আমি ধর্ম নিয়ে কখনো খুব চিন্তা ভাবনা করি নাই। আমি জানি একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনি আল্লাহ। তিনি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। কেন তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এটা আমি আমার মত করে ছোটবেলায় খুব ভাবতাম। আমার জ্ঞান সীমিত। আমার ভাবনাও তাই বাচ্চাদের মতই। পৃথিবীর সেরা সৃষ্টি হিসেবে তিনি আমাদেরকে বেছে নিলেন কেন? আমাদের আদি-পিতাকে সম্মান করার জন্য তিনি যাদের আগুন দিয়ে বানিয়েছেন তাদেরকেও আমাদেরক সম্মান করতে বলেছেন কেন? এ থেকেই বুঝা যায় আল্লাহ তার নিজের সৃষ্টি মানব-জাতিকে কতটা পছন্দ করেন। আল্লাহ এটাও পছন্দ করেন যখন আমরা তাকে পছন্দ করি। তাকে পছন্দ করা মানে তার নির্দেশ অনুযায়ী চলা। আল্লাহকে ভয় করা শ্রদ্ধা করা মানেও আল্লাহকে পছন্দ করা। মানুষ জাতিকে কি যেকোন অবস্থায় আল্লাহকে পছন্দ করবে? তাই আল্লাহ বিবি হাওয়ার সামনে গন্ধম ফলের ব্যাপারটা আনলেন? তিনি দেখালেন কি জন্য তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের পরীক্ষা করতে চান। তিনি আমাদের সবকিছুই দিয়েছেন কিন্তু কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি করা যাবেনা। তিনি আমাদের কাছে চান ধৈর্য্য, সংযম, মহানুভবতা। যাদের এগুলা আছে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন। যাদের নেই তাদের হয়তো সুযোগ দেন।
কি লিখতে বসেছিলাম এটাই মনে নাই। কেন মানবসৃষ্টির আদিকালে চলে গেলাম ব্যাপারটা আমার জানা নেই। ১ সপ্তাহ হবে রুমানা ম্যাডাম আর হাসান সাইদকে নিয়ে পেপারে, টিভিতে, ব্লগে একগাদা লেখা পড়লাম, খবর দেখলাম। যেদিন প্রথম দেখলাম শঙ্কিত হলাম। অনেক ধরনের মারামারির ছবি দেখেছি। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে কি এভাবে মারা যায়? চোখ অন্ধ করতে চাওয়ার কারনটা কি? অপেক্ষা করলাম পরবর্তী খবরের জন্য। সাইদ ধরা পড়েছে। ইরানী ছেলের সাথে ম্যাডামের পরকীয়ার খবর এনেছে। ইরানী ছেলের নামও কোথায় যেন দেখলাম। এই নাম ফেসবুক থেকে সরাতেই যদি এত ঝামেলা তাহলে সেই একাউন্ট কই? কোথায় ইরানী ছেলে? রুমানা ম্যাডাম এতদিন ঢাকায় ছিলেন কোনদিন তাকে নিয়ে কেউ কিছু বলেনি তিনি কানাডায় গিয়ে পরকীয়া শুরু করবেন কেন? আর যদি তার পরকীয়াই করতে হয় ইরানী ছেলেকে নিয়েই যদি তিনি ভবিষ্যত দেখেন তাহলে তার দেশে ফিরার দরকার নেই। সেখানেই ইরানী ছেলেকে নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতেন। ব্লগে , ফেসবুকে মানুষ দুইভাগ হয়ে গেল। রুমানা ম্যাডামের পরকীয়ার প্রমান খুঁজতে লাগল। বেশিরভাগ মানুষ এটা ভুলে গেল ম্যাডাম আর চোখে দেখেন না। তিনি জন্মান্ধ নন। কাজেই এই ব্যাপারটার সাথে নিশ্চয়ই তার পরিচয় নেই। চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করলাম দুনিয়াটা কেমন লাগে। খুব বেশি না। ৫ মিনিটেই দুনিয়াটা অসহ্যবোধ হল। চোখ অমূল্য সম্পদ কেউ এমনি এমনি বলেনা। এই দুনিয়ার যে এত চমৎকার সব রঙ দিয়ে ভরা সেটা অনুভব করার জন্য চোখ লাগে। এই প্রথমবারের মত আমি বুঝতে পারলাম অনুভব করার জন্য হৃদয় না- চোখটাই বেশি জরুরি। একজন জন্মান্ধের জন্য এই অনুভবটা বুঝতে পারতাম না কিন্তু রুমানা ম্যাডামের জন্য বুঝতে পারি।
