somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একবার না পারিলে দেখো ২১ বার !!! :):):)

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গুনে গুনে ২০ বার ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিলেন দিনাজপুরের খোশবুল আলম। পাসের দেখা পাননি। তারপর? পড়ুন ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের এক অসাধারণ কাহিনি ।



সকালেই দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন মো. খোশবুল আলম। ঢাকায় কী যেন একটা কাজ ছিল—সে কারণেই আসা। কথাবার্তা শেষে আমরা তখন খোশবুলের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এতক্ষণ হাত-পা নেড়ে উচ্ছল ভঙ্গিতে কথা বলে যাওয়া মানুষটা কেন যেন ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েই গুটিসুটি মেরে গেলেন। আলোকচিত্রী যতই বলেন, ‘আপনি একটু হাসেন। না হাসলে তো ছবি ভালো হবে না’, খোশবুল আলম ততই গুটিয়ে নেন নিজেকে। পাশে দাঁড়ানো খোশবুলের ভাগনে এবার কৌশলী হয়ে ওঠেন, ‘মামা, মনে করেন, আপনি আজকেই ডিগ্রি পাস করছেন। এবার হাসেন।’ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নয়, খোশবুল ভাগনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রহস্যময় হাসি। সেই হাসি আমাদের নিয়ে যায় অনেক পেছনে। সত্যিই তো, ২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে খোশবুল আলম যেদিন ডিগ্রি পাস করলেন, সেদিন তাঁর হাসিটা কেমন দেখতে হয়েছিল?

পড়ালেখা করে যে...
ভগীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোশবুলের পড়ালেখার শুরু। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম।’ ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়া কৃষকপুত্র সে সময়ই পড়ালেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ জানান দিয়েছিলেন। ধারাবাহিকতার প্রমাণ পাওয়া গেল এসএসসি পরীক্ষায়ও। ‘মাঝে নানা সমস্যায় দু-একবার বছর গ্যাপ পড়ছিল। আশি সালে এসএসসি দিলাম। আমার এলাকায় আমিই প্রথম সেকেন্ড ডিভিশন পাইয়া পাস করলাম।’ বলছিলেন খোশবুল।
এরপর, ভর্তি হলেন দিনাজপুর কে বি এম কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেও, প্রথম বর্ষের পাট চোকার আগেই খোশবুলের কাছে ‘বিজ্ঞান’ ব্যাপারটা কঠিন মনে হলো। দ্বিতীয় বর্ষে তাই পরীক্ষা দিলেন মানবিক বিভাগ থেকে। ফলাফল: ‘থার্ড ডিভিশন’। ‘তখন এরশাদ সরকারের আমল। সে বছর ২০ পার্সেন্ট পাস করছিল। আরও ভালো করার আশা ছিল, তবে থার্ড ডিভিশন পাইয়াও খুব একটা অখুশি হই নাই।’
খোশবুল তখন নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালান। টিউশনি করেন। ক্লাস সিক্স-সেভেনের ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে পড়তে আসে তাঁর কাছে। ওদিকে ছাত্রছাত্রীদের ‘মাস্টার মশাই’য়ের দৃষ্টি তখন অনেক দূরে। ইচ্ছা ছিল ইংরেজি বিভাগে পড়বেন, কিন্তু কাছাকাছি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আর্থিক টানাপোড়েনও একটা বাধা বৈকি। পরিচিত একজন উপায় বাতলে দিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলে এক বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তবে একটা শর্ত আছে, পাস করার পর সেই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে হবে! খোশবুল আকাশ থেকে পড়লেন! এমন অদ্ভুত শর্তে রাজি হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা দিনাজপুর ডিগ্রি কলেজেই স্নাতকে ভর্তি হলেন। ইচ্ছা, স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর করবেন। সুযোগ পেলে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির চেষ্টা করবেন। মনোযোগী ছাত্রের মতো নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলেন খোশবুল। ১৯৮৫ সাল। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। রাত-দিন পড়ালেখা করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘পরীক্ষা ভালোই হইছিল।’ হাজারো স্বপ্ন নিয়ে তখন রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। খোশবুল তখনো জানেন না, একটা গোলকধাঁধায় আটকা পড়তে যাচ্ছেন তিনি!

