ব্যাগপ্যাকটা কাঁধে তুলে নিলাম। রাতুলকে ছাড়া দূরে কোথাও ট্যুরে যাচ্ছি ভাবতে ভাল লাগছে না আমার। আমি রাতুলের কাঁধে একটা হাত রাখলাম, “তুই আমাদের সাথে আসতে পারলে ভাল লাগত দোস্ত!”
রাতুল বিষণ্ণ মুখে বলল, “আম্মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে না পড়লে অবশ্যই আসতাম”!
আমি একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বললাম, “আনটি ভাল হয়ে যাবে দোস্ত। আমি দোয়া করি ওনার জন্য। উঠে পড়ি তাহলে বাসে?”
রাতুল হাসল, “হ্যা যা। শুধু একটা কথা মনে রাখিস। প্রবালের দিক থেকে সাবধান! ও কিন্তু আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই ট্যুরে গিয়ে লিজাকে পটিয়ে ফেলবে”।
আমিও হাসলাম। বললাম, “চিন্তা করিস না, প্রবাল ফাজলামি করেছে। আর তাছাড়া ওকে আমি লিজার কাছে ঘেঁষতেই দেবনা”।
রাতুল আমার পিঠ চাপড়ে দিল, “বেষ্ট অফ লাক বন্ধু!”
বাসে উঠে পড়লাম। দুই একটা রো পরেই দেখলাম লিজা আর স্নিগ্ধা পাশাপাশি বসে ছিল। তাদের পেছনের সিটে প্রবাল বসে আছে, প্রবালের পাশের সিটটা খালি। স্নিগ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করল। আমি এগিয়ে গেলাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজহার, তুই লিজার পাশে বসে যা। আমি পিছনে যাচ্ছি। প্রবালের সাথে কিছু জরুরী কথা আছে আমার”।
স্নিগ্ধা উঠে যেতেই আমি মাথার ওপরের কম্পারটমেন্টে ব্যাগটা রেখে বসে পড়লাম লিজার পাশে। স্নিগ্ধা হচ্ছে আমার ক্লাসমেট প্লাস বেষ্ট ফ্রেন্ডদের একজন। লিজা তার কাজিন। বয়সে সে আমাদের দুই এক বছরের ছোট হতে পারে।
শেষ মুহূর্তে আর একটা ছেলে দৌড়ে এসে বাসে উঠল। এর নাম কমল। ছেলেটার চরিত্র খুব খারাপ। এমন কোন বাজে কাজ নাই যা সে করে না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় চোখ করে লিজাকে দেখছিল, তার দু চোখ জুড়ে লালসার সুস্পষ্ট প্রকাশ। আমার মেজাজ খারাপ হল। মনের ভেতর প্রচণ্ড ক্রোধ জেগে উঠল, ইচ্ছে হচ্ছিল একটা ভারী পাথর দিয়ে ওর মুখটা থেতলে দেই অথবা একটা চাকু হাতে নিয়ে ছেলেটার চোখদুটো উপড়ে ফেলি। হারামির বাচ্চার সাহস কত! লিজার দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকায়!
বাস ছেঁড়ে দিয়েছে। সমুদ্র ভ্রমনে যাচ্ছি আমরা। সমুদ্র আমার কখনোই ভাল লাগেনা। বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য মনে হয়। আমি নিজেকে খুব ভালবাসি, নিজেকে ছোট ভাবতে ভাল লাগেনা। নিজের রিক্ততাটুকু যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, খারাপ তো একটু লাগেই।
লিজা তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। চাঁদের আলোয় ব্যস্ত সড়ক দেখছে। অসম্ভব সুন্দর একটা চাঁদ আকাশে। এই চাঁদ না দেখা মানে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য অজানা থেকে যাওয়া। শরৎ এর পরিস্কার আকাশে ঝকঝকে রুপালী আলো ছড়িয়ে দেয়া বিশাল এক চাঁদ। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে মনটা অন্যরকম এক আনন্দে ভরে যায়। মনে হচ্ছে আজ পূর্ন পূর্নিমা হবে। কিন্তু চাঁদ দেখার আগ্রহ আমার হচ্ছেনা। আমি দেখছি লিজাকে। আমার চোখদুটোর সকল ব্যস্ততা গিয়ে ঠেকেছে লিজার অপরুপ মুখশ্রীতে। চাঁদের আর কি প্রয়োজন? সমস্ত পৃথিবীতে জ্যোৎস্না ছড়াতে এই মেয়েটির এক ফালি হাসিই যথেষ্ট।
লিজার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বন্ধুদের এক আড্ডার আসরে। স্নিগ্ধার সাথে দেখা করতে সে আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিল। সে সময়টা আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ম্যারাথন আড্ডা দিতাম। কোন নির্দিষ্ট বিষয় থাকত না আলাপের। এই কথা বলছি খেলা নিয়ে, হঠাৎ চলে যাই রাজনীতিতে, আবার ফিরে আসি মুভি বিষয়ক আলোচনায়। স্নিগ্ধা লিজাকে এনে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। প্রথম দেখাতেই মেয়েটির রুপ সৌন্দর্যে আমি পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষন নানা বিষয়ে কথা বললাম তার সাথে। অল্প কিছুক্ষণ বাদেই আমরা আবিস্কার করলাম পরস্পরকে “তুমি” করে বলছি। কথায় কথায় আমাদের দুজনের বেশ কিছু কমন ইন্টারেস্ট এর বিষয় উঠে এল।
সেদিনের পর থেকে লিজা প্রায়ই আসত আমাদের সাথে আড্ডা দিতে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় আমার সাথেই কথা বলত। আড্ডার বাইরে মাঝে মাঝে ফোনে, ফেসবুকে কথা হত দুজনের। কিছুদিন বাদেই বন্ধুরা আমাকে আর লিজাকে জড়িয়ে মজা করতে শুরু করল। আমি প্রথমদিকে একটু আপত্তি করতাম কিন্তু লিজা দেখলাম বিষয়টাতে মজা পাচ্ছে। তাই আমিও আর বাঁধা দেইনি। একটা সময় অনুভব করলাম আই এম ইন লাভ উইথ হার। বন্ধুদের কাছে বিষয়টা প্রকাশ করতেই তারা উঠে পড়ে লাগল আমাদের কাপল বানিয়ে দেয়ার জন্য।
এখন পোস্ট গ্রাজুয়েশনের শেষ দিকে আমরা। কেবল ফাইনাল পরীক্ষা বাকি। ডিপার্টমেন্ট থেকে হঠাৎ কক্সবাজার- সেন্ট মারটিন ট্যুরে যাওয়ার কথা উঠল। বন্ধুরা সবাই মিলে স্নিগ্ধাকে ধরল যেন গেস্ট হিসেবে যেন এই ট্যুরে আমাদের সাথে লিজাকে যেতে রাজি করায়। উদ্দেশ্য একটাই- ট্যুরে গিয়ে আমি লিজার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাব, একান্তে কথা বলার সুযোগ হবে! লিজাকে রাজি করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। দুই এক কথাতেই সে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
****
আধাঘণ্টার মত কেটে গেছে। একটা কথাও হয়নি দুজনের মাঝে। লিজার দৃষ্টি অনুসরন করে মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকাচ্ছি আমি আর ভাবছি কি বলে লিজার সাথে কথা শুরু করা যায়। একবার আড্ডা জমিয়ে ফেলতে পারলেই হবে। তারপর যা বলার লিজাই বলবে, আমাকে আর কিছু করতে হবেনা।
লিজা হঠাৎ ইয়ারফোন বের করে কানে লাগাল। একটা মানুষ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকলে তার পাশে বসে আড্ডা জমানো সম্ভব হয়না। আমি চেষ্টা করলাম তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে। “লিজা দেখ! কি সুন্দর চাঁদ! এত চমৎকার জ্যোৎস্না আগে কখনো দেখেছ?”
লিজা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে চাঁদের দিকে তাকাল। একবার শুধু বলল, “সুন্দর”। তারপর আবার ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গান শোনায় মনযোগী হল।
এভাবে তো হয়না! মনে হয়না আজ প্রকৃতি দেখার প্রতি তার কোন আগ্রহ আছে। বেশ মুডি রুপ ধারন করেছে আজ। অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। এই মেয়েকে জীবনসঙ্গী করলে ঠেলা আছে, মুডি মেয়েদের মন রক্ষা করে চলা সহজ ব্যাপার না।
অবশ্য জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার পছন্দ একজন সাদাসিধে বাঙ্গালী কন্যা। সারাদিনের অফিস শেষে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরব সে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। মেয়েটির কপালে জমে থাকবে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে আমার হাত থেকে অফিসের ফাইলটা নিয়ে সুন্দর যায়গায় রাখবে, আমাকে জুতো খুলতে সাহায্য করবে, বেসিনে হাত মুখ ধোয়ার সময় এগিয়ে দেবে পরিস্কার তোয়ালে। রাতে খাবার সময় হঠাৎ লোডসেডিং হলে হাত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করবে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন করবে, “আজ অফিসে অনেক কাজ ছিল তাইনা?” “তোমার মুখটা অমন শুকিয়ে গেছে কেন?” “বস কি দুর্ব্যবহার করেছে নাকি?” “রাস্তায় আসার সময় কি প্রচুর জ্যাম ছিল?” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ডাল-ভাত মাখিয়ে মুখে লোকমা তোলার ফাঁকে হঠাৎ খেয়াল হতেই জিজ্ঞেস করব, “তুমি খেয়েছ তো?” মেয়েটি ঈষৎ হেসে বলবে, “তুমি খাওয়ার পর খাব”। আমি আমার প্লেটের মাখানো ভাত থেকে তাকে নিজ হাতে দুই এক লোকমা খাইয়ে দেব।
কিন্তু লিজা মোটেও তেমন মেয়ে নয়। তার হাতে গৃহস্থালি কাজ মানায় না। ওর জন্ম হয়েছে সাজ গোঁজ করে সারাদিন পুতুলের মত বসে থাকার জন্য। যে ঘরে যাবে সে ঘরে সূর্যের আলোর প্রয়োজন হবেনা, লিজা তার রুপের আলোয় আলোকিত করে রাখবে।
অবশ্য লিজা ঘরে থাকার মত মেয়েও না। সে খুব বেশি ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড। ভাল একটা জব করার ইচ্ছে তার। মেয়েটি কিন্তু অভিনয়ে নামলেও খারাপ করবে না। আকর্ষণীয় চেহারা, ফিগার, গলার ভয়েজ সব মিলিয়ে খুব দ্রুতই আসন গেঁড়ে বসতে পারবে মিডিয়া ভুবনে।
শুধু তাই নয়। লিজা ভাল গান গায়, নাচেও পারদর্শী। আমি জানি এত গুনে গুণান্বিত একটা মেয়েকে বিয়ে করে আমি ঘরের বউ করে রাখতে পারব না। তারপরও আমি তাকে ভালবাসি। নিজের যত পছন্দ সব ত্যাগ করতে রাজি আছি আমি, তবু এই মেয়েকে আমার চাইই চাই।
লিজা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। আমি জানি রাজনৈতিক বিষয়গুলো তাকে খুব ভাবায়। ফেসবুকে একটা ২০,০০০ লাইক সমৃদ্ধ পেইজ চালায় সে, যেখানে নিয়মিত সে বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্র নিয়ে সে আপডেট দেয়। রাজনীতি নিয়ে তার সাথে কি কথা বলা যায় ভাবছি তখন পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “হায় লিজা!”
আমি তাকিয়ে দেখলাম প্রবাল দাঁড়িয়ে আছে। লিজাও দুষ্টামির ভান করে বলল, “হায় প্রবাল”।
প্রবাল হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাসের সামনের দিকে হেঁটে গেল। সম্ভবত কারো সাথে কথা বলবে। আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম লিজার সাথে। “তোর কি মনে হয় লিজা? সরকার পদ্মা ব্রিজ নিয়ে যা করল তার পেছনে কি কোন কূটনৈতিক চাল আছে?”
লিজা ঠোঁট উল্টে বলল, “তার আমি কি জানি?”
আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গী করে বললাম, “কে বলছে একথা? রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যে জ্ঞানধর্মী বক্তৃতা দেয় সে!”
লিজা হাল্কা একটু হাসল।
আমি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ধরে রাখতে চাইলাম, “আচ্ছা ওটা বাদ দেও। কিন্তু বিরোধী দল এই যে দুই বেলা কোন কারন ছাড়াই লাগাতার কর্মসূচি দিচ্ছে, অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তেমন কোন কথা বলছে না। তোমার কি মনে হয়? এর পিছনে কি কারন থাকতে পারে??”
“সেটা তাদের মর্জি, আমরা কি বলব?”
“কিন্তু তোমার কি মনে হয়না এখানে ভারতের কোন চাল আছে?”
“থাকলে থাকতে পারে”।
আমি হয়ত আরও কিছু বলতাম কিন্তু দেখলাম যে প্রবাল ফিরে আসছে। আমাদের সিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। গালে হাত দিয়ে লিজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিজা ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রবালকে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?”
প্রবাল শুরু করল তার চিরায়ত ফ্লরটিং। “দেখি”।
“কি দেখ?”
“আল্লাহতালার অপরুপ সৃষ্টি”।
রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। কিন্তু লিজার মুখে অদ্ভুত সন্দর একটা হাসি ফুটে উঠল। এমন হাসি কি সে কখনো আমার সামনে হেসেছে?
