সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়গুলোতে 'ঘুষ' নেয়া-দেয়া রেওয়াজ হিসেবে পরিণত হয়েছে। শুধু খুলনা অঞ্চলেই প্রতি কেজি চাল সংগ্রহে এর পরিমাণ ৭৫ পয়সা থেকে শুরু করে ২ টাকা পর্যন্ত। স্থানভেদে তা ৩ টাকাও হয়েছে। আর খুলনা অঞ্চল থেকেই ১০ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহে প্রায় দেড় কোটি টাকা 'ঘুষ' তুলেছেন খুলনা জেলা খাদ্য পরিদর্শক ও খাদ্য নিয়ন্ত্রক। ঘুষ গ্রহণের 'চিরায়ত সত্য' এ তথ্যটি এবার ফাঁস করেছে খোদ খাদ্য অধিদপ্তরই। খাদ্য অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. এনায়েত হুসাইন তার ১১ পৃষ্ঠার সরেজমিন প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ভিক্তিতে করা এ প্রতিবেদনটিকে 'অতি গোপনীয়' হিসেবে উল্লেখ করে গত ৬ ডিসেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে- সরকার ঘোষিত চাল সংগ্রহে ঘুষ নেয়ার রেওয়াজ পুরনো। আর এ প্রথা শুধু খুলনাঞ্চলেই নয়; সারাদেশেই। গত বছর ঘুষের পরিমাণ কেজিপ্রতি ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা বেড়েছে। আর উচ্চহারের ঘুষ দিয়েও চাল সরবরাহে আগ্রহের ঘাটতি হয়নি চালকল মালিকদের। বরং বরাদ্দপত্র সংগ্রহে তারা প্রতিযোগিতা করেছেন। কারণ, ঘুষ দেয়া হলেই নিম্নমানের চাল সরবরাহে সুবিধা, যা দেখেও না দেখার ভান করেন খাদ্য বিভাগের স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ঘুষের টাকার জোগান দেয়া হয় কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত করে কম দাম দিয়ে। সরেজমিন প্রতিবেদনের সূত্র ধরে চাল সরবরাহে এগিয়ে থাকা জেলা হিসেবে খ্যাত নওগাঁ ও কুমিল্লার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর সত্যতা আরো স্পষ্ট হয়েছে। এ দুই এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, তাদের এলাকায় প্রতি কেজি চাল সরবরাহে ঘুষের পরিমাণ ১-৩ টাকা পর্যন্ত। যেসব চালকল মালিক টাকা দেন না; তারা চাল সরবরাহের কাজও পান না। তাই অধিকাংশ চালকল মালিক স্থানীয় কর্মকর্তাদের চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট থাকেন। তারা ঘুষ দিয়ে 'অতিরিক্ত' চাহিদাপত্র হাতিয়ে নেন। কারণ, ঘুষ দিলে লোকসানের চেয়ে লাভই বেশি। এতে নিম্নমানের চাল অনায়াসেই সরবরাহ করা যায়। অন্যদিকে ঘুষের টাকাও ব্যবসায়ীর ঘর থেকে যায় না। কৃষককে ধানের দাম কম দিয়েই মেলানো হয় হিসাব। এছাড়া গুদামে জায়গা নেই, আজ চাল নেয়া যাবে না, চালের মধ্যে মরা আছেসহ নানা অভিযোগ তুলে ঘুষ নেয়া খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। খাদ্য অধিদপ্তরের এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে- ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে সংগ্রহ নীতিমালা উপেক্ষা করে অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সরকারি চাহিদার পুরোটাই একসঙ্গে বরাদ্দপত্র আকারে দেয়ার নিয়ম থাকলেও খুলনা মহানগরী, রূপসা ও ফুলতলা উপজেলায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। শুধু রূপসা উপজেলায় ১ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের ক্ষেত্রে ২২টি চালকলের বিপরীতে তিন দফায় বরাদ্দপত্র দেয়া হয়েছে। বরাদ্দপত্র দেয়া চালকল মালিকদের কাছ থেকে প্রথম দফায় কেজিপ্রতি ৭৫ পয়সা, দ্বিতীয় দফায় ১ টাকা এবং তৃতীয় দফায় ২ টাকা হারে ঘুষ আদায় করা হয়েছে। আর ঘুষের টাকা আদায় করতেও দেয়া হয়েছে 'অতিরিক্ত বরাদ্দপত্র ঘুষ'। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রূপসা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলীকে। এই সভাপতি ও তার ভাইয়ের মালিকানাধীন দুটি চালকলের বিপরীতে (মের্সাস শাপলা ও পূবালী রাইস মিল) অতিরিক্ত ৫০ মেট্রিক টন করে ১০০ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দপত্র দিয়ে তার মাধ্যমে অন্য চালকল মালিকদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা তোলা হয়েছে। যাকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের চালকল ব্যবসায়ীরা 'চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও হীন কাজ' বলে মন্তব্য করেছেন। ঘুষের টাকা উঠাতে প্রায় একই ধরনের কৌশল ছিল অন্য জেলা-উপজেলাতেও। প্রতিবেদনে 'ঘুষ' আদায়ের সত্যতা তুলে ধরে বলা হয়- চালের বরাদ্দপত্র নিয়ে ঘুষ দেয়া-নেয়ার বিষয়টি চালকল মালিক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস, সংশ্লিষ্ট সব খাদ্য দপ্তর, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর ও খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে 'ওপেন সিক্রেট'। খুলনা মহানগরী, রূপসা ও ফুলতলা উপজেলার ২৪ জন চালকল মালিক তাদের বক্তব্যে সরাসরি ঘুষ দিয়ে বরাদ্দপত্র পেয়েছেন বলে বক্তব্য দিয়েছেন। আর চালের বরাদ্দপত্র পেতে 'ঘুষ অপরিহার্য' বলেই মেনে আসছেন তারা। ঘুষ দেয়া-নেয়ার কথা স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছেন খুলনা মহানগরীর ৫ জন, ফুলতলা উপজেলার ৬ জন এবং রূপসা উপজেলার ১৩ জন চালকল মালিক। তারা হলেন- দামোদার ফুলতলা বাজারের তিনতারা রাইস মিল- ১ ও ২ এর স্বত্বাধিকারী ও ফুলতলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি কিউএবি এহছানুল হক, ফুলতলা রাইস মিলের মালিক রফিউদ্দিন মোল্লা, লবণচরা রাইস মিলের মালিক ও মহানগর রাইস মিল সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামাল, কামাল রাইস মিলের মালিক এবং জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল, রূপসার নীপা রাইস মিলের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন, লবণচরার হক রাইস মিলের মালিক আনোয়ার হোসেন, লবণচরার এফ রহমান রাইস মিলের মালিক মো. মহসীন, রূপসা নন্দনপুরের কাজী রাইস মিলের মালিক স্বপন নন্দী, রূপসার শাপলা রাইস মিলের মালিক শেখ মোহাম্মদ আলী, রূপসার নিকলাপুর ক্রিসেন্ট রাইস মিলের মালিক পবন কুমার সাহা, রূপসার নিকলাপুর পপুলার রাইস মিলের মালিক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, রূপসা মিল্কি দিয়ারার বাংলা রাইস মিলের মালিক আব্দুল আজিজ, রূপসা মিল্কি দিয়ারার এলআরএস রাইস মিলের মালিক গোপাল সাহা, রূপসা নন্দনপুরের পূবালী রাইস মিলের মালিক দিলীপ কুমার দাস, খুলনা লবণচরার কর্ণফুলী রাইস মিলের মালিক কাজী আব্দুল জব্বার, ফুলতলার হোসেন রাইস মিলের মালিক শাহাদত মোড়ল, ফুলতলার জোবেনা রাইস মিলের মালিক সরদার মাহবুবুর রহমান, ফুলতলার হীরা রাইস মিলের মালিক মহসীন গাজী, ফুলতলার গাজী রাইস মিলের মালিক আব্দুস সামাদ গাজী, রূপসার নিকলাপুর মেসার্স শরীফ রাইস মিলের মালিক শেখ আবু জাফর, রূপসা বেলফুলিয়ার নন্দনপুর রাইস মিলের ব্যবস্থাপক আব্দুল জব্বার শেখ, রূপসা বেলফুলিয়ার আইচাগাতি রাইসমিল-২ এর মালিক জিয়াউল হক, রূপসা আইচাগাতির মধুমতি রাইস মিলের মালিক শেখ আসাদুজ্জামান এবং রূপসার পূবালী রাইস মিল নন্দনপুরের মালিক শেখ আব্দুল ওয়াহিদ। এদের মধ্যে দামোদার ফুলতলা বাজারের তিনতারা রাইসমিল-১ ও ২ এর স্বত্বাধিকারী এবং ফুলতলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি কিউএবি এহছানুল হক প্রতিবেদন তৈরিকারী কর্মকর্তাকে জানান, বোরো ২০১২ সালের মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা ঘোষণার পরপরই খুলনা জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি জেলার সব চালকল মালিকদের নিয়ে খুলনা মহানগরীতে সভা আহ্বান করেন। সভায় প্রতি কেজি চাল বরাদ্দের বিপরীতে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে ৭৫ পয়সা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অন্য বছর ঘুষের হার কম থাকলেও এবার বেশি কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা হয় 'এ বছর বাজার দরের চেয়ে সরকারের সংগ্রহ মূল্যের তারতম্য অনেক বেশি। আর সে কারণে ঘুষ নির্ধারণের হারও বেড়েছে।' চালের বরাদ্দপত্র দিয়ে ঘুষ নেয়ার 'যথার্থ' প্রমাণ হিসেবে প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়- খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে চালকলের ছাঁটাই ক্ষমতা সংবলিত কোনো রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করা হয় না। ইচ্ছামতো চালকল মালিকদের চাহিদাপত্র দেয়া হয়। ঘুষের অঙ্কে তারতম্য ঘটলে চালকলের ছাঁটাই ক্ষমতাও কমবেশি করা হয়। যেমন- রূপসা উপজেলার নীপা রাইস মিলকে ৫৪ মেট্রিক টন চাল সরবরাহের জন্য বরাদ্দপত্র দেয়া হয়। অথচ এরইপাশে অবস্থিত আইচগাতি রাইস মিল-২ বরাদ্দ পায় ৪৯ মেট্রিক টন চাল। অথচ নীপা রাইস মিলের চেয়ে আইচগাতি রাইস মিল-২ এর চাতালের আয়তন, অবস্থান, মসৃণতা এবং পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতা অন্তত ৫ গুণ বেশি। প্রায় একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে অন্য জেলা-উপজেলার বরাদ্দপত্র বিতরণেও। সরেজমিন ফুলতলা এলএসডির (খাদ্যগুদাম) ১১, ১৩, ১৪ ও ১৬ নাম্বার খামালে সংরক্ষিত চালের নমুনা যাচাই করে বিনির্দেশে বর্ণিত মাত্রার অনেকগুণ বেশি ভাঙা, মরা ও বিবর্ণ দানার চাল পাওয়া যায়। রূপসা উপজেলার আলাইপুর এলএসডিতেও ফুলতলার মতো প্রায় একই ধরনের নিম্নমানের চাল পাওয়া গেছে। আলাইপুর এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল আনোয়ার প্রতিবেদন তৈরিকারীর কাছে স্বীকার করেছেন, অবৈধ সুবিধা নেয়া মেসার্স নীপা রাইস মিল ও মেসার্স ক্রিসেন্ট রাইস মিল নিম্নমানের এসব চাল সরবরাহ করেছে। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপের কারণে নিম্নমানের এসব চাল গুদামে ভরা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদন তৈরিকারীকে ঘুষের তথ্য দিলে 'ভীষণ ক্ষতি' হবে বলে চালকল মালিকদের প্রথমে অনুরোধ এবং পরে শাসিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা হুমকি দিয়ে বলেছেন- ঘুষের তথ্য দেয়া হলে ভবিষ্যতে জেলায় রাইস মিলের ব্যবসা বন্ধসহ সরকারি সব ধরনের বরাদ্দ থেকেও বঞ্চিত করা হবে। পরে হুমকির বিষয়টি মিল মালিকদের অনেকেই প্রতিবেদন তৈরিকারীকে জানিয়েছেন। প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে- খুলনা জেলায় ধান-চাল সংগ্রহে কেজিপ্রতি ৭৫ পয়সা থেকে শুরু করে ২ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে জেলা-উপজেলার সভাপতি-সেক্রেটারিদের। বিনিময়ে উৎকোচ হিসেবে তাদেরও দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত বরাদ্দ। আর সরকারি চাহিদার পুরোটা একইসঙ্গে বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও এর বিপরীতে ৩ দফায় বরাদ্দ দেয়ায় স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম-দুর্নীতি স্পষ্ট হয়েছে। এক্ষেত্রে অধিক ছাঁটাই ক্ষমতাসম্পন্ন চালকলের ওপর ইনজাসটিচ করা হয়েছে। দুর্নীতির সুবিধার্থে চালকলের ছাঁটাই ক্ষমতাকে দূরভিসন্ধিমূলকভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘুষ বাণিজ্যের কারণে চালের মান বিনির্দেশ মোতাবেক না হয়ে ভাঙা, ক্ষুদযুক্ত ও নিম্নমানের হয়েছে। অবৈধ লাভের বশবর্তী হয়ে যা (চাল) নির্দিধায় গুদামে পুরেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মিল মালিকরা তথ্য দিতে এলে তাদের সহযোগিতার বিপরীতে হুমকি প্রদানে খাদ্য বিভাগের দুর্নীতি আরো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়েছে- মিল মালিকদের বক্তব্য ও সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে 'অবৈধ ঘুষ' লেনদেনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। ঘুষের বিষয়টি পূর্ব থেকে চলে আসায় এখন রেওয়াজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। স্থানীয় চালকল মালিকদের সহযোগিতায় অবৈধ সুবিধা নিয়ে আসছেন খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তবে, ঘুষ বাণিজ্যে অগ্রণী ভূমিকায় থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শুধাংশু হাওলাদার ও খুলনা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে ডেপুটেশনে কর্মরত খাদ্য পরিদর্শক মো. তৈয়েবুর রহমান।
লিংক: যায়যায় দিন