এক সময় দীর্ঘ দিন শেষ হল। আসমানের নির্দিষ্ট দিক থেকে অগ্রহায়ণের নিস্তেজ সূর্য দূর্বল ভঙ্গিতে তার শেষ আলো ঢালছে। রিজভী সাহেব তার হাল্কা অন্ধকারাচ্ছন্ন অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। ব্যাপারটা এমন নয় যে অন্ধকার তার অপছন্দ। সত্যি বলতে, সর্বদা কোলাহল পূর্ণ অফিসের নিস্প্রাণ চেহারা তার বেশ লাগছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ দেরি হয়ে গেছে। অফিসটাইম শেষ হয়েছে প্রায় দুই ঘন্টা আগে, এখনো না বেরোলে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এত বেলা পর্যন্ত অফিসে থাকা রিজভী সাহেবের এই প্রথম। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তী মানুষ, ঘড়ি ধরে আসেন - ঘড়ি ধরে বেড়িয়ে যান। কিন্তু আজ সকালে অফিসে ঢুকেই দেখেন পুরো অফিসে সব টেবিলে নতুন কাঁচ লাগানো হয়েছে, শুধু তারটা বাদে। তার টেবিলের সেই পুরনো দাগধরা কাঁচ আর মলিন "নগদ গ্রহন" লেখা তার দিকে মুখ ভেংচে মিটিমিটি হাসছে। প্রথমে তার সন্দেহ হল এটা মকবুল সাহেবের কোন প্র্যাক্টিকাল জোক। মকবুল সাহেব সাধারণত লোকজনকে জব্দ করার জন্য তার উর্বর মস্তিষ্কের আইডিয়া গুলো তার ওপরই প্র্যাকটিস করেন।
পরে জানা গেল মিস্ত্রি শুক্র - শনি দুইদিনের বন্ধের মাঝেও সব কাজ শেষ করে ওঠতে পারেনি। শুধুমাত্র তার টেবিলই কেন বাকি - এই প্রশ্নটা লাউয়ের ডগার মত বাড়তে শুরু করলেও বেশি দূর এগুতে দিলেন না। যেভাবেই হোক, ব্যাপারটা আসলে মন্দ হয় নি।
কিছুদিন যাবতই নতুন কাঁচ লাগানোর আলাপ চলছিল। তখন থেকেই রিজভী সাহেব তার নিজের টেবিলের কাজ কিভাবে করতে হবে তা মিস্ত্রিকে দেখিয়ে দিতে চাইছিলেন। বর্তমান কাঁচটা একটু ঢিলে। কেউ এসে চাপ দিলে কাঠ - কাঁচের ঘষায় অদ্ভুত একটা শব্দ হয়, রিজভী সাহেবের পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
পরিস্থিতি আরো সংকটময় হয়ে উঠেছে যখন থেকে মকবুল সাহেব ব্যাপারটা টের পেয়েছেন। তিনি এখন রোজ দুবার করে রিজভী সাহেবের টেবিলে এসে দাঁত বের করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন আর বেশ উৎসাহ নিয়ে কাঁচ নেড়ে শব্দ করতে থাকেন।
পিয়নের কথা অনুসারে আজ অফিস টাইমের পর মিস্ত্রি এসে নতুন কাঁচ লাগিয়ে দেওয়ার কথা। তার জন্যই রিজভী সাহেব অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ঘন্টা দুই হয়ে যাওয়ার পরও যখন মিস্ত্রি এল না তখন বাধ্য হয়েই ওঠতে হল। একবার সন্দেহ হল, এটাও মকবুল সাহেবের কোন ফন্দি নয়তো? মনের চক্ষুতে মুহূর্তের জন্য আগামীকাল সকালে কিভাবে তিনি অযথা দুই ঘন্টা বসে ছিলেন মকবুল সাহেবকে রসিয়ে রসিয়ে সেই গল্প করতে দেখতে পেলেন। অন্যান্যদের সেই গল্পে আনন্দও প্রকাশ করতে দেখা গেল। অন্যকে জব্দ হতে দেখার মত বিনোদন বেশ বিরল।
