আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪১
বাজ ঠোঁটো কাছিম, হক্সবিল টারটল (Eretmochelys imbricata): হক্সবিল কাছিমের মোটামুটি রঙ সবুজ ও বাদামিতে মিশানো থেকে কালো-বাদামী মিশানো হতে পারে। এদের কৃত্তিকাবর্মে মোট ৪টি করে ৮টি পাঁজরার শীল্ড আছে। কৃত্তিকাবর্মের সব শীল্ড একটি অন্যটির কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত, Imbricate, অন্যদের মতো কাছাকাছি নয়। তবে বাচ্ছা এবং বুড়োদের শীল্ড পাশাপাশি হতে পারে। এদের খাপড়া দুপাশ থেকে অপেক্ষাকৃত চাপা এবং পিছনদিকে খাঁজযুক্ত। তবে বুড়োদের খাঁজ নাও থাকতে পারে। বুড়াদের মেরু পাঁজরার শীল্ডের পিছনভাগ ক্ষয় হয়ে একটার উপর অন্যটা না উঠে, পাশাপাশি থাকতে পারে। বক্ষস্ত্রাণের শীল্ডগুলি হয় একদম হলুদ নয় কমলা-হলুদে মিশানো। চার জোড়া প্রান্তনিমড়বস্থ শীল্ড আছে। মাথা অপেক্ষাকৃত সরু, দু’পাশ সমান্তরাল এবং তুণ্ডগ্র ক্রমশ সরু হয়েছে। চোয়াল ঢেউতোলা ও খাঁজযুক্ত। তবে পাখির ঠোটের মতো বাঁকা নয়। ললাটের সামনে ৬ জোড়া আঁইশ আছে। ঘাড়ের শীল্ডের সাথে প্রথম শীল্ডের যোগাযোগ নেই। গলা অপেক্ষাকৃত লম্বা। মাথায় এবং সামনের পায়ের আঁইশগুলি খুবই স্পষ্ট। এগুলি হয় গাঢ় বাদামি অথবা কালো। এরা প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মিমি লম্বা এবং ওজনে ৫০ থেকে ৮০ কেজি হতে পারে;
বাজ-ঠোঁটো কাছিম আমিষভোজী। বাংলাদেশে এই প্রজাতি বিরল।
গোত্র: ডারমোকেলিডী (Family Dermochelydae) এবং প্রজাতি বৃহত্তম কাছিম লেদারব্যাক টারটল (Dermochelys coriacea) এক গোত্র, এক গণ এবং এক প্রজাতি এই গোত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কৃত্তিকাবর্ম খুব উঁচু উঁচু সরু সাতটি চূড়ায় যুক্ত অনেকটা টিনের ঢেউয়ের মতো। এদের উপরের চোয়াল সূচালো ডগাযুক্ত। এদের পায়ে কোনো নখর নেই। লেদারব্যাকদের নেই কোনো শীল্ড বা চামড়ার আঁইশ। কৃত্তিকাবর্ম সংকোচনশীল এবং বক্ষস্ত্রাণ অত্যন্ত নরম মনে হবে। এদের কৃত্তিকাবর্ম খুব সুন্দরভাবে মিশে গেছে মোটা এবং ভারী কাঁধ ও ঘাড়ের সাথে। মাথা ভীষণ ভারী, চোখ তির্যকভাবে অবস্থিত। নিচের চোয়ালের সংগমস্থান একটা বাঁকা আংটার মতো হয়েছে; উপরের চোয়ালের অগ্রভাগের দু’পাশের দুটি চূড়া এবং তার পাশে আছে দুটি গর্ত। এদের সম্মুখের পাখনা ফ্লিপার খুবই লম্বা।পিছনের ফ্লিপার চামড়া দিয়ে লেজের সাথে সেঁটে থাকে। এ কাছিম পূর্বাপর কালো রঙের হলেও এদের সর্বত্র সাদা চিতি থাকতে পারে।
পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন্ত কাছিম প্রজাতি হচ্ছে লেদারব্যাক। এরা গড়ে ১৩৫০ থেকে ১৫০০ মিমি লম্বা এবং সর্বোচ্চ ৬০০ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে বলে প্রেচার্ডের ধারণা। বাংলাদেশে এ প্রজাতি সংগৃহীত না থাকায় এ ব্যাপারে তথ্য প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। বৃহদাকার লেদারব্যাকদের একটির মাথা থেকে অন্যটির মাথা পর্যন্ত সামনের ফ্লিপারের দৈর্ঘ্য ২৭০০মিমি বা নয় ফুট। সমুদ্রকূলে হেঁটে গেলে বালুর উপর ১৮০০ মিমি থেকে প্রায় ২০০০ মিমি পাশযুক্ত দাগ পড়ে। এরা মূলত জেলি ফিশ জাতীয় ও সিলিনটারেট জাতীয় প্রাণী এবং ইউরোকরডেট খায়; অর্থাৎ এরা মাংসাশী। লেদারব্যাক বাংলাদেশে অল্পবিস্তর পাওয়া যায়। টিকটিকি-গিরগিটি: টিকটিকি, গিরগিটি বা রক্ত চোষা ও তকখক, আঞ্জন বা আঁচিলা এবং গুই সাপ বা গুইল সরীসৃপ শ্রেণীর স্কয়ামাটা বর্গের উপবর্গ লেসারটিলিয়ার অর্ন্তগত। টিকটিকি