আদি বাংলার ইতিহাস- পর্ব ৪৭
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
চাকার আবিস্কার
চাকার আবিস্কার নবোপলীয় মানুষের উল্লেখযোগ্য কীর্তি।১০২ অবশ্য রাস্তা তৈরি যেখানে সহজসাধ্য ছিল সেখানে চাকা তৈরি উৎসাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে রাস্তা তৈরি করা কোনো সময়ই সহজসাধ্য ছিল না; জঙ্গলাকীর্ণ কাদাজাতীয় মাটি অসংখ্য নদী-নালায় সিক্ত হতো বলে মালামাল ও মানুষ পরিবহনের জন্য নদীপথ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে তুলনামূলকভাবে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের অনেক পরে এদেশে চাকার ব্যবহার দেখা যায়। নবপোলীয় যুগে বাংলাদেশে যানবাহনে চাকার ব্যবহার ছিল এমন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত সামগ্রী থেকে বুঝা যায় যে, ২০০০/১৫০০ পূর্বেই তারা চাকার সাহায্যে মৃৎপাত্র তৈরি করতো এবং চকচকে পালিশ করতে পারতো।১০৩
আগুনের ব্যাপক ব্যবহার:
পুরানো প্রস্তরযুগেই মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত। কিন্তু নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি ও ব্যবহার নবোপলীয় যুগে শিখেছিল। এসময় কাঠ ঘষে বা চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালানো শেখে। আগুন আবিস্কারের ফলে মানুষের খাদ্যউৎসে পরিবর্তন আসে। কাঁচা মাংসের বদলে ব্যাপকভাবে মাংস ঝলসে খাওয়া শুরু করে। এতে দৈহিক পরিবর্তন ছাড়াও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। মৃৎপাত্র তৈরি, খাদ্য সেদ্ধ, শীত থেকে রক্ষা, বন্য জীবজন্তু থেকে রক্ষার কাজেও আগুনের ব্যবহার তারা করেছে।১০৪ এদেশে আগুনের ব্যবহার ব্যাপক আকারেই ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এমন কি যুদ্ধেও অস্ত্র হিসেবে আগুনের ব্যবহার ছিল। নব্যপ্রস্তরযুগেও এদেশের মানুষ আগুনকে পবিত্রতার প্রতীক বলে এবং পরবর্তীকালে পাপ মোচনকারী বলে গ্রহণ করেছিল। এদশের আদিবাসীরা আগুনের পূজা করতো এ প্রমাণ রয়েছে। ঐতিহাসিক যুগেও এ পূজা বন্ধ হয়নি। এই উপমহাদেশের আদি সাহিত্যগ্রন্থ ঋগবেদেও আগুনের প্রশস্তি রয়েছে।
অলংকার ও প্রসাধনসামগ্রী
খাদ্যের সন্ধানে আগের মতো তত উদ্বিগড়ব থাকতে না হওয়ায় এ সময় মানুষ সাজসজ্জার দিকে নজর দেয়। নারী-পুরুষ উভয়েই শরীরে উল্কি ব্যবহার করত। মেয়েরা গলায়, হাতে ও পায়ে পুঁতির মালা ও গলায় মালার সাথে লকেট ও হাতের বালা পরত এমন প্রমাণ মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে পাওয়া গেছে; বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে কখন থেকে অলংকার ও উল্কির ব্যবহার আরম্ভ নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এদেশে আদিবাসীদের মধ্যে অস্ট্রিকরাই প্রথম অলংকার ও উল্কির ব্যবহার করে বলে অনুমান করা হয়।১০৫ এদেশে দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের আগমনের পর অলংকারের বহুল ব্যবহার হয়ে থাকবে; আদিকাল থেকেই তাদের মধ্যে অলংকারের ব্যবহার ছিল।১০৬ তার পর অবশ্য সাঁওতাল, গারো, চাকমা, টিপরা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই অলংকার ও উল্কির ব্যবহার দেখা যায়। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২০০০/১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই অধিবাসীরা পুঁতি ও মূল্যবান পাথরের (Chalcedony এবং a gate ইত্যাদি) অলঙ্কার ব্যবহার করতো।