সাইদকে অনেকে সহানুভুতি দেখানো শুরু করেছেন। "একহাতে তালি বাজেনা" এরকম কথা দেখলাম। তালি জিনিসটা আসলে কোন খারাপ জিনিশ না। মানুষ এখানে তালির উদাহরন দিচ্ছে কেন তাই চিন্তা করলাম। তালি তখনই হয় যখন তাল মিলে, আনন্দ প্রকাশে আমাদের দুই হাত যখন সমান চলে তখন হাত দিয়ে একটি তাল হয় যেটা হচ্ছে তালি। রুমানা ম্যাডাম আর সাইদের ব্যাপারে তালি আসল কোথেকে? এখানে তো সমান-সমান ব্যাপারটাই নেই!! সাইদ প্রথমে বলল, ধস্তাধস্তির সময় এমন হতে পারে । কিন্তু এত ধস্তাধস্তিতে সাইদের চশমাটার পর্যন্ত কিছু হলনা আর রুমানা ম্যাডাম অন্ধ হয়ে গেল?? আর মানুষ এটাকে বলছে এক হাতে তালি বাজেনা? রুমানা ম্যাডাম যে পরকীয়া করতেন এটা এক অন্ধ সাইদ ছাড়া আর কেউ জানেনা? রুমানা ম্যাডাম কানাডায় কি করতেন সেটা সাইদের থেকে ভাল তাদের জানার কথা যারা কানাডায় ছিলেন। তাদের পাঠানো চিঠিও এই ব্লগেই আছে। রুমানা ম্যাডাম কখনই সাইদের বিরুদ্ধে কারো কাছে অভিযোগ করেননি, তিনি সবার কাছে জানতে চেয়েছেন কিভাবে তার কন্যা আর স্বামীকে কানাডায় আনা যায়। সাইদ তো আর বসে থাকবেনা তাহলে সাইদ কানাডায় কিভাবে ব্যবসা করতে পারে- সেটাও ছিল একটা চিন্তা। এত কিছুর মাঝে পরকীয়া ব্যাপারটা কোথায়? ম্যাডাম যদি সেরকম কোন চিন্তা করেই থাকতেন তাহলে সাইদকে নিশ্চয়ই কানাডায় নেওয়ার চিন্তা করতেন না!!
সাইদ সম্পর্কে একজায়গায় সাইদের ক্যাডেটের এক বন্ধুর কমেন্ট পড়লাম। সাইদ নাকি বিড়াল হত্যা করে নির্মল আনন্দ পেত। নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গমের কথা নাকি মুখে বলে বেড়াত। এগুলা বাদ দিলাম। কিছুক্ষন নিজেকে সাইদের জায়গায় নিয়ে গেলাম। চিন্তা করে দেখলাম কেমন লাগে যদি আমি কিছুই করতে না পারি আমার বিবাহিত বউ অনেকদূর চলে যায়। এটা একজন ছেলের জন্য মানা কঠিন বিশেষ করে আমাদের সমাজে। আমরা সবসময়েই এটা ভাবি ছেলেরাই উপরে থাকবে। শিক্ষা দীক্ষায় ছেলেরা বেশি হলেই সব কিছু ব্যালেন্স হবে। এমনি যদি হয় মানসিকতা- তবে কারো অযোগ্যতার ফল তো তাকেই ভোগ করতে হবে। তারা যখন প্রেম করেন তখন একজন ছিলেন বুয়েটের ছাত্র আরেকজন ঢাবি এর ছাত্রী। বুঝায় যাচ্ছে দুইজনেরই জীবনে লক্ষ্য আছে। সেটাই আমরা মনে করি। যেই ছেলেটা বুয়েটে ইলেক্ট্রিকালে পড়বে সেটা আর যাই হোক কোন এম্বিশনলেস ছেলে হবেনা। কিন্তু বুয়েট থেকে ডিগ্রি নেওয়া সাইদের সম্ভব হয়নি। রুমানা ম্যাডাম নিজেকে থামিয়ে রাখেননি। জ্ঞান অর্জনের স্বাধীনতা যেহেতু আছে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। ঢাবি