এবং তক্ষক মানুষের ঘরদোরে এবং ঘরের বাইরের গাছ-গাছালি ও বন-বাদাড়ে পাওয়া যায়। বাকিদের ঘরের বাইরে বাগানে, আর্দ্র এলাকায়, জলজমা জমিতে, বন-বাদাড়ে এবং সমুদ্রসৈকতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে লেসারটিলিয়ানদের চারটি গোত্র আছে: গেকেকোনিডী (Gekkonidae) এগামিডী (Agamidae) সিনসিডী (Scincidae) এবং ভেরানিডী (Varanidae) প্রথম গোত্রে আছে টিকটিকি ও তক্ষক, দ্বিতীয়টিতে উড়ন্ত টিকটিকি এবং গিরগিটি, তৃতীয়টিতে আঞ্জন বা আঁচিলা এবং চর্তুটিতে গুইসাপ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ২০ প্রজাতির লেসারটিলিয়ান আছে। বাংলাদেশে যেসব প্রজাতি পাওয়া যেতে পারে সেগুলি হচ্ছে: গেক্কোনিডী গোত্রে খসখসে টিকটিকি, হাউস লিজার্ড Hemidactylus brooki; মসৃণ টিকটিকি, কমন হাউস, সিজার্ড, ঐ. H. frenatus, গোদা টিকটিকি, হাউস লিজার্ড H.
flaviviridis এবং ছোট টিকটিকি, হাউজ লিজার্ড H. bowringi ; তক্ষক, Gekko gecko তক্ষক বা ওয়াল লিজার্ড। এগামিডী গোত্রে আছে Draco maculatus নতুন নাম Blanfordil উড়ন্ত টিকটিকি বা ফ্লাইং লিজার্ড, Calotes versicolor, রক্ষচোষা বা গার্ডেন লিজার্ড, সবুজ গিরগিটি, গার্ডেন লিজার্ড C. jerdoni এবং গিরগিটি C. emma । সিনসিডী গোত্রে আছে আঞ্জন স্কিংক Mabuya dissimilis, M. macularia I M. carinata । লাইগোসোমা Lygosoma maculatum ছোট আঞ্জন, Leiolopisma sikkimense এবং সরু আঞ্জন Riopa punctatus এবং R. vosmaeri । ভেরানিডী গোত্রে আছে ধূসর গুঁইসাপ, বেঙ্গল লিজার্ড Varanus bengalensis; সোনা বা হলদে গুই, ইয়েলো বা কমন লিজার্ড V. flavescens ও বড়গুই বা রামগদি, রিং বা মনিটর লিজার্ড V. salvator.
সাপ: উপবর্গ; স্কোয়ামাটা (Suborder: Squamata)
বাংলাদেশের মানুষ যে দলের প্রাণীকে সবচেয়ে ঘৃণা করে, ভয়ের চোখে দেখে এবং দেখামাত্র মারাকে ধর্মীয় অনুশাসন বলে জানেÑ সে হলো সাপ। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় সাপের প্রাচুর্য, সাপের দাপট, সাপের ভয়-ভীতি প্রত্যেক মানুষের চেতনায় সর্বাবস্থায় বিদ্যমান আছে। ভয়-ভীতির জন্য সাপকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাপের পূজা (মনাস দেবীর) এদেশে আজো প্রচলিত আছে। সাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য একটি সম্প্রদায়ই দেশে গড়ে উঠেছে যারা সাপুড়ে নামে পরিচিত। আনন্দ-বিনোদনের জন্য সাপের খেলা এদেশে বহু প্রাচীনকাল ধরে চলে আসছে। সাপ নিয়ে রচিত হয়েছে বহু কালজয়ী লোক-কাহিনী, নৃত্য-সঙ্গীত, লোকাচার ও ধর্ম। এমনকি সাপকে আকৃষ্ট করার জন্য তৈরি হয়েছে বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও রাগ-রাগিনী। এদেশের লোকগাঁথা বেহুলা লক্ষিন্দরের কাহিনী বাংলার সর্বত্র বহু প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত। এতেই বোঝা যায় বাংলাদেশে সাপের প্রাধান্য কত বেশি। বাংলাদেশে অবিষধর সাপের প্রজাতির সংখ্যা ৫২ এবং বিষধর সাপের সংখ্যা ২৭; অবিষধর সাপ: দুমুখো সাপ, ,ব্লাইন্ড স্নেক, গোত্র: টিফলোপিডি (Typhloopidae) বাংলাদেশে আছে তিন প্রজাতি;
সাধারণত দুটি দেখা যায়; তৃতীয়টি (Tkyphlops diiartdii) বিরল। ৮১
দুমুখো সাপ (Tyhplops porrectus) এবং (Ramphotyphlops briaminus):
অজগর, গোত্র: বয়িডী (Boidae): অজগর গোত্রের তিনটি প্রজাতি বাংলাদেশে আছে;
গোলবাহার, রিগাল, বা রেটিকুটেড পাইথন (Python reticulatus): পৃথিবীর দীর্ঘতম সাপ হচ্ছে গোলবাহার, লম্বায় ৯ মিটারের কিছু উপরে (৩২ ফুট পর্যন্ত রেকর্ড করা আছে)।