বয়ন শিল্প
৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কিছু অঞ্চলে বস্ত্র উৎপাদনের জন্য তুলাচাষের প্রচলন ছিল বলে গর্ডন চাইল্ড উলেখ করেন। কাপড় তৈরির নবোপলীয় প্রযুক্তি এখনো পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতা তৈরির যন্ত্র, চরকা, তাঁত নবোপলীয় যুগে আবিস্কার হয়। সুতা ও চরকার আবিস্কার কাপড় বোনার কাজকে সহজ করে দিয়েছে। আধুনিক বিদ্যুৎচালিত তাঁতেও নবোপলীয় যুগের তাঁতের বয়নপদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বস্ত্র আবিস্কার ও ব্যাপক ব্যবহার মানুষকে তার দেহ আবৃত করতে তথা সভ্য হতে সহায়তা করেছে।১০৭ বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে বয়নশিল্পের প্রচলন অত্যন্ত প্রাচীন। পাহাড়ি অঞ্চলে, বিশেষ করে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে জুমচাষে ধানের সঙ্গে তুলার বীজ বপন করার রীতি আদিযুগের। বাংলাদেশে এইসব অঞ্চলে যখন থেকে ধান চাষ আরম্ভ হয় তখন থেকেই তুলা চাষও হয়ে আসছে; এইজন্য এদেশে যুবতী মহিলাদের হাতে তৈরি সুতার মসৃণতা ও আকার-আকৃতির সুনাম কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে। তারই ফলে এককালে তৈরি হতো দুকূল বিশ্বখ্যাত মসলিন ও জামদানি সুতা।
গ্রামের উদ্ভব
নবোপলীয় যুগে ক্রমবর্ধমান জনশক্তি যাযাবর জীবনের ইতি ঘটিয়ে নিজ নিজ কৃষিজমির পাশে স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করতে থাকে। এর ফলে গড়ে ওঠে গ্রাম। জনসংখ্যা আরো বেড়ে গেলে তারা কিছু দূরে গিয়ে নতুন গ্রাম বানাত। এদেশে সমতলভূমিতে গ্রাম পত্তনের ইতিহাস বহু প্রাচীন ক্রমে উর্বর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গ্রামে ছেয়ে যায়। দুই গ্রামের মধ্যে বিস্তীর্ণ জমির ব্যবধান ছিল। গ্রামগুলি তখন বর্তমানের মতো বড় আকারে ছিল না। এদেশের পাহাড়ি এলাকায় কয়েকটি পরিবার মিলেই একটি গ্রাম হতো এবং সমতলভূমিতে গ্রামগুলি আকারে একটু বড় ছিল। এ সময়ে তিন প্রকারের গ্রাম দেখতে পাওয়া যায় বলা হয়েছে। সমতলে কোনো কোনো গ্রাম ছিল স্বনির্ভর, উদ্বৃত্ত ও প্রান্তিক গ্রাম।১০৮ গ্রামগুলি আস্তে আস্তে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নতুন প্রস্তরযুগেও নিজের এলাকাতে পাবার জন্য কর্মে শ্রেণীবিভাগ আরম্ভ হয় যা পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বর্ণবাদে পরিণত হয়। এভাবেই গড়ে উঠে বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবী জাতিগোষ্ঠী।
ক্ল্যান প্রথার ভাঙ্গন ও পরিবারের উৎপত্তিঃ
