১
ছেলেটা বাদাম বেশি পুড়িয়ে ফেলছে। গরম বালুতে বাদামের আঁচ হবার সময় বার বার নাড়া দিতে হয়, সে নাড়া দিতে দেরী করছে।
- তুই কি নতুন? এই দোকানের মামু কই?
- বাবায় দ্যাশে গেসে, আমি অহন একাই দোকান চালাই।
- দেশে গেছে কেন?
- মায়ের খারাপ অসুখ। ভাল হইলেই চইলা আইব আবার।
ছেলেটার বয়স কত হবে, বড়জোর দশ-এগার? ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে কোন মতে বাদামের কড়াই পর্যন্ত নাগাল পায় কি পায় না। টিউশনিতে যাবার সময় তিতুমির হলের কোনা থেকে পঞ্চাশ গ্রাম বাদাম নিয়ে রিকশায় উঠি, এটা আমার রোজকার স্বভাব। বাদামের এক পাশ পুড়ে গেছে, আজকে পোড়া বাদাম খেতে খেতে টিউশনিতে যাব।
মাপার সময় ছেলেটার হাত কেঁপে যাচ্ছে। একবার একটা দুইটা করে বাদাম দিয়ে মাপ দিচ্ছে, পাল্লা একবার উঠে তো একবার নেমে যায়। রিকশা ওয়ালাও একটু উসখুস করছে অপেক্ষা করতে করতে।
- ঠিক আছে মাপ, দিয়ে দে এখন।
- পাঁচ টাকা, স্যার!
২০ টাকার নোট ভাংতি দিতে গিয়ে আবার দেরী হচ্ছে। একটু বিরক্ত হই। সন্ধে সাড়ে ছয়টায় টিউশনি ধানমন্ডিতে, এরমধ্যে দেরী হয়ে গেছে। আমার ছাত্রটা ম্যাপললিফে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তার মা বার বার করে বলে দিয়েছে যেন সময়মত যাই। সাড়ে ছয়টা থেকে কাঁটায় কাঁটায় আটটা পর্যন্ত পড়িয়ে ছেলেটি বিছানায় চলে যাবে। সকালে অনেক ভোরে তাকে উঠতে হয় স্কুলে যাবার জন্য।
অনেকগুলো এক টাকা দুটাকার নোট ফেরত পেলাম। গনে দেখতে ইচ্ছে হল না। টাকাটা মানিব্যাগে গুঁজে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিলাম।
২
বেশীরভাগ বাদামই ভেতরে ভেতরে পুড়ে গেছে, দুইটা মুখে দিতেই ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। রিকশাটা জোরেই ছুটছে, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। ডিসেম্বর মাসের এই সময়টায় রিকশা চড়তে বড় আনন্দ হয়। বাতাসটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চাদরটা ভাল করে গায়ে টেনে দিতেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চনচনে একটা আরামবোধ হয়।
ছয়টা চল্লিশ বাজে যখন বিশাল গেটটা দিয়ে ঢুকছি। ছাত্রের মা বাইরে পায়চারি করছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখেই ঘড়ির দিকে তাকালেন।
- স্লামালেকুম আন্টি।
- রিফাত, তোমার স্যার এসেছে। পড়তে যাও।
রিফাত তার এলসেশিয়ান কুকুরটা নিয়ে খেলছিল। আমাকে দেখে দৌড়ে আসল।
- বার বার বলেছি সন্ধের সময় গায়ে যেন একটা পুলওভার থাকে, আজকেও তুমি শুধু একটা টি-শার্ট পড়ে আছ।
রিফাত মাথা নিচু করে থাকে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে বৈকি। বাদাম বিক্রি করা ছেলেটার কথা মনে হল হঠাৎ করে। মাপার সময় ছেলেটার হাত কাঁপছিল। সেটা নতুন দাঁড়িপাল্লা হাতে নেবার জন্য নয়। ছেলেটার গায়ে শুধু একটা ছেঁড়া গেঞ্জি, তার হাত শীতে কাঁপছিল?
পড়ানোর সময় কি মনে করে মানিব্যাগে হাত দিলাম। সেখানে গুঁজো করে বাদামের ছেলেটার ফেরত দেয়া টাকাটা একসাথে ভাঁজ করে রাখা। একটু দ্বিধা করেও টাকা খুলে গুনলাম। ছেলেটা ২০ টাকার ভাংতি দিয়ে পাঁচ টাকা রাখার বদলে আমাকে ১৯ টাকা ফেরত দিয়েছে!
৩
- তুমি আজকেও আবার একই শার্ট পড়েছ!
- কই নাতো!
- গত সপ্তাহের মঙ্গলবার তুমি এই শার্ট পরে ক্যাফেতে এসেছ। তার আগের শনিবারে হলে এসেছিলাম, তখনো এই শার্টটাই গায়ে ছিল।
- কি জানি, হতে পারে।
- আমি তোমাকে নতুন দুইটা শার্ট গিফট করলাম, সেগুলো পর না কেন?