তবুও আজ রিজভী সাহেবের মেজাজ খুবই ভাল। অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করলেন। তিনি একা মানুষ, ঘরে ফেরার তাড়া নেই। সত্যি বলতে তিন কুলে তার কেউ নেই। এক বুড়ি মা ছিল, গত হয়েছেন তাও প্রায় বছর দশেক। এক ঘটক বেশ কিছুদিন তার বিয়ের চেষ্টাও করেছিল, শেষ পর্যন্ত কিছু হয় নি। অবশ্য রিজভী সাহেবের কিছু বন্ধু আছেন। যদিও তাদের সংখ্যা কম, তবুও আছেন। এই বন্ধুরাই তার সব সুখ - দুঃখের সাথী।
আজ তার মেজাজ ভাল হওয়ার প্রধান কারণ হল, তিনি একজন নতুন বন্ধু পেতে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য বন্ধুর পরিচয় এখনো তার কাছে অজ্ঞাত। এক অজানা রোমাঞ্চের শিহরণ বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে।
★★★
বাস থেকে শাহবাগ মোড়ে এসে নামলেন রিজভী সাহেব। আকাশ ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে বসা ভাসমান একটা দোকান থেকে পুরি আর আলুর চপ খেলেন গোটা কয়েক। এরপর টুপির দোকানে উদ্দেশ্যহীনভাবে কয়েকটা টুপি নাড়াচাড়া করলেন। দোকানি অবশ্য ফিরেও তাকাল না। দীর্ঘ দিনের ব্যবসায় কে সম্ভাব্য কাস্টমার তা সে ভালোই বুঝতে পারে।
পরবর্তী গন্তব্য টিএসসি। সেখানেও ছয় কাপ "স্পেশাল মরিচ চা" চালান হয়ে গেল। এরপর হেলেদুলে যখন উদ্যানের দিকে চললেন তখন রাত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর হঠাৎ আওয়াজ এল -
"ভাইজানের কুন প্রবলেম? "
"না। তেমন কিছু না। "
"এইহানে এমনে ঘুরেন ক্যান? "
"এমনিই "
অন্ধকার থাকে অনুচ্চ হাসির আওয়াজ এল।
" হেহেহে। এমনেই ঘুরেন! তা ভাইজান কি ক্রিকেট খেলেন নাকি? "
উত্তেজনা চেপে যথাসম্ভব শান্ত গলায় রিজভী সাহেব জবাব দিলেন
"খেলি। আরেকজন খেলোয়াড় খুঁজতেছি। "
" তা ব্যাটিং করেন না ফিল্ডিং? "
"ব্যাটিং "
এইবার অন্ধকার থেকে বিশ - বাইশ বছরের একটা ছেলে বেড়িয়ে এল। হাইট বড়জোর সাড়ে পাঁচ, গাট্টাগোট্টা চেহারা। দেখতেও মন্দ না।
" এক ম্যাচ। সাতশো দেওন লাগব। হোটেল হইলে আমার ঠিক করা জায়গায় যাইতে হইব। "
রিজভী সাহেব রাজি হয়ে গেলেন। তিনি আস্ত ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন, হোটেলের কোন প্রয়োজন নেই। রিকশায় উঠেই রিজভী সাহেব ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কোন উত্তর এল না।
"নাম দিয়া কি হইব?"
