কয়েক বছর আগেও ফেসবুকে 'জনপ্রিয়তার মোহ' ব্যাপারটা ছিল না। স্ট্যাটাসগুলোতে একটা পার্সোনাল টাচ থাকতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে এটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কেউ ফেসবুকটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এখানে একটা অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য অনেকে খুব সচেতন। বলা যায়, রীতিমত উঠে-পড়ে লেগেছেন। অলিখিত একটা প্রতিযোগিতা দেখা যায় অনেকের মাঝে। কার চেয়ে কে বেশি 'সুন্দর/জ্বালাময়ী/অসাম' 'স্ট্যাটাস' দিয়ে বেশি 'লাইক' কামাতে পারে তেমন একটা প্রতিযোগিতা যে চলছে এটা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। এই কাজটা করতে গিয়ে রাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে ধর্মনীতি পর্যন্ত যে কোন বিষয়ে ঢালাও কমেন্টারি করা হয়- বুঝে হোক কিংবা না বুঝে।
ওপিনিয়ন এক্সপ্রেশন খারাপ কিছু না, কিন্তু মন্দ ইফেক্টটা হয় তখন- যা বলা হল তা যদি ভেবে-চিন্তে না বলে চটজলদি বলা হয়। সূক্ষ্ম চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মন্তব্য করা হয়। এক্ষেত্রে বড় সমস্যাটা সৃষ্টি করে একটা 'এলিট গ্রুপ' [একাংশ], ফেসবুকে যাদের 'বন্ধু' বা 'অনুসারীর' সংখ্যাটা বেশি। দেখুন, এটা সেই দেশ যেখানে পীরচর্চা হয় যুগযুগান্তর ধরে, সবচেয়ে বেশি। এখানে ফেসবুকে এই এলিট গ্রুপের মেম্বাররা একেকজন 'ডিজিটাল পীর'। পীর যেমন আপনাকে মন্দ কাজ থেকে দূরে রেখে ভালো কাজে নিয়োগ করতে পারে তেমনি মন্দ বা ভণ্ড পীরের কবলে পড়লে আপনার সর্বনাশের সাথে সাথে আরও দশ জনের এমনকি দেশটারও সর্বনাশ হতে পারে। ধর্ম পীরের মুরিদরা যেমন অনেক সময় ভণ্ড পীর চিহ্নিত করতে পারে না তেমনি একই সমস্যায় আক্রান্ত ডিজিটাল পীরের মুরিদরা। তারা মেলাতেই পারে না, যে পীরের এতো অনুসারী তিনি ভুল হয় ক্যামনে? নিশ্চয় তিনি সঠিক, এবং তিনি সঠিক, এবং তিনিই সঠিক। বাকিরা সব ভুল, বিপথগামী, মূর্খের দল।
ডিজিটাল পীরের সবচেয়ে বড় সবক হল পরচর্চা। একজন ডিজিটাল পীরের মুরিদের কাছে যিনি পীরের বায়্যাত হননি তিনি পরিণত হন নগণ্য ব্যক্তিতে। অথচ এই 'নগণ্য' ব্যক্তিদের ট্যালেন্ট নিরীক্ষা করলে দেখা যাবে এদের মাঝে অনেকেই সেই ডিজি পীরের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী, যোগ্য, অনুসরণীয়। তিনি হয়তো অতটা প্রচারপ্রিয় না, নিভৃতের কোন সন্ন্যাসী, কোন প্রকৃত সাধক, ধ্যানী, জ্ঞানী। সাদা মনের মানুষের মতো এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের না করা অবধি তাদের সংস্পর্শ পাওয়া যায় না। অথচ এই লোকগুলোই হওয়া উচিত আমাদের প্রকৃত পীর। কিন্তু প্রকৃত পীররা প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল পীরের রমরমা ব্যবসার সময় আরও যেন গুটিয়ে যান। তাদেরকে খুঁজে পাওয়া আরও বেশি মুশকিল হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় ডিজিটাল পীরদের বাণিজ্য ততদিন থামবে না যতদিন না তাদের ভক্ত-আশেকান-মুরিদরা সচেতন হবেন, আরোপিত অন্ধত্ব ত্যাগ করে আলোর দিকে মুখ তুলবেন, তাদের প্রতিটি কথাকে বেদবাক্য মনে করে আমল করবেন না।
সচেতন দুই ভাবে হওয়া যায়- ভেতর থেকে আপন চেতন কিংবা বাইরে থেকে ধাক্কায় পতন। এছাড়া সচেতন হওয়ার অন্য কোন উপায় আমার জানা নেই। কে কোনটা অবলম্বন করবেন সেটা যার যার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। তবে আপন বোধের শিখা প্রজ্বলিত করাটাই নিঃসন্দেহে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। কারণ ধাক্কায় যে পতন হয় সে থেকে আপনি পুরো দমে উঠে নাও দাঁড়াতে পারেন।
ফেসবুক পীরের মুরিদানদের একাংশ জনপ্রিয়তার মোহে আটকে গেছেন। তারাও যে করেই হোক পীরের রেপ্লিকা হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই বেপরোয়া চেষ্টায় কেউ কেউ সৎ থাকতে পারছেন না। জীবনের মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলছেন। ফেসবুক খেলাফত পরিণত হচ্ছে একক ধ্যান-জ্ঞানে। এই মায়াজাল কোনভাবেই কাটতে পারছেন না। পেশাজীবী ডিজিটাল পীররাই এই অবস্থার জন্য দায়ী।
তাই সময় থাকতেই সঠিক পীরের সন্ধান করুন, ভণ্ড পীর থেকে দূরে থাকুন। বাস্তবে হোক কিংবা ডিজিটালে। ভণ্ড পীররা খুব ভয়ঙ্কর। ওরা নাম বেচে খাবে গুড়, আর আপনাকে পঁচা মাছটিও ভেজে খাওয়াতে পারে।
_______
★ফেসবুক অ্যাডিকশনের লক্ষণ ও উত্তরণের উপায়, ফেসবুকে কি করা উচিত ও কি করা উচিত না★ (ফেসবুক ইউজারদের জন্য অবশ্যপাঠ্য)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:১৮