আরও কিছুক্ষন চলল তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য বিনিময়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। লিজা আজ আমাকে একটু এভয়েড করছে মনে হয়! কারনটা কি?
আরও ঘণ্টা খানেক কেটে গেল। লিজার সাথে কথা বলার সুযোগ মেলেনি। আমি আবার সুযোগ খুজছিলাম কীভাবে কথা বলা যায়! বাস তখন কাচপুর ব্রিজের ওপর। নিচে নদি দেখা যাচ্ছে। আমি না জানার ভান করে লিজাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা এইটা কোন ব্রিজ”।
লিজা হয়ত শুনতে পায়নি। সে কান থেকে ইয়ারফন খুলে জিজ্ঞেস করল, “কি বললে?”
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কোন ব্রিজ?”
লিজা বলল, “তুমি এইটা চিন না!”
আমি বললাম, “ঠিক চিনছি না”।
“আজব ব্যাপার! এইটা কাচপুর ব্রিজ। আগে কখনো আসনি এই পথে?”
“ওহ! মনে পড়েছে”।
আমি মনে মনে হাসলাম। মিথ্যে বলে লাভ হয়েছে, গান শোনা থেকে মনোযোগ সরান গেছে। আমি বলে বসলাম, “আচ্ছা পাকিস্তান এইটা কি করল বলত?”
“কি করেছে?”
“টেস্টে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেল! একদম ফালতু হয়ে গেছে দলটা”।
“এটা কোন বিষয় না। খেলায় হারজিত থাকেই”। বলেই আবার ইয়ারফোন কানে গুজে নিল সে।
আমি অবাক হলাম। পাকিস্তান ক্রিকেট দল নিয়ে কেউ বাজে কিছু বললেই লিজা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। এমনিতে আমি পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে একদমই পছন্দ করিনা, কিন্তু লিজার সামনে কিছু বলিনা। অথচ আজ ফালতু বলার পরও সে গায়ে মাখল না!
খুব বেশি খারাপ লাগছে আমার। লিজা আমাকে এভাবে অবহেলা কেন করছে আজ? সে কি টের পেয়েছে যে আমি তাকে নিয়ে ভাবছি? তাতে তো লিজার খুশি হওয়ার কথা। আমাকে অ্যাভয়েড করছে কীভাবে সে? আমি তো ফেলনা নই। লিজার মত অন্তত ১০টা মেয়ে আমার পেছনে ঘোরে। একটু চেষ্টা করলেই এদের সাথে প্রেম ভালবাসা করা, এমনকি বিছানায় নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যাটা হল- ওরা লিজার মত কিন্তু লিজা নয়। আমার লিজাকেই প্রয়োজন, লিজার মত কাউকে দিয়ে আমার চলবে না।
***
কতটা সময় কেটে গেছে জানিনা। আমার ঘুম ঘুম লাগছিল। একটা ঘোরলাগা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন নার্ভাস ব্রেকডাউনের মত একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। লিজার ক্রমাগত অবহেলায় মনটা বিষিয়ে গেছে। ভাল লাগছে না কিছুতেই। এর মাঝে কমলকে কয়েকবার সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি। প্রতিবার লোলুপ দৃষ্টির আক্রমন বজায় ছিল। লিজা যে বিষয়টি বোঝেনি তা নয়, নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন সে। কিন্তু জগতে চলতে গেলে সুন্দরী মেয়েদের কিছু কিছু সময় না বোঝার ভান করতে হয়।
বাসটা কুমিল্লা পৌঁছেছে। একটা ফিলিং স্টেশনে বাস থামানো হল গ্যাস নেওয়ার জন্য। আবিদ ভাই ঘোষণা দেওয়ার সুরে বললেন, “এখানে একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে তোমরা সবাই নেমে কিছু খেয়ে নিতে পার, আমরা কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি নিচ্ছি এখানে”।
সবাই একে একে বাস থেকে নামতে থাকল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, “নামবি না?”
“তোরা নাম আমার ঘুম পাচ্ছে। একটু পরে নামি”।
আমি আরও কিছুক্ষন পর একটা ঘোরের মধ্যেই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ওরা তিনজন এক কোনায় একটা টেবিল দখল করে বসে ছিল। আমি তাদের পাশে যায়গা করে নিয়ে বসে পড়লাম। প্রবাল কিছু একটা অর্ডার দিল। কি খেলাম ভাল করে লক্ষ করছিনা। ওরা অনেক বিষয়ে হাসি তামাশা করল। আমি কিছু শুনলাম, কিছু শুনলাম না। খাওয়া শেষে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে ভাল করে পানি দিলাম। তারপর যেন একটু চেতনা ফিরে এল।
বাসে এসে উঠার পর আমি লিজার পাশে বসতে যাব, তখন লিজা বলে উঠল, “তুমি না, তুমি না। আমি প্রবালের পাশে বসব। প্রবালের সাথে আমার অনেক কথা আছে। তুমি পিছনে স্নিগ্ধার সাথে গিয়ে বস”।
আমি পিছনে এসে স্নিগ্ধার পাশে বসলাম। এর মধ্যে একটা খবর এল যে কমল নামের ছেলেটা বাসে ওঠেনি। পুরো ফিলিং ষ্টেশনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার সন্ধান মিলল না। কমল নেশা করে, কারো বুঝতে অসুবিধা হলনা যে সুযোগ পেয়ে সে কোথাও গিয়ে নেশা টেশা করে পড়ে আছে। মিনিট দশেক অপেক্ষা করা হল তার জন্য। তারপর আবিদ ভাই বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে ছেড়ে দিতে বললেন। কমলের জন্য কারো সিমপ্যাথি নেই। বরং সে সাথে না থাকলেই সবাই খুশি।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সামনের সিটের চিল্লাচিল্লিতে কাল ঝালাপালা হয়ে গেল। প্রবাল যে এত কথা বলতে পারে সে সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়াই ছিলনা। ক্লাসের মধ্যে সে সবচেয়ে স্বল্পভাষী ছেলে হিসেবে পরিচিত। অথচ লিজার সাথে দুই মিনিটেই জমিয়ে ফেলেছে। রাজনীতি, খেলাধুলা, মুভি, গ্রামের বাড়ির অভিজ্ঞতা, ভ্রমনের অভিজ্ঞতা- এমন কিছু নেই যা নিয়ে তারা কথা বলছে না। প্রবাল মাঝে মধ্যে ফাজলামি করে বলে সে লিজাকে পটিয়ে ফেলবে। কিন্তু প্রবাল আমার ভাল বন্ধু এবং সে লিজার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট সম্পর্কে জানে। প্রবালের কথা সিরিয়াসলি নেয়ার কোন কারন দেখিনা। কিন্তু ওদের এই উদ্যমে ভরপুর আড্ডা আমাকে একমুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছেনা।
আমি স্নিগ্ধার একটা হাত ধরলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইটস নট ওর্কিং”।
স্নিগ্ধা এক হাত বাড়িয়ে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “ইট উইল ওয়র্ক। ডোন্ট গিভ আপ! কিপ ট্রাইং!”
