কিছুদিন আগে সিমেট্রি ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একদল কণা পদার্থবিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো পদার্থবিজ্ঞানের পাঁচটি উন্মুক্ত প্রশ্ন চিহ্নিত করতে যার উত্তর তাদের কাছে নেই এবং যার উত্তর তারা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আসুন দেখি সেই পাঁচটি প্রশ্ন কী যার সঠিক উত্তর আপনি এখন কোন পদার্থবিদের কাছেই পাবেন না। এই নিয়ে লিখেছেন বিখ্যাত সাময়িকী সায়ন্টিফিক আমেরিকানের সহযোগী সম্পাদক ক্লামরাম মসকোইজ।
প্রশ্ন ১- আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী?
আমাদের মহাবিশ্বের শেষ কোথায় এবং কীভাবে এই প্রশ্নটির উত্তর বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু এর সঠিক উত্তর এখনও অজানা আর এ ব্যাপারে যেই তত্ত্বগুলো উপস্থাপন করা হয় সেগুলো নিছক প্রকল্প (Hypothesis) ছাড়া আর কিছু না। এই সমীক্ষাতে প্রশ্নটি উত্থাপন করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভ উইম্পেন। এই প্রশ্নের উত্তর কেন দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা আমরা এখন এটা বোঝার চেষ্টা করি। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা জরুরি তা হলো ডার্ক এনার্জি।
ডার্ক এনার্জি পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে একটা বড় রহস্য। আমাদের গাঠনিক দিক বিবেচনা করলে মহাবিশ্বের ৭২.১ ভাগ ই ডার্ক এনার্জি, ২৩.৩ ভাগ ডার্ক ম্যাটার আর বাকি ৪.৬ ভাগ হল আমাদের চিরচেনা পদার্থের জগৎ। ডার্ক এনার্জি নিয়ে বলতে গেলে আমরা তেমন কিছুই জানিনা। এটা অনেকটা সমুদ্রে থেকে পানি না চেনার অবস্থা। ডার্ক এনার্জি আসলে কী এটার সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না। হতে পারে এটা সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের শক্তি, হতে পারে স্থানের (Space) এর কোন বৈশিষ্ট্য, এমনও হতে পারে এটা নতুন ধরনের কোন পদার্থ। ডার্ক এনার্জি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলো নিয়ে পরে অন্য কোন প্রবন্ধে আলোচনা করব, এখন আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এর ভুমিকা কোথায় সেটা দেখা যাক। আইনস্টাইন মনে প্রাণে মনে করতেন মহাবিশ্ব প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হচ্ছেনা, এটা স্থির। কিন্তু ১৯২০ সালে এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণ করে দেখেন গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এটা তার প্রথম প্রমাণ। এখন আমরা যা জানি তা হচ্ছে মহাবিশ্ব যে শুধু সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই না এই সম্প্রসারনের বেগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে, এখন প্রশ্ন হল কেন এমনটা হচ্ছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই প্রথম ডার্ক এনার্জি তত্ত্বের সূত্রপাত হয়। এটা এমন একটা অজানা অস্তিত্ব যা কিনা মহাবিশ্বের ভরের কারণে সৃষ্ট মহাকর্ষ বলের বিপরীতে কাজ করে মহাবিশ্বকে প্রসারিত করছে। এখন ডার্ক এনার্জির প্রভাবে আমাদের মহাবিশ্বের তিন ধরনের পরিণতি আশঙ্কা করা যায়। প্রথমত যদি ডার্ক এনার্জির এখনকার পরিমাণ স্থির থাকে তাহলে মহাবিশ্ব ক্রমবর্ধমান বেগে সম্প্রসারিত হতে থাকবে, গ্যালাক্সিগুলো একটি অপরটি থেকে অনেক দূরে সরে যাবে আর সৃষ্টি হবে বিশাল শূন্যতা। মহাবিশ্বের সার্বিক তাপমাত্রা কমে এক শীতল পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাকে বলা হয় Big freeze (এইচ.এস.সি তে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অধ্যায়ে মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যুর যে কথাটি লেখা রয়েছে এটা মূলত Big Freeze ই। এ সময় ব্যবহারযোগ্য তাপশক্তির পরিমাণ শূন্য হয়ে যাবে অর্থাৎ মহাবিশ্বের এনট্রপি তখন হবে সর্বোচ্চ। এনট্রপির সংজ্ঞাটাও এখানে বলে দিই, যারা এনট্রপির ব্যাপারটি বোঝেন না তাদের জন্যে হয়তো এটা কাজে আসবে, এনট্রপি হলো কোন সিস্টেমের সেই অভ্যন্তরীণ তাপশক্তি যা কখনো ব্যবহার করা যায় না।) যদি ডার্ক এনার্জির পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে এই শক্তির প্রকটতায় গ্যালাক্সিগুলো ভেতর থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে - একে বলা হয় Big Rip. আর যদি এই পরিমাণ একটা সময় এসে কমে যায় তাহলে অভ্যন্তরীণ মহাকর্ষের প্রভাবে মহাবিশ্বের সামগ্রিক কাঠামো এর মধ্যেই ধসে পড়বে, একে বলা হয় Big Crunch. এখন এই তিনটি সম্ভাব্যতার কোনটি ঘটবে আর আদৌ এদের মধ্যে কোনটি হবে নাকি সম্পূর্ণ অন্য কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার কিছুই আমরা এখনও জানিনা। ডার্ক এনার্জি নিয়ে আমরা যত জানব এই ব্যাপারটিও তত পরিষ্কার হবে। এর জন্যে এতটা তাড়া ও নেই কার ও কারণ মহাবিশ্বের এই পরিণতি ঘটতে বাকি আরও বিলিয়ন ট্রিলিয়ন বছর।
প্রশ্ন ২- হিগস বোসন কণা, এরা আসলে কী করে?
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড রুইজ এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। হিগস বোসন কণা মূলত কণার ভর সৃষ্টির জন্যে দায়ী। যে কণা হিগস বোসন এর সাথে যত বেশি ক্রিয়া করে তার ভর তত বেশি হয়। এ বছরের ১৪ মার্চ LHC তে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অস্তিত্ব প্রমাণ হবার সাথেই হিগস বোসন নিয়ে আরও অনেক প্রশ্নেরও জন্ম হয়।
এই কণার ধর্ম বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব বেশি কিছু জানেন না। আর এটা পদার্থবিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত প্রথম শূন্য স্পিন বিশিষ্ট মৌলিক কণা। আমরা এটা জানি এই কণা অন্য কণাদের ভর সৃষ্টি করে কিন্তু কেন এরা বিভিন্ন কণার সাথে বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করে তা আমরা জানি না, এদের সৃষ্টি নিয়েও আমাদের ধারণা খুবই অল্প। কণা পদার্থবিজ্ঞানে এটি একটি মৌলিক আবিষ্কার আর এই নতুন ক্ষেত্রে আমাদের জানার আছে এখনও অনেক কিছু।
প্রশ্ন ৩-মহাবিশ্বে কেন প্রাণ ধারণ করার মত ভারসাম্য বিদ্যমান?
এই প্রশ্নটি করেছিলেন ফার্মি ল্যাবের Erik Ramberg। এটা বলতে গেলে ধর্মবিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মাঝামাঝি একটা প্রশ্ন। এটা বলাই যায় মহাবিশ্ব তার বিবর্তনে অনেক ধাপ পার হয়ে এসেছে, হচ্ছে। সম্ভাব্যতার বিচারে এই বিবর্তন অনেক দিকেই মোড় নিতে পারত, আর তা হলে মহাবিশ্ব হত সম্পূর্ণ অন্যরকম, হয়তো সেখানে থাকত না কোনো ছায়াপথ, কোনো নক্ষত্র, কোনো প্রাণ! যদি পদার্থ আর প্রতিপদার্থের যুদ্ধে প্রতিপদার্থ টিকে যেত তাহলে হয়তো সব কিছুই হতো অন্যরকম। ডার্ক এনার্জির কথা আমরা পড়লাম, মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে যদি ডার্ক এনার্জির পরিমাণ যা ছিল তার চেয়ে বেশি থাকতো তাহলে মহাবিশ্ব তখনই এত বেশি বেগে প্রসারিত হতো, তাতে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টির সাথে সাথেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত। আর যদি ডার্ক এনার্জির পরিমাণ সামান্যটুকুও কম হতো তাহলে মহাকর্ষের প্রভাবে সাথে সাথেই মহাবিশ্বের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ত। ডার্ক এনার্জির পরিমাণ মহাবিশ্ব সবচেয়ে সুন্দরভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদান, প্রতিটি শক্তি, প্রতিটি কণা ঠিক সেভাবেই ভারসাম্যে আছে যাতে আমরা টিকে থাকতে পারি। কিন্তু কেন এই ভারসাম্য? এটার উত্তর বিজ্ঞানীদের এখনও অজানা।
প্রশ্ন ৪- Astrophysical Neutrino –র উৎপত্তি কোথায়?
অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন নিউট্রিনোগুলো উচ্চ গতি সম্পন্ন আয়নিত মহাজাগতিক রশ্মির (Cosmic Ray) সাথে আলোর ফোটন এর সংঘর্ষে উৎপন্ন হয় বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এই উচ্চ গতি সম্পন্ন মহাজাগতিক রশ্মির উৎপত্তি ঠিক কোথায় আর এদের এই প্রচুর শক্তির উৎস কী তা নিয়ে অনেক তত্ত্ব (Hypothesis) থাকলেও তার কোন প্রমাণ কেউ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেন নি।
এর মধ্যে একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধারণা হলো ব্ল্যাকহোল এ দ্রুত গতিতে পতিত পদার্থ থেকেই এই মহাজাগতিক রশ্মির সৃষ্টি। কিন্তু এই তত্ত্বের সত্যতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। মহাজাগতিক রশ্মি আর ফোটনের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট এই নিউট্রিনোগুলো এতটাই শক্তিশালী হয় যে কখনো কখনো একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নিউট্রিনো একটি উচ্চ গতিসম্পন্ন বেসবল এর সমপরিমাণ শক্তি ধারণ করতে পারে! শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাভিল ইন্সটিটিউট ফর কসমোলজিক্যাল ফিজিক্সের গবেষক Abigail Vieregg ছিলেন এই প্রশ্নটির উত্থাপক। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও জানি না এরা কোত্থেকে আসে আর কীভাবেই বা আসে। যদি আমরা এর উৎস শনাক্ত করতে পারি তাহলে আমরা এই উৎসগুলো কীভাবে এই কণাগুলোকে এত উচ্চ শক্তিতে উন্নীত করে সে ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পারব’।
প্রশ্ন ৫ –মহাবিশ্ব কেন পদার্থ দিয়ে গঠিত, প্রতি পদার্থ দিয়ে কেন নয়?
প্রতিপদার্থ ( Antimatter ) হলো পদার্থেরই একটি রুপ যার সব ধর্মই পদার্থের সাথে মিলে শুধু একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া, সেটি হল তাদের চার্জ তথা আধান। এদের আধান পরস্পরেরর বিপরীত। ধারণা করা হয় মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় সমান পরিমাণ পদার্থ আর প্রতি পদার্থ ছিল। এই সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে বিপরীতমুখী চার্জের জন্যে পদার্থ আর প্রতি পদার্থ পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শক্তিতে রুপান্তরিত হতে থাকে, কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে এই যুদ্ধে পদার্থ জিতে যায় আর এই সংঘর্ষের পর বেঁচে যাওয়া পদার্থ থেকেই পরে আমাদের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় নক্ষত্র, ছায়াপথ, সৃষ্টি হই আমরা। পদার্থ আর প্রতিপদার্থের এই প্রাথমিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকেই ঠিক হয়ে যায় আমাদের মহাবিশ্বের গতিপথ। আর তার স্বরূপই আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন। কিন্তু তারপর ও প্রশ্ন থেকে যায়, সমান পরিমাণ পদার্থ প্রতিপদার্থের সংঘর্ষে কীভাবে কিছু পদার্থ অক্ষত থেকে গেলো, কেন থেকে গেলো, আর যদি এখানে বাইরের কোনো প্রভাবক কাজ করে তাহলে সেটা কী, আর এখানে সেটা কীভাবে কাজ করল। এই একটি প্রশ্নই এখন জন্ম দিচ্ছে হাজারো প্রশ্নের। কেন মহাবিশ্ব পদার্থ দিয়ে গঠিত – কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী Alysia Marino-র এই প্রশ্নটি আসলেই এখন সারা বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে একটি রহস্য। বর্তমানে এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যে বিজ্ঞানীরা Charge Parity Violation নামের একটি প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান করছেন যেখানে কোনো কণিকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রতিপদার্থের জায়গায় পদার্থে রুপান্তরিত হয়। নিউট্রিনো আর প্রতি নিউট্রিনো নিয়ে এই পরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রশ্নের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা।
উপরের পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর বর্তমানে সকল পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে চরম আকাঙ্খিত। বলাই যায় এসব প্রশ্নের উত্তর পদার্থবিজ্ঞানে নতুন যুগের সৃষ্টি করবে, এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায় এর সাথে সাথে সৃষ্টি হবে আরও অনেক নতুন প্রশ্ন। প্রকৃতির রহস্য যে কখনো শেষ হবার নয়।
তথ্যসূত্রঃ
Click This Link
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Higgs_boson
Click This Link
: Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৩