প্রাচীন গ্রিকের প্রধান দুটি মহাকাব্যের একটি। এর স্রষ্টা হোমার, যিনি তার নামের মতই ভারী একটি চরিত্র। বলা হয়, এই কবিতার মূল বিষয়টি; পশ্চিমা বিশ্বের আধুনিক মতবাদ বা অনুশাসনের ভিত্তিস্বরূপ। ধারনা করা হয়, হোমার তার পৃথিবীবিখ্যাত এই মহাকাব্যটি রচনা করেন ৮ শতকের শেষদিকে, (যীশুর জন্মের পূর্বে)- প্রাচীন গ্রিকের 'আনাতোলিয়া' নামক একটি উপকূলবর্তী অঞ্চলের কাছাকাছি।
ওডিসাস মূলত গ্রিক পৌরাণিক- এর একজন কাল্পনিক বীর যাকে রোমানরা 'ইউলিসিস' নামেও সম্বোধন করে থাকে।
গ্রিক পৌরাণিকে বলা হয় ওডিসাস ছিলেন প্রচণ্ডরকম শক্তিশালী এবং অসাধারন বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একজন বীর যোদ্ধা। ট্রয় নগরীর পতনের পর বীর ওডিসাস- এর নিজ দেশে ফেরার এক সুদীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার উপর ভিত্তি করেই 'ওডিসি' কাব্যটি রচিত হয়েছে। ট্রোজানদের সাথে গ্রিকদের ১০ বছরের যুদ্ধের পর প্রাচীন ট্রয় নগরী সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। সুদীর্ঘ ১০ বছর পর ওডিসাস তার নিজ দেশ 'ইথাকার' উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এই রোমাঞ্চকর এবং বিপদসঙ্কুল যাত্রায় স্বয়ং গ্রিক দেব- দেবীরা, বিভিন্নভাবে ওডিসাসকে সাহায্য করেছিলেন।
ওডিসাসের এই দীর্ঘ ১০ বছরের অনুপস্থিতির কারনে গ্রিকের মানুষরা ধরে নেয়, মারা গেছেন 'ওডিসাস'- তিনি আর কখনই ফিরবেন না তাদের রাজা। শর্ত অনুযায়ী তার স্ত্রী 'পেনেলোপ' কে রাজ্যের অন্য রাজারা বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে তিনি কোনভাবেই রাজি হন না। তার এবং তার পুত্র 'টেলেমাকাসের' দৃঢ় বিশ্বাস, অবশ্যই ফিরে আসবেন 'ওডিসাস'।
'ওডিসি' মহাকাব্যের মূল কাহিনী সংক্ষেপ-
ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে ওডিসাস তার নিজের লোকজন এবং ধন- সম্পদ নিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়েন। দীর্ঘ এই সমুদ্র যাত্রায় একের পর এক ঘটতে থাকে রোমাঞ্ছকর সব কাহিনী। বলা হয়ে থাকে, ওডিসাসের এই সমুদ্র অভিযানের কাহিনীই নাকি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিকতার কাহিনী।
নিজে দেশের প্রায় কাছাকাছি চলে আসার পর হঠাৎ সমুদ্রে ঝড় ওঠে। সেই ঝড় তাদের জাহাজকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক দুরের এক দ্বীপে। সেই দ্বীপে বাস করতো কিছু দৈত্য যাদের প্রত্যেকরেই একটা করে চোখ। তাদেরকে বলা হয় 'সাইক্লপস'।
তারা ছিলো মানুষখেকো। দুধে ভিজিয়ে তারা একের পর এক খেতে শুরু করলো ওডিসাসের সঙ্গীদের। নিজ সাহস আর অসাধারন বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ওডিসাস তার কিছু সঙ্গীকে নিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়। পালাবার আগে সে একটি দৈত্যের চোখ, গাছের গুড়ির সাহায্যে নষ্ট করে দিতেও সফল হয়।
সেখান থেকে তারা দ্রুত জাহাজ নিয়ে অন্যত্র রওনা হয়। কয়েকদিন যাত্রার পর তারা পৌঁছায় ভাসমান একটি দ্বীপে। সে দ্বীপের রাজা ওডিসাসকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করে। ওডিসাস তার কাছে 'সাইক্লপসদের' ঘটনা বলে এবং দেশে ফেরার জন্য সাহায্য চায়। রাজা তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে। বায়ুর দেবতাকে তাদের সাহায্য করার কথা বলেন রাজা। টানা ১০ দিনে ভালোভাবে দাঁড় টানে তারা। ওডিসাসের কিছু সঙ্গীর দুষ্কৃতীর কারনে বায়ু দেবতা হঠাৎ তাদের উপর চড়াও হয় এবং আরেকটি প্রবল ঝড় এসে তাদেরকে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