আমি ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বন্ধ করলাম। আকাশ থেকে থোকায় থোকায় কাঁচা সোনার মত জ্যোৎস্না গলে পড়ছে, অদ্ভুত এক হলদে আলোর বন্যায় ডুবে যাচ্ছে দুপাশের গাছগুলো। এ রাতে প্রিয় মানুষের কথা ভাবতে ভাবেতে ঘুমিয়ে পড়তে খুব সাধ জাগে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নামে না। কানের পাস দিয়ে ছুটে চলা বাতাস ফিসফিস করে গল্প বলে যাচ্ছে। কিসের গল্প কে জানে? শব্দগুলো খুব বেশি দুর্বোধ্য। আমার যদি বাতাসের আর্জি বোঝার সাধ্য থাকত, হয়ত বুঝতে পারতাম কি নিদারুন ব্যাথা নিয়ে তারা অনবরত ছুটে চলে!
***
প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় কেটে গেছে। এখনও অন্ধকার চারিদিকে কিন্তু ভোরের সূর্য উকি দিতে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। বাস পৌঁছে গেছে চিটাগং। আবার একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাস থামল। এটা আগেরটার থেকে অনেক বড় রেস্টুরেন্ট। আর একেবারে হাইওয়ের পাশে। ধারে কাছে কোন জনবসতি নেই। রাস্তার দু ধার ঘন গাছ পালায় ঢাকা।
একে একে সবাই নামলাম আবার। স্নিগ্ধা, প্রবাল আর লিজা গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। আমি ঢুকলাম না। লিজা আর প্রবালের এই পাশাপাশি হাটা আমার ভাল লাগছে না দেখতে। একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। মাস খানেক হয়ে গেছে সিগারেট খাওয়া ছেড়েছি। এই মুহূর্তে একটা না খেলেই নয়।
এই পৃথিবী হচ্ছে ধূমপায়ীদের জন্য একটি আদর্শ স্বর্গভূমি। যদি ধুমপান করার ইচ্ছে জাগে তাহলে সাহারা মরুভূমি, আমাজন জঙ্গল কিংবা এন্টার্কটিকায় গেলেও একটা ব্যাবস্থা হয়েই যাবে। রেস্টুরেন্টের পাশে একটা ছোট্ট টঙ দোকান খুঁজে পেলাম। একটা ব্যানসন কিনে নিয়ে ফিলিং স্টেশন থেকে হাটতে হাটতে একটু দূরে চলে এলাম। সিগারেট ছাড়লেও অভ্যাসবশত লাইটারটা সাথেই রাখি। সিগারেট ধরালাম। হাটছি আমি রাস্তা ধরে।
রাতের গভিরতা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু একটু কাঁপছি আমি। শীতের আগমনী সংগীত ঠোঁটে নিয়ে নীরব মুখরতায় একে এক ঝরে পড়ছে শিশির কণা। এই অপূর্ব আয়োজনের মাঝে আমি যেন নিস্তব্ধ রাতের বুক ছিঁড়ে জেগে উঠা একটি মানুষ। মাঝে মাঝে দুই একটা দূরপাল্লার গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়লাম। রাস্তার দুই পাশ ঘন দুর্বায় ঢাকা। আমি ইচ্ছে করেই ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি, সিগারেট ফুঁকছি আর স্যান্ডেলের ফাক গলে ঘাসের ডগায় তির তির করে জমে উঠা কুয়াশার আদুরে ষ্পর্শ নিচ্ছি। অনেক দিন পরে কবিতা লিখতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। আচ্ছা! কবিতা তো ভালই লিখতাম। ছেড়ে দিয়েছিলাম কেন?
হঠাৎ খেয়াল হল রাস্তার ধারে একটা ঝোপের মত অংশে কিছু জোনাকি পোকা খেলা করছে। তারা উড়তে উড়তে মাঝে মাঝে পরস্পরের কাছে চলে আসছে আবার এক ঝটকায় দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু খুব বেশি দূরে যাচ্ছেনা, ফিরে আসছে আবার খেলার মঞ্চে। লিজা একবার বলেছিল সে কখনো সামনা সামনি জোনাকি দেখেনি। তার খুব শখ জীবনে একবার জোনাকি দেখবে। আমি হাত থেকে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দ্রুত পা চালালাম। ফিরে যাচ্ছি রেস্টুরেন্টের দিকে। লিজাকে আজ জোনাকি দেখাব। তার জীবনের খুব বড় একটা শখ পুরন করব আমি।
লিজাকে রেস্টুরেন্টে পাওয়া গেল প্রবালের পাশে। স্নিগ্ধাকে কোথাও দেখলাম না। প্রবাল লিজার হাতটা উল্টে ধরে দেখছে আর কিছু একটা বলছে। যদিও জানি প্রবাল টুক টাক হাত দেখতে পারে, জ্যোতিষী বিদ্যা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তারপরও রাগে আমার সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। কিন্তু চেহারায় শান্ত একটা ভাব ধরে রাখলাম।
লিজার কাছে এসে বললাম, “লিজা তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাব যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না”।
লিজা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “কি জিনিস?”
“সেটা দেখলেই বুঝবে। সারপ্রাইজ। উঠে এস দেখাব তোমাকে”।
“কোথায়?”
“ঐ তো, রাস্তার উলটা পাশে। গেলেই দেখবে”।
“চল সবাই মিলে যাই”। লিজা বলে উঠল।
লিজা “সবাই” বলতে আসলে প্রবালের কথা বুঝিয়েছে সেটা বুঝতে আমার সমস্যা হলনা। আমার চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল। বললাম, “সবাই গেলে সারপ্রাইজটা আর থাকবে না। এক্ষুনি এস, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
লিজা মনে হল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। প্রবালের হয়ত সাথে আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমার সামনে সে কথা বলার সাহস তার নেই।
এত রাতে আমার সাথে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে লিজা একটু অস্বস্তি বোধ করছে। অনেকটা পথ হেঁটে এসে তাকে যেখানটায় জোনাকি দেখেছি সেখানে নিয়ে এলাম। কোথায় জোনাকি? ঝোপটা এক্কেবারে শুন্য মনে হচ্ছে। এদিকে ভোর হতে শুরু করেছে। লিজা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “কোথায় তোমার সারপ্রাইজ”?
আমি বেকুবের মত তাকিয়ে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিও আমার সাথে রসিকতা শুরু করল। নাকি আমি একটু আগে ভুল দেখেছি? “এখানেই তো ছিল!”
লিজা চলে যেতে পা বাড়াচ্ছে, আমি ঝোপটা হাত দিয়ে নাড়া দিলাম। সাথে সাথে বেরিয়ে এল একগুচ্ছ জোনাকি পোকা। লিজা প্রথমে ছোট আকারের মিটি মিটি জ্বলতে ও নিভতে থাকা আলো দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবিষ্কার করল ওগুলো জোনাকি। লিজার চোখমুখ থেকে আনন্দের স্ফুরণ। সে হাত বাড়িয়ে জোনাকি ধরার চেষ্টা করতে থাকল। ভোর হব হব করছে, রাতের আকাশ থেকে কালিমা মুছে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু রাতজাগা জোনাকি। পায়ের নিচে মনে হচ্ছে নব কুয়াশার আলিঙ্গন পেয়ে যৌবনবতী হয়ে উঠেছে ঘাসগুলো। টের পাচ্ছি শিশিরভেজা ঘাসের ষ্পর্শে আন্দোলিত হচ্ছে আমার চেতনার রুদ্ধ বাতায়ন। আমি মুহূর্তটি চিনলাম। এটাই একমাত্র সুযোগ মনের ভেতর জমে থাকা কথাটি বলে দেয়ার। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম, “তোমাকে ভালবাসি লিজা”!
লিজা সম্ভবত কথাটি বুঝতে পারেনি। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে। আমি আবার উচ্চারন করলাম, “আমি তোমাকে ভালবাসি লিজা। অনেক অনেক বেশি ভালবাসি”।
লিজা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। ওকি এখন আবেগে কেঁদে ফেলবে?
একটা রোম্যান্টিক মুভিতে দেখেছিলাম ছেলেটি একগুচ্ছ লাল গোলাপ এনে মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “আমি তোমায় ভালবাসি”।
মেয়েটি সে কথা শুনে আবেগে কেঁদে ফেলে।
মেয়েটির কান্না দেখে ছেলেটি তার দেয়া ফুলগুলো ফিরিয়ে নেয়। বলে, “আমি তোমাকে আর কখনো ভালবাসার কথা বলব না। তোমার চোখের অশ্রুর কারন আমি হতে চাইনা”।
মেয়েটি কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমি সারাজীবন তোমার মুখে এভাবে ভালবাসার কথা শুনে কাঁদতে চাই”।
তারপর তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল।
একটা সুখের দৃশ্য, অথচ পাত্র পাত্রীর চোখে কান্নার জল। জীবনে আমি কখনো এত চমৎকার রোম্যান্টিক দৃশ্য দেখিনি। আমার মত কাঠখোট্টা ছেলেও আবেগে কেঁদে ফেলেছিল।
লিজা অবশ্য কাঁদল না। সে শুধু বলল, “তুমি কি ঠাট্টা করছ আজহার?”
আমি এইরকম একটা প্রশ্ন আসবে বুঝিনি। বললাম, “এক বর্ণও ঠাট্টা নয়, তোমাকে আমি ভালবাসি। অনেক দিন ধরে কথাটা বলার সুযোগ খুজছিলাম। এই রকম মুহূর্ত আর আসবে কিনা আমি জানিনা, তাই বলে দিলাম”।
“কিন্তু আমি তোমাকে সব সময় বন্ধু ভেবেছি আজহার”।
“আমি জানি। কিন্তু আমি চাই বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু হতে”।
“সেটা সম্ভব নয়”।
“কেন সম্ভব নয় লিজা?” আমার কণ্ঠের উত্তাপটুকু স্পষ্ট টের পাওয়া গেল।
লিজা একটু ভয়ে ভয়ে তাকাল আমার দিকে। বলল, “আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি”।
এক মুহূর্তে আমার ভেতরকার কাব্যিক অনুভূতিগুলো শূন্যে মিলিয়ে গেল। কবির স্থানে যায়গা করে নিয়েছে এক আদিম পশু। আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম যেন, “কে সে? ঐ বেজন্মার বাচ্চা প্রবাল?”
“ছিঃ আজহার। তুমি এত নীচ!”
মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার। কি বলছি নিজেও জানিনা। “খুন করে ফেলব আমি জানোয়ারের বাচ্চাকে”।
“আজহার! আমি তোমাকে একটা ভাল ছেলে বলে জানতাম”।
আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। সমস্ত শরীর কাঁপছে প্রচণ্ড রাগে। এই মুহূর্তে আমার মাঝে ক্রোধের যে আগুন জ্বলে উঠেছে তার সামান্য অংশই সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। লিজা ভয় পেয়ে গেল। “আমি রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি” বলে উলটো ঘুরে পা বাড়াল।
আমি বললাম, “এক চুলও এগোবে না লিজা! আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে”।
লিজার মধ্যে তখন আতঙ্ক ভর করেছে তখন। সে আস্তে করে বলল, “কি প্রশ্ন?”
“সত্যি করে বল, বাসে তুমি আমাকে এভয়েড করছিলে কেন? এটা কি প্রবাল শিখিয়ে দিয়েছিল?”
“না। আমার মনে হচ্ছিল তুমি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছ। আর যেন দুর্বল না হও সেজন্য অমনটা করেছি আমি”।
“আর এতদিন আমার সাথে বলা কথা? হাসি আনন্দের মুহূর্ত? ছোট ছোট ব্যাথাগুলো শেয়ার করা? এগুলো কেন করেছিলে?”
“বন্ধু ভেবে করেছি। তুমি যে এত কিছু ভেবে বসবে আমি বুঝিনি”। লিজা আবার পা বাড়াল।
আমি তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। রাগেই এই পর্যায়ে আমার পক্ষে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয় না। “দাঁড়াও লিজা। আমার ভালবাসার মূল্য তোমাকে দিতে হবে লিজা। এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই। এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে তুমি চলে যেতে পারবে না। ঐ বেঈমান প্রবালকে আমি এত সহজে জিতে যেতে দেবনা”।
লিজা হাটতে থাকল।
“লিজা দাঁড়াও বলছি”!
লিজা এবার দৌড় দিল।
পিছন থেকে আমি চিৎকার করলাম, “লিজা দাঁড়াও, আমার কথা এখনও শেষ হয়ে যায়নি”!
হঠাৎ বিপত্তিটা ঘটল। লিজা শিশির ভেজা ঘাসে পা পিছলে পড়ে গেল। রাস্তার পাশে গভীর খাঁদ। লিজা গড়াতে গড়াতে চলে যাচ্ছে খাঁদের গভীরে...
