গত ব্লগে বউরে নিয়া স্যান্ডউইচ যুদ্ধের কাহিনি কইছিলাম। তখনি বলছিলাম শশুর বাড়িতে রান্নাবান্না অভিযান চালাইছি। ওইটার বর্ণনা আইজকা দিমু।
পূর্বকথাঃ গত কোরবানি ঈদে বাসায় ব্যাপক রান্না বান্না অভিযান চালাইছিলাম। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলঃ মেজবানী গরুর মাংস রান্না। আমার জানা ছিল এ রান্না যথেষ্ট কষ্টকর। বিশেষতঃ নানান রকম মসল্লার "সাহি মিশ্রণ" না হলে খেতে ভাল লাগবে না। সেবার কাজে দিয়েছিল প্রথম আলোর নকশায় প্রকাশিত রেসিপি। সেই রেসিপি আর নিজের কিছু Improvisation মিলে নিজের খাটনি স্বার্থক।
বিয়ার পর শশুর বাড়িতে গেলে শাশুরি নানান কিসিমের মজাদার খাবার বানানোর জন্য আল্লাহর নাম নিয়া ঝাপায়া পড়ত। সত্যি বলতে কি উনার খাটাখাটনি দেইখা নিজেরি খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে যায়া যখন হেল্প করতে চাইতাম বলতেন "আজকে না! আরেকদিন তুমি রান্না করবা। আর আমরা খাব"
তখনি পেলান আটছি নিজের রান্না দিয়া বাপের বাড়ির মতন শশুর বাড়িতে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ামু। হেঃহেঃ। কিন্তু এইডাও মাথায় রাখলাম একেবারে নতুন কিছু করতে গেলে মান-সম্মান হারানোর ভয় থাকতে পারে।
অনেক ভাইবা মেজবানি মাংস করবার ব্যাপারে মনস্থির করলাম। কিন্তু মনে হলঃ ঈদের মতন এইবার ও যদি সব মসল্লা আলাদা ভাবে বেটে মিশাতে চাই তাহলে একটু ভুলেই চাকা পাংচার হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে খোজ নিয়ে দেখলাম রানি ব্রান্ডের মেজবানি মসলা পাওয়া যায়। প্যাকেটের গায়ে উপকরণ আর নির্দেশিকা দেখে বুঝলাম আরো কিছু অতিরিক্ত কাজ নিজে করে নিতে হবে।
অভিযান শুরুঃ প্রয়োজনীয় জিনিস একত্রে করে বউয়ের টিটকারি (তুমার কপালে আইজ শণি আছে) আর শাশুড়ির দোয়া নিয়া শুরু করলাম। বউয়ের দিকে তাকায়া নিজের মনে মনে কইলাম, " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে"। অবশ্য কিছুপরেই গতানুগতিক ভাবে উনি আইসা কইল, তোমার কিছু করন লাগব; দাও করি।
আগে মনে মনে ঠিক কইরা নিলাম নিচের রেসিপিটা
যা যা লাগবঃ
১। মাংসঃ ২ কেজি
২। রানি মেজবানি মাংস মসলাঃ ২ কেজির জন্য প্যাকেট
৩। গরম মসলা গুড়াঃ ১ চা চামচ
৪। টমেটো সসঃ ২ টেবিল চামচ
৫। সরিষা বাটাঃ ২ চা চামচ
৬। সরিষা তেলঃ ২ কাপ
৭। টমেটোঃ ২ টা*
৮। শুকনা মরিচঃ ৮-১০ টা
৯। লবণঃ স্বাদমত
১০। পেয়াজ কাটাঃ ২ কাপ
১১। পেয়াজ বাটাঃ আধা টেবিল চামচ
রান্না পদ্ধতিঃ
মাংস টুকরা করে কেটে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর প্যাকেট মসলার অর্ধেক, সরিষা বাটা, লবণ, পেয়াজ বাটা, গরম মসলা গুড়া, অর্ধেক সরিষা তেল এক সাথে মাখিয়ে ১৫-২০ মিনিট মেরিনেট করে রাখতে হবে।
পাতিলে বাকি তেল এ পেয়াজ কাটা ছেড়ে দিয়ে হালকা লাল করে ভাজতে হবে। এরপর বাকি প্যাকেট মসলা ঢেলে ভালমতন কসাতে হবে। দরকার হলে ১ কাপ পানি দিয়ে নিতে হবে। ২-৪ মিনিট পর তাতে মেরিনেট করা মাংস ঢেলে দিতে হবে। এরপর মাংস ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দিতে হবে, যাতে মসলা সব মাংসের গায়ে ঠিকভাবে লাগে। মাংস নেড়েচেড়ে চুলার জ্বাল মাঝারি পর্যায়ে রেখে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর ঢাকনা খুলে হালকা নেড়ে চেড়ে দিতে হবে।
একটা ব্যাপার মাংস ৩-৪ বার ধোয়ার কারণে তার ভিতরে যথেষ্ট পানি ঢুকে যায়। একারণে রান্নার সময় আলাদা করে খুব বেশি পানি দরকার হয় না। আর এম্নিতে মেজবানি মাংসে বেশি ঝোল ভাল লাগেনা। তারপর ও রান্নার সময় পানি দ্রুত শুকিয়ে গেলে বা কেউ ঝোল পছন্দ করলে আলাদা পানি দেয়া যায়।
সেক্ষেত্রে আলাদা পাত্রে পানি গরম করে নিতে হবে। তারপর আধা ঘন্টা কসানোর পর তাতে পানি ঢেলে দিতে হবে।
আরো ১৫ মিনিট পর তাতে শুকনা মরিচ ছিড়ে মাংসে দিয়ে মাখিয়ে দিতে হবে। একটা ব্যাপার চাইলে মরিচ মেরিনেট করার সময় ও দিয়ে দেয়া যায়। তবে প্যাকেট মসলাতে যেহেতু মরিচ গুড়া আছে, একারণে মেরিনেট করার সময় দিলে দুই ঝালের ঠেলায় পরের দিন বাথরুমে খবর হতে পারে। আর পরে মরিচ ছিড়ে দেয়ায় শুকনা মরিচের সুগন্ধটা ছড়িয়ে পরবে, কিন্তু ঝাল অতটা লাগবে না।
আরো ১৫ মিনিট অর্থাৎ রান্না শুরুর মোট ১ ঘন্টা পর টমেটো সস ঢেলে দিতে হবে। এতে ঝোল অনেক ঘন আর মাখা মাখা হয়ে যায়, খেতেও ভালো লাগে।
গরুর মাংস সিদ্ধ হতে মোটামুটি ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট থেকে দেড় ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগে। নামানোর ১০-১৫ মিনিট আগে জয়ফল-জয়ত্রি গুড়া ঢেলে ভালো করে মাখিয়ে দিতে হবে।
নামানোর ৫-১০ মিনিট আগে চাইলে টমেটো টুকরা করে কেটে ছেড়ে দিতে পারেন, খারাপ লাগবে না।
রান্না হয়ে গেলে চুলার জ্বাল বন্ধ করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
রান্নার পরের গল্পঃ
বিবি সাহেব একখান মিক্সড ভেজিটেবল করল পাচফোড়ন দিয়ে। শাশুড়ি আমি রান্না ঘরে ঢোকার আগেই আমার পছন্দের খিচুড়ি আর অন্যান্য আইটেম গুলা করে রেখেছিল, যদিও ইচ্ছা ছিল সবকিছু আমি রান্না করব।
যাইহোক খেতে বসে ভয়ে ছিলাম সবাই কি বলে। সবার প্রশংসা পেলাম।
মাঝখানে ঘটা কিছু টুকরা স্মৃতিঃ
কিছুক্ষণ পরপরই শাশুড়ি বলছিল, "তোমার কষ্ট করার দরকার নাই, আমি করি।" একটু পর দেশ-বিদেশ এর শশুর বাড়ির আত্মীয় পক্ষ থেকে কল দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করছে " বাবা, তুমি রান্না করছ!" এ সব আবেগী কথা শুনে চোক্ষে আমার জল চলে এল। তবে সবচেয়ে সুখস্মৃতি হচ্ছে শশুর বাড়ির সবার মুখে হাসি, আর আমার বৌয়ের চোখে পরিতৃপ্তি।