আমি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পেশার খাতিরে সবসময় দৌড়ের উপরে থাকি। বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই কোন কিছু নিয়ে লিখতে মন চাইলেই ছুটে যাই বিভিন্ন জায়গায়। আমার মূল আকর্ষণ কিন্তু সবসময়ই ছিল 'প্যারানরমাল' ব্যাপারগুলোর দিকে। একবার এক বন্ধুর সাথে বাজি ধরলাম যে, ওদের গ্রামের বাড়িতে যেয়ে রাত কাটাবো। সেই বাড়িতে শুধুমাত্র একটা কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকেনা। গ্রামের সবাই এক নামে চেনে 'আলাউদ্দিন সাহেবের বাড়ি'।
আমার বন্ধুর দাদার নাম। তো, সেই বাড়িতে নাকি রাতে অনেক রকম ঝামেলা হয়। মেহমানরা গেলে থাকতে পারেনা।
আমি ঠিক করলাম, যত কিছুই হোক- যাবো। ক্যামেরাটাও নিয়ে নিলাম। লিখার সাথে সাথে যদি অদ্ভুত কিছুর ছবি তুলে ফেলতে পারি খারাপ কি? দুই পয়সা বেশি চাইতে পারবো খবরওয়ালাদের কাছে।
নির্দিষ্ট দিন রাতের বেলা যেয়ে পৌছালাম ওদের গ্রামের বাড়িতে। বিশাল বড় বাড়ি। ওর দাদা যে জমিদার ছিলো ছাপ পাওয়া যায়। কাজের লোকটাকে আমার আসার কথা আগেই বলে দেয়া ছিলো। সে আমাকে হাঁসি মুখে গ্রহন করলো। আমি তেমন কিছু আনিনি। ছোট্ট একটা ব্যাগ ছিলো, সেটা নিয়ে তাকে ভিতরে রাখতে বললাম। রাত ৯ টার দিকে ডিনার করে ফেললাম। কাজের লোকটা শুতে চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো, কোন কিছু লাগলে যেনো আওয়াজ দেই।
আমি বসে ছিলাম ওদের বৈঠকখানায়। বিশাল বড় বৈঠকখানা। সৌখিন সব আসবাবপত্রে ঠাসা। সবকিছুতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কিছুটা ঘুম-ঘুম লাগছিলো। হঠাৎ, পাশের রুমে অদ্ভুত একটা শব্দ হলো। দৌড়ে গেলাম দেখতে। সম্ভবত ষ্টোর-রুম এটা। দেখলাম, হাবিজাবি জিনিসপত্রে রুমটা ঠাঁসা। ধুলো- বালির রাজ্য। কাশি উঠে গেলো। আওয়াজটা তখনও থামেনি। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে শব্দের উৎপত্তিস্থল খুজতে লাগলাম। জিনিষপত্র সরিয়ে অনেক ভিতরের দিকে ঢুকে গেলাম। মনে এক ফোটাও ভয় কাজ করছিলো না। যেটা কাজ করছিলো, সেটার নাম কৌতূহল। সমানে জিনিষ পত্র ঘেঁটে যাচ্ছি। আওয়াজটাও জোরালো হচ্ছে। এক সময় থামলাম। খুব অবাক হয়ে দেখলাম, সামনে একটা উজ্জ্বল চকচকে জিনিষ। ধরতে ভয় হচ্ছিলো। কি মনে করে যেন হাতে নিলাম। হতবাক হয়ে গেলাম..!!! একটা চেরাগ !!! ঠিক 'অ্যারাবিয়ান নাইটসে' যেমন দেখেছিলাম 'আলাদিন' এর হাতে।
খুবই অবাক হলাম। এরকম একটা জিনিষ এখানে কি করে এলো? যাই হোক, জিনিষটা হাতে নিয়ে চলে এলাম আগের জায়গায়। বসে ভাবছিলাম, কি হতে পারে এটা?? সত্যি সত্যি সেই আলাদিনের জাদুর চেরাগ নয়তো! পরক্ষনে নিজেই হেঁসে উঠলাম নিজের আজব চিন্তা দেখে। তবুও, মানুষ কৌতূহলের কাছে সবসময় পরাজিত। আমিও ব্যাতিক্রম না। কি মনে করে যেনো চেরাগটা ঘষতে শুরু করলাম। প্রায় ১০ মিনিট ধরে ঘষলাম। উদ্দেশ্য ছিলো- কোন দৈত্য বের হয়ে আসলে তাকে বলবো, আমার যেনো ভালো কোন কোম্পানিতে পার্মানেন্ট একটা জব হয়। নাহলে, বাবার আদেশে বাড়ি ছাড়তে হবে। মনের অজান্তেই নিজের কর্মকাণ্ডে হাসলাম কিছুক্ষন। এরপর চোখ লেগে গেলো।
-এই যে, মিয়া ভাই। হ্যালো। শুনতাছেন? হ্যালো....