***
পরের একটা ঘণ্টা কীভাবে কেটেছে তা বিষদ বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লিজাকে কোনমতে খাঁদ থেকে তুলে আনলাম। সে তখন অচেতন, সম্ভবত পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। এই অবস্থায় বাসের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিনা। ওখানে গেলে সবাই কিছু একটা সন্দেহ করে বসতে পারে। আমি দ্রুত তার নিস্তেজ দেহটা পাজকলা করে তুলে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি থামালাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যে একটা প্রাইভেট কার পাওয়া গেল, একজন মানুষ ড্রাইভ করে আসছিল। গাড়িটা থামিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতেই আমাদের তিনি নিয়ে এলেন একটা ফার্মেসি কাম ক্লিনিকে। জায়গাটা কোথায় আমি সঠিক বলতে পারব না।
সেখানে নিয়ে যেতেই ওরা লিজাকে একটা বেডে শুইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। তাড়াহুড়োয় লিজার হ্যান্ড ব্যাগটা আনা হয়নি, রাস্তায় পড়ে আছে। আমার মোবাইলেও চার্জ নেই যে কারো সাথে যোগাযোগ করব। বাসের কাছে ফিরে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। লিজাকে এখানে রেখে তো আমি চলে যেতে পারিনা। কিন্তু বাস তো খুব বেশিক্ষন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না। বড়জোর এক ঘণ্টা! এর মধ্যে যদি লিজার জ্ঞান না ফেরে তাহলে আমরা বাসের কাছে যেতে পারব না। ওরা বাস নিয়ে চলে যাবে! কমলের জন্য তো মাত্র ১০ মিনিট ছিল। সিডিউল খুব টাইট। বাসটা এখন গিয়ে কক্সবাজারে হোটেল শৈবালে থাকবে। ওখানে একদিন থাকার পুরো টিম সেন্ট মারটিনের দিকে যাত্রা করবে।
এর মধ্যে মোবাইলের চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম, স্নিগ্ধার সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে বুঝিয়ে বললাম ঘটনাটা, শুধু আমার প্রপোজ করার অংশটা বাদে। জানলাম বাস রওনা দিয়েছে আমাদের ফেলে। আমি কথা দিলাম লিজার জ্ঞান ফিরলে যত দ্রুত সম্ভব অন্য বাসে করে আমরা হোটেল শৈবালে পৌঁছে যাব।
লিজার জ্ঞান ফিরে এল ঘণ্টা তিনেক পর। জ্ঞান ফেরার পর সে আমার সাথে আর কোন কথাই বলল না আর। তাকে বুঝিয়ে বললাম কি ঘটেছে। অন্য একটা বাসে চড়ে আমরা কক্সবাজার গেলাম। সেখান থেকে রিক্সা করে রওনা দিলাম হটেল শৈবালের দিকে। সারাটা পথ লিজার সাথে আর একটি কথাও বলিনি আমি। মেয়েটির কাছ থেকে একটু আগেই প্রত্তাখ্যাত হয়েছি আমি। কথা বলব কোন মুখে?
ভালবাসার মানুষের সামনে "ভালবাসি" শব্দটি উচ্চারনের পর যারা প্রত্যাখ্যাত হয়, তাদেরকে দুই দলে বিভক্ত করা যায়।
একদলের কাছে "ভালবাসি" শব্দটি বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরের মত। যতক্ষণ শব্দটি বেরিয়ে না আসে, দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। দুটো শক্ত হাত যেন তার গলায় সাঁড়াশির মত চেপে বসে। প্রতিমুহূর্তে নিষ্পেষিত হতে হতে ক্লান্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। শব্দটি বেরিয়ে যেতেই যেন ভারী পাথরটির হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি মেলে। শুধু মনে হয়, "এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই, আমি আমার ভালবাসার কথাটা জানিয়ে দিতে পেরেছি"।
আর একদল থাকে "ভালবাসি" শব্দটি যাদের কাছে ঝোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা শেষ সম্পদের মত। শব্দটি উগড়ে দিতেই তারা নিঃস্ব-রিক্ত-অসহায় হয়ে যায়। নিজেকে তখন মনে হয় রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের চেয়েও অধম। মুখে হাসি ধরে রাখলেও, হৃদয়ের ভেতরের শুন্যতাটুকু খুব বেশি কষ্ট দেয়। রঙ বেরঙের পোশাক পরে বসে থেকেও সে জানে অন্তত একজন মানুষের সামনে সে দিগম্বর উন্মাদের সমপর্যায়ের। শুধু আফসোস হয় "কেন বলে দিলাম? ভালবাসাটুকু নিজের মাঝেই কেন ধরে রাখলাম না?"
আমি এই দ্বিতীয়দলের মানুষ। ভালবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে আমি মেয়েটির কাছে নিজেকে উপহাসের পাত্রতে পরিনত করেছি। মাটি ভেদ করে মুখটা লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে খুব।
****
হোটেল শৈবালের বাইরে আমাদের বাস দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে বাস দেখেই আনন্দে উদ্ভাসিত হল লিজার মুখ। সে রিক্সা থেকে নেমেই দৌড়ে গেল। প্রবাল স্নিগ্ধা আবিদ ভাই সহ আরও অনেকেই হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল। লিজা দৌড়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর স্নিগ্ধাকে ছেড়ে সে প্রবালের হাত ধরল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। চোখে চোখে কথা হল অনেক। মাঝে মাঝে এমন কেন হয়? কেউ না চাইতেই দুহাত ভরে পায় আর কেউ সারাজীবন তপস্যা করেও খালি হাতে ফেরে!
লিজাকে ওদের সাথে রেখে আমি এক পাশে চলে এলাম। “কি হয়েছিল”, “কেন হয়েছিল”, “কীভাবে হয়েছিল”- এমন একগাদা প্রশ্ন শুনতে হবে। এখনই রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না। কিন্তু স্নিগ্ধা আমাকে পাকড়াও করল। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে।
আমি বললাম, “আমি এখন কিচ্ছু বলতে চাচ্ছিনা স্নিগ্ধা। সবটুকু তোকে পরে বুঝিয়ে বলব”।
স্নিগ্ধা বলল, “আমি লিজার ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিনা আজহার”।
“তাহলে?”
“আমি জানতে চাই কমলের ব্যাপারে”।
“কমল? তার ব্যাপারে আমি কি বলব?”
“কমলকে আহত অবস্থায় কুমিল্লার সেই ফিলিং স্টেশনের পেছনে কয়েকটা গাছের আড়ালে পাওয়া গেছে। তার শরীরের নানা যায়গায় আঘাতের চিহ্ন। কেউ ভারী পাথর বা ইট দিয়ে তার মাথা ও মুখে আঘাত করেছে। চোখের আশে পাশে কাঁটা দাগ। কেউ যেন চোখ দুটো উপড়ে ফেলতে চাইছিল”।
“ব্যাপারটা দুঃখজনক”। আমি মাথা নেড়ে বললাম।
স্নিগ্ধা শক্ত করে আমার একটা হাত চেপে ধরল, “আমি জানি কাজটা তুই করেছিস”।
“কি বলছিস তুই?” আমার কণ্ঠে নির্ভেজাল বিস্ময়।
স্নিগ্ধা আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর এই দৃষ্টির সামনে আমি তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নিচু করে ফেললাম। সে বলল, “আজহার। আমার দিকে তাকা”।
আমি তাকালাম না।
“এই কাজটা তুই করেছিস তাইনা?”
মাথা নিচু করেই বললাম “কোন কাজ?”
“না বোঝার ভান করিস না। তুই নিজেকে যতটা ভাল অভিনেতা ভাবিস ততটা ভাল তুই না! আমার কাছে স্বীকার কর। কমলকে তুই মেরেছিস”?
“আমি কাউকে মারিনি”।
“আমার কাছে লুকনোর চেষ্টা করিস না আজহার। তোকে আমার চেয়ে ভাল করে কেউ চিনেনা। কমলের দিকে তাকানর সময় তোর চোখের দৃষ্টি আমি দেখেছি। স্পষ্ট প্রতিহিংসা। আমি জানতাম তুই খারাপ কিছু একটা করে বসতে পারিস”।
“কেন মারব আমি তাকে?”
“কারন সে বাজে ভাবে তাকাচ্ছিল লিজার দিকে। সেটা তোর সহ্য হয়নি। তুই একটা সিক!”
“আমি সিক? তুইও এই কথা বলতে পারলি স্নিগ্ধা?”
“কেন বলব না? আমি জানি তোর মধ্যে এক ধরনের ইনফেরিঅরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে। যেটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের পর্যায়ে পড়ে। নিজেকে ছোট ভাবতে ভাল লাগেনা তোর। যারা সেটা তোকে ফিল করায় তার ক্ষতি করিস তুই। এক ফাংশনে তোকে র্যাগিং করেছিল বলে তুই হামিদ ভাই আর তার বন্ধুদের পিটিয়েছিলি লোক লাগিয়ে”।
“সেটা ডিফারেন্ট ইস্যু...”
“না ডিফারেন্ট না”। স্নিগ্ধা আমাকে থামিয়ে দিল। “এমন আরও অনেক উদাহারন দিতে পারি আমি। কয়টা শুনতে চাস তুই? এই সবই প্রমান করে রেগে গেলে তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাস। তখন তোর পক্ষে যেকোনো অঘটন ঘটানো সম্ভব”।
আমি চুপ করে থাকলাম।
“আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছিলাম তোর ভেতরের এই কমপ্লেক্স দূর করব। আর লিজার মত এমন একটা মেয়েকে যদি তুই জয় করতে পারিস তাহলে তোর মনে হবে তুই ফেলনা না, তুই ছোট না, তুই ও মানুষ। কিন্তু মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য তুই যে এত নিচে নামতে পারবি সেটা আমার ধারনার অতীত ছিল”।
আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।
“তুই জানিস কেন রাতুল আসেনি এই ট্যুরে? তার মা অসুস্থ না, মিথ্যে বলেছে সে তোর জন্য। রাতুল সুদর্শন, বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। যেকোনো মেয়ে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে তাই সে চায়নি এই সময়টা তোর আর লিজার আশে পাশে থাকতে। আমরা বন্ধুরা তোর জন্য এত কিছু করলাম আর তুই এই প্রতিদান দিলি? সবাই যা বলে ঠিকই বলে... তুই আসলেই একটা স্যাডিস্ট...”
আমি আর কথা না বলে চলে এলাম। হোটেলের নীচতলার ওয়াশরুমে ঢুকলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ঐ ঘোরলাগা অবস্থা আবার সৃষ্টি হয়েছে। চোখে মুখে পানি দেয়া দরকার।
****
আমি বেসিনে পানির কল ছাড়লাম। মুখ নিচু করে পানি দিতে যাব হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ একজন আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে মনে হল, আমার পরে বেসিন ব্যবহার করার জন্য কেউ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই বুঝলাম এমনটা হওয়ার কথানা! পাশাপাশি এত গুলা বেসিন থাকতে কেউ একজন আমার পিছনে এসে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য কি? সামনে আয়না আছে, চাইলেই মাথা উঁচু করে মুখ দেখে নেওয়া যায় পেছনের মানুষটার কিন্তু আমি চেষ্টা করলাম ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। পেছন দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি একটা দড়ি দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে।
ক্রমাগত গলায় চেপে বসছে দড়িটা। দম আটকে আসছে। একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক ঘিরে ধরল আমাকে। আমি তার মধ্যেও এক পলকের জন্য পিছনের মানুষটার মুখ আয়নায় দেখে চমকে গেলাম।
অতি কষ্টে একবার প্রশ্ন করলাম, “কেন?”
পেছনের লোকটা সাপের মত হিস হিস করে উঠল। কিছু বলল না।
ওয়াসরুমের দরজায় টোকা পড়ল। কেউ একজন ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে। গলার দড়ি আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল। আমি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। আর কত সেকেন্ড সময় বাঁচব? ১০ সেকেন্ড? ৫ সেকেন্ড? দরজায় এবার আরও জোরে টোকা পড়ল। আমার দেহ সম্পূর্ণ নিথর হয়ে গেছে। হাটু গেঁড়ে পড়ে যাচ্ছি। চেতনা লোপ পাচ্ছে আমার। মৃত্যু যন্ত্রণা এত ভয়ংকর কেন? চোখের সামনের পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে...
****
আমি চোখ মেলতেই দেখলাম একজোড়া চোখ রাজ্যের উদ্বেগ নিয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পরে আমাকে দেখছে। বেঁচে আছি তাহলে! কয়েকবার চোখ পিট পিট করতেই দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে গেল। এটা রাতুল। রাতুল চলে এসেছে! আমার আর কোন চিন্তা নেই তাহলে!
আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। রাতুল আমাকে বাঁধা দিল। তাকিয়ে দেখলাম রাতুলের পাশে বসে আছে স্নিগ্ধা। তার চোখে পানি।
আমি আস্তে করে বললাম, “কাঁদছিস কেন? আমার জন্য কাঁদতে হবেনা। তবে একটা জিনিস কি জানিস তোরা? আমাকে যতটা খারাপ আমাকে ভাবিস আমি ততটা খারাপ নই”।
“আমাকে মাফ করে দে আজহার। আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম”। স্নিগ্ধা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল।
“কেন বলছিস?” আমার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি।
“আমি বুঝতে পেরেছি কমলকে তুই মারিস নি...”