ভাসতে ভাসতে তারা আরেকটি অজানা দ্বীপে নোঙ্গর করে। সেখানে নেমে ওডিসাস তার সঙ্গীদের দুটি দলে ভাগ করে শিকার করতে পাঠায়। একটি দল শিকার করতে করতে বনের ভিতরের দিকে চলে যায়। দলের সর্দার সবাইকে সাবধান থাকতে বলে। হঠাৎ তারা খুব মিষ্টি কণ্ঠে গানের আওয়াজ শুনতে পায়। সেই গানের সুরে তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চলে যায় আরও ভিতরের দিকে। শুধুমাত্র দলের সর্দার বুঝতে পারছিলো এটা কোন বিপদের আভাস। সে সবাইকে সাবধান করলেও কেউ তার কথা শুনলো না। তারা কণ্ঠস্বরের পিছু নিতে নিতে একটি প্রাসাদের সামনে চলে এলো। সেটা ছিলো সেই দ্বীপের রানীর প্রাসাদ। সবাই তাকে শারসি রানী বলে। সর্দার বাদে বাকি সবাই ভেতরে ঢুকলেন। রানী তাদের সবাইকে খুব আদর যত্ন করে খাবার খাওয়ালো। সে খাদ্য ছিলো মন্ত্র পড়া। ফলে, তারা সবাই শূকরে পরিনত হয়ে যায়। দলটির সর্দার ব্যাপারটি দেখতে পান কিন্তু একা কিছু করার সাহস তার নেই। সুতরাং, সে ফিরে গিয়ে ওডিসাসকে ব্যাপারটা জানায়। ওডিসাস একাই তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে পরে। জঙ্গলের মাঝখানে তাকে সাহায্য করার জন্য উপস্থিত হন এক দেবী, (সম্ভবত 'অ্যাথেনা') তিনি ওডিসাসকে রক্ষা করার জন্য একটা কবচ দেন। ওডিসাস সেই কবচ নিয়ে রানীর প্রাসাদে যায় এবং রানী যথারীতি তাকেও মন্ত্রমিস্রিত খাবার খাওয়ায়। কবচের কারনে ওডিসাসের কিছু হয় না। রানী বুঝতে পারে ইনি কোন সাধারন মানুষ নন। হয়তো কোন দেবতা। রানী ভয়ে জড়সড় হয়ে পরে। ওডিসাস রানীকে বলে তার সঙ্গীদেরকে মানুষের রুপ ফিরিয়ে দিতে। রানী তা ই করে। এরপর রানী নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চায় এবং ওডিসাসকে দেশে ফেরার জন্য সাহায্য করে। পথে কোথায় কি বিপদ হতে পারে তার আভাসও জানিয়ে দেয়। রানীটি ওডিসাসের প্রেমে পরে যাচ্ছিলো বুঝতে পেরে, ওডিসাস দ্রুত তার সঙ্গীদের নিয়ে দ্বীপ ত্যাগ করে।
এরপর আবার যাত্রা শুরু করে ওডিসাস। কয়েকদিন ভালোভাবে দাঁড় টানার পর হঠাৎ তারা শুনতে পায় দূর থেকে ভেসে আসছে কোন সাইরেনের শব্দ। দ্রুত সেটার মাত্রা বাড়ছে। ওডিসাস বুঝতে পারে এটাই সেই ডাইনীদের দ্বীপ যেটার কথা শারসি রানী তাকে আগেই বলেছিলো। এই সাইরেনের শব্দই তাদেরকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে সেই দ্বীপের দিকে এবং ধ্বংস করে দেবে তাদের সকলকে। ওডিসাস তার সঙ্গীদের কানে তুলো ভরে নিতে বলে। তারা কানে তুলো ঢুকিয়ে দাঁড় টানতে থাকলো ফলে তারা সেই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো। ডাইনীদের মায়াময় সঙ্গীত কারও কানে পৌছালো না। এভাবে কিছুক্ষন চলার পর এক জায়গায় এসে তাদের জাহাজ স্থির হয়ে যায়। কেউ বুঝতে পারছিলো না এর কারন। হঠাৎ সমুদ্রের নিচ থেকে ভেসে ওঠে ৬ মাথাওয়ালা এক বিকট প্রাণী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ওডিসাসের ৬ জন সঙ্গীকে মুখে তুলে নিয়ে আবার ডুবে যায়।
এরপর দ্রুত তারা দাঁড় টানতে শুরু করে এবং সেই বিপদসঙ্কুল অঞ্চলটি থেকে দূরে চলে আসে।
