আন্তর্জাতিক মেডিয়াতে অর্থনীতির বিষয় গুলো ফলো করলে, নিয়মিত একটা ভয়ের মধ্যে থাকবেন। গ্রিস গেলো , হায় হায়, রিসেশান আসতাছে। চায়নার ইয়েন পইরা গ্যাছে, চায়নার অর্থনীতিক অবস্থা খারাপ হইতাছে- হায় হায় আরেক ক্রাইসিস আসতাছে। ইউরোজনের প্রবৃদ্ধি কমে গ্যাছে- হায় হায় আরেক ক্রাইসিস।
নিয়মিত একটা উথাল পাথালের মধ্যে থাকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি।
বাংলাদেশের বাঙ্গালি আমরা সেই উথাল পাথালের বিপরীতে দাড়ায় থাকি, আমাদের নিয়মিত ৬% গ্রোথ। কোন কিছু আমাদের স্পর্শ করেনা। বাংলাদেশের মেডিয়াতেও খবর গুলো জোরালো ভাবে আসেনা, ফলে বাংলাদেশের মানুষও টের পায়না, সাড়া বিশ্বের অর্থনীতির এই ইয়ো ইয়ো জাম্প।
বিশেষত, ২০০৭-৮ এর দিকে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ব্যাপক পতন হলো, বিশ্বের বড় অর্থনীতি গুলো সঙ্কুচিত হয়ে আসলো সেই সময়ে অর্থনীতিবিদেরা একটা আশঙ্কা করছিল যে, এর ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়বে -বিশেষত পোশাক শিল্পে। পোশাক শিল্পের মালিকেরাও একটা বড় আশংকা করছিলো যে, এর ধাক্কা ওদের উপরে পড়বে। কিন্তুক তেমন্ কোন লং টার্ম ইম্প্যাক্ট পরে নাই।
এখন এই মুহূর্তে চীনের অর্থনীতির গতি নিয়ে সারা বিশ্বে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হইছে, অনেক গুলো স্টক মার্কেট পরে যাচ্ছে। হারিকারি অবস্থা। কিন্তু আমাদের কোন বিকার নাই।
এইটা কি বাংলাদেশের অর্থনীতির ঋজুতার জন্যে নাকি অন্য কোন বিষয় আছে?
একটা জিনিষ আমাদের ধরে নিতে হবে, একটা বড় ঘটনায় বিশ্বের সকল দেশের অর্থনীতি ইম্প্যাক্ট হবে আর আমাদের দেশের অর্থনীতি ইম্প্যাক্ট হবেনা, এইটা হইতে পারেনা। এই খানে কোন কিন্ত আছে।
এই কিন্তটার শুধু মাত্র দুইটা হাইপথেসিস হইতে পারে।
এক। বাংলাদেশ অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতির সাথে আমাদের সংযোগ খুব কম। ফলে, বিশ্ব অর্থনীতির ওঠা নামায় বাংলাদেশের অর্থনীতির কিছু যায় আসেনা।
দুই। বাংলাদেশের অর্থনীতির যেই ডাটা আছে সেই গুলোর, বড় একটা অংশ মন গড়া। ফলে, অর্থনীতি ভালো হোক খারাপ হোক, ডাটা ডাটার মত প্রগতি দেখায় যায়।
এই গুলো হাইপোথেসিস মাত্র। আমরা একটু দেখি, আসল ইস্যু টা কি। এই জন্যে আমাদের দেখতে হবে, বিশ্ব অর্থনীতির সাথে আমাদের সংযোগ কোথায় ?
