১৯৩২, তানজানিয়া। অঞ্চলটির নাম Njombe। স্থানীয়দের মতামত অনুযায়ী এই অঞ্চলে কিছু সিংহ আছে যারা সাধারন সিংহ নয়। এরা অশরীরী আত্মা জাতীয় কিছু। স্থানীয়দের মধ্যে এরকমও বর্ণিত আছে যে, এই সিংহগুলো একজন ডাইনীর, যার নাম 'Matamula Mangera'। অনেক আগে 'Matamula'-কে তার নিজ গোত্রের লোকেরাই কোন কারনে গ্রাম থেকে দূর করে দেয় এবং তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই নাকি 'Matamula' এই সিংহগুলো পাঠিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই সিংহগুলো শুধুমাত্র পুরুষদের আক্রমন করতো। মেয়েদেরকে এবং বাচ্চাদেরকে তারা কোন কারনে আক্রমন করতো না। স্থানীয়রা এই সিংহগুলোকে এতটাই ভয় পেত যে তারা এই ব্যাপারে কোন কথাই বলতে চাইতো না। তারা ভাবতো, কথা বললেই চলে আসতে পারে সেই প্রেত সিংহগুলো। এই সিংহগুলো প্রায় ১৫০০, অনেকের মতে ২০০০ এর মতো মানুষ হত্যা করে যা পশু-আক্রমনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং ভয়ানক। অবশেষে, ইংল্যান্ডের একজন বিখ্যাত শিকারি 'জর্জ রাশবি' ঘটনাচক্রে সেই এলাকায় আসেন এবং সিংহগুলোর ব্যাপারে শোনেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যে করেই হোক এই গরীব লোকগুলোকে সিংহের ত্রাস থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি মোটমাট ১৫টা সিংহ মারতে সক্ষম হন তবে, সবগুলোকে মারতে পারেননি। বাকিগুলোকে পড়েও আর দেখা যায়নি। স্থানীয়রা এখনও বলে যে ডাইনী 'Matamula'-র প্রতিশোধ শেষ তাই সে তার সিংহ নিয়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। এই ঘটনা নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে এবং টিভি সিরিজও তৈরি হয়েছে।
"THE NEW-JERSEY SHARK"-
এটি ১৯১৬ সালের ঘটনা। হাঙ্গরের আক্রমন বা এর প্রজাতি সম্পর্কে বিজ্ঞানিরা তখনও গবেষণা চালাচ্ছিলো। অনেক প্রজাতি তখনও সনাক্ত করা হয়নি। নিউ জার্সি উপকূলে 'চার্লস ভ্যানসান' নামে একজন ব্যাক্তি তার পোষা কুকুরকে নিয়ে সাঁতার কাটছিলো। একটা হাঙর অতর্কিতভাবে লোকটির উপর হামলা চালায়। অনেকেই দূর থেকে দেখছিলো এই আক্রমন। একজন লাইফ-গার্ড লোকটিকে বাঁচাতে নেমে যায় সমুদ্রে কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাঙরটি তার কাজ শেষ করে মুহূর্তে গায়েব হয়ে যায়। কিছুদিন পর সেই একই হাঙরের আক্রমনে আরেকটি লোক প্রান হারায়। নিউ জার্সির সেই উপকূলটি আস্তে আস্তে ভয়ানক হয়ে উঠতে থাকে। সেই বছর জুলাই ১২ তে আবারও আক্রমন হয় এবং, এবার আক্রমণটি হয় ১১ বছরের এক বাচ্চার উপরে। সে উপকুলের খুব সামনেই সাঁতার কাটছিলো, কিন্তু ধূর্ত হাঙরটি উপকূলের কাছে এসেই বাচ্চাটিকে নিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে 'স্ট্যানলি ফিশার' নামে একজন লোক সমুদ্রে ঝাঁপ দেয় বাচ্চাটাকে রক্ষা করার জন্য তবে সেটা সম্ভব হয়না। হাঙরটি তাকেও আক্রমন করে তবে 'স্ট্যানলি' একমাত্র ব্যাক্তি যিনি এই হাঙরটির আক্রমন থেকে বেঁচে ফিরে। অনেকদিন ধরে চললো হাঙরটির আক্রমন। কেউ কিছু করতে পারছিলোনা কারন হাঙরটি ছিলো প্রচণ্ডরকম ধূর্ত। অবশেষে জুলাই ১৪, একটি স্ত্রী-হাঙর ধরা পড়ে যার পেটে মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এটিই ছিলো সেই ধূর্ত হাঙরটি। তখন বিজ্ঞানিরা মতামত দেন, স্ত্রী 'গ্রেট হোয়াইট শার্ক'ও মানুষের জন্য ভয়ানক একটি প্রানি। কারন, এর আগ পর্যন্ত তারা মনে করতো শুধুমাত্র পুরুষ 'গ্রেট হোয়াইট শার্ক'ই মানুষকে আক্রমন করে। আর এটাও বলা হয় যে, নিউ জার্সির আক্রমণগুলো যাই হোক, তখন থেকেই মুলত 'গ্রেট হোয়াইট শার্ক'কে বিজ্ঞানিরা সবচেয়ে ভয়ানক 'মান-ইটার' আখ্যায়িত করেন। নিউ জার্সির এই হাঙর-আতঙ্ক নিয়ে 'Peter Benchley' নামক একজন ব্যাক্তি একটি বই লেখেন যা ব্যাপক সারা ফেলে। পরবর্তীতে 'স্টিভেন স্পিলবার্গ' এই বইটি থেকে তৈরি করেন অমর এক মুভি, যার নাম "JAWS"
মূল বইটির নামানুসারেই মুভিটির নাম দেয়া হয় এবং কমবেশি সবাই আমরা এই মুভিটি দেখেছি।
"THE BEAST OF GEVAUDAN"-
নরখাদকের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত এবং সবচেয়ে রহস্যময় যে ঘটনাটি তা ফ্রান্সে ঘটে। ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৭ পর্যন্ত এই জন্তুটি ফ্রান্সের মানুষের সবচেয়ে বড় আতংকের কারন হয়ে থাকে। অনেকেই বলে থাকে এটি অস্বাভাবিক বড় আকারের একটি নেকড়ে, যার গায়ের রং লাল, গায়ে প্রচণ্ডরকম গন্ধ এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বড় দাঁত। ১৭৬৪ এর জুনে একটি কম বয়সী মেয়ে এর প্রথম শিকার হয়। পরবর্তীতে এটি ২১০ জন মানুষকে আক্রমন করে, এর মধ্যে ১১৩ জন মারা যায়। ৯৮ জন গুরুতর আহত হয়। আক্রমণগুলো এতো দ্রুত এবং নির্দয় হতো যে অনেকে মনে করতো এটা ঈশ্বরের পাঠানো কোন শয়তান যে মানুষকে তাদের পাপের শাস্তি দিতে এসেছে। মানুষ আস্তে আস্তে ধারনা করতে লাগলো এটা আসলে কোন 'ওয়্যার উলফ' অর্থাৎ, অর্ধ- মানব, অর্ধ-নেকড়ে। শিকারিরা এবং সৈন্যরা ব্যার্থ হচ্ছিলো একে ধরতে। অবশেষে 'জন চ্যাস্টল' (স্থানীয় এক দুর্ধর্ষ শিকারি) ১৭৬৭ সালে এই নরখাদকটিকে হত্যা করে। পৌরাণিকে আছে, জন এটিকে হত্যা করতে 'সিলভার বুলেট' ব্যাবহার করেছিলেন।
"THE MAN-EATER OF TSAVO"-
১৮৯৮ সাল। কেনিয়ার সাভো অঞ্চলে ব্রিটিশ রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছিলো। প্রথম কয়দিন ভালোভাবেই কাজ চললো কিন্তু, কয়দিন পর শুরু হলো ঝামেলা। একে একে নিখোঁজ হতে থাকলো শ্রমিকরা। প্রত্যক্ষদর্শী কিছু শ্রমিকদের মতে কাজটা করছে দুটো সিংহ (পরে জানা গেছে তারা ছিলো ভাই)।
এই সিংহ দুটি ছিলো অস্বাভাবিক রকমের বড়। প্রতিদিন রাতে এসে তারা স্রমিকদেরকে তাবু থেকে টেনে বের করে নিয়ে যেতো। তাদের মারার কৌশল ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। প্রচণ্ড বুদ্ধির সাথে তারা তাদের শিকারকে আক্রমন করতো। এই সিংহ দুটি নিয়েও একই রকমভাবে সাভো এলাকায় সৃষ্টি হলো ত্রাসের। স্থানীয়রা বলতে লাগলো এই দুটো আসলে সিংহ নয়। এরা অশরীরী প্রেতাত্মা। সাভো এলাকার পুরনো রাজার প্রেতাত্মা যে চায়না এখানে ব্রিটিশরা আসুক। তাই সিংহের রুপে এসে আক্রমন করে সবাইকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। সিংহ দুটির নাম দেয়া হয়েছিলো 'ঘোস্ট' এবং 'ডার্কনেস'। ১০০ জনের মতো শ্রমিক তাদের ভয়ে পালিয়ে গেলো। রেলের কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। কেউ চাইছিলো না সেই অশরীরী সিংহ দুটির শিকার হতে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার ইনচার্জ 'জে প্যাটারসন' তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে করেই হোক, নরখাদক দুটোকে মারতে হবে। ১৯৮৯ এর ডিসেম্বরে তিনি প্রথমটিকে মারতে সক্ষম হন এবং তার ২ সপ্তাহ পর তিনি দ্বিতীয়টিকেও হত্যা করেন। ততদিনে সিংহ দুটো প্রায় ১৪০ জনকে মেরেছিলো। পরবর্তীতে 'প্যাটারসন' নিজেই এই ঘটনাটি নিয়ে একটি বই লিখেন এবং তা ব্যাপক সারা ফেলে। সিংহ দুটো যেখানে থাকতো সেই গুহার খোঁজও পান তিনি। সেই গুহাটি আজও আছে। মানুষের অসংখ্য হাড়-গোড় ও সেখানে আছে। শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামে রয়েছে সাভোর এই বিখ্যাত দুই নরখাদকের দেহাবশেষ। কেনিয়ার কর্তৃপক্ষও সাভোতে নরখাদক এই দুই ভাইয়ের কীর্তি নিয়ে ছোট একটি মিউজিয়াম তৈরির ব্যাপারে রাজি হয়েছে। এ ঘটনাটি নিয়ে হলিউডে যে মুভিটি তৈরী হয়েছে তার নাম- The Ghost and the Darkness
"GUSTAVE"-
উপরে বর্ণিত সব নরখাদকেরা এখন ইতিহাস। তারা সবাই মারা গেছে অনেক আগে। কিন্তু এখন যার কথা বলবো, সে জীবিত আছে এখনো.....
আফ্রিকার বুরুণ্ডি। যেখানে রয়েছে আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক এবং সবচেয়ে ধূর্ত নরখাদক। যার নাম স্থানীয়রা দিয়েছে 'গুস্তাভ'। ৬ মিটার লম্বা, ১ টন ওজনের 'গুস্তাভ' একটি পুরুষ কুমির।
একজন ফ্রেঞ্চ ন্যাচারালিস্ট 'প্যাট্রিস ফে' (যে কয়েক বছর চেষ্টা চালিয়েছিলো 'গুস্তাভ' কে ধরতে) বলেন যে, গুস্তাভ একমাত্র জীবিত সবচেয়ে বড় কুমির পুরো আফ্রিকার মধ্যে। সে এখন পর্যন্ত ৩০০ জন মানুষ মেরেছে। স্থানীয়রা বলে, 'গুস্তাভ' শুধুমাত্র খাওয়ার জন্যই মানুষ মারে না, সে মানুষ মেরে মজা পায়। প্রত্যেক আক্রমনে সে একাধিক মানুষকে হত্যা করে এবং তারপর সে গায়েব হয়ে যায় সেখান থেকে। মাসের পর মাস, এমনকি বছরেও নাকি তাকে আর দেখা যায় না। কেউ বলতে পারেনা সে কখন কোথায় আবার দেখা দিবে। একবার একদল শিকারি তাকে ধরতে এসেছিলো কিন্তু তাদের বিফল হয়ে ফিরে যেতে হয়। ও, 'গুস্তাভকে' নিয়ে কিন্তু হলিউডে মুভিও তৈরি হয়েছে। সে মোটামুটি এখন একটা নামকরা চরিত্র। বলা হয় 'গুস্তাভ' এর বয়স নাকি প্রায় ৬০ বছর। 'ফে' মুলত 'গুস্তাভকে' ধরতে চেয়েছিলো স্থানীয় লোকদের জীবন রক্ষার জন্য। সে নাকি এর জন্য একটি বিশাল খাঁচাও তৈরি করেছিলো কিন্তু চালাক 'গুস্তাভ' সেই খাঁচার সামনেও আসেনি। চোখ ফাকি দিয়ে চলে গেছে অন্য এলাকায়। মজার ব্যাপার হলো- বুরুণ্ডির 'রুজিজি' ন্যাশনাল পার্কে 'গুস্তাভের' জন্য বেশ বড় একটা জায়গা বানিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে তাকে ধরার পর রাখা হবে। কথা হলো, চালাক 'গুস্তাভ' কি আদৌ ধরা পড়বে, নাকি সে রয়ে যাবে সবার ধড়া -ছোঁওয়ার বাইরে......???? এসময়ের সবচেয়ে বড় নরখাদককে আমরা দেখতে পারবো কি পারবোনা এটা সময়ই বলবে।
--------------------------------- -----------------------------