নব্যপ্রস্তরযুগে হাতিয়ারের উনড়বতির ফলে সব মানুষের একসাথে কাজ করা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। পরিবারের সকল সদস্যই এক খণ্ড বা একাধিক খণ্ড জমি চাষ করতে পারত। তাই পুরনো প্রস্তরযুগের যৌথ শ্রম ব্যবস্থার বদলে পরিবারের উৎপত্তি হয়।১০৯ ক্ল্যানের সর্দার পরিবারের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিত। সব পরিবারের হাতিয়ার, পশু ও ঘর ছিল। বার্নস ও রাল্ফ মনে করেন, এ যুগে বিবাহ প্রথা চালু হয়। দু’ধরনের বিবাহ পদ্ধতি চালু ছিল। নবোপলীয় যুগের পরিবারগুলোতে বহুগামিতা (Polygamous) ও একগামিতা (Monogamous) উভয় ব্যবস্থা চালু ছিল বলে মনে হয়।১১০ স্ত্রী বা স্বামী যে কোনো দিক থেকে বহুত্ব ধারাকে বুঝানোর জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা বহুবিবাহ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বহুপতি প্রথাও এদেশে বর্তমান ছিল যার ইঙ্গিত পরবর্তীকালের গ্রন্থ মহাভারতে পাওয়া যায়। বহুপত্নী প্রথা বহু অঞ্চলে প্রচলিত ছিল তেমনি কোনো কোনো অঞ্চলে বহুপতি-প্রথা যে বর্তমান ছিল তার প্রমাণ রয়েছে। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, নব্যপ্রস্তরযুগে বিবাহ প্রথার সবে আরম্ভ। কাজেই বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-কানুন বা রীতি-নীতি তখনও পুরোপুরিভাবে গড়ে উঠেনি। এই জন্যই প্রাকবিবাহকালে কোনো স্ত্রীলোকের সন্তানলাভ তখনও গর্হিত বলে গণ্য হয় নি। পরবর্তীকালের বিভিনড়ব সাহিত্য ও ধর্মপুস্তুকে তার বর্ণনা রয়েছে। এক পুরুষের বহু স্ত্রী থাকায় নবোপলীয় যুগে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে কখন থেকে পরিবারের উৎপত্তি জানা না গেলেও, নব্যপ্রস্তরযুগ থেকেই পরিবার গঠন ও ব্যক্তিমালিকানায় সম্পত্তি অর্জন সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসবাসকারীদের মধ্যে পরিবার গঠন হয়েছিল। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আর্যরা যখন ভারতে আসে, তাদের মধ্যেও বিবাহ প্রথা ও পরিবার গঠন ছিল। অর্থাৎ নব্যপ্রস্তরযুগের প্রথম থেকেই ভারত-উপমহাদেশে এবং তার বাইরে পারিবারিক জীবন প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। নব্যপ্রস্তরযুগের কোনো এক সময় থেকে বাংলাদেশে সমাজজীবন (Community life) পরিত্যক্ত হয়ে পারিবারিক জীবন চালু হয়েছিল বললে ইতিহাসবিরুদ্ধ হবে বলে মনে হয় না।
১০১ D.H. Gordon: The Prehistoric Background of Indian Culture.
১০২ V. Gordon Childe: Man Makes Himself..
১০৩ ইরফান হাবিব (অনুবাদ কাবেরী বসু), প্রাক ইতিহাস (২০০৪), পৃষ্ঠা ৬৯।
১০৪ W. L. Thomas (Junior): Man’s Role in Changing the Face of the Earth..
১০৫ M. Abdul Mumin Chowdhury- Buddhism in South Asia.
১০৬ বিজয় চন্দ্র মজুমদার: বাংলা ভাষার দ্রাবিড়ী উপাদান।
১০৭ ফয়েজ আলম: প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি।
১০৮ রামশরণ শর্মা: আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ।
১০৯ V. Gordon Childe: Man Makes Himself.
১১০ Richard Fick: Social Organization of North-Eastern Indian in Buddhas Time.
আগামী পর্বেঃ রাষ্ট্রের উদ্ভব
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪৬