আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪২
বাংলাদেশী পাখিঃ
বাংলাদেশে বন্য প্রাণীর মধ্যে পাখির অবস্থান অত্যন্ত রঙিন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। সারা পৃথিবীতে পাখি প্রজাতির সংখ্যা ৮,৬০০ থেকে ৮,৭০০ বলে পাখি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁদের মতে ভারত উপমহাদেশে পাখির সংখ্যা ১২০০; বাংলাদেশে একসময় প্রায় সমস্ত পাখিই ছিল, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৬০০ এর কাছাকাছি বলে তাঁরা ধারণা করেন।৮২ এদের মধ্যে ২০০টি শীতের পাখি এবং ৪০০টি স্থানীয় বাসিন্দা। তবে আদিকাল থেকেই দেশে পাখির সংখ্যা ছিল অত্যাধিক; বাংলাদেশের পাখিগুলি মোট ৬৪টি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে ৪২টি পরিবার নন-প্যাসেরাইন বা অগায়ক এবং বাকিরা প্যাসেবাইন বা গায়ক পাখি। অগায়ক পাখির কণ্ঠস্বরও সুমধুর হতে পারে। তবুও এরা অগায়ক এজন্য যে এদের গলায় ভয়েস-বক্স বা সুর-বাক্স নেই যা গায়ক পাখিতে আছে।
অগায়ক পরিবারগুলি হচ্ছে: Podicipitidae, ডুবুরী; Phaethontidae, ট্রপিক বার্ড; Pelicanidae, গগনবেড়; Phalacrocoracidae, পানকৌড়ি; Ardeidae, বক: Ciconidae, হাড়গিলা ও মানিকজোড়া; Threskiornithidae, কাস্তেচরা; Phoenicopteridae, ফ্লেমিংগো; Anatidae, হাঁস; Accipitridae, চিল, শকুন, ঈগল ও বাজ; Pandionidae, মেছো ঈগল; Falconidae, ফ্যালকন; Phasianidae, বনমোরগ ও ময়ূরতিতির; Turnicidae, বটের বা লাওয়া; Gruidae, সারস; Rallidae, ডাহুক-কোড়া; Heliornithidae, ফিনফুট; Otididae, ডাহর; Jacanidae,, পিপি; Haematopdidae, শুক্তীভোজী বাটান; Rostratulidae,, রঙ্গীলা চ্যাগা; Recurvirontridae,, ডেঙ্গা; Burthinidae, খড়মা; Glareolidae, বাবুই বাটান; Charadriidae, হট্টিটি, চাপাখি, কাদাখোচা, চ্যাগা ও গুলিন্দা; Stercorariidae, জলদস্যু পাখি; Laridae, গাংচিল, জল কবুতর; Columbidae, হরিয়াল; ঘুঘু ও কবুতর; Psittacidae, টিয়া ও লটকন; Cuculidae,, কোকিল; Strigidae, পেঁচা; Podardidae, ফ্রগমাউথ; Caprimulgidae, রাতচরা; Apodidae, আবাবিল ও নাককাটি; Trogonidae, ট্রোগন; Alcidinidae, মাছরাঙ্গা; Meropidae, সূইচোরা; Coraclidae, নীল কণ্ঠ; Upupidae হুদ হুদ; Bucerotidae, ধনেশ; Capitonidae, বসন্ত বাউরী এবং Picidae, কাঠঠোকরা।
প্যাসেরাইন বা গায়ক পাখির দলে আছে: Eurylaimidae, ব্রডবীল; Pittidae, নীল পাখি, সুমচা; Alaudidae, ভরত পাখি; Hirundinidae, আবাবিল; Lanidae, কসাই পাখি; Oriolidae, হলদে পাখি; Dicruridae, ফিঙ্গে ও ভীমরাজ; Artamidae, লাটোরা; Stumidae, শালিক ও ময়না; Corvidae, কাক; Campephagidae, গুধুকা; Irenidae, ফটিকজল ও নীলপরী; Pycnonotidae, বুলবুলি; Muscicapidae, সাতভায়লা, প্যাংগা, চটক, সিপাহী, টুনটুনী, দোয়েল ও শ্যামা; Paridae, তিতপোখ; Sittidae, নাটহ্যাচ; Motacillidae, খনজন; Dicaeidae, ফুলঝুরি; Nactaraniidae, মৌটুসি, মৌচুষি ও স্পাইডার হান্টার; Zosteropidae, শ্বেতাঙ্খি; Ploceidae, বাবুই ও চড়ুই এবং Fringilidae, বাঘেরী ও বানটিং।
বিশেষ বিশেষ পাখি