রাতুল স্নিগ্ধার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “... যে কমলকে মেরেছে, সেই তোকে মারার চেষ্টা করেছে। তুই কি জানিস কে তোকে মারার চেষ্টা করেছিল?”
আমি উপড়ে নিচে হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকালাম।
“বল আজহার। আমাকে বল কে সে?”
আমি চুপ করে থাকলাম।
“আজহার আমাকে একবার বল কে করেছে এই কাজ?”
আমি কিছু বললাম না।
“কাজটা কি প্রবাল করেছে? লিজাকে পাওয়ার জন্য বেঈমানটা তোকে আর কমলকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল?”
আমি হয়ত কিছু একটা বলতাম কিন্তু হঠাৎ লিজা আর প্রবাল কেবিনে প্রবেশ করল দেখে থেমে গেলাম। লিজা একটা কমলা রঙের শাড়ি পড়েছে। কমলা রঙটা তার খুব প্রিয়। আমি আগে কখনো তাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখিনি। অসাধারন লাগে দেখতে! প্রবালের গায়ে সাদা পাঞ্জাবী। ওদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা এখন পরস্পরের খুব কাছের মানুষ।
আমি বললাম, “তোরা এখন একটু বাইরে যা সবাই। আমি লিজার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই”।
স্নিগ্ধা, প্রবাল আর রাতুল বাইরে চলে গেল। লিজা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম, “আমার কাছে এসে বস লিজা”।
লিজা বাসল না, দাঁড়িয়েই থাকল।
“একটু বস লিজা। কোন প্রশ্ন করব না। শুধু দুইটা কথা বলি। শুনেই চলে যেও আর যাওয়ার পর প্রবালকে একটু ডেকে দিও।”।
লিজা এগিয়ে এসে আমার বেডের কাছে বসল।
“আমার একটা কথা রাখবে লিজা?”
“কি?”
“অনেক দূরে চলে যেও তুমি আমার সামনে থেকে। আর কখনো এসোনা। আমি হচ্ছি এক টুকরো অন্ধকার। আমার আশে পাশে থাকলে তোমার জীবনেও আঁধার নেমে আসবে”।
“আমিও ঠিক সেটাই ভাবছি”। বলেই লিজা উঠে দাঁড়াল।
“আর একটা কথা ছিল যে ...”
“কি?”
“যদি কখনো কোন কারনে একবারের জন্য হলেও একটু একাকী বোধ কর, আমাকে মনে মনে স্মরণ করবে। আমি ঠিকই পৌছে যাব”।
“মনে মনে ডাকলে কীভাবে জানবে তুমি?”
“কীভাবে বুঝব সেটা জানতে চেওনা, আমি নিজেও জানিনা”।
লিজা চলে যেতে উদ্যত হল। আমি আবার ডাকলাম, “লিজা”।
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লিজা, আমার দিকে ঘুরে তাকাল।
“যদি স্মরণ করার পরও দেখ যে আমি আসিনি, তবে ধরে নিও তোমার পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া এই আজহার নামের ব্যাক্তিটি আর নেই, হারিয়ে গেছে বিস্তৃতির অতলে... ”
লিজা আর শোনার জন্য থামল না, বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। প্রায় সাথে সাথেই প্রবাল ঢুকল কেবিনের ভেতর। ঠোঁটে ধরে রেখেছে হাসি। আমার বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে এসে বসল সে।
আমিও একটু তিক্ত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম, “প্রবাল! তুই কি ভেবেছিস আমি তোকে দেখতে পাইনি?”
“মানে?” চমৎকার অভিনয় করল প্রবাল।
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম, “আমি আয়নায় তোর মুখ দেখে ফেলেছিলাম! আমি জানি তুইই আমাকে মারতে চেয়েছিলি!”
প্রবাল মাথা নিচু করে থাকল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
প্রবাল মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, “তুই একটা স্যাডিস্ট সেটা আমি অনেক আগে থেকেই জানা। আমি জানি তুই কমলকে টর্চার করেছিস, কারন সে লিজাকে বাজে দৃষ্টিতে দেখেছে। আমি জানতাম সুনার অর লেটার তুই আমাকেও মারার চেষ্টা করবি কারন লিজা আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু লিজাকে আমিও ভালবাসি। তুই তাকে পাওয়ার জন্য যা করতে চেয়েছিলি তা আমি করতে বাঁধা কোথায়? দেয়ার ইজ নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার"।
আমাকে ফেয়ার আনফেয়ার শেখাচ্ছে প্রবাল! আমি হাসলাম।
প্রবাল ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল, "কিন্তু বিশ্বাস কর তোকে মেরে ফেলা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোকে অজ্ঞান করে কোথাও লুকিয়ে রাখতে, যাতে তুই আর আমাদের আসতে না পারিস...”।
"চুপ কর!" আমার চেহারায় বা কণ্ঠে হয়ত এমন কিছু ছিল যা দেখে প্রবাল ভয় পেয়ে গেল। "... তোকে অনেক আগেই আমি সরিয়ে দিতে পারতাম প্রবাল। কেন দেইনি জানিস?”
“কেন?” শব্দটি যেন অতি কস্টে উচ্চারন করল প্রবাল।
“কারন লিজা তোকে ভালবাসে। লিজাকে এক মুহূর্তের জন্যও আমি অসুখি দেখতে চাইনা”।
প্রবালের চোখে অপরাধীর দৃষ্টি ফুটে উঠল।
“একটা অনুরোধ রাখবি আমার?” বলে নিজেই হেসে উঠলাম আমি, “হা হা হ... আমি আজহার! আমি কিনা অনুরোধ করছি! হা হা হা...” হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললাম, “অনুরোধ নয়, আদেশ! আমি আদেশ করছি তোকে! লিজাকে নিয়ে দূরে চলে যাবি... অনেক অনেক দূরে। কিন্তু যদি কখনো খবর পাই লিজাকে কষ্ট দিয়েছিস তুই! পৃথিবীর যে প্রান্তে গিয়ে লুকাস না কেন, আমি ঠিকই খুঁজে বের করব তোকে। তোর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ টুকরো টুকরো করে কাটব তারপর শেয়াল কুকুর দিয়ে খাওয়াব! হা হা হা হা...”
আমি উন্মাদের মত হেসেই চলেছি। চেষ্টা করছি হাসি থামাতে কিন্তু মনে হচ্ছে এই হাসি আর কোনদিন থামবে না...
******************
উৎসর্গঃ ব্লগার মামুন রশিদ ভাইকে। ওনার লেখা আমার কাছে খুব ভাল লাগে। তারচেয়ে বেশি ভাল লাগে ব্লগের প্রতি ওনার ডেডিকেশন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:৪৪