আন্তর্জাতিক বানিজ্যে, আমাদের প্রধান সংযোগ পোশাক শিল্পে। যেহেতু বাংলাদেশের ৮০% এক্সপোর্ট গারমেন্টস।
পোশাক শিল্পে আমাদের অধিকাংশ রপ্তানি, কম্পিটিটিশনের অন্যে দেশ থেকে কম মুল্যে করা হয়। বিশ্ব অর্থনীতি যখন পরে যায় তখন, পোশাক শিল্পের ভোক্তারা হয় তাদের ক্রয় কমিয়ে দেয় অথবা কম ভ্যালুর পন্যের দিকে ঝুঁকে পরে। ফলে, বায়াররা তখন কম ভ্যালুর সোরসিং এর দিকে নজর দেয়।
একজন বায়ারও সব সময়, তার ঝুঁকিকে ডিস্ট্রিবিউট করার জন্যে, বিভিন্ন দেশে উৎপাদনকে বন্টন করে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় আসলে, এই বায়ার তখন কম ভ্যালুর কাজের জন্যে বাংলাদেশের উপরে নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়, রিস্ক বেশী নিয়ে হলেও।
ফলে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিপর্যয় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কমই টাচ করে ।
দ্বিতীয়ত এই সময়ে সে, তার ম্যানুফাকচারারকে দাম কমানোর জন্যে চাপ দেয়। বাংলাদেশের বড় গারমেন্ট ফ্যাক্টরি গুলো এখনো সুপার নরমাল প্রফিট করে, কারন, তার স্রমের দাম কম। ফলে সে সেই চাপটা নিতে পারে। ফলে সে বায়ারের চাপে প্রাইস কমায়। যেইটার সাথে অনেক কম্পিটিং দেশ প্রতিযোগিতা করতে পারেনা।
ফলে বড় প্রতিষ্ঠান গুলোর অর্ডার সেই ভাব কমে আসেনা। অনেক ক্ষেত্রে অর্ডার বাড়ে। এইটা অবশ্যই, আমাদের পোশাক শিল্পের অর্থনৈতিক ভিত্তির একটা ঋজুতা নির্দেশ করে।
দ্বিতীয়ত হইলো ইম্পোরট। বিশ্ব অর্থনীতির পতন হইলে, কমোডিটি এবং র মেটেরিয়াল সব কিছুর দাম কমে, চাহিদা কমে আসার জন্যে।
ফলে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ইম্পোরট করে, তাদের পণ্যের দাম কমে আসে। মনে করেন, চালের দাম কমে আসা। তেলের দাম কমে আসা। স্টিলের দাম কমে আসা।
এর ফলে, আমাদের ইম্পোরট ভিত্তিক বানিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। আমাদের ম্যাক্রো ইকনমিক ডাটা আরও মজবুত দেখায়।
কিন্তু, তার মানে কি, বিশ্ব অর্থনীতির পতন আমাদের জন্যে ভালো ? এবং বিশ্ব অর্থনীতির সাথে এই সংযোগহীনতা কি মিন করে ? এবং এর সাথে আমাদের দ্বিতীয় হাইপথেসিস, বুজরুকি ডাটার সম্পর্ক কি?
বাংলাদেশের ম্যাক্রোইকনমিক ডাটা শুধু মাত্র, পোশাক শিল্প এবং ইম্পরটের সাথে এই সংযোগ এবং নির্ভরতা থেকে একটা জিনিষ বুঝতে পারি, আমাদের ম্যাক্রো ইকনমি বলতে আমরা যা বোঝাই, তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে।
যেমন আমাদের লেবার ফোরসের মাত্র, ৪%(৪০ লক্ষ) পোশাক শিল্পে কাজ করে। বাকি ৯৬% এর বড় একটা অংশ ম্যাক্রো ইকনমিক ডাটায় অত্যন্ত প্রান্তিক ভুমিকা রাখে।