শামুকখোর ঘরগিন্নী; গোত্র: ডিপসাডিডী (Dipsadidae) নির্বীষ:
উদয়কল বা কুক্রী সাপ: কুক্রী সাপের ৭টি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যেতে পারে; কুক্রী সাপ ক্যানটরস্ কুক্রী স্নেক (Oligodon cyclurus):
বলয়যুক্ত কুক্রী সাপ, ব্যাণ্ডেড কুক্রী বা কমন কুক্রী (Oligodon arnensis):
কালোমাথা সাপ, উপগোত্র সিবাইনোফিনি (Sibynophinae):
নাট্টিসিডী গোত্র (Natricidae): বিভিন্ন ধরনের ঢোঁড়া সাপ এই গোত্রের অন্তর্গত। মোট ছয়টি প্রজাতি আমাদের দেশে আছে। রেতি বা আঁচিল সাপ, ফাইল/ওয়াট স্নেক (Acrohordus granulatus): গোত্র-ক্রোরকরডিডী (Acrochordidae):
গোত্র কলুব্রিডী (Colubridae): এ গোত্রের পরিতিচিতি প্রজাতি হচ্ছে দুধরাজ, কালনাগিনী এবং লাউডগা; মোট ১২টি প্রজাতির কলুব্রিড বাংলাদেশে পাওয়া যেতে পারে; গোত্র হোমালোপসিডী (Oligodon cyclurus): এই গোত্রের মধ্যে পরিচিত হচ্ছে ফণিমনসা, পাইনা ঢোঁড়া, জলঢোঁড়া এবং ডিমখোর সাপ। এর অন্তর্গত ৩টি উপগোত্র এবং ১৩টি প্রজাতি আছে; সুন্দরী সাপ বা হোয়াইট বেলিড ম্যানগ্রোভ সেড়বক আমাদের সুন্দরবন এলাকায় আছে। সংখ্যায় অল্প বিধায় চোখে পড়ে না।
বিষধর সাপ:
সবুজ বোরা সাপ (পিটভাইপার) নামে আরো পাঁচ প্রজাতির বিষধর সাপ সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘন বনে এবং চা বাগান ও পাহাড়ি অঞ্চলের বাঁশের ঝাড়ে এবং স্যাঁতস্যাঁতে বাগানে, ঝর্ণার ধারে পাওয়া যায়; ইলাপিনী উপবর্গে এদেশী প্রজাতি: ওয়ালের কেউটে বা ওয়ালস ক্রেইট (Bungarus sindanus walli ধিষষর) ছোট কালো কেউটে বা লেসার ব্লাক ক্রেইট (B. lividus) কালো কেউটে বা ব্লাক ক্রেইট (B. niger), কাল কেউটে বা কমন ক্রেইট (B. Caeruleus), শাকিনী বা বান্ডেড ক্রেইট (B. fasciatus) সরু প্রবাল সাপ বা স্লেনডার কোরাল স্নেক (Calliophis melanurus) গোখরা বা কোবরা (Naja naja) এবং শঙ্খচূড় বা কিং কোবরা (Ophiophagus hannah);
সামুদ্রিক সাপ: বাংলাদেশের সকল সামুদ্রিক বিষধর সাপ উপগোত্র হাইড্রোফিনীর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর সব সাপের মধ্যে সামুদ্রিক সাপদের বিষ সবচেয়ে শক্তিশালী। এদের বিষ গোখরার চেয়ে ৪ থেকে ৮ গুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন। বাংলাদেশে যে ১২ প্রজাতি, Das (১৯৯৪) এর মতে ১৩ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ আছে তার দুটি উভচর সাপ। এরা ডাঙ্গায় ডিম পাড়ে। বাকিরা বাচ্চা দেয়। এ পর্যন্ত মোট ৯টি প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। অনুকূল পরিবেশের জন্য এদেশে প্রচুর সাপের আবাসস্থল ছিলো। পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় গত কয়েশত বছরের মধ্যে কোনো কোনো প্রজাতির মাপ লুপ্ত হয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর বর্তমানেও দেশে যেসব প্রজাতির সাপ রয়ে গেছে তাও প্রতিকুল পরিবেশে ক্রমশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রাচীন সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি সাহিত্যে দেশের সাপের সম্পর্কে অনেক উল্লেখ আছে সাপ কিছু কিছু বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সেজন্যই এগুলি পুনঃউল্লেখ করা হলো না।
৮১ ইদানিং কিছু কিছু সাপের বৈজ্ঞানিক নামের পরিবর্তন হয়েছে।
আগামী পর্বে পাখি
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪০