৩০১৩, মে' ৫।
চট্টগ্রামের শহরের বাড়িতে রৌদ্রকোজ্জ্বল এক বিকালে আসাদ সাহেব বাড়ির ছাঁদে নিজের বাগানে লাগানো ক্যাকটাস, রজনীগন্ধ্যা আর গোলাপের টবে পানি দেয়া শেষ করে ছাঁদের ইজি চেয়ারটায় আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে আজকের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন।
একটু পর আসাদ সাহেবের স্ত্রী রীতা নিজের প্রাইভেট রকেটে করে প্যারিস থেকে অফিস শেষ করে বাড়িতে পৌঁছেছেন। প্যারিসের অফিসের সারাদিনের ক্লান্তি আর প্যারিস থেকে চট্টগ্রামের দীর্ঘ ৪৭ মিনিটের যাত্রার ক্লান্তি অবশ্য রীতার রকেট বাড়ির ছাঁদে ল্যান্ড করার আগেই গোসল করে কাটিয়ে ফেলেছেন। রকেট বাড়ির ছাঁদে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই ছাঁদের এটেনডেন্ট রোবট "ওহা" মিসেস রীতার যাত্রার পোশাক খুলে বাড়িতে পরার ইজি টাওয়ালটা পরিয়ে দিয়ে ১৫০ তলা ভবনের ছাঁদ থেকে ৫ম তলায় আসাদ-রীতাদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার লিফটে তুলে দিয়েছে। 'ওহা' রকেটের দরজা খোলার আগেই রীতার চোখ স্ক্যান করে রীতার মনের ভাষা পড়ে নিয়েছিল, সে ছাঁদে বসা স্বামীর সাথে দেখা বা কথা বলার আগেই বাসায় গিয়ে খাবার রেড়ি করে আসবে। 'ওহা' তাই যেখানে ৯.৫ সেকেন্ড লাগত সেখানে ৪.৭ সেকেন্ডে রীতাকে ফ্ল্যাটে যাওয়ার লিফটে তুলে দিয়ে আসাদ সাহেবের সাথে গল্প করছিল, এইসব কথা 'ওহা' আসাদ সাহেবকে বলতেই আসাদ সাহেব 'ওহা'কে জাপান থেকে কেনার জন্য বৌয়ের সাথে কথা কাটাকাটির গল্পটা মনে করতে চেষ্টা করছিলেন। আজ থেকে ১৩ বছর ৬ মাস ২৯ দিন ৪৪ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড আগে ১৪৯৯ ডলার দিয়ে কেনার সময় স্বামী-স্ত্রী দু'জনে টকিও'র নাকাদা কোম্পানীর সদর দপ্তরে দিয়ে কি কান্ড করেছিল তার একটা ১৪ মি:১৪ সে: এর ফুটেজ নিজের স্ক্রীনে ফুটিয়ে তুলেছে "ওহা"। আসাদ সাহেবের মনের কথা চোখের ইশারা দেখে বুঝে নিয়ে ৫ মিনিট চলার পর বন্ধ করে দিয়েছে 'ওহা'। ওহা'র এই গুনটার জন্য আসাদের সাহেবেরও খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে বুদ্ধিমান রোবট 'ওহা'। বর্তমানে 'ওহা'র চাইতেও বুদ্ধিমান ও ক্ষীপ্র গতির চাইনা রোবট আরও অনেক কম দামে পাওয়া গেলেও সাংসারিক কাজের জন্য সাড়ে ১৩ বছর আগে 'ওহা' ধারে কাছেই যেতে পারে এমন কোন রোবট ছিলনা পৃথিবীতে।
এমন সময় দুই গ্লাস (কৃত্রিম) কদ বেলের শরবত নিয়ে ছাঁদে স্বামী পাশে এসে বসলেন রীতা। আসাদ সাহেব স্ত্রীর হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেনঃ আজ কি নাইলার আসতে আরও দেরি হবে? লান্সের পরিবর্তে শরবত দেখে আসাদ সাহেব আগেই আন্ধাজ করে বুঝে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা।
স্ত্রী বললেনঃ এখন বোধয় ইরানের কাছাকাছি, আমার সাথে ক্লাশ শেষ করে আজারবাইন রকেট স্টেশনে যখন ফ্লাইটের অপেক্ষা করছিল তখন কথা হয়েছিল, মনে হয় ২৬ মিনিট মতো লাগতে পারে।
আর ওমরের কোন খোঁজ নেয়া গেছে- আসাদ সাহেবের প্রশ্ন?