- পরব এর পরের বারই।
- লাল শার্টটাতে তোমাকে খুব মানায়, আমি এত শখ করে কিনলাম আর তুমি একবার পরতেও পারলে না!
হলে ইদানীং চুরি হচ্ছে। সেদিন সন্ধেয় টিউশনি থেকে ফিরে এসে আবিষ্কার করলাম, বারান্দায় শুকোতে দেয়া নতুন দুইটা শার্টই মিসিং। দুইটাই ওঁর দেয়া উপহার। এটা কিভাবে বলি! মেয়েরা এইসব ব্যাপার খুব লক্ষ্য করে। ওঁ ঠিক ধরে ফেলেছে।
হলের চার তলা থেকে জামা কাপড় চুরি হচ্ছে, এটা একটা কথা হল! পাশের রুমের রনি ভাইও বললেন, তারও একটা দামী প্যান্ট চুরি হয়েছে দিনে দুপুরে। নিচে দারোয়ান থাকে, তারপরও এতো সাহস!
৪
বাদামের ছেলেটাকে আর খুঁজে পাইনি। সামান্য টাকা পয়সার হিসেব রাখতে না পারলে বাদামের দোকান চালানো কঠিন কাজ। এরমধ্যে আবার বাদাম ঠিকমতো ভাজি করতে শেখে নি। পলাশীর মোড়ে অন্য একজন বাদাম বিক্রি করে। তাকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারলাম না। এরা ভাসমান ছেলেমেয়ে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। হয়তো তার মা-র অসুখ ভাল হয় নি, কিংবা পলাশীর মোড় ফেলে অন্য কোথাও বাদাম বিক্রি করছে। কে জানে!
বিকেলে টিউশনির জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। নিচ থেকে একটা হইচই শুনে বারান্দায় এগিয়ে গেলাম। হলের কোনায় রাস্তার উপর একটা জটলা মত। চিৎকার শুনে মনে হল, চোর ধরা পড়েছে। চারদিক থেকে অনেকেই ছুটে আসছে।
নিচে নেমে রিকশা খুঁজতে গিয়ে জটলার দিকে এগিয়ে গেলাম। চোর ধরা পড়েছে, ধুমধাম মার চলছে। রনি ভাইও সেখানে আছেন। তার হাত মুঠি পাকানো।
চোরের ক্ষীণ শরীরটা রাস্তায় কুঁকড়ে পড়ে আছে। এরমধ্যে মার খেয়ে কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। গায়ের জামাটা রক্তে মাখামাখি হয়ে টকটকে লাল হয়ে আছে। এত বেশি রক্ত, সেটা কিভাবে সম্ভব? চোরটা মারা যাবে তো!
- রনি ভাই, বাচ্চা ছেলে। ছেড়ে দেন এইবার!
- আরে বাচ্চা কি, শালা চোরের বাচ্চা চোর। আমার প্যান্ট এই শালাই নিয়েছে। আজকে আবার চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা খেয়েছে। এই গুলারে মাইরা হাড্ডি না ভাঙ্গলে সোজা হবে না!
জনতাও সাড়া দিচ্ছে। রনি ভাই সহ আরও কয়েকজন হাত তুললেন।
- এই শালা, বল এই শার্ট কার থেকে চুরি করেছিস?
ছেলেটার শার্টটা ভাল করে খেয়াল করে চমকে উঠলাম। এটা তো চুরি যাওয়া নতুন লাল শার্টটা, ছেলেটার গায়ে ঢলঢল করছে। তার চেয়ে বেশি চমকে উঠলাম, ছেলেটার রক্তাক্ত মুখটা দেখে। বাদাম বিক্রি করা ছেলেটা! আশপাশের সবার হাত-পা ধরে ক্ষমাভিক্ষা করছে।
- রনি ভাই। এই শার্টটা আমার, আমিই ওকে দিয়েছি।
রনি ভাই বিরক্ত ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকালেন।
- আমার জিনসও কি তুমি ওকে গিফট করেছ?
কিছু বলতে পারি না। রনি ভাই তাকে একদম খামোখা মারছেন না। ছেলেটা চোর, আমার শার্ট সে চুরি করেছে। আজকেও অন্য রুম থেকে জিনিস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তাই বলে এমন নির্মমভাবে মারধোর!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। আজকেও টিউশনির দেরী হয়ে গেল। রিফাতের মা এরমধ্যে নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকে বারান্দায় পায়চারি করছেন। তার ছেলের ঘুমোতে যাবার দেরী হয়ে যাবে। আর চুরি করে ধরা পরা ছেলেটি পলাশীর মোড়ে রক্তাক্ত মুখে ফুটপাতে পড়ে থাকবে। তার স্কুলে যাবার তাড়া নেই, তার মা-রও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই।
আদনান সাদেক
ঘটনাকালঃ ১৯৯৮-৯৯।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:২২