সতর্কীকরণঃ এই লিখা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখিত।
Graphic content alert: Some readers may find the contents of this article inappropriate, offensive or shocking.
আগ্নেয়াস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকখানি বিরক্তিকর অংশ হল বুলেট। অতএব পাঠকগণ সাবধান হোন, এই লেখা পদার্থবিজ্ঞান থেকে প্রাণীবিদ্যা কোন কিছুই বাদ দেবে না।
যাইহোক, শুরু করব একটা খুব কমন ভুল শুধরে নিয়ে। জনপ্রিয় অর্থে ‘বুলেট’ বলতে আমরা যা বুঝি তার নাম আসলে বুলেট নয়। এর নাম ‘কারট্রিজ’ (cartridge) বা ‘বুলেট কারট্রিজ’। অর্থাৎ বিভিন্ন হলিউডি মুভিতে আমরা যখন অস্ত্র রিলোড করতে দেখি তখন অস্ত্রে যে জিনিসটা ভরা হয় তা কারট্রিজ, বুলেট নয় । বাজারে বিভিন্ন ধরণের কারট্রিজ পাওয়া যায়, তবে প্রায় সমস্ত ধরণের কারট্রিজের বেসিক কর্মপদ্ধতি একই রকম। সকল কারট্রিজের পরিচয় বহন করে তার ব্যাস যা ক্যালিবার নামে পরিচিত। এই ব্যাস সাধারণত মিলিমিটারে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ 9mm বুলেট কারট্রিজ মানে এর ব্যাস ৯ মিলিমিটার। অনেকসময় এই ক্যালিবারের হিসেব ইঞ্চিতেও প্রকাশ করা হয়, যেমন- .৩৮, .৪৫ ইত্যাদি। আমরা সবার প্রথমে শুরু করব একটি কারট্রিজের গঠন দিয়ে। একটা কারট্রিজের মূলতঃ তিনটা অংশ থাকে।
এগুলো হলঃ
১। প্রাইমার ( Primer)
কারট্রিজের সবচেয়ে নীচের অংশটি হল প্রাইমার। প্রাইমারের ভেতর গোল পাত্রের মত অংশটিকে বলে কাপ (cup)। এই কাপের ভেতর থাকে খুবই স্বল্প পরিমাণ বিস্ফোরক। কোন অস্ত্র দিয়ে গুলি করার সময় যখন ট্রিগার টেনে ধরা হয় তখন ওই অস্ত্রের ফায়ারিং পিন প্রাইমারে আঘাত করে। এই আঘাতের ফলে প্রাইমারের ভেতর থাকা পুরো বিস্ফোরক একবারে জ্বলে ওঠে এবং গুলি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এছাড়া সমস্ত প্রাইমারের বাইরের আবরণকে বলে রিম। এই রিম কারট্রিজকে অস্ত্রের সাথে আটকে থাকতেও সহায়তা করে।
২। বুলেট কেস ( Bullet Case)
প্রাইমারের ঠিক ওপরের অংশটির নাম হচ্ছে বুলেট কেস। এই কেস হল কারট্রিজের সবচেয়ে বড় অংশ। কেস এর ভেতর থাকে প্রপেল্যান্ট বা বুলেটের জ্বালানী, যার কাজ হল বুলেটকে সচল করা। প্রপেল্যান্ট ও একটি দাহ্য ও পাউডার জাতিয় বিস্ফোরক পদার্থ । প্রাইমার থেকে বিস্ফোরনের আগুন যখন প্রপেল্যান্টে পৌঁছায় তখন প্রপেল্যান্টও জ্বলে ওঠে। এর ফলে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস উৎপন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন হল, প্রাইমারের প্রয়োজন কি? সরাসরি কেস এ থাকা জ্বালানী কেন জ্বালানো হয় না? এর উত্তর হল, সমস্ত বিস্ফোরকই আঘাতে জ্বলে ওঠে না। তাই প্রাইমার এবং প্রপেল্যান্ট হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া প্রপেল্যান্টে এমন ধরণের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয় যা প্রাইমারের মত একবারে জ্বলে ওঠে না, বরং ধাপে ধাপে প্রচুর গ্যাস তৈরী করে জ্বলে ওঠে। প্রপেল্যান্টের বিস্ফোরক প্রাইমারে ব্যবহার করা হলে তা ফায়ারিং পিনের আঘাতে জ্বলে ওঠবে না আর প্রাইমারের বিস্ফোরক প্রপেল্যান্টে ব্যবহার করা হলে বিস্ফোরণে অস্ত্রের নল সহ ঊড়ে যেতে পারে। আগ্নেয়াস্ত্রের বিবর্তনের প্রথমদিকে এ ধরনের সমস্যা বেশ কমন ছিল।
৩। বুলেটঃ
কারট্রিজের একদম মাথায় যে গোল সলিড ধাতুর টুকরা থাকে তার নাম বুলেট। বুলেট কেস এ প্রপেল্যান্ট পুড়ে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস তৈরী করে। কেসিং এর শক্ত ধাতব দেহের ভেতর এই গ্যাস প্রসারিত হওয়ার জন্য সামনে থাকা ধাতব টুকরো বুলেটের পেছনে প্রচন্ড চাপ দেয়। এই চাপে বুলেট টি নল দিয়ে বেরিয়ে আসে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
এবার চলুন যাই আঘাত করার দিকে।
বেশীরভাগ সময়ই কারট্রিজের মাথায় থাকা এই বুলেট তৈরী হয় সীসা, টিন এবং অ্যান্টিমনির সংকর ধাতু দিয়ে ( অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে)। সীসা তুলনামূলকভাবে একটি নরম ধাতু। তাই প্রায়ই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে এই সীসার বুলেট বিকৃত (deform) হয়ে যায় । যেই বুলেট যত বেশী বিকৃত হয় তার আহত করার ক্ষমতা তত বেশী। অন্যদিকে তার ভেদ করার ক্ষমতা (penetration power) তত কম। তাই সাধারণত কোন প্রাণীকে আঘাত করার জন্য সীসার নরম বুলেট ব্যবহার করা হয় আর কোন বস্তু ধ্বংস করার জন্য ( যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে রেডিও বা আরমার্ড গাড়ি ) অপেক্ষাকৃত শক্ত ধাতুর বুলেট ( লোহা, নিকেল, টাংস্টেন ) ব্যবহার করা হয়।
আঘাত এর আলোচনায় সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হল বুলেট প্রবেশের ক্ষত এবং বেরিয়ে যাবার ক্ষত ( entry hole and exit hole)। মনে করুন আপনি একজন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ। আপনার কাছে এমন একটি কেস এল যেখানে কোন ব্যক্তি দাবী করছে পুলিশ তার ভাইকে অবৈধভাবে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এখন আপনি কি করে বুঝবেন গুলি কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে আর কোন দিক দিয়ে বেরিয়েছে?
এর উত্তর পাওয়া যাবে পরবরতী অংশে।
বুলেটের প্রবেশ পথ বা এন্ট্রি হোল এর কিছু ইউনিক বৈশিষ্ট আছে। মানুষের চামড়া অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল একটি জিনিস। ফলে যখন বুলেট মানুষের দেহে প্রবেশ করে তখন দেহের চামড়া ফ্লেক্সিবলিটির জন্য প্রসারিত হয়ে বুলেটকে ঢোকার পথ করে দেয় আর বুলেট প্রবেশ করার পর তা আবার চেপে আসে। এর ফলে বুলেটের এন্ট্রি হোল হয় ছোট, ইন ফ্যাক্ট বুলেটের ব্যাসার্ধের চেয়েও বেশ অনেকটা ছোট। এজন্য মুভিতে যেমন ক্ষত দেখেই বিশেষজ্ঞ অস্ত্রের ক্যালিবার বলে দেয় বাস্তবে তেমনটা হয় না। তবে বুলেটটি যদি অনেক দূর থেকে আসে তবে এর গতি কম হয় এবং তা দেহে প্রবেশ করতে বেশি সময় নেয়। ফলে যে এন্ট্রি হোল তৈরী হয় তা মোটামুটি ভাবে বুলেটের ব্যাসের সমান বা সামান্য ছোট হয়। এবং এন্ট্রি হোল এর ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়ই চামড়ার ঠিক নিচেই অবশিষ্ট গান পাউডার, উত্তপ্ত সীসার কাল পোড়া ছাই ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়া আঘাত করার স্থানে যদি চামড়ার অল্প নিচেই হাড় থাকে ( যেমন মাথার করোটি) তবে অল্প ক্যালিবারের বুলেটের ফলে সৃষ্ট এন্ট্রি হোল হয় ভেতর মুখি। ক্যালিবার বড় হলে ছোট ছোট হাড়ের টুকরা ভেঙ্গে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এছাড়া মুখ এবং মাথার এন্ট্রি হোলের চারদিকে অনেক সময় ঘষা দাগ ( stretch mark) এর মতোও সেখা যায়।
ছবিঃ ছোট এন্ট্রি হোল।
বুলেট বেরিয়ে যাওয়ার সময় এর গতি কম থাকে এবং বেশিরভাগ সময়ই অনেকখানি বিকৃত হয়ে যায়। এর ফলে এ সময় বুলেট মাংশপেশীতে অপেক্ষাকৃত বেশী ক্ষতি করে ( Tissue Disruption) । এজন্য বুলেটের বেরিয়ে যাওয়ার পথ বা এক্সিট হোল অনেক খানি বড় হয় এবং টিস্যু অনেকটা টেনে ছেঁড়া ( ragged) মনে হয়।
ছবিঃ বড় এক্সিট হোল
তবে এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। আমরা জানি
গতিশক্তি Ek = 0.5mv^2
যেখানে Ek= Kinetic energy.
m= Mass
v= Velocity.