"নাইলা" আর "ওমর" হলো "আসাদ আর রীতা"র একমাত্র ছেলে আর একমাত্র মেয়ে। নাইলার আজকে ১৬ বছর ২৯ দিন। এবার রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে 'আজারবাইজান ইউনিভার্সিটি'তে। বড় ছেলে ওমর নাইলার চাইতে ৩ বছর ২৭৬ দিনের বড়। এবার টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পিট করে বের হবে। সে গতকাল থেকে কোন নিউজ দিচ্ছে না বাড়িতে। বাবা-মা'র সাথে রাগ করে সেল ফোন অফ রেখেছে। ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য তার হাতে লাগানো সিকিউরিটি ডিবাইসটাও বন্ধ করে রেখেছে গত ৫০ ঘন্টা ধরে। ফলে বাবা-মা'র সাথে গত দুই দিনতো কোন কথাতো হয়ও নি তাছাড়া ম্যাক আইডি, ইএমআইডি, হ্যাক আইডি সবটাই বন্ধ। তবে জন্মের পর ব্রেনে বসানো হাই সিকিউরিটি ম্যানেজ গার্ডের মাধ্যমে বাসার কাজের দায়িত্ব পাওয়া রোবট "আজিমা"র একটু আগে কথা হয়েছিল। আজিমা জেনেছে "ওমর" আজ দুপুরের দিকে নাইলার সাথে কথা বলেছে আর গতরাতে "এলিমা"র সাথে (ওমরের গার্ল ফ্রেন্ড) চেন্নাইতে রাত কাটিয়েছে। কথাগুলা স্বামীর সাথে শেয়ার করতে করতে ইতিহাসের টিচার হিসেবে ইতিহাসের একটা কথা স্বামীকে জোর দিয়ে স্মরন করিয়ে দিলেন- "ইন্ডিয়ান মেয়েরা চিরকালই এমন হয়, তা এই যুগে যেমন প্রাচীন আধুনিক ও প্রাচীন কালেও তেমন। কোন পারিবারিক বন্ধনেতো এরা নিজেরা বিশ্বাস করেই না অন্যান্য জাতীগোষ্টির পারিবারিক বিশ্বাস-মূল্যবোধ ও বন্ধনকে ভাঙ্গার জন্য হেন কোন পন্থা নেই যেটা তারা অবলম্বন করে না !
এমন সময় নেয়ে-ঘেমে একাকার হয়ে ঢাকা থেকে পাবলিক বিমানে করে ওদের বাড়ির ছাঁদে ল্যান্ডিং পয়েন্টে নেমে সোজা বাবা-মা'র কাছে হাজির "নাইলা"। ওহা'র দেয়া রিফ্রেশিং টাওয়ালটা গায়ে জড়াতে জড়াতে নাইলা বাবা-মা দুইজনের উদ্দ্যেশে বলেছে- "ভাইয়া ফোন দিয়েছিল, বলেছে- সে ঐ মেয়ে বিয়েকে বিয়ে করবে। আর তোমরা রাজি না থাকলে সে ইন্ডিয়ায় ঐ মেয়ের সাথে লিভ টু গেদার করে ওখানেই থেকে যাবে। আর রাজি থাকলে জানাতে বলল, সে আজ রাতেই বাসায় ফিরবে।
নাইলা বাবা-মা'কে অতিদ্রুত খবরটা পাস করে অতি দ্রুতই বাসায় যাওয়ার জন্য লিফটের দিকে রওনা দিয়েছে। প্রায় পৌনে ১০ মিনিট পর ক্লাশের ম্যাক প্যাড, জামা-কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বাড়ির কাপড় পরে আবারও ছাঁদে বাবা-মা'র সাথে জয়েন্ট করেছে। প্রায় সাথে সাথেই আজিমাও তিন জনের দুপুরের খাবার নিয়ে ছাঁদে হাজির। নাইলা বলেঃ দেখ আব্বু, দেখ আম্মু আমারও কিন্তু ঐ মেয়েকে একদম পছন্দ না কিন্তু তা নিয়ে এতক্ষন মন মরা হয়ে থাকার কি আছে? আর তাছাড়া তোমরা মানা করলেই কি তোমার ছেলে শুনবে?
এমন সময় আজিমা সবাইকে উদ্দেশ্য করে যে নিউজ দিল তাতে সবার মন খুশিতে ভরে উঠল ! আজিমা জানালোঃ ওমর আজ রাতে বাসায় ফিরবে এবং এলিজার সাথে তার রিলেশন ব্রোক আপ হয়ে গেছে। সবচাইতে খুশির কথা হলো, এলিজার প্রতি ওমরের সব রকম নেশা বা মোহ কেঁটে গেছে আর দীর্ঘ ৫২৬ দিনের সম্পর্কের মাঝে ওমর পিজিক্যালি সুখি হলেও মেনটালি কখনোই পুরোপুরি সুখি ছিলনা ! আর আজ তাই পুরোপুরো ভাবেই তাদের রিয়েলশন ব্রেক আপ হয়ে গেল। এমন একটা খুশির নিউস দিয়ে আজিমা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে ৫ তালায় নিজের ডিউটিতে জয়েন্ট করার জন্য খুব দ্রুতই স্থান ত্যাগ করল।
আসাদ সাহেব, স্ত্রী রীতা আর কন্যা নাইলা যখন খুশি মনে খাবার খাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রথম কথাটা মিসেস রীতাই বললেন- সব মানুষকেই একদিন তাদের আপন নীড়ে ফিরে আসতেই হবে। মুল হারানো মানুষ যতই আধুনীক হোক না কেন কোন ভাবেই সুখি হতে পারবেনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আদিকাল থেকেই আছে। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে, আপন শিকড়ের মায়া ভুলে গিয়ে যারাই আত্মভোলা থেকেছে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কথাগুলা শুনে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে করে লম্বা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ খেতে লাগলেন আসাদ সাহেব। এমন সময় মায়ের কথা টেনে নিয়ে নাইলা আস্তে আস্তে বলছে- জান মা, আজ না ৫ মে ! আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ঢাকার রাস্তায় পুরো দেশবাসির চোখের সামনেই হাজার হাজার এতিম ও আলেমদের গুলি মেরে হত্যা করেছিল তখনকার এক জালিম সম্রাজ্ঞী ! নাইলার কথা কেড়ে নিয়ে মা বলেনঃ তখন পৃথিবীর মানুষ অনেক আধুনীক হয়েছিল কিন্তু দেশের মুল জনগোষ্টির বিশাল একটা অংশ ছিল অশিক্ষিত- তাদেরকে যা বলা হতো তাই বিশ্বাস করত। নিজেদের কোন বিবেক - মূ্ল্যবোধ বলে কিছু ছিল না। হাতে গুনা কিছু লোক ছিল শিক্ষিত আর তারাই নিয়ন্ত্রন করতে দেশের প্রশাসন-পুলিশ-মিডিয়া। এই কথিত শিক্ষিত লোকগুলোই টাকার বিনিময়ে নিজেদের মাথা-মেধা ও কলম বিক্রি করে দিয়েছিল বিদেশী প্রভু ও তাদের এই দেশিয় দালাল শাষক গোষ্টির কাছে। সবচেয়ে কাঙ্গাল ও দালাল ছিল সেই সময়ের মিডিয়া বা সাংবাদিক নামধারী কিছু কুলাংগার অর্ধশিক্ষিত লোক। তারা টাকার বিনিময়ে একটা অবৈধ শাষকের গোলামে পরিনত হয়েছিল। এই কুলাংগারদের প্রপাগান্ডার কারনেই তখনকার মোটামুটি আধুনিক সমাজও সবকিছু বুঝে চুপ মেরে ছিল। ঐ সময়ের সাংবাদিকরূপি দালালরা সরকারী টাকার লোভে, বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে সরকারী প্রেশনোটকে রং চং মাখিয়ে খবর বলে প্রাচার করতো। আর সাংবাদিকরূপী এইসব দালালদের কারসাজির কারনে সেই সময়ের ঐ টেরোরিষ্ট লেডি লিডার, কিলার প্রাইম মিনিষ্টারের ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছিল।
অনেকক্ষন ধরে মা-মেয়ের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষন আসাদ সাহেব চুপ করেই খাচ্ছিল। এবার তিনি নিজেই যোগ করলেনঃ আরে তুমরা যে এত কথা বলছো, একটা কথা কি ভেবে দেখেছো- তখনকার পৃথিবীর মানুষ নিজেদের অনেক আধুনিক মনে করত। অথচ সবার সামনেই রাতে আঁধারে রাস্তার উপরে শহরের বাতি বন্ধ করে দিয়ে পার্শ্ববর্তি দেশ থেকে সৈন্য এনে হাজার মানুষকে হত্যা করে লাশ সহ ঐ বিদেশী সৈন্যদের গাড়িতে করে সিমান্তের ওপারে ফেলে দিয়েছিল। আর এইসব চোখের সামনে দেখার পরও কেউ রাস্তায় নেমে তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ দেখ, সেই সময়ে দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক নেত্রী "খালেদা জিয়া" গভীর রাতের নিজের বাসা থেকে পুলিশের বাঁধায় বের হতে না পেরে নিজের বাসায় সাংবাদিক ডেকে নিয়ে দেশবাসিকে ঐ অত্যাচারিত আলেম ও এতিম লোকগুলার পাশে দাঁড়াতে বললেও ঐ সময়ে ঐসব আবাল পাবলিকগুলা রাস্তায় নেমে তাদের পাশে দাঁড়ানোতো দুরের কথা ঐ জালিম-খুনি সরকারের টাকা খেয়ে ওনার নিজের দলের লোকেরাই ঘর থেকে বের হন নি!
নাইলা বলেঃ মা, সেই মহিলা রাক্ষসি-ডাইনীটার নাম কি ছিল?
প্যারিস ইউনির্ভাসিটির ইতিহাসের অধ্যাপিকা মিসেস আসাদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন "শেখ হাসিনা"।