নামটার সাথে সবাই পরিচিত। আমি মাঝে-মাঝে একটা জিনিষ চিন্তা করি, যখনই কেউ ফানি কিছু বা হাস্যকর কিছু করে- অনেককেই বলতে শোনা যায়- 'চাল্লিগিরি বন্ধ কর'
এটা কি সেই 'চার্লি'-কে স্মরণ করেই বলা? তার নাম থেকেই কি 'চাল্লি' শব্দটার উদ্ভব? যাই হোক, অসম্ভব কিছু না।
'স্যার চার্লস স্পেন্সর "চার্লি" চ্যাপলিন'- ছিলেন একজন ইংলিশ কৌতুক অভিনেতা। সেই সাথে ডিরেক্টর, রাইটার, মিউজিক কম্পোজার। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের সবচাইতে সফল একজন অভিনেতা যাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত অভিনেতা ধরা হতো।
American Film Institute- ১৯৯৯ সালে 'চ্যাপলিন'-কে 'সিনেমা ইতিহাসের সর্বকালের সেরা একজন কিংবদন্তী' ঘোষণা করে।
এছাড়াও ১৯১০ থেকে ১৯২০, এই সময়টিতে 'চ্যাপলিন'-কে বলা হতো 'পুরো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাক্তি'।
নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে মানুষকে হাসানো খুব কঠিন একটি কাজ ছিলো। এখনকার যুগে সেটা অনেক সহজ। চলচ্চিত্র শিল্পের সেই কষ্টকর দিনগুলোতে 'চ্যাপলিন' শুধুমাত্র তার মুখভঙ্গি, আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মানুষকে হাসাতেন। পরবর্তীতে, সবাক চলচ্চিত্রের যুগেও নির্বাক চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি মানুষকে বিমোহিত করে রেখেছিলেন। তার বেশিরভাগ চলচ্চিত্র তিনি নিজেই পরিচালনা করতেন এবং ঘটনাগুলোও তিনি নিজেই লিখতেন।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রটির নাম 'The Tramp'/ 'ভবঘুরে'।
এই চরিত্রটির স্রস্টাও তিনি নিজেই।
Tramp- চরিত্রটি প্রথমবার আসে 'Kid Auto Races at Venice' নামক ছবিতে ১৯১৪ সালে।
'চ্যাপলিন' ছিলেন নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তি। তার মধ্যে ছিলো অসম্ভব রকমের 'ক্রিয়েটিভিটি' বা সৃষ্টিশীলতা। 'চ্যাপলিন'-এর গুরু ছিলো একজন ফ্রেঞ্চ কৌতুক অভিনেতা 'Max Linder'- যাকে দেখে প্রভাবিত হয়েই 'চ্যাপলিন' মূলত চলচ্চিত্রে এসেছিলেন।
২০০৮ সালে Martin Sieff নামক এক লেখক 'চ্যাপলিনের' উপর লেখা একটি বইয়ের আলোচনা করতে যেয়ে বলেছিলেন- "চ্যাপলিনকে বড় বলা ভুল হবে, কারন সে বিশাল।
১৯১৫ সাল, যুদ্ধের পর পুরো পৃথিবী ক্ষত- বিক্ষত। অসহায় মানুষরা যুদ্ধের ভয়াবহতায় স্তব্ধ, শোকাহত। ঠিক সে সময়, পৃথিবীর মানুষদের মুখে একটুকরো হাঁসি ফোটানোর দায়িত্ব নেন 'চ্যাপলিন'।
পরবর্তী ২৫ বছর ধরে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে যান তার সমস্ত সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা আর পর্দায় তার হাস্যকর কর্মকাণ্ড দিয়ে। পৃথিবীর মানুষ, যুদ্ধের ভয়াবহতার পর দু-দণ্ডের জন্য হলেও শান্তি পায়, মন খুলে হাঁসার সুযোগ পায়। 'হিটলারের' জাগরন এবং 'গ্রেট ডিপ্রেশন' বা 'মন্দার' সময়ও তিনি তার দায়িত্ব থেকে বিন্দুমাত্র নরেননি। এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে যে, পৃথিবীতে তার মতো এরকম কেউ আছে কিনা, যিনি অগনিত মানুষকে একসাথে এতো আনন্দ, বিনোদন, সুখ দিয়েছেন এবং মানসিক চাপ থেকে পরিত্রান দিয়েছেন, -যখন তাদের এটি সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো"।
