আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩৩
ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলীতে শিলাকুণ্ড নামে একটি জলাশয়ের উলেখ আছে, শিলাকুণ্ড ও শিলা(ই)দহ একই নাম হতেও পারে; দুয়েরই অর্থ প্রায় এক; সতট-পদ্মাবতী বিষয়ের উলেখ হতে বুঝা যাচ্ছে যে, দশম-একাদশ শতকেই পদ্মা বা পদ্মাবতীর প্রবাহ ইদিলপুর-বিক্রমপুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং ঐদিক দিয়েই বোধহয় সাগরে প্রবাহিত হতো। কুমারতালক মণ্ডলের (যে মণ্ডল কুমার নদীর তল বা অববাহিকা, নদীর দুই ধারের নিন্মভূমি) উল্লেখ হতে অনুমান হয় কুমার নদীও তখন বর্তমান ছিল এবং পদ্মাবতীর সঙ্গে তার যোগও ছিল। সাতশ বছর পর রেনেলের নকশায় তা লক্ষ করা যায় এবং গড়াই-মধুমতী-শিলা(ই)দহ-বালেশ্বর যদি কুমারের সঙ্গে অভিন্ন না হয় তাহলে সে যোগ এখনও বর্তমান। কুমার নদী এখন মরণোন্মুখ।
মহানন্দা:
মহানন্দা উত্তর দিক হতে আগত গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রধান উপনদী। হিমালয়ের পাদদেশে দার্জিলিং-এর নিকটবর্তী মহালড্রীম পর্বত হতে মহানন্দার উৎপত্তি। ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটি পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পূর্ণিয়া ও মালদহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিকট বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মহানন্দাও অনেক প্রাচীনকালে ছিল পূর্ববাহিনী এবং করতোয়ার দিকে ছিল এর স্রোতধারা। মধ্যযুগের প্রারম্ভিককালেই মহানন্দা দক্ষিণ দিকে ঘুরে যায়। কুশী ও মহানন্দার গতিপথ পরিবর্তনের ফলেই গৌড়, লক্ষ্মণাবতী ও পাণ্ডুয়া অঞ্চল নিন্মজলাভূমিতে পরিণত। পরবর্তীকালে এগুলি হয় পরিত্যক্ত নগরী।৬৬
এখান থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে মহানসন্দা গোদাগাড়ির কাছে পদ্মায় পতিত হয়েছে। নাগর, টাংগন ও পুনর্ভবা এ নদীর উপনদী। টাংগন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও ও পীরগঞ্জ হয়ে দিনাজপুর জেলার বিরলের কাছে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। পরে এটি মহানন্দায় পতিত হয়। পুনর্ভবা (১৬০ কি.মি.) এই নদী দিনাজপুর জেলার মধ্য দিয়ে ৮০ কিমি এবং রাজশাহী জেলার মধ্য দিয়ে ৮০ কি.মি. প্রবাহিত। পুনর্ভবা নদীর উৎপত্তিস্থল দিনাজপুরের বিওলাইয়ের জেলা। এটি সর্পিল পথে দক্ষিণ দিকে প্রবহমান হয়ে করতোয়ার শাখা ডেপার সাথে মিলিত হওয়ার পর দিনাজপুর শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরাও-এর নিকট ভারতে প্রবেশ করেছে। পরে ফিরোজাবাদের কাছে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মহানন্দায় পতিত হয়েছে।
বড়ালঃ (১৪৭ কি.মি.)
বড়াল পদ্মা নদীর বাম তীরের (পুর্ব তীর) শাখানদী। এটি চরঘাটের নিকট উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে আটঘড়িয়ার নিকট দু’ভাগ হয়ে মূল স্রোত নন্দনকুজা নামে বহমান। এটি চানকোরের কাছে গুর নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এ মিলিত স্রোত গুমানি নামে পরিচিত। এ নদী চাটমোহরের কাছে আবার বড়াল নামে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে আত্রাই-করতোয়ার সাথে মিশেছে। এ মিলিত ধারা হুরাসাগর নামে পরিচিত যা যমুনায় গিয়ে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৪৭ কি.মি.।
ইছামতিঃ
ইছামতি পদ্মার আরেকটি শাখানদী। এটি পাবনা শহরের দক্ষিণে পদ্মা থেকে বের হয়ে পাবনা শহরকে দু’ভাগে ভাগ করে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বেড়া থানার পাশ দিয়ে হুরাসাগরে পড়েছে। বর্তমানে এ নদীর উজানে পাবনা শহরের নিকট আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে সচল ধারা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি এখন নিষ্কাশন খাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পদ্মা নদীর ডান তীরের (পশ্চিম পাড়ে) শাখানদীগুলো দেশের পশ্চিমাংশে গঙ্গা অববাহিকায় বদ্বীপীয় এলাকার শেষ প্রান্তে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। এ নদী হতে নির্গত ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, মধুমতি, ধলেশ্বরের ধারাসমূহ এবং এদের অসংখ্য শাখানদী যা সুন্দরবনের গরান জলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
ভৈরব (২৫০ কি.মি.)
