" অনেকদিন পর তোমাদের সবাইকে একসাথে দেখে বেশ ভাল লাগতেছে। অবশ্য আমি জানি, তোমরা আমার প্রতি ভালবাসা থেকে আস নাই। আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এটা তোমাদের জন্য একরকম সুখবরই হওয়ার কথা। তোমরা আসলে আমার বিছানার চারদিকে জড়ো হয়েছ কে সম্পত্তির কোন ভাগ পাবা এইটা জানার জন্য।
এইজন্য আমি তোমাদের দোষারোপও করি না। জন্মের পর থেকেই আমি তোমাদের সাথে পাষানের মত আচরণ করছি। এইজন্য তোমরা আমাকে মাফ করবা এমন আশাও আমি করি না। তাই আজকে আমি তোমাদের ডাকছি শেষবারের মত কিছু কথা বলার জন্য, যেন এই বুড়া মানুষটাকে গালি দেওয়ার আগে নিজে একটু বিবেচনা করতে পার। আজকে আমি তোমাদের থেকে আমার পাপ - পূণ্য কিছু লুকাব না। আমার জীবনের সেইসকল জিনিস বলব যা কোনদিন কখনো কারও কাছে প্রকাশ করি নাই, তোমাদের মায়ের কাছেও না।
তোমরা জান, আমার বাপ যখন মারা যায় তখন আমার বয়স ছয় মাস। বুকের দুধ ছাড়ার পরই মায়ের আবার বিয়ে হইল আর আমি গেলাম এতিমখানায়। মায়ের নতুন বাড়িতে আমার যাওয়া নিষেধ ছিল। এমনকি এতিমখানার জন্য চাউল তুলতে গেলেও ওই বাড়িতে আমার ঢোকা বারণ ছিল। একবার লুকায়ে ঢুকছিলাম। ছোট ছিলাম, মনে মানতো না। সৎ বাপ জালিম ছিল, ধইরা এমন মার মারছিল যে বাম চোখ এক সপ্তাহ বোজা ছিল। ওই চোখে এরপর থিকাই কম দেখি। মাও স্বামী নাখোশ হবে এই ভয়ে আমাকে দেখতে আসত না।
এইভাবেই একসময় ডাঙ্গর হইলাম। আলীপুর মক্তব থেকে পাশ নিয়া বের হইয়াই পরলাম বিপদে। কাজ কাম তেমন কিছু জানি না, বয়স কম হওয়ায় ইমামতিও করতে পারি না। আত্মীয় - স্বজন তেমন কেউ নাই যে গিয়া ওঠব। শেষ পর্যন্ত হামিদগাঁওয়ে এক মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ জুটল। টাকা - পয়সা তেমন ছিল না কিন্তু থাকা খাওয়ার চিন্তা আর ছিল না। মসজিদের ইমাম সাহেবের পাটের ব্যবসা ছিল, ওইখানেও যাতায়াত শুরু হইল। কয়েক বছর ঘুরতে হাতে মোটামুটি টাকা - পয়সাও আসল।
ইমাম সাব তাগিদ দেওয়া ধরলেন, বালেগ পুরুষ অবিবাহিত থাকা ঠিক না। সুন্নত তরক হয়। তার ওকালতিতেই এক শীতে তোমাদের মাকে ঘরে আনলাম। হাতে টাকা পয়সা কিছু ছিল, কয়েকজন থেকে আরও কিছু কর্জ করে চৌচালা ঘর তুলে সংসার পাতলাম। এরপর যে কাহিনী বলব তা দুনিয়ার আর কোন প্রাণী জানে না। এতদিন একা বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়া রাখছি।
মসজিদ থেকে অল্প দূরেই খাঁ সাহেবদের ঘাট বাঁধানো পুকুর ছিল। আমি ভোরে ওঠে পুকুর থেকে পাক - সাফ হয়ে মসজিদের তালা খুলে আজান দিতাম। বেশ ভোরেই উঠতে হত নইলে মসজিদের সামনে মুসল্লিদের জমায়েত হয়ে যেত। সেই সময় দুনিয়া অন্যরকম ছিল। মানুষের দিলে খোদাপাকের ভয় ছিল। মুসল্লির অভাব হত না।
সেইদিন ছিল শুক্রবার। আমি রোজকারের মত অন্ধকার থাকতেই পুকুরে অজু করার জন্য নামতেছি। এমন সময় হঠাৎ ঘাটের শ্যাঁওলায় পা পিছলায়ে গেল। পাকা সিঁড়িতে পরে মাথায় ভাল রকম চোট পাইলাম। মাথার পেছন থেকে গলগল করে রক্ত ঘাড়ের কাছ দিয়ে নামতেছে টের পাইতেছি, কিন্তু শরীর সাড়া দিতেছে না। বহু চেস্টা করেও বিন্দুমাত্র নড়তে পারলাম না। বুঝলাম ডাক চলে আসছে, সময় আসন্ন। কেন জানি বারবার তোমাদের মায়ের মুখটা চোখে ভাসতে লাগল। ওই মেয়েমানুষের আগে জীবনে আদর - সোহাগকি কোনদিন বুঝি নাই। মনটা কোনভাবেই তারে ছাইড়া যাইতে চাইতেছিল না। কয়েকবার ডাকাডাকির চেস্টা করলাম, ফল হইল না।
এমন সময় হালকা হাসির শব্দ পাইলাম। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হওয়া ধরছে। সেই আবছা আলোয় দেখি পুকুরের পানির ওপর দাঁড়ায়া কে যেন হাসে। ভোরের এই সময়টায় জ্বীনের আনাগোনা বাড়ে জানতাম। কিন্তু যেই মুহূর্তে চোখ পড়ছে আমি সেই সময়ই জানতাম এইটা সাধারণ কোন জ্বীন না। এ খোদ শয়তান।
সংকটে আমার ঈমান ফসকায় গেল। তারে বললাম, আমারে বাঁচাও।
সে হাইসা বলে, তোমারে কেন বাঁচাব? আমার কি লাভ?