এর শিক্ষক হয়েছেন। একজন মেয়ে ঢাবি এর শিক্ষক হয়েছে এটা যে তার পরিবারের প্রতি কত বড় সম্মানের ব্যাপার তা আমাদের পরিবার থেকেই আমি জানি। তাহলে এখান থেকেই দুরত্ব শুরু হচ্ছে। একজন ইন্টার পাস আরেকজন ঢাবি এর শিক্ষক। একজনের কমেন্ট পড়লাম সাইদ রিপিটেড ইগ্নোরেন্সের স্বীকার। তার বউ এত উপরে উঠছে আর তাকে ছোট করছে। এখন আরেকজন উঠতে পারবেনা দেখে রুমানা ম্যাডাম পড়বেননা? আজকে থেকে ২০ বছর আগে আমার আরেক মেয়ে কাজিনের কথা মনে পড়ল। পিএইচডি এর অফার পাওয়ার পরেও যাওয়া হয়নি কারন দুলাভাই যেতে দেননি। ২০ বছর আগের সাথে এখনকার পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে বলেই জানি। এখন একটা পরিবার ছেলের লেখাপড়া এবং নিশ্চয়তার জন্য যেরকম পরিশ্রম করে মেয়ের জন্যও করে। এখন ছেলে পড়ালেখা করবে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আর মেয়ে পড়ালেখা করবে ভালো জামাই পাওয়ার জন্য - এরকম চিন্তার দিন আশা করি শেষ হয়েছে। আমরা মেয়েদের শিক্ষার কথা বলি, একটা দেশের অগ্রগতির জন্য মেয়েদের শিক্ষাকে আলাদা প্যারামিটার হিসাবে গন্য করি তাহলে নিশ্চয়ই তাদের আমরা আটকিয়ে রাখতে পারিনা? কেউ যদি এরকম মনে করে মেয়েদের বাইরে পড়তে দিলেই তারা পরকীয়া করবে তাহলে সেটা তার ভুল চিন্তা তাদের মানসিকতার সমস্যা। পরকীয়ার সাথে বাইরে পড়তে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এটা সম্পূর্ন আলাদা জিনিস। এটা আমাদের সমাজে বৈধ না কিন্তু আমাদের সমাজের ব্যাধি। কারা পরকীয়া করে এটার কোন রেঞ্জ নাই। এটা বস্তিতে হয়, গ্রামে গঞ্জেও হয় এটা হাইক্লাস ফ্যামিলিতেও হয়।
একটা মেয়ে যখন লেখাপড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে তখন ছেলেদের সাথেই তার পাল্লা হয়। বুয়েটে, ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় ছেলেদের সাথে মেধার লড়াইয়ে জয়ী হয়ে তারা ভর্তি হয়। জ্ঞানের জগত হল স্বপ্নের জগত। এই চমৎকার জগতের গাছে যখন আমরা তাদের উঠিয়ে দেই তখন তাদের মই কেড়ে নেওয়ার দরকার নেই। আর একজন ছেলের কর্তব্য কি? আমাদের ধর্মেই সম্ভবত একটা কথা বলা আছে। স্ত্রী যদি ধনী হয় তারপরেও স্বামীকে স্ত্রীর এবং সন্তানদের দায়িত্ব নিতে হবে। স্ত্রীর-এর ভর পোষনের দায়িত্ব। নিজেদের ছেলে মেয়ের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করার পর তার স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার সে পায়। এরপর স্ত্রী যদি পরকীয়া করে স্ত্রীকে ত্যাগ করার অধিকার সে পায়- তাকে হত্যা করার বা চোখ তুলে ফেলার নয়।
ঠিক আছে স্ত্রী-এর কথা বাদ দিলাম সাইদের কি নিজের মেয়ের প্রতি এতটুকু মমতা ছিলনা? তার মেয়ের ভরন-পোষন নিশ্চয়ই মা দেয়। নিজের বউকে যদি হত্যা করতেই হয় তাহলে সেটা নিজের মেয়েকে আড়াল করেই করত। নিজের মেয়ের সামনে করার দরকার কি?