১৬ কোটি মানুষের একটা দেশে গড় আয় যখন, মাসিক ৬৫০০ টাকার কাছাকাছি তখন বুঝতে হবে, এই বাকি ৯৬% মুলত কৃষি, কৃষি ভিত্তিক কিছু ভ্যালু এডিশান এবং কিছু প্রাইমারী অর্থনীতি - এই বেসিক অর্থনীতির খুব বেসিক সেবা খাতকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
সরকারের বগল বাজানো জন প্রতি, ১০০০ ডলার বাৎসরিক আয়, মানে ৬৫০০ টাকা মাসিক আয়ই বলে দিচ্ছে অর্থনীতিতে, তার ভুমিকা প্রান্তিক। এবং এইটা পরিষ্কার ১৬ কোটি মানুষের দেশে,
বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযোগহীন এই, ৯৬% জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ নিম্ন আয়ের ট্র্যাপে আটকানো।
বিশ্ব অর্থনীতির সাথে তার সংযোগহীনতা এই জনগোষ্ঠীর জন্যে, পোশাক শিল্পের মত কোন ধরনের দৃঢ়তাকে নির্দেশ করেনা। বরং নির্দেশ করে, তার ৬৫০০ টাকা আয়ের ট্র্যাপে আটকে পড়া টাকেই। কারন, কোন মতেই এতো নিম্ন উৎপাদনের একটা দেশ, তার নিজের একই নিম্ন আয়ের ভাই ব্রাদারদের মধ্যে, উৎপাদন, কেনা, বেচা সংযোগের মাধ্যমে ৬০০০ থেকে ২৬০০০ টাকায় পৌঁছাতে পারবেনা(২৬ হাজার টাকা হচ্ছে, মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার মাসিক সীমানা)।
দ্বিতীয় যেইটা বিষয় সেইটা হইলো, কমোডিটির দাম পরে যাওয়াতে, কৃষি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এখনো গ্রামে থাকা ৭০% জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরাসরি। যার ইম্প্যাক্ট আমরা বিগত কয়েক বছর দেখেছি। ধানের দাম পরে যাওয়াতে, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষক তখন, পেটে ভাতে থেকে, অন্য খরচ কমিয়ে দেয়, গ্রামের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়।
বিগত, কয়েক বছরের ধানের দাম কমে যাওয়ার বিষয়টা আমরা দেখেছি। পর পর কয়েক বছর কৃষকরা সাফার করেছেন। (কিন্তু যদিও সরকার গ্রামের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে গ্যাছে , সে অন্য গল্প)।
এই খানে আরও একটা আলাপ আসে, তা হইলো, ধানের দাম কমা তো সরকারের সাফল্য তাহলে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত স্বস্তি পায়। তাইলে সেইটায় তো অখুশি হওয়ার কিছু নাই।
বাস্তবতা হইলো, এইটাই হইলো সেই সাইক্লিকাল দারিদ্র, যার কথা আমরা আগে বলেছি।
প্রশ্ন হচ্ছে আর কত বছর, ৪০ টাকার চাল খাইয়ে কৃষককে গরীব রাখবেন ?
সব কিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু চালের দাম যদি না বাড়ে, সব্জির দাম যদি না বাড়ে তাহলে কৃষকের পরিবার চলবে কিভাবে ?
এই খানেই আসে, রিয়েল প্রগতির প্রশ্নটা যেই প্রগতিতে, আপনার প্রান্তিক লোকটার উপার্জন ও এমন একটা পর্যায়ে যাবে যখন সে, ৮০ টাকা দিয়ে চাল কিনতে পারবে। চালের দামের ওঠানামা তাকে স্পর্শ করবেনা। এইটাই রিয়েল প্রগতি।
এবং এই খানেই আমরা একটা সংযোগ দেখি। কিভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পতনে বিগত কয়েক বছরে, আমাদের কৃষকেরা এবং গ্রামের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হইছে। কিছু দিন আগের একটা স্ট্যাটাসে, আমার বেশ কিছু বন্ধু কমেন্ট করেছিলেন, যারা বলেছিলেন কিভাবে , গ্রামের এবং মফ্ঃস্বলের অনেক ব্যবসায়ী ধ্বসে পড়েছে এবং আলু হতে শুরু করে বেশ কিছু প্রোডাক্টে অনেক কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে গ্যাছে।
এই খানে এখন আসে, আমাদের দ্বিতীয় হাইপথেসিস বুজরুকি ডাটার ভুমিকা। বুজরুকি ডাটার ভুমিকা এই খানে যে, বুজরুকি ডাটা গ্রামের অর্থনীতির এই ধাক্কা খাওয়াটাকে, কৃষকের এই সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়াকে লুকিয়ে রাখে।
রাখতে সে পারে, কারন তাকে এক দিকে সাপোর্ট দেয় পোশাক শিল্পের গ্রোথ, দুই ইম্পোরটের ভ্যালু কমে আসাতে ব্যাল্যান্স অফ পেমেন্ট চাপ কমে আসা।
চার নাম্বার যেইটা এখন ডিটেলস আনবোনা এখন সেইটা হইলো, আমাদের জিডিপি টু লোণের রেসিওটা কম থাকাতে কিভাবে উচ্চ ঋণ করে, অর্থনীতিতে একটা এক্টিভিটি যোগ হচ্ছে যেইটা শুধু মাত্র একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর পকেট ভরাচ্ছে কিন্তু আমাদের ফিউচারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কিন্ত, এইটা এখানে আনলাম কারন, বুজরুকি ডাটাতে এই স্পেন্ডিংটা একটা গ্রোথের পারসেপ্শান সৃষ্টি করছে।
কিন্ত, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ব অর্থনীতির সাথে আমাদের অর্থনীতির সংযোগ যে একেবারেই নাই তা নয় এবং তার ইম্প্যাক্ট আমাদের উপরে পরে কিন্তু বুজরুকি ডাটা দিয়ে সেই ইম্প্যাক্টাটা লুকিয়ে রাখা হয় মাত্র।
ম্যাক্রো ইকনমিক ডাটার দিকে দেখলে, বিশ্ব অর্থনীতির সাথে বিচ্ছিন্ন একটা দেশ। এইটার থেকে পরিষ্কার হয়, , আমাদের ৯৬% এর বিচ্ছিন্ন অংশটি একটা সাইক্লিক পভারটিতে আটকে আছে। (সাইক্লিক পভারটি শব্দটায় অনেকে আপত্তি করবেন, কারন, এইটা আশির দশকের শব্দ। কিন্তু, আই আম সরি। বিশ্ব ব্যাংকের ডাটায় পভারটি না বললেও, মাসিক ৬০০০ টাকা আয়কেও দরিদ্রের অধিক কিছু বলতে পারছিনা বলে দুঃখিত। )
সাইক্লিক পভারটি শব্দটা এই খানে আনার কারন হলো, কৃষি পন্যের ভিত্তিতে উৎপাদিত সেকেন্ডারি পন্য, কল সেন্টার, আইটি পণ্য, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মেধা ভিত্তিক পন্য, পোশাক শিল্প বাদে অন্য শিল্প পন্য, কুটির শিল্প, তাত, পাটজাত দ্রব্য, ফাউন্ড্রি, মেটাল শিল্প, ভ্যালু এডেড মৎস্য শিল্প ইত্যাদি ইত্যাদি সহ অজস্র দিকে, বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযোগ করা বাদে শুধু নিজেদের মধ্যে ৬০০০ টাকা আয়ের পন্য বিপণন করে, এই জনগোষ্ঠী কোন মতেই, তার এই নিম্ন আয়ের চক্র থেকে বেরোতে পারবেনা।
এই সংযোগ স্থাপন হলে, বিশ্ব অর্থনীতি পড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতিও পড়বে, উঠলে বাংলাদেশ ও উঠবে। কিন্তু তখন সেই কানেক্টেড অর্থনীতি একটা সত্যিকারের প্রগতিকে নির্দেশ করবে । যখন চালের দামের উঠা নামা দিয়ে, সরকারের সাফল্য নির্ধারণ হবেনা। এবং এখন কমোডিটি পন্য ভিত্তিক যে সংযোগ আছে, সেই সংযোগের ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধাক্কার ইম্প্যাক্টকে , বুজরুকি ডাটা দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২৯