"না মানে আবার যদি কখনো লাগে ওই জন্য। "
"আবার লাগলে আইয়া পরবেন। আমি আশেপাশেই থাকি। " বলে মুচকি হাসল ছেলেটা।
রাস্তায় আর তেমন কোন কথা হল না। রিজভী সাহেব দুই একবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছেলেটাকে সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত দেখা গেল।
বিষয়টা ঠিক পছন্দ হল না। আরেকটু যাচাই - বাছাই করে নেওয়া উচিৎ ছিল।
চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন রিজভী সাহেব। ভেতরে বসার রুমে কোন আসবাবপত্র নেই। টিভির সামনে শুধুই আরামদায়ক চেহারার একটা জাজিম পাতা। ছেলেটাকে সেখানে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন চা, পানি বা জুস কিছু চলবে কি না।
"লাগব না। আপনে রেডি হইয়া আসেন। কাম শুরু করেন। "
"চাইলে কিন্তু পাগলা পানিও আছে। "
এবার ছেলেটাকে ইতস্ততঃ করতে দেখা গেল।
"যদি বিদেশী কিছু থাকে তাইলে ... "
রিজভী সাহেব উঠে গেলেন, ফিরলেন দু গ্লাস ভোদকা হাতে। দুজনে মিলে ধীরে ধীরে চুমুক দিলেন। পুরো গ্লাস শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটা হঠাৎ ওঠে দাঁড়াল -
" আপনে কি দিছেন এইটা আমারে... "
দু পা যাওয়ার আগেই আবার পড়ে গেল ছেলেটা। রিজভী সাহেব মাথা নাড়লেন। এইজন্যই তিনি সোফা কিনেন নি। পড়ে গিয়ে কোথাও লেগে গেলে সমস্যা। নিজের জিনিসে খুঁত তার একেবারেই পছন্দ নয়।
★★★
ছেলেটার জ্ঞান ফিরল ঘন্টাখানেক পর। কিচেনে একটা লোহার চেয়ারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়েছে তাকে, বাম হাতের শিরায় একটা স্যালাইন বাঁধা। গ্যাসের চুলার পাশে পেছন ফিরে রিজভী সাহেব খুব দ্রুত কয়েকটি ক্যাপসিকামের টুকরা নিখুঁত দক্ষতায় কাটছেন। ছেলেটা প্রথমে বাঁধন খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু তা ঢিলে পর্যন্ত হল না। চীৎকার করতে গিয়ে টের পেল তার মুখে মোটা অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। রুদ্ধ আওয়াজে পেছন ফিরে তাকালেন রিজভী সাহেব, মুখে দরাজ হাসি আর হাতে পাতলা কিন্ত চওড়া একটা স্টীলের চাপাতি। কিন্তু কিছু বললেন না। রান্না হল একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, এর মাঝখানে কথা বলার মত সময় তার নেই।
সব প্রস্তুতি শেষ হলে তিনি দক্ষতার সাথে ছেলেটার ডান হাত কনুই পর্যন্ত কেটে নিলেন, তারপর গজ -ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষত আটকে দিলেন। ছেলেটাকে মরতে দেওয়া যাবে না। মানুষের শরীরে মাংস নিতান্ত কম থাকে না, এক দিনে খেয়ে শেষ করা সম্ভব না। আর মরে গেলে লিভার / ব্রেনের মত সুস্বাদু জিনিসগুলো নস্ট হয়ে যাবে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল "তাজা" মাংসের স্বাদই আলাদা!
★★★
চতুর্থ দিন রাত্রে ছেলেটাকে খাওয়া শেষ হল। রিজভী সাহেব রাতের খাবার শেষ করলেন টিভির সামনে বসে, তার পছন্দের সিরিয়াল "বোঝে না সে বোঝে না " দেখতে দেখতে।
নিজ মস্তিষ্কের ভেতর তিনি তার নতুন বন্ধুর উপস্থিতি স্পস্ট অনুভব করতে পারছেন। আজ সারারাত তার সাথে গল্প করবেন ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। উপরন্তু মিস্ত্রি এসে আজ তার টেবিলের কাঁচও নিখুঁত ভাবে বসিয়ে গেছে।
নতুন বন্ধুকে তিনি প্রথম প্রশ্নটা করলেন
" তোমার নাম কি? "
মস্তিষ্কের ভেতর থেকে সাড়া এল -
"জাকের মিয়া। আমার নাম জাকের মিয়া। "
(সমাপ্ত)
( গল্পটা পুরনো। তখনো 'বোঝে না সে বোঝে না' সিরিয়ালের মিউজিকের আওয়াজ পেতাম। আজকাল আর পাই না। সম্ভবত বন্ধ হয়ে গেছে। )
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:০২