ভৈরব নদী ভারতের মালদহ জেলার শ্রুতকীর্তি নদী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থানের বিপরীতে উৎপনড়ব হয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে জালঙ্গির সাথে মিলিত হয়। এ মিলিত ধারা কিছু পথ চলার পর ভাগ হয়ে মেহেরপুরের পশ্চিম পথ দিয়ে সুবলপুরের নিকট মাথাভাঙ্গায় পতিত হয়েছে। তারপর মিলিত ধারা পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে কোটচাঁদপুরের নিকট দক্ষিণমুখী হয়েছে। চলার পথে এ নদী বহু নদীর সাথে মিশেছে। এর উলেখযোগ্য অংশ হলো ইছামতি ও কপোতাক্ষ। ইছামতির কিছু অংশ বাংলাদেশে এবং কিছু অংশ ভারতে অবস্থিত- যার কিয়দংশ সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। এটির একাংশ কালিগঙ্গা নামে অভিহিত, যার কৈখালি পর্যন্ত নাম কালিন্দি। অতঃপর এটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পূর্বভাগ হাড়িভাঙ্গা এবং পশ্চিম ভাগ রাইমঙ্গল নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানা নির্ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
মাথাভাঙ্গা (১৫৬ কি.মি.)
মাথাভাঙ্গা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জালঙ্গিরের নিকট গঙ্গা হতে উৎপনড়ব হয়ে কুষ্টিয়ার ইনসাফনগরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে চুয়াডাঙ্গার নিকট পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। সেখানে চূর্ণ নদীর সাথে মিশে ভাগীরথীতে পড়েছে। চিত্রা, নবগঙ্গা ও কুমার মাথাভাঙ্গার শাখানদী। মাথাভাঙ্গার ক্ষীণ ধারা চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার মধ্যবর্তী নিন্মাঞ্চল হতে চিত্রার উৎপত্তি। দক্ষিণ-পূর্বক দিকে অগ্রসর হয়ে দর্শনার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গাজীরহাটে নবগঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। পরে এ মিলিত স্রোত খুলনার দৌলতপুরের নিকট ভৈরবে পড়েছে। বেগবতী এ নদীর একটি উপনদী। নবগঙ্গা চুয়াডাঙ্গা শহরের নিকট মাথাভাঙ্গা হতে উৎপন্ন হয়ে ঝিনাইদহ জেলা অতিক্রম করে মাগুরার নিকট কুমার নদীতে প্রবাহিত হয়ে মাগুরা জেলা সদরের নিকট নবগঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ বাঁধের ফলে উজানে এ নদীর মুখ বন্ধ থাকায় বর্তমানে এটির ধারা ক্ষীণপ্রায়।
গড়াই-মধুমতি-বালেশ্বর (৩৪১ কি.মি.)
গড়াই নদী কুষ্টিয়া জেলার তালবাড়ীয়ার নিকট পদ্মা থেকে উৎপন্ন। এটি কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ি ও মাগুরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাগুরা জেলার কচুয়া হতে মধুমতি নাম ধারণ করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে আঠাররাঁকিতে বাগেরহাট জেলায় প্রবেশ করে। অতঃপর বরিশাল জেলার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়ে হরিণঘাটার মোহনায় বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এ নদীর আরেক অংশ আঠারবাঁকি হতে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে কাটাখালের মাধ্যমে রূপসায় পতিত হয়। এটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে একভাগ চালনা বন্দরের নিকট হতে পশুর নাম নিয়ে এবং অন্যভাগ শিবসা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই নদী কুষ্টিয়ায় ৩৭, ফরিদপুরে ৭১, যশোহরে ৯২, খুলনায় ১০৪ এবং বরিশাল জেলায় ৩৭ কিমি প্রবাহিত হচ্ছে।
আড়িয়াল খাঁ (১৬০ কি.মি.)