সবচেয়ে বড় ও ছোট: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাখি হচ্ছে সারস, Sarus Crane, Grus antigone । এ পাখির ঠোঁটের আগা থেকে, দাঁড়ানো অবস্থায়, পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু। কিন্তু লম্বার দিক থেকে ময়ূর এবং ডানা মেলে ধরলে শকুন সবচেয়ে বড় পাখি। বিশাল আকৃতির বক এবং হাড়গিলাও বড়দের দলে পড়ে। আমাদের সবচেয়ে ছোট পাখি হচ্ছে ফুলঝুরি, Tickell’s Flowerpecker, Dicaeum erythrorhynchos । এরা লম্বায় মোটে আড়াই ইঞ্চি এবং ওজনে প্রায় পাঁচ গ্রামের মতো। ছোটদের দলে আরো আছে ফ্লায়ারপেকার; সবচেয়ে সুন্দর পাখি: বাংলাদেশের সুন্দরতম পাখি ভারতীয় ও বর্মী ময়ূর Indian Peafowl এবং Burmese Peafowl, Peafowl, Pavo cristatus ও P. muticus ছিল। প্রজাতি দুটি এদেশে বিলুপ্ত বলাই ভালো। ছোটদের মধ্যে সুন্দর হচ্ছে মৌটুসি বা নীলটুনী, Purple Sunbird, Nectarinia asiatica । এছাড়াও আছে হলদে পাখি এবং ট্রোগন।
পাখির আয়ু: একটি পাখি কত বছর বাঁচে এ প্রশ্ন অনেকের; বাংলাদেশে দীর্ঘায়ু কামনার ক্ষেত্রে এবং সে কামনা যখন বিরক্তির সাথে হয়, তখন লোকে বলে ‘অমুক শকুনের হায়াৎ পেয়েছে।’ ভাবখানা এই যে, শকুন শত বছর বা দীর্ঘদিন বাঁচে। বাস্তবের সাথে এর মিল নেই। পাখি কত বছর বাঁচে সে বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এর বড় কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে বনে বা প্রাকৃতিক পরিবেশে পাখি পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয় না। তবে পোষা পাখির জীবন-ইতিহাস থেকে পাখি বিশারদেরা জেনেছেন যে, প্রকৃতিতে চড়ুই বাবুই ধরনের ছোট পাখির গড় আয়ু ৬ থেকে ৮ বছর, কাক জাতীয় পাখির গড় আয়ু ১০ থেকে ১৫; শকুন বা বৃহদাকার পাখির আয়ু মোট ৩০ থেকে ৪০ বছর। শকুন সর্বোচ্চ ৫২ বছর, হুতুমপেঁচা ৬৮, রেভেন ৬৯, ময়ূর ২০ বছর, কবুতর ৩৫ বছর খাঁচায় বেঁচেছে এমন রেকর্ড আছে।
স্থানীয় পাখি:
স্থানীয় আবাসিক বা বাসিন্দা পাখি বলতে ইংরেজি রেসিডেন্ট বার্ডকে বুঝানো হয়েছে। সারা বছর ধরে আমাদের বাড়ির পাশে ঝোপে, ঝাড়ে, জলাশয়ে, নদীর তীরে ও বনেবাদাড়ে এবং পাহাড়ে যেসব পাখির আনাগোনা, যাদের ডাকে প্রতিনিয়ত আমাদের ঘুম ভাঙ্গে, যাদেরকে বাসা বাঁধতে ও ডিম পাড়তে দেখি সেই দোয়েল-কোয়েল, শ্যামা, কাক-কোকিল, বক, ডাহুক কোড়া, নীলকণ্ঠ, বসন্ত বাউুরী এবং চড়ুই-বাবুইরাই হচ্ছে এদেশের স্থানীয় বা আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের পাখি নিয়ে এমন গবেষণা হয় নি যা থেকে এদেশের সব স্থানীয় পাখির বাসা বাঁধা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়েছে। তবে ই.সি.এস. বেকারের লেখা ফোনা অব ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সিরিজের পাখি খণ্ডসমূহ (১৯২২-১৯৩০); সালীম আলী ও এস.ডি.রিপলের লেখা হ্যান্ডবুক অব দি বার্ডস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান নামক ১০ খণ্ড বইতে (১৯৬৮- ১৯৭৪) যেসব পাখিকে বাংলাদেশের পাশের এলাকার বাসিন্দা বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং আমরা সারা বছর ধরে যাদেরকে এখানে দেখি তারা সবাই বাংলাদেশের বাসিন্দা বা স্থানীয় বা আবাসিক পাখি। আমাদের পাখির প্রজাতির বেশির ভাগই স্থানীয়।
ঘুরে বেড়ানো পাখি:
স্থানীয়ভাবে ঘুরে বেড়ানো পাখি হচ্ছে ইংরেজি লোকালি মাইগ্রেটরি পাখি। এমন পাখি বাংলাদেশে কম। পাপিয়া বা পাইড ক্রিস্টেড কুকু এবং লালপাখা কোকিল বা রেড উইংগড ক্রিস্টেড ক্রিস্টেড কুকু এ পর্যায়ের পাখি। পাপিয়া গ্রীষ্মের শুরুতে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং বাচ্চারা পূর্ণতাপ্রাপ্তির সাথে সাথে বা আগেই এদেশ ছেড়ে উত্তরের পাহাড়ি এলাকা বা হিমালয়ের দিকে চলে যায়। লালপাখা কোকিল গ্রীষ্মকালে এদেশে আসে। এরা এখানে ডিম পাড়ে কিনা তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। শামুকখোর, মদনটাক এবং কাস্তেচরা পাখিও স্থানীয়ভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে উপরের কোকিল প্রজাতিদ্বয়কে গ্রীষ্মকালীন পাখি বা Summer visitor বলা যায়। ব্যাপক গবেষণা হলেই কেবল জানা যাবে কোকিল ছাড়া অন্য কোনো পাখি যেমন মোহনায় পাংচিলের কোনো দল, এদেশের গ্রীষ্মকালীন প্রজাতি কিনা। এসব প্রজাতি যদি এদেশে কেবল সংসার পাততে আসে তবে এদেরকে গ্রীষ্মকালীন প্রজননকারী বা Breeding Visitor বলা যেতে পারে। পাপিয়া ও লালপাখা কোকিল অবশ্য এ দলে পড়ে। শীতের পাখি: বাংলাদেশে শীতকালে এমন কিছু পাখি দেখা যায় যা সচরাচর অন্য সময়ে দেখা যায় না। এমন পাখি শীতকালে বাজারে বিক্রি হয় এবং বন্দুকধারী শিকারিরা শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে সরকারি যানবাহনের জ্বালানি পুড়িয়ে দেশের চরাঞ্চল এবং হাওড়ে গিয়ে মারে। সে থেকেই এসব পাখির নাম হয়েছে শীতের পাখি। শীত মৌসুমে হিমালয় পর্বতমালা এবং সুদূর সাইবেরিয়া থেকে, কদাচ উত্তর মেরু থেকেও কিছু পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছরই আসে এবং আবার ফিরে যায়। এই সংবার্ষিক আসা-যাওয়াই হচ্ছে পাখির পরিব্রজন, অভিপ্রায়ন বা মাইগ্রেশন। অভিপ্রায়ত পাখিকে আমরা বলি শীতের পাখি, অতিথি পাখি, পরিব্রাজক, যাযাবর প্রভৃতি।
চলার পথের পাখি:
ইংরেজি প্যাসেজ মাইগ্রান্ট বা বার্ডস ইন ট্রানজিট বলে একটি দলকে বলা হয়। এরা উত্তর মেরু, ইউরোপ ও হিমালয় অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় যায়। এই যাওয়া আসার পথে তারা আমাদের দেশে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে এবং মার্চ এপ্রিলে এরা এদেশের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় স্বল্পকালীন আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশে পাখির ইতিহাস দেশের অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার বা সরীসৃপের মত নয়। দেশে বিদ্যমান ৬ শত প্রজাতির বেশির ভাগই দেশের আদি বাসিন্দা নয়। দেশের বৃক্ষরাজির মতো পক্ষীকুলের অনেকেই বিদেশাগত। গত কয়েক হাজার বছর যাবত ক্রমাগত এরা এসেছে এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। তবে নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং এদের আদি নিবাস আমাদের জানা নেই। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, বনজঙ্গল ধ্বংস, খাল-বিল ভরাট, আবহাওয়া পরিবর্তন, খাদ্যাভাব ও আবাসস্থল হুমকির মধ্যে থাকায় পাখিদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
৮২ কাজী জাকের হোসেন- বার্ডস অব বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে কোনো কোনো প্রজাতির পাখিসহ বহু প্রজাতির জন্তু-জানোয়ার ইতিমধ্যে লুপ্ত হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে আরো লুপ্ত হবার সম্ভাবনা। এ বিষয়ে এদের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হবে আগামী পর্বে ।
আগামী পর্বেঃ- বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪১