এটা কোন ভুতের গল্প নয়
বছরখানেক আগের ঘটনা। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সারাদিন আজাইরা ঘুরতাম। কাজ- কাম তেমন একটা করতাম না। আব্বা আম্মা বকা-ঝকা করতেন কাজ করি না বলে।
আমার আসলে কাজ করতে ভালো লাগতো না। সারাদিন বাসায় বসে মুভি দেখার চেয়ে বড় কাজ আর কি ই বা থাকতে পারে? যাই হোক, এমন সময় একদিন বাসায় এলো আমার এক ফুপাতো ভাই। বয়সে বড়। আমাকে আজাইরা ঘুরতে দেখে সেও চিন্তিত। পরামর্শ দিলো, বসে না থেকে টেক্সটাইল এর উপর একটা কোর্স করতে। এটার নাকি এখন ভালো চাহিদা। কুমিল্লার কোন একটা জায়গার কথা বললো। তার শ্বশুর বাড়ি থেকে নাকি একটু দুরেই।আমি একগাল হাসলাম।
উনি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর কেন জানি নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেলাম কোর্সটা করার জন্য। কোর্স করতে যেতে হবে ঢাকার বাইরে, কুমিল্লার দিকে। এজন্যই হয়তো রাজি হলাম কারন, বহুদিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। একরকম হলিডেই ধরে নিলাম। আব্বা- আম্মা তো বেশ খুশি আমার এই উদ্যোগে। তারা ভাবলেন, এবার হয়তো আমার মাথায় কাজের ধান্দা আসতে শুরু করেছে। সঠিক ব্যাপারটা আমি ছাড়া কেউ জানলো না। দরকারও নেই।
তিন মাসের কোর্সের জন্য বাসা ছাড়লাম। কুমিল্লায় এক মেসে থাকা শুরু করলাম। কোর্সের সব ছাত্রদেরকেই ওইখানে থাকতে হয়। থাকলাম। দেখতে দেখতে ৩ মাস কেটে গেলো। কোর্স শেষ করলাম। শেষ দিনের ঘটনা-
ব্যাগ- ট্যাগ গোছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ফুপাতো ভাই বারবার ফোন দিয়ে বলছিলো, তার শ্বশুরবাড়িতে যেতে। সে নিজেও নাকি তখন শ্বশুরবাড়িতে। যাবো কি যাবোনা, চিন্তা করছিলাম। পরে ফোন করে বলে দিলাম আসতে পারবো না। আজকে রাতেই বাসায় ফিরতে হবে।
জামা-কাপড় যা কিছু এনেছিলাম সব একটা ব্যাগে ভরলাম।
বের হতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে মেসের এক সিনিয়র ভাই মনির, আমার পথ আটকালো। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি ব্যাপার মনির ভাই, কোন সমস্যা?
মনির ভাই মুখে একটা স্ফীত হাঁসি ঝুলিয়ে বলল- চলে যাচ্ছো শুনলাম। তা, রাতে কেনো? সকালে বের হলেই তো পারতে? আমি বললাম- তা পারতাম, তবে ভাই বাড়ির জন্য মন টানছে। আর, ঢাকার মায়া বেশীদিন ভুলে থাকতে পারি না। তাই আর সকালের অপেক্ষা করলাম না।
মনির ভাই বললেন- ঠিক আছে, যেতে চাচ্ছো যাও তবে সোজা রাস্তায় ডানদিকে- বাঁশঝাড়ের যে পথটা আছে ওদিক দিয়ে যেয়ো না। বা দিকের ঢালু রাস্তাটা ধরে যেয়ো। সময় বেশি লাগলেও ওই পথটাই সেফ। স্থানীয়রা বলে, বাঁশঝাড়ের পথটা নাকি ভালো না। বেশ প্যাঁচালো। আজব আজব সব জিনিষ দেখা যায়। গত মাসেও নাকি এক বুড়ো লোক, ওই পথে যাওয়ার সময় গলা- কাঁটা এক লোককে দেখে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। এমনিই ভীতু মানুষ, তার উপর এই যাত্রাকালে উনি এসে শুনিয়ে দিলেন মস্তক বিহীন কাহিনী।
ধুর, মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো উনার উপর।
সিনিয়ার ভাই, যাওয়ার সময় দোয়া না করে এসেছেন ভয় দেখাতে, সাথে ফ্রি ‘কু’- ডাক দিতেও ভুললেন না।
জিদ চড়ে গেলো। যেভাবে হোক, আজই ঢাকা যাবো। মুখে একটা সাহসী হাঁসি ফোটানোর চেষ্টা করে বললাম- সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ মনির ভাই। তবে, আমি এসবে বিশ্বাস করি না। ভালো থাকবেন। আবার এলে দেখা হবে- বলে বেরিয়ে গেলাম। উনাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলাম না। মনির ভাই কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, আমি ঝড়ের বেগে চলে এলাম।
শুরু করলাম যাত্রা-
বের হয়েই মনে হলো, কাজটা ঠিক হয়নি। সকালে বের হলেই ভালো হতো। যাই হোক, এখন আর এতো চিন্তা করে লাভ নেই। বেরিয়ে পরেছি যেহেতু, গন্তব্যে না পৌঁছে থামবো না। তাছাড়া, ফিরে গেলে মনির ভাই আমার সাহসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সুতরাং, মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম- জীবনের প্রথম প্যারানরমাল কোন অভিজ্ঞতার।
ঘড়িতে সময় তখন আনুমানিক ৯টা। গ্রাম অঞ্ছল, তাই মনে হচ্ছিলো রাত ১২টা, ১টা বেজে গেছে।
পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক দুরের কিছু বাড়িতে হ্যারিকেনের আলো জ্বলছিলো। আকাশের দিকে তাকালাম। বিশাল বড় এক চাঁদ উঠেছে, ফুল মুন। বুঝলাম, আজ পূর্ণিমা। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ মামা। আমার জন্য ভালই হয়েছে। পথ চলতে সুবিধা হচ্ছে। অন্ধকারে এই কাঁচা রাস্তা ধরে হাটা কষ্টকর হয়ে যেতো।
পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে, আমি একা চাঁদের আলোয়, মৃদু বাতাস- পরিবেশটা ভৌতিক কিনা জানিনা তবে, হালকা বাতাসটা গায়ে কেমন যেনো একটা কাঁপুনি ধরায়। সেটা ভয়ের কারনেও হতে পারে। আমল দিলাম না। ভয় পাওয়ার কোন কারন যদিও নেই, তবু অশুভ কিছু মনে করতে চাইছিলাম না। অজানা কারনে তারপরও বারবার মনির ভাইয়ের সেই গলা কাঁটা কাহিনীটা, মনে জায়গা করার চেষ্টা চালালো। সফল হতে দিলাম না। মনে করলেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে আমি জানি। আর চলতে পারবো না। তাই, অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম।
বেশ খানিকটা পথ হাঁটতে হবে কাঁচা রাস্তা ধরে। এরপর, পাকা রাস্তা ধরে খানিকটা পথ হাঁটলেই বাস স্ট্যান্ড। ওখান সারা রাতই বাস চলাচল করে।
মনে মনে ভাবছিলাম, ফুপাতো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি একটু সামনেই। একবার গিয়ে আসলে মন্দ হতো না। ভাই তো আছেই, সাথে ভাবি, ভাবির বাবা- মা, এবং ভাবির ছোট বোন। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট। সময়টা বেশ খানিকটা উত্তেজনার মধ্যেই কাটতো আশা করি। তরুন বয়সের এই উত্তেজনাটাই আঁটকে রাখা দায়। হুটহাট করে কাউকে ভালো লেগে যায়।
মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে কিছু রোমান্টিক চিন্তা চলে এলো মাথায়। পরিবেশ কিছুটা চেঞ্জ হলো।
পরবর্তী প্রায় ১৫ মিনিট, ভয় নামক কোন বস্তু আমার মধ্যে সংক্রমিত হতে পারলো না। রোমান্টিকতার কাছে হার মানলো ভৌতিকতা।
হঠাৎ --------
কাছে- পিঠেই কোথাও প্রচণ্ড জোড়ে একটা শেয়াল ডেকে উঠলো। ভেঙ্গে খান খান করে দিলো আমার রোমান্টিক নীরবতা। কলিজা এক লাফে গলায় চলে এলো। আশে-পাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলাম না তবে বুঝতে পারছিলাম শেয়ালটা আমার ৪ কি ৫ হাত দূর থেকে ডেকেছে। সম্ভবত ডান দিকের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে।
বাঁশঝাড় !!!!!!!
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বাঁশঝাড়ের পথটা দিয়ে চলে এসেছি, খেয়ালই নেই। কি করবো ভেবে পেলাম না। বা দিকের ঢালু পথটা; যেটার কথা মনির ভাই বলেছিলেন, সেটা অনেক পিছনে ফেলে এসেছি। বাঁ দিকে এখন বিশাল এক ফাঁকা মাঠ। ঘুরে যাবো কিনা ভাবছি, হঠাৎ সামনে চোখ পড়তে দেখলাম- একটা শেয়াল আমার সামনে দিয়ে রাস্তাটা ক্রস করলো। ক্রস করে সে ডানপাশের বাঁশঝাড়ে ঢুকে গেলো।
দৃশ্যটা খুব সাধারন হলেও আমার কাছে মনে হচ্ছিলো- এই সাধারন দৃশ্যটা আমার হার্ট এবং ব্লাড- সার্কুলেশন বন্ধ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একবার ভাবলাম, মেসের দিকে দৌড় দেই। কিন্তু মনে হলো, শেয়ালটাও যদি পিছনে দৌড়াতে শুরু করে তখন আরেক ঝামেলা। দৌড়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সামনের দিকেই হাটা শুরু করলাম আর, যতো দোয়া জানতাম সব একাসাথে পড়া শুরু করলাম।
এমন সময় হঠাৎ মনে হলো, কেউ আমার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে। স্পষ্ট শুনতে পেলাম হাটার শব্দ। ভয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে তিনগুনে দাঁড়ালো। খুব ভারী পদশব্দ। আমার হাটার তালে তালে হাঁটছে। মনের ভুল নাতো?
নাহ, শব্দ যথেষ্ট স্পষ্ট। আমি পরিক্ষা করার জন্য থামলাম, শব্দটাও থেমে গেলো। যখনই চলতে শুরু করি, পিছনের শব্দটাও তখনই শুরু হয়। আচ্ছা মুসিবতে পরলাম। অপ্রত্যাশিত অতিথির জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এখন মনে হচ্ছে, সে এতো সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। কিছু একটা করা দরকার। কয়েকবার ঘুরে তাকানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলাম। সাহসে কুলালো না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম।
এভাবে আর বেশিক্ষন চলতে পারবো না। পরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকলে শেয়ালের খাদ্যে পরিণত হতে হবে। এক মিনিটের জন্য থামলাম। বেশ লম্বা করে একটা নিশ্বাস নিলাম।
শুরু করলাম দৌড়........
ডানে বায়ে তাকালাম না। সোজা নাক বরাবর দৌড়াতে থাকলাম। পিছনের শব্দটাও প্রখর হলো। সেও দৌড়াচ্ছে আমার পিছু পিছু। কে, আমি জানি না। শুধু জানি, কেউ একজন আছে আমার পেছনে। কে হতে পারে চিন্তা করে আমার রক্ত হিম হয়ে গেলো। থামলাম না। যতো জোড়ে সম্ভব দৌড়ালাম। আজ এই দৌড়, জীবন বাঁচানোর দৌড়। সহজে থামবে না।
প্রায় ২০ মিনিট দৌড়ানোর পরও বাঁশঝাড়টা কোনভাবেই ক্রস করতে পারছিলাম না। প্রতিবারই হাতের ডানদিকে এসে উপস্থিত হচ্ছে বাঁশঝাড়টা। কি হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আজই কি তাহলে আমার শেষ দিন? ঢাকায় কি প্রান নিয়ে ফেরা হবে?
দোয়া কালাম পড়া এক মিনিটের জন্যও থামালাম না। মনে বেঁচে থাকার অদম্য আশা নিয়ে দৌড়ের গতি আরও বাড়ালাম।
কতক্ষন দৌড়েছি মনে নেই। এক সময় দম ফুরিয়ে এলো। আর দৌড়ানো সম্ভব না। একটা গাছের নিচে দাড়িয়ে ভয়ানকভাবে হাঁপাচ্ছিলাম। জীবনে কখনও এতো দৌড়াইনি। বাঁশঝাড়টা আর চোখে পড়লো না। মনে হয় এবার ঠিক রাস্তায় চলে এসেছি।
একটু দূরে আলো জ্বলতে দেখলাম। কয়েকটা পাকাবাড়ি চোখে পড়লো। বুঝলাম, লোকালয়ের দিকে চলে এসেছি। আর ভয় নেই। কাছে গিয়ে চিনতে পারলাম জায়গাটা। একটু সামনেই ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি।
দেরি করলাম না। সরাসরি গিয়ে উপস্থিত হলাম। সবাই আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো। আমি কথা বাড়ালাম না। সৌজন্যতা শেষ করে ভাইকে কিনারে নিয়ে গিয়ে সব খুলে বললাম। ভাই কিছুটা রাগ হলেন ও পথে আসার জন্য। আমি আবারও মুখে সাহসী হাঁসি ফুটিয়ে বললাম- ব্যাপার নাহ।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত-
গেস্ট রুমে আমার থাকার ব্যাবস্থা করা হলো। খাওয়া শেষ করে শুতে আসলাম। রোমান্টিক চিন্তাকে খারাপ গালি দিয়ে দূর করেছি অনেক আগেই। সে কারনে ভাবির ছোট বোনও কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলো। আসলে, মন থেকে তখনও ওই ব্যাপারটা মুছে ফেলতে পারছিলাম না। ভয়াবহ একটা অভিজ্ঞতা হলো। কখনও ভুলবো না আজকের রাতটার কথা। শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কাধ থেকে ব্যাগ ট্যাগ সব নামালাম। সবকিছু ঠিক আছে কিনা চেক করার জন্য কাধের ব্যাগটা খুললাম। ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আমার এক জোড়া জুতা--------
ব্যাপার বুঝতে পারলাম। পেছনে হাটার শব্দটার মূলে ছিলো আমার এই জুতা।
ব্যাপারটা তখন লজিক্যালি চিন্তা করলাম। সব মিলে গেলো। অতিপ্রাকৃতিক কিছুই ঘটেনি। শেয়ালের ডাক থেকেই শুরু হয়েছিলো আমার ভয়। সেটা থেকে হ্যালুসিনেশন। রাস্তাটা প্যাঁচালো, মনির ভাই আগেই বলেছিলেন। আতঙ্ক নিয়ে দৌড়চ্ছিলাম, মাথা কাজ করছিলো না, আর রাস্তা চেনা না থাকায় একই পথে বারবার ঘুরে চলে আসছিলাম। আর হাটার শব্দের ব্যাবচ্ছেদ তো আগেই করা হলো।
এই হচ্ছে ঘটনা।
কিছু করার মতো না পেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালের বাস ধরতে হবে। শেষ একটা চিন্তা মাথায় আঘাত করলো- একটা শেয়ালকে দেখেছিলাম, আমার বা পাশ থেকে রোড ক্রস করে ডানদিকের বাঁশঝাড়ে ঢুকে যেতে। ডানদিকে ছিলো বিশাল একটা ফাঁকা মাঠ। সেখানে কোন শেয়াল থাকলে আগেই চোখে পরতো।
(উপরে বর্ণিত ঘটনা ৯৯ ভাগ সত্য)
................................................. ...............................................
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:২২