"দেখছনি কারবার! " তৃতীয় বারের মত স্বগতোক্তি করলেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান ওরফে খালেক মেম্বার।
উত্তর বঙ্গের রুক্ষ আবহাওয়া, সূর্যদেব স্বর্গ থেকে তার ক্রোধ মাটির পৃথিবীতে বিনা ভিসায় চালান করতে কসুর করছেন না। এর মাঝে শরীরে ভারি কম্বলের মত তোয়ালে জড়িয়ে রাখা রীতিমতো বীরত্বের কাজ। সেই অতিমানবীয় কাজটিই খালেক মেম্বার গত বিশ মিনিট যাবৎ করে চলেছেন। মেম্বার এমনিতেই বেশ স্বাস্থ্যবান, তার ওপর হালকা হাই প্রেসারের ধাত আছে। এছাড়া দুপুরে বেশ গুরুপাক খানাপিনাও হয়েছে। এক চাচা - ভাতিজার বিবাদে সালিশ করতে গিয়েছিল, ফলাফল পক্ষে যাওয়ায় ভাতিজা জোর করে খাইয়েছে। তাই একরকম ঝর্ণার মত ঘাম হচ্ছে তার।
বাঁশের মোটা এক ফালিতে কায়দা করে বসানো আদি এবং অকৃত্রিম ক্ষুর দিয়ে নিজের হাতের কারুকার্য দেখাচ্ছে নিতাই শীল, মেম্বারের ঘামে ভেজা মুখ বেশ অসুবিধা করছে তার। কোন এক কারণে মেম্বারের চর্বিযুক্ত মুখ দেখে বারবার পোষা মাদি শুয়োরটার কথা মনে পরছে।
আর দশজনের মত সাধারণত নরসুন্দরের দুয়ারে পদধূলি দেওয়ার প্রয়োজন হয়না মেম্বার সাহেবের, নাপিতই তার বাড়িতে গিয়ে সেবা দেয়।
আজ নিজে আসার পেছনে একটা কারণ আছে। সামনেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াবে সে, লোকজনের কাছে যাওয়া আসার দরকার আছে। তাছাড়া এই "মালু" রা বড় চালাক, নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদের বাগ মানানো শক্ত। মালুদের মাঝে ভাল একটা ভোট ব্যাংক বানানোর পরিকল্পনা আছে খালেক মেম্বারের।
তবে এটা তার প্রধান উদ্দেশ্য নয়। প্রধান উদ্দেশ্য হল নির্ভরযোগ্য সাক্ষী বানানো। উপযুক্ত নেতার মত নাপিতের দোকানে এসে বসেছে খালেক মেম্বার, বিদায় করেছে সাথে থাকা হাসু আর বগাকে। হাসিমুখে গল্প করেছে লাইনে থাকা আরও দুজনের সাথে। তারপর সবার শেষে গিয়ে চেয়ারে বসেছে। নাপিত ছাড়াও এখন আরও তিনজন নিরপেক্ষ সাক্ষী আছে তার।
সে বাজী ধরে বলতে পারে এই চারজনের কেউই আন্দাজ পর্যন্ত করতে পারেনি যে এইমাত্র জোয়াহের চেয়ারম্যান কে খুন করে এসেছে সে।
আসলে তাকে খুন করার কোন ইচ্ছাই ছিল না খালেকের। তবুও বাধ্য হয়ে করতে হল, অনেকটা আত্মরক্ষার্থেই করতে হল। সামনের নির্বাচনে খালেক জিতবে এই ধ্রুব সত্যটা চেয়ারম্যানও টের পেয়েছিল, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিজেরই এক সময়ের সহচর খালেককে সরিয়ে দেওয়ার। হ্যাঁ, জোয়াহের চেয়ারম্যান এর "হিটম্যান " হিসেবে কাজ করেছে খালেক একসময়। সে-ই খালেককে হাতে ধরে রাজনীতি শিখিয়েছে। আর তার শেখানো শিক্ষা তারই উপর প্রয়োগ করেছে খালেক। তাকে মারার কন্ট্রাক্ট চেয়ারম্যান কাকে দিয়েছিল তা জানেনা খালেক, চেয়ারম্যান এর সার্কেলের ভেতরে থাকা তার গুপ্তচর সে খবরটা দিতে পারেনি। অবশ্য তার দরকারও নেই। গাছই যখন উপড়ে ফেলা গেছে তখন লতাপাতা দিয়ে কি হবে!
এসব ভেবে মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠেছিল তার মুখে।
এমন সময়ই অদ্ভুত ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সে।
নাপিতের দোকানে সামনে পেছনে বসানো দুইটি বড় আকৃতির আয়না একে অপরকে প্রতিফলিত করে চলেছে অসীম পর্যন্ত। আলোর সূত্র মেনে তাই চৌধুরী খালেকুজ্জামান তার সামনের আয়নায় তার মাথার সামনের এবং পেছন ভাগের অসীম পর্যন্ত প্রতিকৃতি দেখতে পাচ্ছেন।
সে মাথা নাড়লে প্রতিকৃতি গুলোও নাড়ে, সে হাসলে তারাও হাসে। তারা খালেকুজ্জামানকে অনুসরণ করে, সম্পূর্ণ অনুগত ভৃত্যের মত। অন্তত আজ পর্যন্ত তাই করত।
কিন্তু আজ হঠাৎ তাদের একজন বিদ্রোহ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
খালেকুজ্জামান স্পস্ট দেখতে পাচ্ছেন তার প্রতিকৃতি গুলোর মাঝে ছয় নম্বরটি তার মত হাসছে না, সে হাসির মত অবস্থায় নেই।
ওই প্রতিকৃতিটি সেলুনের চেয়ারে কাত হয়ে পরে আছে, তার গলা নিখুঁত ভাবে একান থেকে ওকান পর্যন্ত নিখুঁত ভাবে জবাই করা।
তাকে দেখে কেন যেন খালেকুজ্জামানের জবাই করা শুয়োরের কথা মনে হচ্ছে।
গালের ওপর নিতাই শীলের দক্ষ ক্ষুরের আঁচড়ের মধ্য দিয়েই চতুর্থ বারের মত বিরবির করে স্বগতোক্তি করল মেম্বার,
"দেখছনি কারবার! "
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:১৬