ঢাকার বাইরে থাকার কারনে তেমন একটা ট্রিপ করা হয়ে ওঠে না “ভ্রমণ বাংলাদেশ”এর আয়োজনে নানা ট্রিপের ছবি দেখে আর বণর্না পড়ে আফসোসও হয় । নাফাখুম যাবার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু হরতালের কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর বসে থাকি পরবর্তী ইভেন্টের দিকে । সময় ও সুযোগ হয় হামহাম ইভেন্টে জয়েন করার ।
ইভেন্ট দেখে মনা ভাইকে ফোন দিয়ে যাবার ব্যাপারটা ফাইনাল করি। সব সময় চোখ রাখি ফেসবুকের ইভেন্টের দিকে । সময় ঘনিয়ে আসে, প্রস্তুতিও শেষ হয়। সকাল ৭টায় শরিয়তপুর থেকে ঢাকা আসি বাসে। এরপর ”ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর অফিসে আড্ডা শেষ করে চলে যাই বাস স্ট্যান্ডে। নতুন কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয় । খুবই বন্ধুবৎসল তারা। দেখে বোঝার উপায় নেই আমি নতুন। রাত সাড়ে এগারোটার বাসে আমরা ২০জন রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দ্যেশে । পথে উজান-ভাটি রেস্টুরেন্টে বিরতিতে এককাপ চা শরীরটাকে চাঙ্গা করে তোলে। ভোর ৪টা শ্রীমঙ্গল পৌছাই ।
একটা হোটেলে চারটা রুম নিয়ে ফ্রেশ হই সবাই । গল্প করতে করতে দিনের আলো ফুটে ওঠে । সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি রাজকান্দির লুকানো বনে। পথে ছোঁয়া পাই লাউয়াছড়া বনের। পাহাড়ি আকাঁবাকা পথ সাথে চা-বাগান মনটাকে ভরিয়ে তুলেছিল আনাবিল আনন্দে। জীবনের প্রথম চা-বাগান দেখার আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করার মত না ।
পাঁচটা অটোরিকসাতে করে সকাল ৮টায় রওনা দিয়ে ১০টা নাগাদ পৌছাই কলাবন পাড়াতে । এরপর শুরু হয় রাজকান্দি রির্জাভ ফরেস্টে হাঁটা । দল সবার প্রথমে ছিলাম, প্রায় দেড় ঘন্টায় পৌছাই অপরুপ হামহাম ঝর্নাতে । হাম হাম কিংবা হামহাম বা চিতা ঝর্ণা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝরণা। চিৎকার করে উঠি ঝর্নাটাকে দেখে। যেমনটি ভেবেছিলাম তার চাইতেও অপরুপ। তেমন লোকজন না থাকায় আনন্দ উপভোগের মাত্রাটা বেড়ে যায়। ঝর্নাতে প্রায় ৩ ঘন্টার মত গোসল করি ।
নাহিয়ান ভাই বিদেশীদের পেয়ে খুশি তাদের সাথে ছবি তুললেন তিনি । এক জার্মান পযটককে নিয়ে গ্রুপের সবাই ছবি তুললাম । বললাম “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর ক্লাবের কথা শুনে খুশি হলেন তিনি । বললেন ভবিষতে সম্ভব হলে আমাদের সাথে যোগ দিবে কোন ইভেন্টে।
ঝর্না উপরে উঠি দলনেতা তাহসিন ভাই আসার আগে। তিনি পিছিয়ে পড়াদেরকে উৎসাহ দিয়ে নিয়ে আসছিলেন। দলের নামি-দামি খাদকের সমাহার । বিশাল ভুড়িওয়ালা হাসান ভাই, পলাশ ভাই, সদ্য বিবাহিত ভুড়িয়াল রুমি ভাইদের জন্য কষ্টকর ছিল দিনটি ।
পথে বৃস্টি পাইনি । ঝকঝকে রোদ পুরো পথে কষ্ট দিয়েছে । বৃষ্টি না থাকায় ঝর্নার উপরের অংশটা দেখেছি । বৃষ্টি থাকলে যেটা সম্ভব হত না । একে একে দলের সবাই চলে আসলো ঝর্নার নিচে । গোসল করলো মন ভরে । ছবি তোলা হল । দল থেকে দেয়া শুকনো খাবার খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম ।
এবার ফেরার পালা । আসার সময় তেমন বেশি না হলেও ফেরার সময় সবাই টের পেল অনেককেই জোঁকে ধরেছে । আমাকে মাত্র একটা জোঁক ধরে ছিল । মিতা আপুকে একটা বড় আকারের টাইগার জোঁক ধরতে যাচ্ছিল । আমি পেছন থেকে দেখে সেটা ফেলে দিয়েছিলাম বলে তিনি বেঁচে গেলেন সে যাত্রায় ।
পলাশ ভাই, নাহিয়ান ভাই সহ আরো কয়েকজনকে ধরেছিল জোঁক । কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি । শ্রীমঙ্গল ফিরে হোটেলে ফ্রেশ হতে যেয়ে তারা টের পায় তারা জোঁক আক্রান্ত । দুপুর তিনটায় ফেরা শুরু করি বিকল্প পথে । যাবার পথটি ছিল টিলা দিয়ে আর ফেরার পথে ঝিরি আর টিলার সমন্বয়ে। অটোরিকসাতে করে আবার যাত্রা শুরু হল শ্রীমঙ্গলের দিকে । সন্ধ্যাটা নেমে গেলে হুট করে । গা ছমছম করা রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম । ভয় হচ্ছিল কোন প্রানী না এসে পড়ে পথে ।
রাত সাড়ে ৮টায় পৌছালাম শ্রীমঙ্গলে । ফ্রেশ হয়ে চমৎকার রেস্টুরেন্ট কুটুমবাড়িতে খেলাম । মনা ভাই ঢাকা থেকে বলে রেখেছিল । তাই তারা গরম গরম খাবার পরিবেশন করলেন আমাদের জন্য । আড্ডাটা রেস্টুরেন্টে জমালাম রাত প্রায় ১২টা পযন্ত। এরপর চলে গেলাম বাস কাউন্টারে। রাত ১টায় বাস ছাড়লো ঢাকার উদ্দ্যেশে। আনন্দ আর মজার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম ।
পর্যটকরা অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দেবার জন্য খাবার এবং প্লাস্টিকের পানীর বোতল সঙ্গে করে নিয়ে থাকেন এবং খাবারকে পানির স্পর্শ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায়ই পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটকরা প্রায়ই সেসব ব্যবহৃত জিনিস বহন করে আবার নিয়ে আসতে আগ্রহ দেখান না এবং যত্রতত্র ফেলে নোংরা করেন ঝর্নার নিকট-অঞ্চল। যা ঝরণা এমনকি জঙ্গলের সৌন্দর্য্যহানির পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর।
তাই পর্যটকদেরকে পঁচনশীল বর্জ্য পুতে ফেলা এবং অপচনশীল বর্জ্য সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিংবা পুড়িয়ে ফেলা উচিত ।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকার গাবতলী, ফকিরেরপুল, সায়েদাবাদ থেকে সকাল হতে রাত ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের বাস যায় কমলগঞ্জ পর্যন্ত। এছাড়াও ট্রেনেও যেতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেটের ট্রেন ধরতে হবে। পথে শ্রীমঙ্গলে নেমে যেতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে মাইক্রোবাসও ভাড়া নিতে পারেন। ট্রেনে গেলে খরচ কিছুটা কম হবে, আর বাস কিংবা মাইক্রোতে গেলে ভাড়া একটু বেশি পড়বে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি দুপুরে রওনা হয়ে সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখানে রাত কাটিয়ে হামহাম গেলে। এখানে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা থেকে নিচে ২৫০ টাকা পর্যন্ত হোটেল পাবেন। এছাড়া সড়ক ও জনপদ বিভাগ ও চা বাগানগুলোর প্রত্যেকেরই রেস্ট হাউজ আছে, একটু আগে থেকে কথা বলে এসব জায়গায় থাকতে পারলে ভ্রমণটা আরামদায়ক হবে। যাত্রাপথে উপজেলা সদর থেকে কুরমা সীমান্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পাকাই পাবেন। তবে এরপরের অংশের প্রায় পুরো রাস্তাই কাঁচা। এখানেই শেষ নয়, কলাবাগান নামের পাহাড়ি আদিবাসী এলাকা পেরিয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পাহাড়ের উঁচু নিচু প্রায় ৫ ঘন্টার পথ হাঁটার পথ দেখা পাওয়া যাবে হামহামের। শ্রীমঙ্গলে রাত কাটিয়ে খুব সকাল অর্থাৎ ৬ টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়তে হবে হামহাম এর উদ্দেশ্যে। কারন আপনাকে দিনে দিনেই ফিরে আসতে হবে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়ায় অনেক অটোরিকসা পাবেন। সেক্ষেত্রে হোটেল থেকেই অটোরিকসাঠিক করে নিতে পারেন। আসা-যাওয়ার ভাড়া পড়বে ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:২৬