার লবণচোরায় এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র তিন টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি।
ফলে খুব সহজেই বোঝা যায় বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের নামে আরেকটি বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে বিদ্যূৎ কেনার আয়োজন হচ্ছে।
৮৫% মালিকানাই থাকবে এনটিপিসি’র
যৌথ প্রকল্প বলে ঊল্লেখ করা হলেও মাত্র ১৫% বিনিয়োগ করেই সিংহভাগ মালিকানা থাকবে ভারতীয় কোম্পানির । এনটিপিসি ও পিডিবির যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থাৎ তিন হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয় করবে পিডিবি ও ভারতীয় কোম্পানি অর্থাৎ প্রত্যেকে ১৫% করে বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ শতাংশ বা ৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা অর্থায়ন হবে ঋণের মাধ্যমে যা এনটিপিসি বিভিন্ন ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে।কাজেই দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৮৫% মালিকানাই থাকবে এনটিপিসি’র। বাস্তবে এটি মূলত ভারতীয় মালিকানা ও ব্যাবস্থাপনায় একটি ভারতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রই হবে, যে বিদূৎ কেন্দ্র থেকে সরকার বেসরকারি বিদ্যূৎ কেন্দ্র বা আইপিপি’র কাছ থেকে যেমন চড়া দামে বিদ্যুৎ কেনে সেভাবে কিনবে।
রামপালে জমি অধিগ্রহণ করার পরিমান ১৮৩৪ একর। EIA রিপোর্টে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প এলাকায় (১৮৩৪ একর) ধান, মাছ, গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদির উৎপাদন ধ্বংস হবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে ৬২,৩৫৩ টন এবং প্রকল্প এলাকায় ১২৮৫ টন ধান উৎপাদিত হয়।
ধান ছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে ১,৪০,৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে বছরে৫২১৮৬৬ মেট্রিক টন এবং প্রকল্প এলাকায় ১৮৩৪ একর জমিতে (৫৬৯৪১ মেট্রিক টন) মাছ উৎপাদিত হয়। এই সবই আমরা হারাবো।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১০০ একরের একটি ছাইয়ের পুকুরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। অ্যাশ পন্ড থেকে , ছাই মিশ্রিত পানি মাটির নীচে ও আশাপাশের জলাভূমিতে মিশে বিষাক্ত ভারী রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে মারাত্মক দূষণ ঘটাবে।
PRESENT DANGER:File photograph of the ash slurry overflow from the NTPC's Simhadri plant in Devada village in Vishakhapatnam in June 2010. The MoEF panel has cited proximity to habitation to reject the NTPC's Madhya Pradesh project.
সরকারি পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ)অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানী করতে হবে। আমাদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সুন্দর বনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-
কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ , কয়লা সহ অন্যান্য রাসায়নিক ও ভারী বস্তু লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে;
রাতে জাহাজ চলার সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবন চক্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ।
কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে রাসায়নিক পদার্থ,কয়লার গুঁড়া, ভাঙা টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে;
চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে;
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পানি আসবে সংলগ্ন পশুর নদী থেকে। এ জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারীদের লবণাক্তমুক্তকরণ প্ল্যান্ট বসানোর প্রয়োজন পড়বে। পশুর নদী এমনিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে এ নদী থেকে এই হারেপানি প্ল্যান্টে টেনে নিলে সে ক্ষেত্রে নদীর উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সেচ কাজ বিঘ্নিত হবে।
তথ্যসুত্রঃইআইএ রিপোর্ট।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে! এটা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা দুমত পোষণ করেছেন তাঁদের মতে সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আসলে দূরত্ব ৯ কিলোমিটার।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এলাকার পানি, বাতাস ও মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এলাকার পানি শতভাগ, বাতাস শতকরা নববই ভাগ এবং মাটি শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ দূষিত হয়ে পড়বে। মাটির লবণাক্ততা এবং বাতাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যমান স্বাভাবিক অবস্থায় পানি ও মাটির ক্ষেত্রে দু’দশক পরে এই দূষণ হতে পারে শতকরা ২০ ভাগ করে এবং বাতাসের ক্ষেত্রে শতকরা ১৫ ভাগ মাত্র।
কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষুদ্রকণিকা, কার্বন মনো-অক্সাইড, মারকারি, আর্সেনিক, সীসা, ক্যাডমিয়ামসহ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়। ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ও উৎপন্ন হবে ।
ইআইএ রিপোর্টে এসম্পর্কে বলা হয়েছে:
Another major health risk involves cooling tower. With world experience, different studies suggest that bacterial contamination of cooling tower may cause outbreak of pneumonia in the surrounding community. Aerosol dispersed from the cooling tower favour growth of bacteria causing pneumonia
বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু তা কি দেশের স্বার্থের বিনিময়ে? সুন্দরবন ধ্বংস করা একটা অযাচিত সিদ্ধান্ত। অপ্রয়োজনীয় ইস্যু নিয়ে প্রতিদিন হরতাল ডাকে কত দল অথচ প্রিয় সুন্দরবনের জন্য একদিন আন্দোলন করার মানসিকতা কারো নাই!! আমাদের জাতীয় স্বার্থে রুখে দাড়াতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে একটি প্রকল্প থামিয়ে দেয়ার সাথে সাথে একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখাও আমাদের কর্তব্য, কারণ বিদ্যুতের চাহিদাও আমাদের প্রকট। বিদ্যুৎ চাই তবে সুন্দরবনের ক্ষতি করে নয়।
সুন্দরবন রক্ষার্থে, রামপাল তাপবিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলের লক্ষে আমরা একটি আন্দোলনের ডাক দিয়েছি, আপনারাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় সহযাত্রী হবেন। এই কামনায় যোগ দিন
তথ্যসুত্রঃ ই আই এ রিপোর্ট।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও।
সুন্দরবন বিষয়ে বিশেষজ্ঞগন।
রামপাল বিদুৎ কেন্দ্র নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
প্রকৌশলী কল্লোল মুস্তফা
বিভিন্ন ব্লগ
http://www.thehindu.com' target='_blank' >thehindu.com