
আমার বই পড়াকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। আলেকজান্ডার বেলায়েভের "দি আ্যামফিবিয়ান ম্যান" পড়ার আগে ও পরে।এই দুই অংশে।আমার বই পড়াটা শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা ও আগ্রহে।সাধারণত দেখা যায় একজন পাঠক বই পড়া শুরু করে তার পরিবারের কোনও সদস্য বা চারপাশের কোনও বই পড়ুয়াকে দেখে। আমার চারপাশে কেউ গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট করার মত গাধা ছিল না। তারা পড়ত পাঠ্য বই আর আমাকে বলত বেকুব। যে কিনা ক্লাসের বই এর নীচে গল্পের বই রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ত।
আমি যখন এইটে পড়ি তখন আমার এক কাজিন শহর থেকে স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে চলে এল থাকার জন্য।সাথে নিয়ে এল এক ট্রাংক ভর্তি বই। তার কাছ থেকে তিন গোয়েন্দা,রবীন্দ্রনাথ,শরৎ পড়া শুরু আমার। আমার পড়ার আগ্রহ দেখে একদিন আমার কাজিন ম্যাক্সিম গোর্কির "মা" আমার হাতে তুলে দিল।
বলল,বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে সেরা ও গুরুত্বপূর্ণ এই বই। মনোযোগ দিয়ে পড়িস।কুইনাইন জ্বরের জন্য ভাল দাওয়াই কিন্তু বড্ড তেতো।আমার কাজিন একটা ভুল বয়সে অসাধারণ একটি বই আমার হাতে তুলে দিয়েছিল।রাশিয়ান লেখকদের লেখার স্টাইল এমনিতেই একটু জটিল।কঠিন শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ হরহামেশা।তারপর এই বই এর অনুবাদ যে ব্যাক্তি করেছিলেন( নাম মনে নেই কলিকাতার একজন)তিনি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে বইটাকে আরও কঠিন করে তুলছিলেন একজন কিশোর এর জন্য। কোনোমতে ৫০-৬০ পেজ পড়ে বই রেখে দিলাম। এবং একইসাথে আমার মনে বিদেশী বই এর প্রতি একটা ভয় ঢুকে গেল।এই ধাক্কাটা আমাকে বিদেশী সাহিত্যের সাথে পরিচয়কে প্রায় বছর তিনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিল।ততদিনে আমি দেশী ও ইন্ডিয়ান লেখকদের নামকরা সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। তারপর একদিন.. ততদিনে আমি কলেজে পড়ছি।রহস্য পত্রিকা কিনার জন্য গেলাম বুকস্টলে। গিয়ে দেখি দোকানী নতুন একটা বই সাজিয়ে রাখছেন। মলাট দেখে আমার কেন জানি মনে হল ভৌতিক বই হতে পারে। আমার মনের মাঝে একটা বাচ্চা সবসময় বাস করে আসছে। এই এখনও আমি গভীর আগ্রহ আর ভয় নিয়ে পিশাচ কাহিনী,ভূতের গল্প পড়ি।বইটি কিনে ফেললাম। নাম "দি অ্যামফিবিয়ান ম্যান"। লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ।বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা ক্লাসিক।
বাসায় এসে পড়া শুরু করলাম। পাতার পর পাতা মুগ্ধ হয়ে পড়ছি। আর ভাবছি মানুষ এসব কিভাবে লেখে। বেলায়েভকে একবার পেলে এই কথাটি জিজ্ঞাস করতামই করতাম আমি।শুরুর পর আজ পর্যন্ত অসংখ্যবার এই বই পড়েছি আমি। মজার ব্যাপার হল এক রুশ বই পড়ে বিদেশী বই পড়া বাদ দিয়েছিলাম আমি আবার আর এক রুশ ফিকশন পড়ে বিদেশী সাহিত্যে ডুবলাম আমি।
কি জাদু আছে উভচর মানবে?
পৃথিবীর সেরা সার্জন সালভাদর আবার বিজ্ঞানীও বটে। তিনি এমন সব অপারেশন করতে পারেন যা বাইরের চিকিৎসকরা কল্পনাও করতে পারে না। সালভাদর আবার খ্যাপাটেও বটে। তার মতে বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে অনেক ত্রুটি।বিশেষ করে মানবদেহে।তাই তিনি বিচিত্র সব অস্ত্রোপচার করেন।তিনি লামা আর ঘোড়ার সংমিশ্রণ করে বানিয়েছেন নতুন ধরনের লামা যা দ্রুত ছুটতে পারে।করেছেন বেড়ালের মুখওয়ালা কুকুর। কুকুরের মুখওয়ালা বাঘ। বিচিত্র এইসব অপারেশন করে তৈরি করা প্রাণীগুলো সব যে কাজের তা নয় কিছু এমনি শখের বশে। তবে তার সেরা সৃষ্টি হল ইকথিয়ান্ডার। উভচর মানব।গ্রীক ভাষায় মৎসমানব। যে মানুষের মত তবে অপারেশন করে তার দেহে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে হাঙরের কানকো। যার ফলে ইকথিয়ান্ডার পানিরে নীচে থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স বন্দর মুক্তো শিকারিদের জন্য স্বর্গরাজ্য। এখানে মুক্তা তোলার জন্য জাহাজ নিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা। বদমেজাজি এই ক্যাপ্টেন এর সহযোগী বিকলাঙ্গ সাহসী নাবিক বালথাযার। এদিকে সাগরে শুরু হয়েছে এক দানবের উপদ্রব। সে জেলেদের মুক্তা শিকারি নাবিকদের ভয় দেখায়। তার ভয়ে কেউ সাগরে নামতে চায় না।পেদরোর ব্যবসা লাটে উঠার উপায়। সবাই ভয় পেলেও দুঃসাহসী বালথাযার আর পেদরো রহস্য উদঘাটন করে ফেলে সাগর দানোর। সে আর কেউ নয় আমাদের ইকথিয়ান্ডার।তাকে ধরার ফাঁদ তৈরি করে পেদরো। কারণ সে চায় এই উভচর মানবকে বন্দী করে তার দ্বারা সাগরের সব মুক্তা তুলে আনতে। এই লক্ষ্যে ডাক্তার সালভাদর এর বাড়িতে পাঠানো হয় বালথাযার এর ভাই ক্রিস্টোকে। সে ছলচাতুরী করে ডাক্তারের মন জয় করে নেয়। এবং ইকথিয়ান্ডারের চাকর হিসাবে নিয়োগ পায়। এদিকে ইকথিয়ান্ডার যদিও উভচর কিন্তু সে মানুষের মতই আবেগী। তার রয়েছে প্রেম কাম সবই। সে সাগর এ একবার সাতার কাটার সময় ডুবে যাওয়ার হাত থেকে উদ্ধার করে গুট্রিয়ারা নামের এক রূপসীকে। পড়ে যায় তার প্রেমে ইকথিয়ান্ডার। ঘটনাক্রমে এই গুট্রিয়ারা আবার বালথাযার এর মেয়ে। যাকে বিয়ে করার জন্য মরীয়া ক্যাপ্টেন পেদরো। কিন্তু গুট্রিয়ারাও সুদর্শন ইকথিয়ান্ডার এর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু তাদের মিলন হবার আগেই পেদরো জোর করে গুট্রিয়ারাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় তার গ্রামের বাড়িতে।পরে গুট্রিয়ারার বন্ধু অলসেন এর কাছে সব শুনে ইকথিয়ান্ডার গুট্রিয়ারাকে উদ্ধার করার জন্য রওনা দেয় পেদরোর বাড়িতে। কিন্তু ওখানে সে পেদরোর হাতে বন্দী হয়ে যায়।তাকে বন্দী করে মুক্তা তোলার কাজে ব্যবহার করতে থাকে পেদরো।
ঘটনাক্রমে ইকথিয়ান্ডার পালাতে সক্ষম হয় পেদরোর কাছ থেকে। কিন্তু এবার ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। বালথাযার তার ভাই ক্রিস্টোর কাছ থেকে ইকথিয়ান্ডারের শরীরের বিশেষ একটি দাগ এর কথা শুনে নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে অনেক আগে তার শিশু ছেলেকে সে ডাক্তার সালভাদর এর কাছে রেখে এসেছিল চিকিৎসার জন্য। যার শরীরেও ছিল একই স্থানে একই রকমের জন্মদাগ। ডাক্তার সালভাদর বালথাযারকে জানিয়েছিল তার ছেলে মারা গেছে কিন্তু লাশ আর ফেরত দেয় নি। এর ফলে বালথাযার এর ধারনা জন্মে ইকথিয়ান্ডার তারই ছেলে।সে কোর্টে মামলা করে দেয় সালভাদর এর বিরুদ্ধে। তার সন্তানকে ফেরত ও বিকলাঙ্গ করার প্রতিকার চেয়ে।সারা বিশ্ব জেনে ফেলে সাগর দানোর রহস্য। মামলা চলতে থাকে এর মধ্যে ধর্ম ব্যবসায়ী আর্চ বিশপ এর নোংরামি প্রকাশ পায়। লোভী পেদরোর নীচুতা আমরা দেখতে পায়। অবশেষে জেলার এর সহায়তায় ইকথিয়ান্ডারকে মুক্ত করে সালভাদর। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে। গুট্রিয়ারাকে সে খুঁজে চলে যাবার সময়। দুঃখের ব্যাপার হল গুট্রিয়ারা ও আড়াল থেকে তাকে দেখে। কিন্তু সামনে আসে না। কারণ যদি ওকে দেখে ইকথিয়ান্ডার না যেতে চায়। ওদের প্রেমটা অপূর্ণই থেকে যায় শেষপর্যন্ত।
কাহিনী এটুকুই। আমার মতে এই বই এর সবচেয়ে বড় মেসেজ হল প্রকৃতি বিসাদৃশতা পছন্দ করে না। ঈশ্বর যাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছে তাকে সেভাবেই রাখা ভাল। নাহলেই হয় সমস্যা।তবে এই বই এর সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে বালথাযার এর পিতৃ স্নেহ। ইকথিয়ান্ডারে একাকীত্ব আমাদের স্পর্শ করে। তার কষ্ট আমাদের নাড়া দেয়। সালভাদরের গবেষণা আমাদের মুগ্ধ করে তবে তারচেয়ে বেশী লাগে বালথাযার এর কষ্ট। ইকথিয়ান্ডারকে হারিয়ে শোকে সে পাগল হয়ে পড়ে। সাগর পাড়ে ছুটে আর খোজে তার সন্তানকে।
প্রিয় বই এর তালিকায় এই বইটি দুই এ আছে। আমার মনে হয় আজীবনই থেকে যাবে। এই বই পড়ার পর আমি অনেকবার ভেবেছি কেন এত প্রিয় আমার বইটি।নানা কারণের মধ্যে একটি সম্ভবত কাজী মায়মুর হোসেন এর ঝরঝরে অনুবাদ। এত সহজ আর সুন্দর করে লিখেছেন মুগ্ধ না হয়ে উপায় কি? সাধারনত আমি কোনও অনুবাদ ভাল লাগলে মূল বইটি সংগ্রহ করে পড়ি। কারণ অনুবাদের সাথে মূল বই এ অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে সেবার অনুবাদে। তারা মূল বইকে কেটে-ছিড়ে প্রায় অর্ধেক এ নামিয়ে আনে। কিন্তু আমার প্রিয় বই হওয়া সত্ত্বেও এটার মূল ইংরেজি আমি পড়িনি। যদি মুগ্ধতার রেশ সামান্য কেটে যায় এই ভয়ে।
সেবার কাছে আমি আজন্ম ঋণী। সেবা শুধু আমাকে নয় এদেশে অসংখ্য পাঠককে বিদেশী সাহিত্যের সাথে পরিচিত করেছে। বানিয়েছে বইপাগলা।এই বইটির জন্য ঋণটা আরও বেড়েছে।
ছবি- আমার নিজের কাছে থাকা কপিটির।