"আমরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদেরকে একধরনের সেলফ ডিলিউশনে ডুবিয়ে রাখি যে, আগামি কয়েক সেকেন্ড পরে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাব না, বা কালকে যে আমি বাসায় ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যাব না—এ ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত। আল্লাহর সাথে আমার একধরনের চুক্তি আছে: তিনি আমাকে সত্তর-আশি বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেনই।"
বাকারাহ-এর এই আয়াত দুটিতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে জীবনের সকল বিপদ-আপদ, দুঃখ, হতাশাকে হাসিমুখে পার করার জন্য এক বিরাট মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন—
ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে নামাযে সাহায্য চাও, যদিও এটা করা খুবই কঠিন, তবে তাদের জন্য কঠিন নয়, যাদের অন্তরে স্থিরতা-নম্রতা রয়েছে—যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, একদিন তাদের প্রভুর সাথে দেখা হবেই। [বাকারাহ ৪৫-৪৬]"
আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাঁড়িওলা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।” ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামায পড়লেই আল্লাহ ﷻ আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা।
এই আয়াতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রয়েছে: ১) সবর صبر এবং ২) আস্তাই’-নু أستعين । সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাব, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করব না, এই ভেবে যে: একদিন আল্লাহ ﷻ সব ঠিক করে দিবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৯] আছে,
তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।
আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৯] এর লেখা—
শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার মেয়ের জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।
উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫][৭] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর ﷻ আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪]
আস্তা’ই-ন এর অর্থ করা হয়: সাহায্য চাও। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে: আপনি একা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারছেন না, আপনি এখন সহযোগিতা চান। যেমন: রাস্তায় আপনার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি একা ঠেলে পারছেন না। তখন আপনি রাস্তায় কাউকে অনুরোধ করলেন আপনার সাথে ধাক্কা দেবার জন্য। এটা হচ্ছে আস্তা’ই-ন। কিন্তু আপনি যদি আরামে গাড়িতে এসি ছেড়ে বসে থেকে রাস্তায় কাউকে বলতেন ধাক্কা দিতে, তাহলে সেটা আস্তাই’ন হতো না।[১] একারণেই আমরা সূরা ফাতিহাতে বলি: ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাই’ন—আমরা যথাসাধ্য চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাই।
এই দুটি শব্দ যখন একসাথে হয়: আস্তাইনু বিস-সাবরি أ سْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ তখন এর মানে দাঁড়ায়: যতই কষ্ট, দুর্ভোগ হোক, অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ কাজ না করে হালাল উপায়ে চেষ্টা করতে থাকা, নিজের ঈমানকে ঠিক রাখা এবং একই সাথে আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাওয়া।
এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার কিছু উদাহরণ দেই—
আপনি অনেক চেষ্টা করেও একটা ব্যবসা ধরতে পারছেন না। মাত্র কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারার জন্য কাজটা আপনার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, আপনি ঘুষ দেবেন না, মামা-চাচা ধরবেন না, মন্ত্রীকে একটা ফ্লাট কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তদবির করবেন না। আপনি ধৈর্য ধরে, কোনো পাপ না করে, নামাযে আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাইবেন এবং একই সাথে চেষ্টা করতে থাকবেন: অন্য কোনো হালাল উপায়ে এগোনো যায় কি না। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো হালাল উপায়ে ব্যবসাটা না-ও হয়, ভালো কথা, অন্য কিছুর জন্য চেষ্টা করবেন। আল্লাহর ﷻ উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখবেন যে, আপনার ভালোর জন্য আল্লাহ ﷻ আপনাকে সেই ব্যবসাটা করতে দিতে চাননি অথবা আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করা হয়েছে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য।
আপনার বাচ্চার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আপনি তার মাথায় পানি না ঢেলে, তাকে ডাক্তার না দেখিয়ে, জায়নামাযে বসলেন আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। আপনি বাচ্চার চিকিৎসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, আর নামাযে বার বার আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাইবেন—এটাই এই আয়াতের শিক্ষা। আবার অনেকে বাচ্চার কঠিন অসুখ হলে এবং অনেক চেষ্টার পরও অসুখ ভালো না হলে, আল্লাহর ﷻ উপর রাগ করে নামায পড়া ছেড়ে দেন, “কেন আমার বাচ্চারই এই কঠিন অসুখটা হবে? আমি কী অন্যায় করেছি? ওই ঘুষখোর চৌধুরী সাহেবের বাচ্চার কিছু হয় না কেন?”—ঠিক এই কাজটা করতেই এই আয়াতে মানা করা আছে।
দেশে ইসলামের দুর্দিন যাচ্ছে, মুসলিমদের ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে, মসজিদে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার টুপি-দাঁড়ি বা হিজাব দেখে একদিন আপনাকে রাস্তায় কিছু বখাটে যুবক ধরে মারধোর করল, আর আপনি ঘরে বসে শুধুই আল্লাহর ﷻ কাছে কান্নাকাটি করছেন, যেন আল্লাহ ﷻ দেশের অবস্থার পরিবর্তন করে দেন, আবার দেশের মুসলিমদেরকে ক্ষমতা দিয়ে দেন, দেশে ইসলামের রাজত্ব কায়েম করে দেন—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। এই আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে: আপনি ন্যায় বিচার পাবার জন্য পুলিশের কাছে যাবেন, দরকার হলে সেই যুবকগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবেন। যতদিন ন্যায় বিচার না পাচ্ছেন: চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন, পত্রিকায় লেখালেখি করবেন এবং একই সাথে প্রতিদিন আল্লাহর ﷻ কাছে নামাযে সাহায্য চাইবেন। কিন্তু কখনই প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব থেকে কু’রআনের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো কাজ করে ফেলবেন না। যেমন, বোমাবাজি, রাস্তায় নিরীহ মানুষের গাড়ি ভাঙা, নিরীহ মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করা ইত্যাদি কু’রআনের শিক্ষার বিরোধী কোনো কাজ করবেন না। আল্লাহর ﷻ উপর ভরসা রাখবেন যে, তিনি একদিন না একদিন ন্যায় বিচার করবেনই, সেটা এই দুনিয়াতে না হলে, আখিরাতে অবশ্যই হবে।
…কিন্তু এটা করা খুবই কঠিন, তবে তাদের জন্য কঠিন নয়, যাদের অন্তরে স্থিরতা-নম্রতা রয়েছে।
বিপদে ধৈর্য ধরে, লক্ষ্য ঠিক রেখে আল্লাহর ﷻ কাছে নামাযে সাহায্য চাওয়াটা যে কত কঠিন, সেটা আল্লাহ ﷻ ভালো করেই জানেন। একারণেই তিনি এই আয়াতে শুধু كَبِيرَةٌ কাবিরাতুন না বলে, বিশেষ ভাবে জোর দিয়ে বলেছেন: لَكَبِيرَةٌ লা-কাবিইরাতুন—খুবই কঠিন। তিনি জানেন মানুষের প্রবৃত্তি হচ্ছে যেভাবেই হোক প্রতিশোধ নেওয়া, একটু সুদ, ঘুষ দিয়ে ঝটপট কাজটা করে ফেলা, একটু দুই নম্বরি করে হলেও প্রমোশন নেওয়া, ব্যবসায় লাভ করা। দুনিয়ার শত প্রলোভন, দুই নম্বরির সুযোগ, প্রতিশোধের জ্বালাকে উপেক্ষা করে ইসলামের শিক্ষায় অটল থাকা কঠিন ব্যাপার। আর যতদিন পর্যন্ত যা চাচ্ছি তা না পাচ্ছি—ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর ﷻ উপর ভরসা রেখে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, আর নামাযে দু’আ করতে থাকা—এটা খুবই কঠিন কাজ তাদের জন্য যাদের অন্তরে ‘খুশু’ নেই।
খুশু خشع হচ্ছে এমন এক ধরনের ভয়, যার কারণে আপনার হাত-পা অবশ হয়ে আসে, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় যে, আপনি কোনো এক ভয়ে দুর্বল হয়ে গেছেন, আপনার ভেতরে আর কোনো ধরনের ঔদ্ধত্য নেই।[৮] যেমন, আপনি একদিন প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছেন। একটা খোলা মাঠে দৌড়িয়ে যাচ্ছেন দূরে সামনে একটা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। তখনি হঠাৎ দেখলেন: সামনে একটা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী টর্নেডো আপনার দিকে তেড়ে আসছে, বাড়ি-ঘড় খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিতে দিতে। ডানে-বাঁয়ে কোথাও পালাবার জায়গা নেই। টর্নেডোর এই প্রচণ্ড শক্তি দেখে ভয়ে আপনার হাত-পা জমে গেল, শরীর অসাড় হয়ে এল—এটা হচ্ছে খুশু। আল্লাহর ﷻ প্রতি আপনার এই ধরনের ভয় থাকার কথা।
আপনি একটা সরকারি অফিসে গিয়ে একজন কর্মচারীকে চুপচাপ একটা টাকার খাম দিতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনার হাত কাঁপা শুরু হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সাহস করে দিতে পারলেন না—এই হচ্ছে খুশুর লক্ষণ। আপনি ইন্টারনেটে একটা বাজে সাইটের এড্রেস টাইপ করে এন্টার চাপতে যাচ্ছেন, কিন্তু তখন আপনার হাত জমে গেল, হৃদপিণ্ড দপ দপ করা শুরু করল, জিহবা শুকিয়ে এল—এটা খুশুর লক্ষণ। যারা আল্লাহর ﷻ প্রচণ্ড ক্ষমতাকে উপলব্ধি করে বিনম্র হয়ে যায়, আল্লাহর ﷻ ভয়ে খারাপ কাজ করতে গেলে হাত-পা অবশ হয়ে যায়, নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ﷻ প্রচণ্ড ক্ষমতার কথা চিন্তা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় শরীর দুর্বল হয়ে যায়—তারা খুশু অর্জন করতে পেরেছে। খুশু হচ্ছে অন্তরের এক বিনম্র অবস্থা, যার প্রভাব তার কথা, কাজ, চলাফেরা দেখে বোঝা যায়।
আমরা যারা ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করি, আমাদের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় আমাদের কাছের মানুষরা আমাদের মনের এমন সব দুর্বল জায়গায় আঘাত করে, এমন সব খারাপ কাজ করে, যার জন্য আমরা ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে মরি। আমরা ইচ্ছা করলেই এমন এক চরম প্রতিশোধ নিতে পারি যে, এর পরে ওরা আর কোনোদিন আমাদের সাথে এরকম করার কথা চিন্তাও করবে না—শুধু দরকার একটুখানি অন্যায় করা, ইসলামের গণ্ডির বাইরে এক পা দেওয়া। কিন্তু আল্লাহর ﷻ কথা মনে রেখে আমরা তা করি না। ঈমান নষ্ট করার ঝুঁকি নিই না। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, মনে মনে রিহার্সাল করতে থাকি: একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কী কী বলা যায়, কী কী করা যায়—কিন্তু পরদিন ঠিকই নিজেকে সংবরণ করি, যেন এমন কোনো কিছু করে না ফেলি, যার জন্য আল্লাহকে ﷻ জবাব দিতে পারব না—এটা খুশু এবং সবরের লক্ষণ।
দ্বিতীয় আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ—
"যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, একদিন তাদের প্রভুর সাথে তাদের দেখা হবেই। [বাকারাহ ৪৬]"
আজকে যদি আপনাকে ডাক্তার বলে: আপনার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আপনি আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবেন, সিঙ্গাপুরে গিয়েও লাভ হবে না—আপনি তখন কী করবেন? আপনি কি তখন কাঁথা জড়িয়ে টিভির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু তারকা শো, টক শো, হিন্দি সিরিয়াল দেখবেন? আপনি কি পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সাথে শেষ বারের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবেন? আপনি কি আপনার ছেলেমেয়েকে শেষ বারের মতো একটু খুশি করার জন্য ভিডিও গেম কিনে দিবেন, যেখানে তারা রামদা-ছুরি নিয়ে একপাল অর্ধ মৃত, রক্তাক্ত জম্বিকে মেরে কোনো এক বিকৃত কারণে বড়ই আনন্দ পায়? আপনি কি এই অবস্থায় আপনার মেয়েকে নৃত্য শিল্পী বানাবেন, ছেলেকে ব্যান্ডের দলে যোগ দেওয়াবেন, যেন তারা সেগুলো করে আপনার মৃত্যুর পরে আপনার জন্য ‘অশেষ সওয়াব’ অর্জন করে?
না, আপনি তখন এগুলোর কিছুই করবেন না। কিন্তু আজকে আপনি ঠিকই সেগুলো করে যাচ্ছেন এটা ভালো করে জেনে যে: আপনি আজকে হোক, কালকে হোক, একদিন না একদিন মারা যাবেনই। তারপর একসময় আপনাকে আবার জাগিয়ে তোলা হবে এবং তারপর আপনাকে ধরে নিয়ে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড় করানো হবে: আপনার জীবনের প্রতি মুহূর্তের হিসাব দেবার জন্য। সেদিন তাঁর সামনে মাথা নিচু করে আপনি তাঁকে কী বলবেন—সেটা ঠিক করে রেখেছেন?
কোনো কারণে আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চাই না। এরকম চিন্তা মাথায় এলেই আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমরা দ্রুত চিন্তার টপিক পাল্টে ফেলি। যদি আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আমাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলা শুরু করে, আমরা জলদি তাকে বলি, “কি বলছেন এইসব! আস্তাগফিরুল্লাহ! এই সব মরা-টরার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বাদ দেন এইসব। আসেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”
আমরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদেরকে একধরনের সেলফ ডিলিউশনে ডুবিয়ে রাখি যে, আগামি কয়েক সেকেন্ড পরে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাব না, বা কালকে যে আমি বাসায় ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যাব না—এ ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত। আল্লাহর সাথে আমার একধরনের চুক্তি আছে: তিনি আমাকে সত্তর-আশি বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেনই।
যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, একদিন তাদের প্রভুর সাথে দেখা হবেই— এদের কথার ধরন, পোশাকের ধরন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রকৃতি, ঘরের আসবাব পত্র, লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখা বইগুলো, ফেইসবুকের স্ট্যাটাস, মোবাইল ফোনের অ্যাপসগুলো—এই সবকিছু দেখলে বোঝা যায় যে: এদের জীবনে কোনো একটা বিরাট উদ্দেশ্য আছে এবং এরা সেই ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এরা শপিং মলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুদা ঘুরে বেড়ায় না, প্রতিদিন ফোনে দুই ঘণ্টা গল্প করে না, দিনে তিনটা হিন্দি সিরিয়াল দেখে না, ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে না, রাস্তা ঘাটে বসে পুরো সময়টা মোবাইল ফোনে Angry Birds খেলে না। এদের ভাবসাব পুরোই আলাদা। একদল সস্তা ধরনের মানুষ এদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে, এদেরকে নানা ধরনের নাম দেয়: মোল্লা, নিনজা, তালেবান, ব্যাকডেটেড— কিন্তু তাদেরই মধ্যে কিছু আছে, যারা এদের দিকে শ্রদ্ধা নিয়ে তাকিয়ে থাকে, আর বাসায় ফিরে ভাবে, “ইস, আমি যদি এদের মতো হতে পারতাম…”
। [কপি পেষ্ট পোষ্ট, মূল লেখা এইখানে] ।
[১] নওমান আলি খানের সূরা বাকারাহ এর উপর লেকচার।
[২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
[৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
[৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
[৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
[৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
[৭] সবর শব্দের আভিধানিক অর্থ।
[৮] খুশু শব্দের সমার্থক শব্দগুলো।
[৯] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১০:৪২