বিখ্যাত নাট্যকার 'জর্জ বার্নার্ড শ' বলেন- 'চ্যাপলিন', চলচ্চিত্র শিল্পের একমাত্র 'জিনিয়াস' ব্যাক্তি।
'চ্যাপলিন' এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
'চ্যাপলিন' ১৮৮৯ এর ১৬ এপ্রিল লন্ডনে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা- মা'ও ছিলেন চিত্তবিনোদনকারী। বাবা 'চার্লস স্পেন্সর চ্যাপলিন Sr', ছিলেন একজন গায়ক ও অভিনেতা এবং মা 'হ্যানা চ্যাপলিন'- ও ছিলেন গায়িকা এবং অভিনেত্রি। 'চ্যাপলিনের' বয়স যখন ৩ বছর তখন তার বাবা মা আলাদা হয়ে যায়। 'চ্যাপলিন' তার মায়ের সাথেই থাকতেন এবং তার কাছ থেকেই তিনি গান শেখেন। ১৯০৩ সালে 'চ্যাপলিন' সর্বপ্রথম একটি চরিত্রের জন্য ডাক পান। এটি ছিল 'শার্লক হোমস' নাটকে 'বিলি' নামক এক কিশোরের ভুমিকা।
নাটকটির রাইটার ছিলেন William Gillette এবং নাটকের মূল ভুমিকায় ছিলেন H. A. Saintsbury. 'চ্যাপলিনের' অভিনয় দক্ষতা দেখে Saintsbury খুশি হয়ে 'চ্যাপলিনকে' তার সহকারী করে নেন। ১৯০৫ সালে রাইটার Gillette নতুন একজন অভিনেত্রীকে নিয়ে আসেন তার নতুন নাটক 'ক্ল্যারিস' এর জন্য। অভিনেত্রীর নাম ছিলো- 'ম্যারি ডোরো'।
এখান থেকেই 'চ্যাপলিনের' সাথে 'ম্যারির' বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং সেটা ভালোবাসার দিকে চলে যায়। যুবক 'চ্যাপলিন' এদিকে 'ম্যারির' প্রেমে গভীরভাবে পতিত হয়ে পরেন। সেটা বেশিদূর এগয় না। Gillette-এর সাথে 'ম্যারি' চলে যান আমেরিকা। যুবক 'চ্যাপলিনের' হৃদয় প্রথমবারের মতো ভেঙ্গে যায়।
১১ বছর পর হলিউডে 'চ্যাপলিনের' সাথে আবার দেখা হয় 'ম্যারির'। 'ম্যারি' যদিও 'চ্যাপলিনকে' চিনতে পারেনা। পরে যখন 'চ্যাপলিন' নিজের নাম পরিচয় দেন তখন সে চিনতে পারে। 'চ্যাপলিন' তাকে বলে যে, সে তাকে ১১ বছর আগে ভালোবাসতো কিন্তু, 'ম্যারি' সেটা জানতো না। 'ম্যারি' সেটা শোনার পর আফসোস করে তবে ঘটনা এগোয় না। ২ বছর পর একদিন 'ম্যারি' তাকে ডিনারে আমন্ত্রন করে এবং 'চ্যাপলিন' খুশি মনে সে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যান। এ ব্যাপারে 'চ্যাপলিন' নিজে বলেছিলেন যে তারা 'ম্যারির' কক্ষে খুব স্বাভাবিকভাবেই ডিনার করেন। উল্লেখযোগ্য কিছুই হয় না।
১৯১৩ সালে 'সেনেট' নামক এক ব্যাক্তি তার ছবির জন্য 'চ্যাপলিনকে' অফার করেন। 'মেকিং এ লিভিং' ছবির জন্য 'চ্যাপলিনকে' নির্বাচন করা হয় তবে, সেই ছবিটি তেমন সারা পায় না। 'সেনেট' প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয় 'চ্যাপলিনের' উপর। সবাই বলে, 'চ্যাপলিনকে' আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিত। সে সুযোগ কাজে লাগে। তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এরপর।