"আমি বাকি জীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব। আমি এখন মরতে চাই না।"
জওয়াব হইল, তুমি তো এমনিতেই শেষ। তোমার কাছে আমার নেওয়ার কিছু নাই। তবে তোমার বংশধর থেকে যদি সবচেয়ে প্রিয়টা দেও তাহলে হইতে পারে।
কোন ভাবনা চিন্তা না কইরাই রাজি হইলাম।
সে বলল, তুমি আশি বছর বাঁচবা। বিষয় - সম্পত্তি হবে। এরপর তোমার বংশধর থেকে তোমার সবচেয়ে প্রিয়জনকে আমি নিয়া যাব।
এরপর আমার নজর ঘোলা হইয়া আসল। তারপর আর কিছু খেয়াল নাই।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি ঘরে। তোমাদের মা আমার সেবায় ব্যাস্ত। তাজ্জব ব্যাপার হল, মাথায় হালকা ফোলা কিন্তু কোন কাটাদাগ নাই। শুনলাম পুকুরের ঘাটলায় পরে ছিলাম, লোকজন দেখে তুলে আনছে। তোমাদের মা কেও আর কিছু বললাম না।
এরপর মুয়াজ্জিনের কাজ ছেড়ে দিয়ে পাটের ব্যবসায় পুরাপুরি নামলাম। শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করা, তাই সৎ থাকতে পারলাম না। পাটে ভেজা বালু দিয়া ওজন বাড়াইতাম। এরপর হলুদ - মরিচের ব্যবসা হইল, লবনের আড়ৎ দিলাম। সিদ্ধান্ত নিছিলাম জীবনে কোন সন্তান নেব না। কিন্তু তোমাদের মা জিদ করল। ঘটনার বছরখানেক পর প্রথম সন্তান আসল, তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয়। তারপরও আমি চেস্টার কমতি রাখি নাই। তোমাদের সাথে ইচ্ছা কইরাই খারাপ আচরণ করতাম, মার - ধোর করতাম, খাওয়ার কস্টও দিতাম। টাকা পয়সার কমতি ছিল না, কিন্তু কোনদিন তোমাদের হাতে কোন সদাইপাতি কিনা দেই নাই। তোমাদের সাথে নরমসুরে কোনদিন দুইটা কথা বলছি এমনটাও মনে পরে না।তোমাদের দিনের পর দিন ঘরে বন্দি কইরাও রাখছি। সবই মনে আছে। তোমাদের মা মনে মনে কস্ট পাইত কিন্তু আমার মিজাজের ভয়ে কিছু বলতে পারত না। কোন কোন দিন দিলটা ভাইঙ্গা যাইত, তারপরও শক্ত হইতাম যাতে কারও ওপর মায়া না পরে।
মা আয়েশা- সুরাইয়া, জামাইদের বইলো তারা যেন পারলে আমাকে ক্ষমা করে। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করতাম যেন তারা নাতিগুলারে নিয়া তারা বাড়িতে না আসে। সব সময় ভয় হইত, যদি মায়া পইড়া যায়।
বাবা রহিম, তুমি যখন বাজান বইলা ডাকতা তখন দিল শক্ত করা বড় কঠিন হইত।চোখের বাইরে থাকলে শুনছি নাকি মনের বাইরে হয়। এইজন্য বাচ্চা থাকতেই তোমারে মাদ্রাসায় দিছিলাম। এরপর শহরে রাইখা পড়াইছি, সবসময় চেস্টা করছি যেন দুই ঈদ ছাড়া বাড়িতে না আস। আমি যা করছি তোমাদের ভালোর জন্যই করছি, এইটা ছেলে হইয়া তুমি যদি না বোঝ তাহলে মনে কস্ট নিয়া মরব।
আমার আশি বছরের আয়ু প্রায় শেষ। সময় হইয়া আসছে। জানি জাহান্নাম ছাড়া আমার আর কোন গতি নাই, তারপরও বিষয় আসয় শরীয়ত মতেই ভাগ করছি। বাবা রহিম, তুমি পাবা মাসকান্দা চড়ার এগার বিঘা আর.........."
উৎসর্গঃ জগতের সকল "কঠিন হৃদয়" বাবার প্রতি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ২:৩৬