মায়ের দোয়া হোটেলের পেছন দিকে অন্ধকারমত একটা সীটে বসে আছে শ্রাবণ। সামনের প্লেটে এই হোটেলের বিখ্যাত খাসির চপ। কিন্তু সেদিকে শ্রাবনের মন নেই, সে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। এই হোটেলটা তার বাবার, কিন্তু তিনি এখন আর কাউন্টারে বসেন না। ম্যানেজারই সব কাজ চালায়। তাঁর আলুর ব্যবসা আছে, সেটা নিয়েই তিনি এখন ব্যস্ত। কিছুদিন হল আলুর দাম পরে গেছে, ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। তবে বাপের ব্যবসা মন্দা যাওয়া শ্রাবণের ভাবনার বিষয় নয়।
ভাবনার বিষয় হল ওর ছোটবোন অর্পিতা কে রবীন্দ্রসরোবরে একটা ছেলের সাথে ফুচকা খেতে দেখা গেছে। ছেলেটি আর কেউ নয়, তারই বন্ধু জাহিদ। এবং এটা খুবই খারাপ খবর । জাহিদের বাবার দুইটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। বংশও বেশ ভাল।
তারপরও এটা খারাপ খবর।
কারণ জাহিদকে চেনে শ্রাবণ, সে একটা লম্পট।
মেয়েটার নাম ছিল রেখা, জাহিদের পঞ্চম শিকার। ডাগর চোখ, সেই চোখেই হারিয়ে গিয়েছিল শ্রাবণ। কিন্তু পাত্তা পায়নি সে, পাত্তা পেয়েছিল দামি গাড়ি আর ডিএসএলআর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো জাহিদ।
রেখাকে ফেরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল শ্রাবণ, বলেছিল জাহিদের সাথে আগের মেয়েগুলোর সম্পর্ক আর সর্বনাশের কথা। কিন্তু শোনেনি সে।
আজও শ্রাবনের মনে সেই বিকেলটি অম্লান যেদিন অন্য এক বন্ধুর কাছে ফ্ল্যাটের চাবি চেয়েছিল জাহিদ, রেখাকে ইঙ্গিত করে বলেছিল "চারমাস ধইরা ঘুরতাছি, আইজ মা*টারে খামু। "
অর্পিতাকে বুঝিয়ে লাভ নেই, যেমন লাভ হয় নি রেখাকে বুঝিয়ে।
আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত পতঙ্গকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই,.....
একমাত্র উপায় আগুনটাকে নিভিয়ে দেওয়া।
ভাবে শ্রাবণ .... ভাবে...
বিখ্যাত মুর্শিদ মিয়ার চাপ বিস্বাদ লাগে শ্রাবনের, মুখের ভেতর ঘি দিয়ে ভাজা মাংস নাড়কেলের ছোবলার মত মনে হয়।
ভাবে শ্রাবণ ... ভাবে...
.
.
.
আজ বার দিন যাবৎ জাহিদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আজও হোটেলে বসে ভাবছে শ্রাবণ।
জাহিদ নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় অর্পিতার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ খুঁজে এনেছে সে। ছেলে ঢাবি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পাশ করেছে, ভাল চাকরি করে। শীগ্রই বিদেশ চলে যাবে, তাই বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। অর্পিতা এবার ইন্টার দেবে, বিয়ে দিলে পড়াশোনা নস্ট হবে।
তবে এটা শ্রাবনের আজকের ভাবনার বিষয় নয়। মেয়েছেলের এত পড়াশোনার কি দরকার!
কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ এসেছিল। আদর আপ্যায়ন করে বিদায় করেছে শ্রাবণ, খাইয়েছে তন্দুরি, কাবাব আর খাসির চপ। তারা জাহিদের সব বন্ধু বান্ধব কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, শ্রাবণকে একটু বেশীই করছে। তার অবশ্য কারণও আছে, জাহিদকে সর্বশেষ শ্রাবনের সাথেই দেখা গেছে।
কিন্তু শ্রাবণ বলেছে সে জাহিদকে সন্ধ্যায় ছবির হাটে রেখে নিজ হোটেলে চলে এসেছে ব্যবসার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য, রাতেও সেখানেই ছিল। এ ব্যাপারে শ্রাবনের শক্ত অ্যালিবাই হল হোটেলের বাবুর্চি মুর্শিদ মিয়া। এছাড়া পাশের মুদি দোকানী পরদিন ভোরে দোকান খুলতে এসে মুর্শিদ মিয়া আর শ্রাবণকে একসাথে দাঁত মাজতে মাজতে হোটেলের পেছন থেকে বেরোতেও দেখেছে।
পুলিশ তদন্তে সুবিধা করতে পারছে না। সম্ভবত ভাল নাস্তা পানির জন্যই তারা প্রায়ই হোটেলে আসছে।
তবে এসবও শ্রাবনের আজকের ভাবনার বিষয় নয়।
তার আজকের ভাবনার বিষয় নরমাংসের স্বাদ কেমন সেটা।
আচ্ছা, নরমাংস কি স্বাভাবিক মাংসের মতোই খেতে?
নরমাংস এর স্বাদ কি মুরগির মাংসের মত, না গরুর মত, না..... খাসির মত?
আচ্ছা এই যে ওসি এইমাত্র খাসির চপ খেয়ে গেলেন তিনি কি জানেন নরমাংসের স্বাদ কেমন?
তিনি কি জানেন খাসি আর মানুষের মাংসের স্বাদে পার্থক্য কি?
শ্রাবনের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
{এই গল্প উৎসর্গ করা হলঃ আমার বন্ধু সোহাগ (যে বেশ থ্রিলারের কঠিন ভক্ত, কিন্তু প্রেমকাহিনী লেখতে ভালবাসে),
নিলয় কান্তি দেবনাথ ও অন্তর মাহমুদ (এদের সাথেই জীবনে প্রথম রবীন্দ্র সরোবরে গিয়েছিলাম, খানিকটা অপ্রস্তুত ভাবে দেখেছিলাম জুটিবদ্ধ ফুচকা খেতে থাকা কপোত কপোতীদের),এবং রায়হান কবির (যে খুবই ভাল লেখে কিন্তু পাছে লোকে কিছু বলে বিধায় প্রকাশ করে না) }