পদার্থবিদ্যার এই সূত্র অনুযায়ী কোন বুলেটের ভেলোসিটি দ্বিগুন বাড়লে তার গতি শক্তি চারগুণ হয়। ভেলোসিটি তিনগুণ হলে গতিশক্তি বাড়বে নয় গুণ। এজন্যই রাইফেল কিংবা AR-15 বা Ak-47 এর মত অ্যাসাল্ট রাইফেলের ক্ষেত্রে ক্ষতি অনেক বেশি হয় কারণ সাধারণ হ্যান্ডগানের চেয়ে এগুলোর বুলেটের ভেলোসিটি অনেক বেশি। আগেই বলেছি, বুলেটের ক্যালিবার নির্নয় হয় তার ব্যাস বা প্রস্থের মাপ দিয়ে। কিন্তু হ্যন্ডগান (পিস্তল, রিভলবার) এর বুলেট কারট্রিজ রাইফেলের গুলোর চাইতে দৈর্ঘ্যে অনেকটা ছোট হয়। তাই এগুলোতে গানপাউডার আঁটে কম। ফলে হ্যান্ডগানের বুলেটের ভেলোসিটি তুলনামূলক কম হয়। হ্যান্ডগানের ( পিস্তল, রিভলবার) বুলেট হাড়ে লাগলে সাধারণত হাড়ের মাঝেই আটকে যায় কিংবা হাড়ের মাঝে ছোট একটা ছিদ্র হয় যেন হাড়ের মাঝ দিয়ে ছোট ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করা হয়েছে। অন্যদিকে রাইফেলের বুলেট হাড়ে লাগলে তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
এখন, খুব ছোট ক্যালিবারের বুলেট, যেমন .২২ , এর ভর খুবই কম হওয়ায় এর ভেলোসিটি আপনা আপনিই বেশি হয়। বুলেট খুব ছোট হওয়ায় তা তেমন একটা বিকৃত হওয়ারও সুযোগ পায় না। এর ফলে এই ধরনের বুলেট দ্রুত দেহে প্রবেশ করে বেরিয়ে যায় ও এন্ট্রি হোল এবং এক্সিট হোল উভয়ই ছোট হয়। এ ধরণের ক্ষেত্রে এন্ট্রি হোল এবং এক্সিট হোল নিরণয় করা বেশ কঠিন।
এবার সংক্ষেপে কয়েক ধরণের বুলেট-
১। এপি বা বর্মভেদী ( AP - Armor Piercing) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্কের বহুল ব্যবহার শুরু হওয়ার পর এই ধরণের বুলেটের ওপর প্রচুর পরিমাণ এক্সপেরমেন্ট এবং উন্নতি সাধন হয়েছে। এইধরণের বুলেট সাধারণত তৈরি হয় স্টীল বা টাংস্টেন দিয়ে, ওপরে কপার বা পিতলের আবরণ থাকে। এরা সুক্ষ্ম মাথা বিশিষ্ট বুলেট।
২। এফএম জে বা সম্পূর্ণ ধাতব "জ্যাকেট " ( FMJ - Full Metal Jacket ) : মূলত সীসার বুলেট, ওপরে পেটা লোহার আবরণ থাকে।
৩। জে এস পি বা নরম মাথা বুলেট (JSP - Jacketed Soft Point ) : এই ধরনের বুলেটের আবিস্কার হয় ভারত উপমহাদেশে। আরও পরিস্কার করে বললে উনিশ শ শতাব্দীতে দমদমের সেনানিবাসে এক ভারতীয় সেনা এফএমজি বুলেটের মাথার স্টীলের আবরণ কেটে ফেলেন ও শুধু সীসার আবরণ রেখে দেন, এভাবেই প্রথম শুরু হয় জে এসপি র যাত্রা। এর নরম মাথা দেহে লেগে খুব দ্রুত থেঁতলে যেত। ওই সময় এটা শত্রুকে আঘাত করার 'মানবিক' উপায় হিসেবে বিবেচিত হত।
3. জে এইচ পি বা গর্ত মাথা বুলেট ( JHP - Jacketed Hollow Point ) জে এসপি বুলেটের নরম মাথায় গর্ত করে এই ধরনের বুলেট বানানো হয়। আর্মার বিহীন টার্গেটে ভয়াবহ প্রভাব হলেও আর্মারে কার্যত অর্থ হীন। মূলত আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে থাকে।
আজ এ পর্যন্তই থাক। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
বিঃদ্রঃ ছবির লিমিটে পৌঁছে যাওয়ায় শেষ দুইটি বুলেটের ছবি দেওয়া গেল না। শটগানের কার্ট্রিজ নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আজ আর সময় নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৪৩