এভাবে আরও কিছু বিপদসঙ্কুল এলাকা দিয়ে তারা যাত্রা করে। পথে ওডিসাসের সঙ্গীদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ, লোভ, হিংসার কারনে দেবতারা তাদের বিরুদ্ধে আবার চড়াও হয় এবং তাদের উপর ঘোর বিপদ নেমে আসে। দেবতাদের আক্রোশে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় ওডিসাসের জাহাজ। শুধুমাত্র ওডিসাসের সততার কারনে দেবতারা তাকে নিরাপত্তা দেয় এবং সে সাতরিয়ে পারে আসতে সক্ষম হয়। বাকিরা সবাই তলিয়ে যায় সমুদ্রের অতল গহ্বরে। যে দ্বীপে ওডিসাস আশ্রয় নেয় সেখানকার রাজা তাকে সাদরে গ্রহন করে এবং তার সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শোনে। রাজা তাকে নিজ দেশ 'ইথাকার' উদ্দেশ্যে, যাত্রা করার সকল বন্দোবস্ত করে দেয় এবং সাথে কিছু লোকজনও প্রেরন করে। বলা হয়, জাহাজে চড়ার পর ওডিসাস, বেশ লম্বা সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পরে। সেই ঘুম ভাঙ্গে 'ইথাকার' মাটিতে এসে।
দেবী "অ্যাথেনার' কথা অনুযায়ী সে তার আসল পরিচয় গোপন রাখে এবং তার পুত্র 'টেলেমাকাসকে' খুজে বের করে। তার কাছেও সে তার আসল পরিচয় লুকিয়ে রেখে তার মা'র খবর জানতে চায়। টেলেমাকাস তাকে বর্তমান অবস্থার কথা খুলে বলে এবং এটাও জানিয়ে দেয় যে, তার বাবা ওডিসাস আর কখনও ফিরে আসবে না। তাই তার মা'কে খুব শীঘ্রই নতুন কারও সাথে বিবাহে আবদ্ধ হতে হবে। অন্যান্য রাজ্যের রাজারা সবাই 'পেনেলোপকে' বিয়ে করার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো কারন, তাকে বিয়ে করা মানে রাজত্ব নিজের হাতে চলে আসা।
ওডিসাস সব ঘটনা বুঝতে পারে এবং সে ভিখারির বেশ ধরে কৌশলে রাজপ্রাসাদে জায়গা করে নেয়। রাজাদের মধ্যে কে 'পেনেলোপকে' বিয়ে করবে সেটা ঠিক করার জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পেনেলোপের কাছে ওডিসাসের একটা ধনুক ছিলো। সেটা এতোটাই শক্ত ছিলো যে ওডিসাস ব্যাতিত অন্য কেউই সেটা টানতে পারতো না। সেই ধনুকটা দিয়ে যে তীর ছুরতে পারবে, পেনেলোপ তাকেই বিয়ে করবে। একে একে সবাই হার মানতে বাধ্য হয়। শক্তিশালী ওডিসাসের ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়া কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। অবশেষে ওডিসাস নিজে উঠে আসেন এবং ধনুকটি ব্যাবহার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। সবাই তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, ফিরে এসেছে তাদের ওডিসাস। রাজ্য দখল করার কূটনৈতিক চাল যাদের মধ্যে ছিলো তাদের সকলকেই ওডিসাস তৎক্ষণাৎ হত্যা করে। রানী চিনতে পারেন তার স্বামী ওডিসাসকে। দীর্ঘ ২০ বছর পর ওডিসাস ফিরে আসে তার পরিবারের কাছে। বিশ্বস্ততা, সততা, একাগ্রতা আর ধৈর্য্যের অপূর্ব সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ওডিসাসের পৃথিবী বিখ্যাত রোমাঞ্চকর কাহিনী।
বইটির ডাউনলোড লিংক-
শেষ কথা-
হোমারের পৃথিবীবিখ্যাত অমর এই মহাকাব্য সেই ৮ এর শতক থেকে এখন অব্দি মানুষের মনে জয় করে আসছে। কি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তার লেখনিতে যার কারনে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এই মহাকাব্যটি পৃথিবীর অন্যতম এক ক্ল্যাসিক হিসেবে চলে আসছে। অনুবাদ করা হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায়। অসম্ভব সাহস, ধৈর্য্য, একাগ্রতা, সততা বিশ্বাস ইত্যাদি সবকিছুর সমন্বয় একটি মাত্র কাব্যে একসাথে ঘটানো খুব সাধারন কোন কথা নয়। কিছু কিছু সৃষ্টি মানুষকে এমনভাবে অমর করে রাখে যা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। মানুষের মাঝে এমন ক্ষমতা অবশ্যই আছে যার দ্বারা সে ইচ্ছা করলেই পারে অসাধ্যকে সাধন করতে। প্রয়োজন- আত্মবিশ্বাস।
............................................. ..........................................
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৩৫