The Tramp বা 'ভবঘুরে' চরিত্রটি নিয়ে কিছু কথা-
এই চরিত্রটি 'চ্যাপলিনের' নিজের তৈরি। এক 'বোকা- সোকা সাধারন মানুষ যার মন- মানসিকতা উদার। সে এক ভবঘুরে যে সর্বদা সমাজের সুশীল ব্যাক্তির রুপ, বিনয়, মর্যাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যেনো কেউ তার আসল পরিচয় না জানতে পারে। যদিও সে কাজ করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই তার পেট চালাতে পছন্দ করে, মাঝে মাঝে সেখানে সে কিছুটা চালাকি করে তার চাহিদা মেটানোর জন্য এবং বেঁচে থাকার তাগিদে।
Tramp -চরিত্রটি মজার একটি চরিত্র। তার গায়ের পোশাক, প্যান্ট, হ্যাট, কোনকিছুই কিন্তু তার নিজস্ব ছিলো না। সব ধার করা। তার নিজের একমাত্র জিনিসটি ছিলো তার হাতের লাঠিটি। এই চরিত্রটি রাতারাতি সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ফ্রেঞ্চরা বলে-"Charlot", ইতালি, স্পেন, অ্যান্ডোরা, পর্তুগাল, গ্রিস, রোমানিয়া, তুরস্কে বলে-"Carlitos", এবং জার্মানিতে "Vagabund"
বিনোদন জগতের সবচেয়ে বেশি অনুকরণীয় চরিত্র 'চ্যাপলিনের' The Tramp । 'চ্যাপলিন' একবার কাউকে না জানিয়ে 'Chaplin look-alike' কম্পিটিশনে যোগ দেন কিন্তু সেখানে সে হেরে যান। দুনিয়া জুড়ে তার ভক্তরা তাকে এতোটাই পছন্দ করতো ও অনুকরন করতো।
অনেক গুনে গুণান্বিত ছিলেন 'চ্যাপলিন'।
নিজের বেশিরভাগ ছবি তিনি নিজেই লিখতেন, পরিচালনা করতে, গান লিখতেন, কম্পোজ করতে, সুরও করতেন। তার অসাধারন প্রতিভার কারনেই তাকে আজ অব্দি সারা বিশ্ব জুড়ে সম্মান দেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার তৈরি 'মূর্তি' রয়েছে।
শেষ কথা- ১৯৬০ এর দিকে 'চ্যাপলিনের' স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরে। তার জীবনের সর্বশেষ ছবি A Countess from Hong Kong- শেষ করার পর এবং ১৯৭২ সালে 'একাডেমী অ্যাওয়ার্ড' গ্রহনের পরপরই তার স্বাস্থ্য আরও ভেঙ্গে পরে। তিনি হুইল চেয়ারে বন্দি হয়ে পরেন। ১৯৭৭ এর 'বড়দিনে' 'চ্যাপলিন' ঘুমের মধ্যে মারা যান....
পৃথিবী তাকে আজও স্মরণ করে গভির স্রদ্ধাভরে। ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও সবসময় স্যালুট করে যাই এই মানদ-দরদী 'জিনিয়াসটিকে', যার প্রতিটি ছবিতে রয়েছে চমৎকার সব ম্যাসেজ।
'চ্যাপলিনের অনেকগুলো ছবির মদ্ধ্যে যেগুলো সেরা ধরা যায়'-
1. Modern Times (1936)
2. City Lights (1931)
3. The Great Dictator (1940)
4. The Gold Rush (1925)
5. The Kid (1921)
6. Limelight (1952)
7. The Immigrant (1917)
8. The Circus (1928)
9. Monsieur Verdoux (1947)
10. A Dog’s Life (1918)
-এর বাইরে আরও মুভি থাকতে পারে। ধন্যবাদ।
...................................... ...............................................
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:২৯