পাস-ফেলের সমীকরণ
প্রথমবারের ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। খোশবুল আলম অকৃতকার্য। একটু অবাক হলেও মেনে নিলেন খোশবুল। ভাবলেন, এ বছর হয়নি, পরের বছর হবে। আরও ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে। ’৮৬ সালে পরীক্ষা দিলেন। ফলাফল: অপরিবর্তিত! এক বিষয়ে পাস, তো আরেক বিষয়ে ফেল। পাস-ফেলের সমীকরণে তখন এমনিতেই হাবুডুবু খাচ্ছেন, এরই মধ্যে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ শুরু হলো। বাড়ির বড় ছেলের একটা ‘গতি’ করতে চান বাবা-মা। খোশবুল নারাজ। এহেন গতি তাঁর কাছে ‘ক্ষতি’ বলেই মনে হলো! ‘চাকরি নাই বাকরি নাই, এহনো ইন্টার পাস। বিয়া কি করমু?’ তাঁর এমন যুক্তি বাবা-মা মানলেন না। ১৯৮৬ সাল, ঘোরাবান্দের আবদুল হামিদের মেয়ে হামিদা বানুর পাশে বরের বেশে দেখা গেল খোশবুল আলমকে।
এরই মধ্যে প্রতিবছর পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছেন তিনি। ফল একই—অকৃতকার্য! ’৮৮ সালে এক ছেলের বাবা হলেন। ’৮৯ সালে ঘরে এল যমজ সন্তান। ভাবলেন, এবার হয়তো ভাগ্য ফিরবে। হলো না। দুঃখী মানুষটাকে আরও দুঃখী করে দিয়ে তিন দিনের মাথায় ছেলে দুটোর মৃত্যু হলো।
পরের বছরগুলো খোশবুলের জন্য খুবই ঘটনাবহুল। মেয়ে খালেদা খাতুনের জন্ম হলো। সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে ’৯৫ সালে ভর্তি হলেন নীলফামারী হোমিওপ্যাথি কলেজে। অনেক পরিবর্তনের মাঝেও একটা বিষয় অপরিবর্তিত থেকে গেল। খোশবুলের ডিগ্রি পরীক্ষার ফল—অকৃতকার্য! নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও, খুব বিপাকে না পড়লে এর মাঝে প্রায় প্রতিবছরই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন কে বি এম কলেজ থেকে, বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন পর পর ১২ বার, এরপর দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিতে শুরু করলেন। অকৃতকার্যের ভূত তাঁর পিছু ছাড়ল না।
তত দিনে খোশবুলের স্কুল-কলেজের বন্ধুরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছেন। পরীক্ষার হলে গিয়ে বসতে হয় বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলেদের সঙ্গে! পরীক্ষার হলে যাঁরা দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাও বয়সে ছোট। এসব কোনো কিছুই আমলে নেননি তিনি। ‘সেই শুরু থেইকা প্রত্যেকটা পরীক্ষায় দেখছি, আশেপাশে সবাই বই খুইলা, কাগজপত্র বাইর কইরা, এইটা-ওইটা দেইখা লেখতেছে। আমি কখনোই নকল করি নাই। মনে হইত, যা পারি তা-ই লিখমু। এমনও হইছে, শিক্ষকেরা আমারে ভাই বা চাচা ডাইকা সামনে বই খুইলা দিছে। বলছে, “এইবার অন্তত আপনি পাস করেন।” কিন্তু আমি কী দেখমু? বইয়ে যা আছে, সব আমি জানি। সব পারি। নকল করার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু খাতায় লিখতে গেলেই কী জানি এলোমেলো হইয়া যায়!’
১৮, ১৯, ২০তম বার গেল! জেদি মানুষটাও এবার দুর্বল হয়ে পড়লেন। মানুষজনের কটাক্ষ, অপমান আর নিতে পারছিলেন না। ‘২১ বারের সময় পরীক্ষা দিতে যাইতেছি। খুব বেশি কিছু পড়ি নাই। নতুন কইরা কী পড়মু? এতবার পড়ছি! মনে মনে আল্লাহরে কইলাম, আল্লাহ, এইবার আমারে পাস করায়া হল থেইকা বাইর করো। নাইলে হল থেইকাই উঠাইয়া নিয়া যাও। সিদ্ধান্ত নিছিলাম, এইবার পাস না করলে দূরে চইলা যামু। পরিচিত মানুষগুলারে আর মুখ দেখামু না। রেজাল্টের আগে তাড়াহুড়া কইরা ছেলের বিয়া দিলাম। পরে যদি আমি না থাকি!’

আলোর দেখা
২০১০ সাল। ভুল্লিরহাট বাজারে খোশবুলের হোমিওপ্যাথির দোকান ‘খালেদা হোমিও হল’। সন্ধ্যা থেকেই পাড়ার লোকজন তাঁর দোকানে আসা-যাওয়া করছেন, ‘খোশবুল, রেজাল্ট হইছে শুনলাম। তোমার খবর কী?’ খোশবুল কিছু বলেন না। ফলাফল দেখেননি, মনে মনে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে দোকানে এল বন্ধুর ছেলে রথীন, খোশবুলের সঙ্গেই সেবার পরীক্ষা দিয়েছেন। বললেন, ‘চাচা, রোল আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা কন। মোবাইলে দেখি।’ খোশবুল দিলেন। খানিক মুঠোফোন টিপাটিপি করে রথীনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর, ‘চাচা, আপনি তো পাস করছেন!’
২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ‘থার্ড ডিভিশন’ পেয়ে পাস করলেন খোশবুল। বাজারে পরিচিত-অপরিচিত সবাই ভিড় করতে লাগল খালেদা হোমিও হলে। ‘মিষ্টি খাওয়াও, মিষ্টি খাওয়াও!’ আশপাশে মিষ্টির দোকান নেই। সবাইকে ঝাল ঝাল পেঁয়াজু খাইয়ে খোশবুল উদ্যাপন করলেন তাঁর মিষ্টিসন্ধ্যাটা!
ছেলে আবদুল হাকিম, মেয়ে খালেদা, স্ত্রী, নাতি-নাতনিকে নিয়ে এখন ভালোই আছেন ‘ডিগ্রি পাস’ খোশবুল। ২০১১ সালে স্নাতকোত্তর করার জন্য রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ভালো একটা চাকরির স্বপ্ন, কিংবা জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ তাঁর এখনো ফিকে হয়ে যায়নি। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘২০টা অপমানের মাল্য আমার গলায় আছে। এইবার দেখি, ২০টা সম্মানের মাল্য গলায় পরা যায় কি না!’
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:১৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×