আড়িয়াল খাঁ পদ্মা নদী হতে নির্গত সর্ব-দক্ষিণের শাখানদী। এ নদীর তিনটি উৎসমুখ পিঁয়াজখালি, হাজার খাল ও ডুবুলদিয়া। হাজার খালের উৎসমুখ অত্যন্ত ক্ষীণ ও শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায়। ডুবুলদিয়ার উৎসমুখ দিয়ে বর্ষায় প্রবল স্রোত প্রবাহিত হলেও শুকনোর সময় এটি ক্ষীণ হয়ে যায়। এর অপর উৎস পিঁয়াজখালি দিয়ে পদ্মার প্রধান স্রোত প্রবাহিত হয়। এ ধারাটি মাদারিপুরের নিকট সম্ভুকে ও অপর ধারা ডুবুলিয়ার সাথে মিলিত হয়ে মাদারিপুর এবং শরিয়তপুর জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বরিশাল জেলার মুলাদি থানার শফিপুরে মেঘনায় পতিত হয়েছে। অতঃপর তেতুলিয়া নাম ধারণ করে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। আড়িয়াল খাঁর এক শাখা সায়েস্তাবাদের নিকট পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে মেঘনার ধারা শাহবাজপুরে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। অপর শাখা কীর্তনখোলা নামে বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে নলছিটি পর্যন্ত এ নামে প্রবহমান। পরে এ নদীর প্রবাহ বিভিন্ন নামে হরিণঘাটায় বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এছাড়া আড়িয়ালখাঁ নদী হতে উৎপন্ন হয়ে বুড়িশ্বর ও আধারমানিক নদী পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। আড়িয়াল খাঁ ফরিদপুরের ভিতর দিয়ে ১০২ কিমি এবং বরিশাল জেলার ভিতর দিয়ে ৫৮ কিমি প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমাঃ
দেশের উত্তর-পূর্বাংশে সুরমা-মেঘনা নদীর ধারা ভারতের শিলং মালভূমি, ত্রিপুরা ও মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চল হতে আগত পাহাড়িয়া নদীসমূহ ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিস্তীর্ণ হাওড়-বাওড় অঞ্চলের জলপ্রবাহকে বহন করে। চাঁদপুরের নিকট এ জলধারা পদ্মা-যমুনা নদী ধারার পানি গ্রহণ করে এবং মিলিতভাবে এ বিশাল জলরাশিকে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত করে। সুরমা নদীর মূলধারা বরাক নামে ভারতের মণিপুরের উত্তরে পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণ ঢালে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘুরে কাছাড় জেলার বদরপুরের নিকট সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ দু’ধারা দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে সুনামগঞ্জ জেলার মারকুলিতে মিলিত হয়। সুরমা নদী শিলং মালভূমি ও মেঘালয়ের খাসিয়া জয়ন্তিয়া ও গারো পাহাড় হতে আগত বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি গ্রহণ করে। পূর্বদিক থেকে আগত নদীগুলো হলো লুবা, হারি, গোআইন গাং, ধলাই, বেগপানি,যাদুকাটা, গুনাই, সোমেশ্বরী, কংস ও আরো অনেক ছোট ছোট স্রোতস্বিনী। কংস নদী মোহনগঞ্জের নিকট এসে দু’ভাগে ভাগ হয়েছে দক্ষিণ ধারায় মগরা এসে মিলিত হয়। পশ্চিম শাখার উপরের অংশ মগরা, মধ্যম অংশ বৌলাই এবং নিন্মাংশ ঘোড়াউত্রা নামে পরিচিত। এ ধারা পুনরায় কুলিয়ারচরের নিকট সুরমায় পড়েছে। ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকা হতে আগত মনু নদী মৌলভীবাজারের নিকট কুশিয়ারায় পতিত হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর দু’ভাগে ভাগ হয়। উত্তর শাখার নাম বিবিয়ানা, আর দক্ষিণের শাখা বরাক নামে প্রবাহিত হয়ে ভাটিতে কালনি নাম ধারণ করে আজমিরিগঞ্জের নিকট সুরমায় পতিত হয়েছে। মেঘনা নদী হতে নির্গত কয়েকটি শাখানদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়ে ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় হতে উৎপন্ন কয়েকটি উপনদীর জলধারা বহন করে পুনরায় মেঘনায় পতিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিতাস প্রধান শাখানদী। পাহাড়ি উপনদীগুলোর মধ্যে রয়েছে গোমতি, হাওয়া, কাগনি, সোনাবুড়ি, বুড়িমঙ্গল, কাকড়ি, ধানজুড়ি, জাঙ্গালিয়া ও ডাকাতিয়া। ডাকাতিয়া চাঁদপুরে মেঘনায় পতিত হয়েছে।
৬৬ সুশীলা মণ্ডল: বঙ্গদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ)
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩২