-হারুন ইয়াহিয়া
প্রাণের জটিল অবকাঠামো
বিবর্তনবাদের এমন বৃহৎ অচলায়তনে অবসিত হবার প্রাথমিক কারণ হলো এই যে, এমনকি সরলতম বলে বিবেচিত জীবের মধ্যেও রয়েছে অবিশ্বাস্য রকমের জটিল অবকাঠামো। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, একটি জীবকোষ মানুষের সকল প্রযুক্তিগত উৎপন্নের চাইতে জটিল। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উন্নত গবেষণাগারেও অজৈব বস্তুর সমাহার ও সংশ্লেষে একটি জীবকোষ উৎপাদন করা যাবে না।
একটি জীবকোষ গঠনের জন্য অনুকূল ও সহযোগী অবস্থা, পরিবেশ ও অনুষঙ্গের সংখ্যা এত বিপুল যে শুধু সংমিশ্রনের তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাবে না।
কোষ গঠনের মূল উপাদান প্রোটিনের সমাপতনিকভাবে সংশ্লেষিত হবার সম্ভাবনা ৫০০ এ্যামাইনো এসিডযুক্ত সাধারণ প্রোটিনের ক্ষেত্রে 10 to the power of 950 -এ ১ গণিতশাস্ত্রে 10 to the power of 50 -এ ১ অপেক্ষা কম সম্ভাবনা (Probability)-কে কার্যত অসম্ভব বলে বিবেচনা করা হয়।
কোষের পরমাণু কেন্দ্রে অবস্থিত ডিএনএ অণু হচ্ছে বংশানুগতি তথ্যের ভান্ডার এবং সেটি একটি অবিশ্বাস্য ডাটা ব্যাংক। হিসেব কষে দেখা গেছে ডিএনএ-তে কোড করা তথ্য যদি কাগজে-কলমে লেখা হয়, তাহলে তা' দিয়ে প্রতিটি ৫০০ পৃষ্ঠা সংবলিত ৯০০ খন্ডের এনসাইক্লোপিডিয়ার এক বিশাল গ্রন্থাগার গড়া যাবে।
এই পর্যায়ে একটি চিত্তাকর্ষক ধাঁধার উদ্ভব ঘটেঃ ডিএনএ'র পুনর্সৃষ্টি হতে পারে কেবল কতিপয় বিশেষায়িত প্রোটিন (এনজাইম)-এর সহযোগে। কিন্তু এনজাইমগুলোর সংশ্লেষণ সম্ভব কেবল ডিএনএ-তে কোড করা তথ্য দ্বারা। যেহেতু তারা উভয়ে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, সুতরাং পুনসৃর্ষ্টি প্রক্রিয়ায় উভয়কে একই সময়ে বিদ্যমান থাকতে হবে। প্রাণ আপনা আপনিই উদ্ভুত হয়েছে এই তত্ত্বটি এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট বিবর্তনতাত্ত্বিক অধ্যাপক লেসলি ওর্গেল তাঁর তত্ত্বের এই বিপর্যয় স্বীকার করেছেন ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যা 'সায়েন্টিফিক আমেরিকান' ম্যাগাজিনেঃ
প্রোটিন ও নিউক্লেয়িক এসিড উভয়ের গঠনপ্রণালী অতি জটিল। এটা প্রায় অসম্ভব যে, উভয়ে একই স্থানে ও একই কালে স্বতঃ উদ্ভুত হয়েছিল। আবার, একটি ছাড়া অন্যটির অবস্থানও অসম্ভব মনে হয়। কাজেই প্রাথমিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তই করতে হয় যে, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কস্মিনকালেও জীবনের উৎপত্তি হতে পারে না।
জীবন যদি প্রাকৃতিক উপায়ে উদ্ভুত না হয়ে থাকে তাহলে, সন্দেহ কি, জীবন 'সৃষ্টি' করা হয়েছে অতিপ্রাকৃত উপায়ে। এই সত্য সুস্পষ্টরূপে বাতিল করে দেয় বিবর্তন তত্ত্বকে, যার মূল উদ্দেশ্য সৃষ্টিতত্ত্ব অস্বীকার করা।
বিবর্তনবাদের কাল্পনিক যন্তর-মন্তর
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ডারউইনের তত্ত্বকে নস্যাৎ করে তা হচ্ছে এই যে, "বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়া" বলে এই তত্ত্বে উপস্থাপিত উভয় ধারণাই বাস্তবে বিবর্তনী ক্ষমতাহীন বলে অনুভূত হয়।
ডারউইন তাঁর তথাকথিত বিবর্তন তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে "প্রাকৃতিক নির্বাচন" (ন্যাচারাল সিলেকশন) প্রক্রিয়ার ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। এ প্রক্রিয়ার ওপর তিনি কতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তা তাঁর বইয়ের শিরোনাম থেকেই অনুমান করা যায়ঃ The Origin of Species, By Means of Natural Selection (প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে)...
'প্রাকৃতিক নির্বাচন' ধারণামতে কেবল সেসব প্রাণীই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকবে যারা অধিকতর শক্তিশালী এবং তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বন্যজন্তুর আক্রমণের হুমকির মুখে একটি হরিণের পালের মধ্যে যে হরিণগুলো দ্রুততর গতিতে দৌড়াতে পারবে সেগুলোই বেঁচে থাকবে। সুতরাং হরিণের পাল গড়ে উঠবে দ্রুততর ও বলবত্তর হরিণদের নিয়ে। তবে কোন সন্দেহেরই অবকাশ নেই যে, এই প্রক্রিয়া হরিণদের বিবর্তিত করে অন্য কোন প্রজাতি, যথাঃ ঘোটক-এ রূপান্তরিত করবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোন বিবর্তনবাদী ক্ষমতা নেই। ডারউইনও এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং তাঁর বই "প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি"-তে তাঁকে বলতে হয়েছেঃ
ঘটনাক্রমে অনুকূল বৈচিত্র্যের উদ্ভব না ঘটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্বাচনের কিছুই করার থাকে না।
লামার্কের প্রভাব
তাহলে এ "অনুকূল বৈচিত্র্য" বা পরিবর্তনগুলো কিভাবে ঘটতে পারে?
ডারউইন তাঁর সমকালের বিজ্ঞানের আদিম ধারণা থেকে এ প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন। ডারউইনের পূর্বসূরী ফরাসী জীববিজ্ঞানী লামার্ক বলেন যে, প্রাণীকূলের জীবনব্যাপী অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তর প্রজন্মে বর্তায়; এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে সংবহিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সমাহারের ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল। লামার্ক এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ দাবি করেন যে, হরিণের বিবর্তনে জিরাফের উদ্ভব হয়। হরিণদের উঁচু ডালের পাতা খাবার নিরন্তর চেষ্টার ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে তাদের গলা লম্বা হতে থাকে, পরিশেষে তাদের বিবর্তিত উত্তর প্রজন্ম জিরাফ আকারে নতুন প্রজাতিরূপে উদ্ভুত হয়।
ডারউইনও অনুরূপ কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন; যেমন, The Origin of Species গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে কিছু ভল্লুক খাদ্যের সন্ধানে জলে নেমে তিমি হয়ে যায় কালান্তরে।
কিন্তু মেন্ডেলের আবিস্কৃত উত্তরাধিকারবিধি, যা বিংশ শতাব্দীতে বিকশিত প্রজননবিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত, পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয় এ বিশ্বাস যে প্রাণীকূলের অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তর প্রজন্মে বর্তায়। এভাবেই একটি বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়ারূপে প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্বটি অনাদৃত হয়ে পড়ে।
নয়া ডারউইনবাদ ও পরিব্যপ্তি
এ সমস্যার একটি সমাধানে পৌঁছার আশায় ডারউইনবাদীরা ১৯৩০ দশকের শেষ দিকে উত্থাপন করেন, "আধুনিক সংশ্লেষী তত্ত্ব" (Modern Synthetic Theory) যা, নিও-ডারউইনিজম নামে সমধিক পরিচিত। নিও-ডারউইনিজম "অনুকূল বৈচিত্রের কারণ" স্বরূপ প্রাকৃতিক পরিবর্তনের অতিরিক্ত প্রাণীদেহে জীনের (gene) পরিব্যপ্তি (mutation) ধারণার আমদানি করে; বাহ্যিক কারণ যথা বিকিরণ বা তেজস্ক্রিয়তা কিংবা পুনরুৎপাদন ভ্রমের ফলে জীনের এরূপ বিকৃতি ঘটে বলে তাদের ধারণা।
আজ সমগ্র বিশ্বে বিবর্তনবাদের যে আদর্শ বা মডেল টিকে আছে তা হচ্ছে, নিও-ডারউইনিজম। এই তত্ত্ব মতে পৃথিবীতে যে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী বিদ্যমান রয়েছে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে এমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে তাদের জটিল অঙ্গ সংস্থানগুলো যথাঃ চোখ, কান, ফুসফুস, ডানা - প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে জীনঘটিত বিকৃতির ফলে পরিব্যপ্তি লাভ করে। কিন্তু এ তত্ত্বটি নস্যাৎ করছে একটি সোজা সাপটা বৈজ্ঞানিক সত্যঃ পরিব্যপ্তি প্রাণীদের বিকশিত করে না, বরং তাদের ক্ষতি করে।
এর কারণ অতি সহজবোধ্য; ডিএনএ-এর আছে অতি জটিল সংযুতি (Structure), এলোপাতাড়ি বিন্যাসভঙ্গ কেবল তার ক্ষতিই করতে পারে। মার্কিন প্রজনন বিজ্ঞানী বি. জি. রঙ্গনাথন এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ
প্রথমত, প্রকৃতিতে প্রকৃত পরিব্যপ্তি খুবই বিরল। দ্বিতীয়ত, পরিব্যপ্তি যেহেতু জীনের সংযুতির সৃশৃঙ্খল পরিবর্তন নয় বরং এলোপাতাড়ি, সেহেতু বেশির ভাগ পরিব্যপ্তিই ক্ষতিকর। অতি সৃশৃঙ্খল একটি সংযুতিতে এলোপাতাড়ি পরিব্যপ্তির ফল মন্দই হবে, ভালো হবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোন ভূমিকম্প যদি অতি সৃশৃঙ্খল একটি সংযুতি, যথা দালান, কাঁপিয়ে দেয় তাহলে তার ফলে ওই সংযুতির কাঠামোতে যে পরিবর্তন সংঘটিত হবে তা, খুব সম্ভব, কাঠামোর উন্নতিসূচক হবে না।
বিস্ময়কর নয় যে, কোন উপকারী অর্থাৎ যা জীন কোড উন্নত করে, এমন পরিব্যপ্তি আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সব পরিব্যপ্তিই ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, "বিবর্তন প্রক্রিয়া" বলে যে পরিব্যপ্তি হাজির করা হয়েছে তা আসলে জীন অভ্যন্তরের এমন একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা যা প্রাণীসত্তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, এবং তাকে অক্ষম বা বিকলাঙ্গ করে। (মানুষের ক্ষেত্রে পরিব্যপ্তির সবচাইতে সাধারণ পরিণাম হচ্ছে কর্কটরোগ বা ক্যানসার)। নিঃসন্দেহে একটি বিধ্বংসী প্রক্রিয়াকে "বিবর্তন প্রক্রিয়া" বলা যায় না। অপরপক্ষে, "প্রাকৃতিক নির্বাচন এককভাবে কিছুই করতে পারে না", স্বয়ং ডারউইন এ কথা স্বীকার করেছেন। এতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রকৃতিতে "বিবর্তন-প্রক্রিয়া" বলে কিছু নেই। যেহেতু বিবর্তন প্রক্রিয়ার কোন অস্তিত্ব নেই সুতরাং বিবর্তন নামে কোন কাল্পনিক ঘটনাও কদাপি সংঘটিত হয়নি। ... (চলবে)
*** অনুবাদ করেছেনঃ আবুল বাশার ***
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:২৫