ভারী একটা গলার শব্দে ঘুম ছুটে গেলো। সামনে চেয়ে দেখি মাঝারি সাইজের এক লোক দাড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম, কাজের লোকটা হয়তো। বিরক্তির সুরে বললাম- কি হলো চাঁচা? আমি আপনাকে ডাকিনি তো? কোন সমস্যা?
সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলল- কি কন মিয়া ভাই? ডাকেন নাই? টানা দশমিনিট ধইরা আমার বাসস্থান, I mean, আমার চেরাগটারে ঘইশা দফা- রফা ছুটায়া দিলেন, এখন কন ডাকেন নাই???
আমি নড়ে- চরে বসলাম। কি হচ্ছে, বুঝার চেষ্টা করলাম।
লোকটা আবার বলতে শুরু করলো- মিয়া ভাই, আমি এই চেরাগের দৈত্য। আপনে আমারে দশমিনিট আগে ডাক দিসিলেন, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতাসিলো তাই একটু লেইটে বাইর হইসি। বাইর হয়া দেখি আপনে ঘুমে। চিন্তা করতাসিলাম, ডাক দিমু কিনা। অনেকক্ষণ দাঁড়ায়া আসিলাম, পরে পা টনটন শুরু করলো। তাই না পাইরা আপনেরে ডাক দিলাম।
আমার মাথা চক্কর দিলো। কি হচ্ছে এসব? হয়তো কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়াতে হেলুসিনেসন হচ্ছে। ঘাবড়ালাম না। ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করলাম। মনে সাহস সঞ্চয় করে বললাম- আপনি এই চেরাগের দৈত্য! কিভাবে সম্ভব? এখানে এলেন কি করে? আর আপনি দেখতেই বা এমন ছোটখাটো কেন? দৈত্য হলে আপনাকে অবশ্যই হতে হবে বিশাল দেহী, দাড়িওয়ালা, বিশাল আকারের ভুঁড়ি, আর চেরাগ থেকে বের হয়েই প্রচণ্ড জোরে হো ..হো...করে হাসবেন। কই মিয়া? এগুলা কিছুই তো নাই আপনার মধ্যে। আবার কথাও বলছেন কেমন আজব ভাষায়!
লোকটা তখন হাঁসতে হাঁসতে বলল- ভাই, আপনের কথা ঠিক। আসলে হইসে কি, বহু দিন ধইরা আপনেগো দেশে পইরা আসি। কে যে আমারে এখানে নিয়া আইসিলো, সঠিক মনে নাই। বহুদিন ধইরা থাকতে থাকতে আপনেগো ভাষাটা আয়ত্ত করসি। খারাপ লাগে নাই। মধুর ভাষা। মাঝে মধ্যে এই বাসায় জমিদার সাহেবের নাতিরা আসে। ইংলিশে কি জানি কয়। তাগো থেইকা কয়টা ইংলিশ ও শিখসি। তয় আমি কিন্তু আপনের মতো শুদ্ধ কইতে পারুম না। গেরামে আসিলাম তো, এখানে যেমন, তেমনি শিখসি। আর দেহের কথা কন? ওইটা তো ভাই স্বাভাবিক। আর কত তাগড়া থাকতে কন? বয়স হইসে না? সেই আলাদিনের আমল থেকা সার্ভ করা শুরু করসি। এখনও করতাসি। কোন থামাথামি নাই। তয়, একটু স্লো হয়া গেসি এই আরকি।
আমি লোকটার কথা শুনে বহু কষ্টে হাঁসি চাপিয়ে বললাম- তো, হাসলেন না কেনো হো হো করে? লোকটা বলল- মিয়া ভাই আর লজ্জ দিয়েন না। হাসছি ঠিকই, বয়সের কারনে হাঁসির জোরও কইমা গেসে। তাই শুনতে পারেন নাই। হায়রে বয়স! কি আসিলাম, কি হয়া গেলাম!
আমিও তার সাথে আফসোস করা শুরু করলাম।
একটু পর, আফসোস শেষ হলে লোকটা বলল- তো বলেন মিয়া ভাই- কি করতে পারি আপনের জন্য?
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না। ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও খুব আজব লাগছে। বলার মতো কিছু খুজে না পেয়ে বললাম- থাক ভাই, আমার জন্য কিছু করা লাগবে না। আপনি বসেন, গল্প করি।
লোকটা একটু রাগান্বিত কণ্ঠে বলল- ঐ মিয়া, মজা লন নাকি! আপনে আমারে ভাই কইলেন কোন হিসাবে? আমি আপনের কোন জনমের ভাই?
আমি থতমত খেয়ে বললাম- ওহ, সরি দৈত্য সাহেব। ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা প্রার্থী।
লোকটা বলল- It's Ok, আপনে আমারে বলতে পারেন চেরাগের দৈত্য। ভাই না কইলেই খুশি হই। আমার এক ভাই আছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে ইন্তেকাল করছে। আমারে অইত্যাধিক স্নেহ করতো। ভাই ডাক শুনলে আমি ইমোশনাল হইয়া যাই, বুঝলেন ভাই?
আমি বললাম- হুম, ব্যাপারটা আসলেই দুঃখজনক। তো, আপনার ভাই কি যুদ্ধ করতে যেয়ে মারা পরেছিলো? জবাবে সে বলল- নাহ। সে যখন ইন্তেকাল করে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলতাছিলো।
আমি বললাম- ও আচ্ছা, আপনি বসেন, দাড়িয়ে আছেন কেনো?
চেরাগের দৈত্য আমার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কিছু খাবেন?
জবাবে সে বলল- না ভাই। আপনেগো দেশের ভেজাল খাবার খাইয়াই তো আমার বডির এই দশা। আর খামু না। মাফ চাই। এখন আমি শুধু পানি খাই। আর কিছু না।
তার কথা শুনে আমারও কিছুটা লজ্জা লাগলো। বাইরের কেউও আমাদের দেশে সেফ না।
আমি বললাম- আচ্ছা, চেরাগের দৈত্য। আপনি তো বহুদিন ধরে আমাদের দেশে আছেন। কেমন লাগলো আমাদের দেশ? দেশের মানুষ?
দৈত্য বলল- দেখেন মিয়া ভাই, আমি এখন আপনেরে দুই- চারটা সত্য কথা কমু আপনের দেশ লয়া। আপনে কিন্তু কিছু মনে করবার পারবেন না।
আমি বললাম- ঠিক আছে, আপনি বলেন আমি শুনি। তার আগে বলে নিন, চেরাগের ভিতরে থেকে আপনি দেশের খবরাখবর জানেন কিভাবে?
দৈত্য বলল- মিয়া ভাই, জিনেরা সবই পারে। আমি সব খবর পাইতাম অন্যান্য জিন ভাইগো কাছ থেইকা। ওরা সব জায়গায় ছরায়া আছে। যখনি কিছু ঘটে আইসা আমারে খবর দিয়া যায়। আমি অনেক পুরানা জিন তো, সিনিয়ার। সবাই সম্মান দেয়। যাই হোক, আমি শুইনা খালি আফসোস করি। আসলে মিয়া ভাই- আপনেগো দেশে বহুদিন ধইরা আছি তো, দেশটার উপরে মায়া পইরা গেছে। কিছু করতে পারিনাই কারন আমার তো আগে চেরাগ থেইকা বাইর হওন লাগবো। আর কোন মানুষ আমারে আদেশ না করা পর্যন্তও আমার বাইর হওয়া নিষেধ।
আমি বললাম- ও আচ্ছা, দুঃখজনক ব্যাপার। বের হতে পারলে আপনি কি করতেন?
দৈত্য বলল- সব শালাগুলারে জনমের শিক্ষা দিয়া দিতাম। শালারা দেশের নিমক খায়া দেশের লগে বেঈমানি করলো ৭১-এ। মানে রাজাকারগুলা। আমি সব খবর পাইসি। তখন তো আমি এখানেই আছিলাম। আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করতে পারি নাই। তবে, দেশ স্বাধীন হইলেও আপনেরা কিন্তু এখনও পুরাপুরি স্বাধীন হইতে পারেন নাই মিয়া ভাই। এইটা মানেন?
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না। চেরাগের দৈত্যের এরকম 'ইন্টেলেকচুয়াল' কথা বার্তার কি উত্তর দিবো- মনে মনে খুঁজতে লাগলাম।
দৈত্য বলল- আপনেরা এখনও সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি করেন, পড়াশুনার লাইনেও কয়দিন আগে একটা দুর্নীতি ধরা পড়লো। কি জানি কয় ওইটারে- কি ভারশিটি জানি.......
ঢাকা ভার্সিটি ???- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
দৈত্য বলল- হ ভাই, ঢাকা ভারশিটি। কি খারাপ অবস্থা, আপনেই কন। আবার পড়তে গেলেও ঝামেলা। ঐ যে আপনেগো সার, কি জানি নাম হের- 'করি-মল'।
হের কাহিনিও শুনলাম। এগুলা কি শুরু হইসে আপনেগো দেশে, কন দেহি মিয়া ভাই?
আমার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসছিলো। কিছু বলার নেই। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। বললাম- আচ্ছা দৈত্য ভাই,---সরি, চেরাগের দৈত্য। এখন তো আপনি মুক্ত। আপানাকে আমি মুক্ত করে দিলাম। এখন তো আপনি কিছু করতে পারেন!
দৈত্য বলল- ভালো আইডিয়া মিয়া ভাই! হারামিগুলারে শিক্ষা দেওন তো উচিত। আপনে আমার লগে চলেন অক্ষনি। যেগুলারে সামনে পামু শিক্ষা দিয়া দিমু। অক্ষনি চলেন। আর আপনেরে আমার ভালো লাগছে। আপনে আমারে ভাই কইতে পারেন। তয়, কারে দিয়া শুরু করবেন?
আমি কোন কিছু না ভেবেই বললাম-প্রথমে চলেন শিক্ষক 'করি-মলের' বাসার দিকে যাই। উনারে দিয়াই শুরু করি। দৈত্য এক কথায় রাজি হয়ে বলল- চলেন।
আমি ঘর থেকে বের হতে হতে বললাম- সত্যিই ভাই। আপনার মতো একজনকে আমার খুবই দরকার ছিলো। এই যেমন, এই মুহূর্তে 'করি-মলকে' শিক্ষা দিতে আমার তর সইছে না, কিন্তু চাইলেও আমি এই মুহূর্তে সেটা করতে পারতাম না, কারন তার বাসা আমি চিনি না, আবার তার সাথে নাকি উঁচু লোকদের উঠা-বসা। কিন্তু এখন আপনি আমার সাথে আছেন, এগুলো কোনও ব্যাপারই না। তাই না? চোখের পলকে আপনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আপনি তো জিন, আপনার অনেক ক্ষমতা। এখন চলেন, যাই।
দৈত্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল- মিয়া ভাই, তা ঠিক আমার অনেক ক্ষমতা। কিন্তু বহুদিন ধইরা তো টেরাই করি না। জাদু- মন্ত্র সব ভুইলা খায়া বইসা আসি।
আমি বললাম- কি বলেন এগুলো? তাহলে কেমনে হবে? আমরা তাকে শিক্ষা দেবো না?
জবাবে দৈত্য বলল- আচ্ছা খারান, টেরাই কইরা দেহি।
দৈত্যের টেরাই কাজে দিলো। আমাকে সে ৫ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করতে বলেছিলো। করেছিলাম। চোখ খুলে দেখি আমি একটা বেডরুমে দাড়িয়ে আছি। বুঝতে পারলাম, শিক্ষক 'করি-মলের' বেডরুম। দেয়ালে তার ছবি ঝুলছে। কিছুক্ষন পর 'করি-মল রুমে ঢুকলো।
-কি ব্যাপার! আপনারা কে? আমার বেডরুমে এলেন কিভাবে? 'করি-মল' হুঙ্কার ছেড়ে বলল।
জবাবে দৈত্য কিছু বলতে গেলে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম- আমি কথা বলি। চেরাগের দৈত্য তখন রেগেমেগে বলল- ধুর মিয়া ভাই, ওগো মতো মানুষের লগে কথা কওনের টাইম নাই। আমরা ওরে শাস্তি দিতে আইছি, দিয়া জাইগা, লন। দেরি করলে পুলিশ আইতে পারে। আমি বাংলাদেশের পুলিশগো ডরাই।
আমি ভেবে দেখলাম, আসলেই ঠিক। এদের সাথে কথা বলে টাইম ওয়েস্ট করার কোন মানে হয় না।
আমি বললাম- দৈত্য ভাই। আমি ওর দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিলাম। যা করার জলদি করেন। আমি পাশের রুমে আছি। 'করি-মল' হতবিহবল হয়ে সবকিছু দেখছিলো। ফোন করতে যাবে ওমনি দৈত্য তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। 'করি-মলের' বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম। মিনিট পাঁচেক পর দৈত্য ভাই এসে বলল- মিয়া ভাই। জলদি চক্ষু বন্ধ করেন। আমি বন্ধ করলাম। গায়ে একটু গরম হাওয়া অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখলাম, আগের জায়গায় চলে এসেছি। সাথে চেরাগের দৈত্য। জিজ্ঞেস করলাম- দৈত্য ভাই, কি শাস্তি দিলেন 'করি-মলকে'? ও এমন বিকট চিৎকার করছিলো কেন?
দৈত্য ভাই মিটিমিটি হেঁসে বলল- ভাই, ওর যেটা প্রাপ্য ছিলো সেইটাই ওরে দিছি।
কি করলেন বলেন না ভাই- আমি বললাম।
দৈত্য বলল- ওর শরীরের একটা বিশেষ অঙ্গ কাইটা ফেলছি। এখন ও আর ঐ ধরনের ঘটনা ঘটাইতে পারবো না মিয়া ভাই।
আমি বলার কিছু খজে পেলাম না। ভাবলাম, ঠিকই আছে। যার যেটা প্রাপ্য।
দৈত্য বলল- মিয়া ভাই, আর কেডা আছে জলদি কন? খুন হপায় গরম হইছে।
আমার মাথায় তখন 'আনাগোনার' ঘটনাটা চলে এলো। একটা বিউটি পার্লার। দৈত্যকে ব্যাপারটা বললাম। দৈত্য বলল- আরে ভাই? আগে কইবেন তো? অয় তো আমার ফাস্ট টার্গেট আছিলো। আমার জীন ভাইগো আমি আগেই কয়া দিছিলাম, সাবধান। তগো বউ, মাইয়ারা জানি মানুষের রুপ ধইরা ঐ বিউটির পারলারে সাজবার না যায়। স্পা ভিডু বাইরায়া যাইবো। পরে কানবি।
আমি বললাম- ঠিক বলেছেন দৈত্য ভাই, ওকেও একটা শাস্তি দেয়া উচিত। আমাদের যেসব বোনেরা না জেনে গেছে ওদের কি অবস্থা, ভাবুন একবার।
দৈত্য ভাই বলল- লন ভাই, জলদি। শুভ কাজে দেরি করতে নাই।
আমি বললাম- ঠিক আছে ভাই, চলেন। তবে উনি মহিলা মানুষ তো, সরাসরি উনার বেড রুমে যাওয়া ঠিক হবেনা। বাইরের রুমে যাবো।
আবারও চোখ বন্ধ করলাম। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুলে দেখলাম, একটা ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে আছি। বিউটিশিয়ান আপা আমাদের সামনে বসেই টিভি দেখছিলো। আমাদেরকে হঠাৎ এভাবে ঘরের মধ্যে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারাল সে। জ্ঞান ফিরার আগেই আমরা তার মুখ বেধে ফেললাম যেনো সে চিল্লাতে না পারে। কিছুক্ষন পর তার জ্ঞান ফিরলো। আমি ভাবছিলাম, উনাকে কি শাস্তি দেয়া যায়। দৈত্য ভাই আমাকে অনেকগুলা আইডিয়াই দিলো কিন্তু কোনটা মনমতো হলো না। বিভিন্ন কারনে বাদ দিতে হলো। পরে একটা শাস্তি ঠিক করলাম। দৈত্য ভাইকে বললাম, সারা দেশে উনার যতগুলা শো-রুম আছে সবগুলায় একযোগে একটা ভুমিকম্প ঘটান। এখন তো রাত। কেউ নেই নিশ্চয়ই সেখানে। জলদি। সবগুলো যেনো একসাথে ভেঙ্গে পরে।
দৈত্য বলল- ঠিক আছে মিয়া ভাই, হয়ে যাবে।
বিউটিশিয়ান আমাদেরকে চোখ বড় বড় করে দেখছিলো। কিছু বলতে পারছিলো না। কিছুক্ষন পর দৈত্য যখন আমাকে বলল- মিয়া ভাই, কাজ হয়া গেছে। ময়দান ফাঁকা কইরা দিছি- কথাটা শুনে আরেকবার জ্ঞান হারালো বিউটিশিয়ান। আমরা আবার চলে এলাম আগের জায়গায়।
এরপর আরও বেশ কিছু জায়গায় গেলাম দৈত্য ভাইকে নিয়ে। একদল বখাটে ছেলেদের উচিত শিক্ষা দিলাম। শালারা একটা মেয়েকে প্রতিদিন বিরক্ত করতো। মেয়ের বাবা বাধা দেয়ায় ছেলেগুলো মেয়েটার বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে। পরে জানা গেছে, লোকটা ছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধা। ব্যাপারটা আমি সহ্য করতে পারিনি। দুইজন মিলে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিলো, পিটিয়ে শালাদের রক্তাক্ত করে ফেলবো। দৈত্য ভাই আমাকে আটকালো। বলল- মিয়া ভাই, মারন লাগবো না। আমি বুঝতে পারছি এগো কি করন লাগবো। আপনে একটু চিপায় খারান, আমি আইতাছি কাম সাইরা।
আমি প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে একটা গাছের চিপায় দাড়িয়ে রইলাম। প্রায় মিনিট তিনেক পর দৈত্য ভাই ফিরে এলো। মুখে হাঁসি। আমি জিজ্ঞেস করলাম- এবার ওদেরকে কি শাস্তি দিলেন ভাই?
দৈত্য ভাই বলল- আর কইয়েন না ভাই, যে শাস্তি দিছি, সারা জীবন আমারে ইয়াদ রাখবো। আমি কৌতূহল দমাতে পারছিলাম না। বললাম- কি শাস্তি দিলেন বলেন না! কিছুই তো বুঝতে পারছি না! দৈত্য ভাই বলল- চুপ কইরা কিসুক্ষন খারায়া থাকেন। দেখতে পাইবেন।
আমি দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম, একদল তরুণী মেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেলো। মেয়েগুলা অসম্ভব সুন্দর- নিজের মনেই কথাটা বলতে বাধ্য হলাম।
দৈত্য ভাই আমার দিকে চেয়ে মুচকি একটা হাঁসি দিয়ে বলল- মিয়া ভাই, চিন্তে পারেন নাই? আমি অবাক হয়ে বললাম- কাকে চিন্তে পারবো?
দৈত্য ভাই বলল- ক্যালা ভাইজান? আমরা না একটু আগে এগোরে মারতে আইছিলাম! ভুইলা গেলেন?
হোয়াট......!!! এরাই সেই!! মানে, যেই মেয়েদের দলটা দেখলাম একটু আগে, ওরা আসলে সেই ছেলেগুলো???
দৈত্য ভাই বলল- জি মিয়া ভাই, ঠিক ধরসেন। এরাই সেই ছেলেগুলা। এগোরে সুন্দরী মাইয়া বানায়া দিসি। এবার ওরাও বুঝুক, টিজিং কারে কয়? ওগোরও বুঝার দরকার আছে। এটাই ওগো শাস্তি।
আমার তো ওদিকে হাঁসতে হাঁসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। কোনমতে বললাম- ভাই, চরম একটা শাস্তি হয়েছে। আসলেই এটার দরকার ছিলো- বলে আবার হাঁসতে লাগলাম।
কিছুক্ষন হাঁসা হাঁসির পর আগের জায়গায় চলে এলাম। জানিনা তাদের বোধোদয় হবে কিনা, তারপরও। মনে একধরনের শান্তি পেলাম।
বৈঠকখানায় বসলাম দুইজন। ভাবতে লাগলাম, এভাবে গুনে-গুনে কয়জনকে শাস্তি দিতে পারবো আমরা? কয়জনকে? আজ দেশভর্তি এরকম মানুষ। যেদিকে তাকাই সেদিকেই এরকম। কাউকে ভরসা করা যায় না। কি হবে আমাদের? কি হবে এই দেশের? কয়জনকে আমরা শাস্তি দিবো? এরা যদি নিজেরা ঠিক হতে না চায় আমরা কতটুকু করতে পারবো ঠিক করতে? মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।
এদিকে সকাল হয়ে আসছিলো। দৈত্য বলল- মিয়া ভাই, আজকে আপনের সাথে থাইকা অনেকগুলা ভালো কাজ করলাম। অনেক ভালো লাগতাসে। এটা তো জানেন যে আমি ৩টার বেশি আদেশ পালন করিনা। কিন্তু আপনে নিজের জন্য কিছুই চান নাই, তাই আপনের জন্য আমি মন থেইকা সার্ভ করসি, বিশ্বাস যান। কোন লিমিট দেই নাই। আপনের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আমারে দেখা মাত্রই কইতো- যাও, এক বস্তা স্বর্ণ নিয়া আসো, নান্নার বিরানি নিয়া আসো, বসুন্ধরায় একটা প্লট বুকিং দাও, এই করো- সেই করো, এইটা আনো, ওইটা আনো, হাবিজাবি, আরও অনেক প্যাঁচাল। কিন্তু ভাই, আপনে নিজের দিকটা একবারও চিন্তা করেন নাই। নিজের কোন প্রয়োজনের কথা আমারে কন নাই। আপনে ভালো মানুষ। নিজেরে নিয়া চিন্তা না কইরা আপনে আগে দেশরে নিয়া চিন্তা করসেন। আপনেরে দিয়া কিছু হবে, মিয়া ভাই। দেশের সবগুলা মানুষের উচিত আপনের মতো চিন্তা করা। তাইলে যদি দেশের কিছুটা উন্নতি হয়।
আমি হেঁসে বললাম- ভাই। কিছু হোক না-হোক, চেষ্টা চালিয়ে যাবো।
দৈত্য বলল- মিয়া ভাই, আমি এখন চেরাগে ঢুকবো। তার আগে আপনার জন্য কিছু করতে চাই। বলেন ভাই, কি লাগবো আপনার?
আমি বললাম- দুঃখিত দৈত্য ভাই। আপনি অনেক কিছু করেছেন। আমার মনের ক্রোধগুলো মিটাতে সাহায্য করেছেন। এটাই অনেক। আর কিছু দরকার নেই। চেরাগটা তো এখানেই থাকবে। আপনি কোনোভাবে পারলে আমার সাথে মাঝে-মধ্যে যোগাযোগ কইরেন। তাহলেই হবে।
দৈত্য বলল- ভাই, আপনেতো সকালেই রাজধানীতে চইলা যাইবেন। মানে আপনেগো প্রিয় রাজধানী, ঢাকায়। আমার বাড়িও কিন্তু 'কোহকাফ' নগরিতে আছিলো। জিনের রাজধানী। ওহ, ভালো কথা, শুনলাম, আপনেগো প্রানের রাজধানীও নাকি দুইভাগ হয়া যাইতাছে? ঘটনা কি সত্য?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। কোনও উত্তর নেই আমার কাছে।
দৈত্য বলল- সরি মিয়া ভাই, মনে কষ্ট পাইলেন মনে হয়। এক কাম করেন, আমারে আপনের বাড়ির ঠিকানাটা দিয়া দেন। নাইলে বিভক্ত ঢাকায় যায়া আপনের বাড়ি খুইজা বাইর করতে আরেক চিপায় পরন লাগবো।
আমি একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিলাম।
দৈত্য বলল- যাই হোক ভাই, এভাবে হবে না। আপনেরে কিছু না দিয়া যাইতে পারলে আমারও খারপ লাগবো। So, ভাইজান কিছু আবদার করেন জলদি। আমার বেশি সময় নাই। চেরাগে যাইতে হবে।
মানুষের স্বহজাত প্রবৃত্তি থেকে আমিও বের হতে পারলাম না। বললাম- ঠিক আছে ভাই, আমার অনেক দিনের শখ একটা 'i Pad'- এর। পারলে একটা 'i Pad' এনে দেন আমাকে।
দৈত্য বলল- i Pad-কি জিনিষ ভাই? খাইতে কেমন?
আমি হেঁসে বললাম- ভাই এটা খাওয়ার জিনিষ না। অনেক কাজের জিনিষ। আপনি পারলে দেন।
দৈত্য বলল- দাঁড়ান মিয়া ভাই, খবর লাগাই।
দৈত্য খবর লাগাতে শুরু করলো। আমি বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম সাধের 'i pad'-এর জন্য। অপেক্ষা করতে করতে একসময় ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো।
- চাঁচা, ও চাঁচা, উঠেন। সকাল ১০টা বাজে।
পরিচিত একটা গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে দেখি কাজের লোকটা পাশে দাড়িয়ে আছে। আশে- পাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম আমার দৈত্য বন্ধুকে। কোথাও দেখলাম না। দেখার কথাও না। পুরো ব্যাপারটাই ছিলো স্বপ্ন। হজম করতে একটু সময় লাগলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বেশ পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া একটা পিতলের চেরাগ আমার হাতে। চেরাগটা ঘষতে ঘষতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুঝতেই পারিনি। যাই হোক, হাত মুখ ধুয়ে রেডি হলাম। ঢাকার বাস ধরতে হবে। যাবার আগে আমার বন্ধুকে ফোন করে চেরাগটার কথা বললাম। জানালাম, আমি ওটা আমার কাছে রাখতে চাই। ও বিনা বাক্যে রাজি হলো।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত-
চেরাগটা ঢাকায় নিয়ে এলাম। একটা আর্টিকেল লিখলাম চেরাগটা নিয়ে। চেরাগটার একটা ছবিও দিলাম। ছাপা হলো বেশ কয়টা পত্রিকায়। মাঝে মাঝে বন্ধুরা আসে চেরাগটা দেখতে। আমি দেখাই। বিশেষ কিছুই তারা এর মধ্যে খুজে পায় না। কারন এটা জ্বালানোরও অযোগ্য। কোনভাবেই এটা জ্বালানো সম্ভব না। কিন্তু, আমি ঠিকই জ্বালাই। যখনি প্রয়োজন পরে চেরাগটা জ্বালাই। জ্বালাতে থাকবো, যতদিন বেঁচে থাকবো। যদিও সেদিনের পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা স্বপ্ন তবুও, সেই স্বপ্ন থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি, এবং জানতে পেরেছি দেশকে ঠিক রাখতে হলে কি করতে হবে আমাদের। আর এই সব কিছুর মূলে ছিলো সেই চেরাগ। আর্টিকেলের শেষে আমি লিখেছিলাম- "এই চেরাগটা কিন্তু আমাদের সবার ভিতরেই বিদ্যমান তবে, আজ সেটা নিভু-নিভু। একসময় হয়তো সেটা পুরোপুরি নিভে যাবে। আমরা পতিত হবো ঘোর অন্ধকারে। প্রয়োজন, একটু আগুনের। বেশি না, একটু আগুন হলেই আমরা প্রত্যেকে এটা নতুন করে জ্বালাতে পারবো। আসুন, সবাই মিলে এই চেরাগটাকে জ্বালাই"।
.......................................... ..............................................
বিঃদ্রঃ- এটি একটি কল্প- কাহিনী। বাস্তবের কারও সাথে কোন মিল নেই। মিল পেলে অবশ্যই তা কাকতালীয় ধরে নিতে হবে। তবে, গল্পে বর্ণিত 'ইভেন্ট'- গুলো ১০০ ভাগ সত্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:২৪