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম রুমানা ম্যাডামের পরকীয়া সম্পর্ক আছে। যদিও সেটার কোন প্রমান নেই। সাইদ নিজেই রিমান্ডে বলেছে সে হীনমন্যতাবোধে ভুগত। শেয়ার বাজারে লসের কারনে তা আরও প্রকট আকার ধারন করে। স্ত্রীর চোখ তুলতে নয় তাকে হত্যা করতেই গিয়েছিল। একটা চোখ তুলাও সহজ ব্যাপার নয়। মনে হয় চোখ খুব নরম কিছু। চোখ আসলে খুব শক্ত কিছু। খুব সহজে এর ক্ষতিসাধন সম্ভব না। আমার এই লেখা পড়ে অনেকেই বলবে একতরফা লেখা। দুইদিকেই ভাবা উচিত ছিল। এই ব্যাপারটা আর ভাবতে চাইনা। কয়েক মাস ধরেই এই ব্যাপারটাতে আমি খুব বিরক্ত। কিছু হলেই মানুষ যে ভিক্টিম তারই দোষ খোঁজা শুরু করে। যে গুলি খায় কেউ কেউ বলে নিশ্চয়ই তার কোন দোষ ছিল। যাকে রেপ করা হয় নিশ্চয়ই তার কোন দোষ ছিল নাইলে রেপ হল কেন? কয়েকদিন আগেই পেপারে পড়লাম এক মেয়েকে রেপ করা হয়েছে আবার তাকেই দোররা মারা হয়েছে। অনেক ভেবেই কিছু চিন্তা করে বের করতে পারলাম না তাকে দোররা মারা হল কেন? হতে পারে রেপ করার সময় বাধা দেওয়াও এখন একটা অপরাধ।
কেউ আমার লেখায় কিছু মনে করেননা আমারা আসলে মন খুব খারাপ। আমি খুব আশা নিয়ে ছিলাম ম্যাডামের এক চোখ ভাল হবে কিন্তু কিছুক্ষন আগে খবরে জানতে পারলাম সেই সুযোগ নাকি নেই। ম্যাডাম চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছেন। তিনি বারবার বলছেন " আমি আমার মেয়েকে আর দেখতে পাবনা"। তিনি কিন্তু তার বাবার কথা বলেননি, তার প্রফেশনের কথা বলেননি। তিনি এই সবুজ পৃথিবীর কথা বলেননি তিনি বলেছেন তার মেয়ের কথা। একজন নারী বিবাহিত জীবনে স্বামীর কাছে বিশ্বাস-ঘাতকতা হয়ত করতে পারে কিন্তু একজন মা পারেন না। সেই ছোট মেয়ের কাছে তিনি পুরোপুরিই মা।
আমার জীবনে সফলতার থেকে ব্যর্থতা বেশি কিন্তু আমার বন্ধু বান্ধব সবাই জানে আমি সবসময় আশার কথা বলি। আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ইতিবাচক। রুমানা ম্যাডাম আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি এখন আপনার মেয়ের চোখে দুনিয়া দেখবেন। অন্ধ হয়েও আপনি অনেক কিছু করে ফেলতে পারবেন। হুমায়ুন আহমেদের বইয়েই তো পড়েছিলাম অন্ধ ছেলের পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করার কাহিনী। এবার আপনি কাহিনী গড়ুন। চোখ দিয়ে যেমন অনুভব করা যায়। মন দিয়ে হয়ত দুনিয়াও দেখা যায়। আপনি দুনিয়া দেখুন মন দিয়ে আর অনুভব করুন আপনার মেয়ের চোখ দিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১১ রাত ১২:১৩