স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের কথাঃ
১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সফলভাবে সামরিক শাসনের সময় আইয়ুব খান বাঙালীদের মিলিটারীদের প্রতি মনোভাব পরিবর্তনের জন্যে জিয়ার উপরে নির্ভর করেছিলেন। জিয়া ছিলো বাঙ্গালী যুবকদের জন্যে সেনাবাহিনীতে একজন রোল মডেল।
১৯৬৫ সালে ইন্দো পাকিস্তান যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান তার সাহসিকতার জন্যে পাঞ্জাবের খেমকারন সেক্টরে একজন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং সেখানে তার আন্ডারে ছিলো ৩০০-৫০০ সৈন্য। এবং ইতিহাসের পাতায় আছে ঐ সেক্টরেই সব থেকে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিলো ভারতীয়দের সাথে, এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী বীর হিসেবেই নিজের নাম লিখিয়েছেন জিয়াউর রহমান। যুদ্ধের পরে সব থেকে বেশি সংখ্যক বীরত্বসূচক পদক পেয়েছিলো জিয়ার ইউনিট। জিয়াউর রহমান পেয়েছিলেন জীবিতদের মধ্যে সব থেকে বীরত্ব সূচক পদক হিলাল ই জুরত। এবং তার ইউনিট পেয়েছিলো সাহসী সূচক দুই টি সিতারা ই জুরত পদক [ তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ পদক] এবং নয় টি তমঘ ই জুরত পদক [ চতুর্থ মর্যাদাপূর্ণ বীরত্বের জন্যে দেয়া হয়]।
১৯৬৬ সালে জিয়াউর রহমান মিলিটারী ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। এর পরেই তিনি চলে যান কোয়েটায় সেখানে তিনি কমান্ড এবং ট্যাক্টিকাল ওয়ারফেয়ারের উপরে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন।
জিয়া প্রশিক্ষক হিসেবে সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তা হিসেবে বাঙ্গালী সৈন্যদের অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করেছেন এবং তিনিই অনেকটা নিজের হাতে গড়ে তুলেন ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
দীর্ঘ দিন ধরে ন্যায়বিচারের জন্যে ক্ষুধার্ত এবং বঞ্চিত একটি জাতিকে সামরিক দিক দিয়ে সবল করে তোলার জন্যেই জিয়া তার সমস্ত দিয়েই চেষ্টা চালিয়েছেন।
১৯৬৯ সালে ঢাকার গাজীপুরের জয়দেবপুরে অবস্থিত সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সামরিক প্রশিক্ষক সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে যোগ দেন জিয়াউর রহমান, যদিও তখন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে এক ধরনের দুরুত্ত্ব প্রবল ভাবে অনুভূত হচ্ছিলো। এর কিছু পরেই জিয়াউর রহমান চলে যান জার্মান আর্মিতে, সেখানেই তিনি প্রশিক্ষন নেন এডভান্সড মিলিটারী এবং কমান্ড ট্রেইনিং এর উপরে, তার কয়েকমাস পরে আবার চলে যান ব্রিটিশ আর্মিতে।
এর পরের বছর ১৯৭০ সালে জিয়া ফিরে আসেন আবার, তখন দেশে জাতিগত বিভেদ প্রায় স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিলো। বিশেষ করে ৭০ এর ভোলার সাইক্লোনে সরকারের সহজোগিতার অভাব এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ত্বে নির্বাচনে জয়লাভ ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তখন এমনকি সেনাবাহিনীতেও বিভেদ দেখা দিলো।
অক্টোবর ১৯৭০, জিয়া মেজর হিসেবে কমিশন লাভ করলেন এবং তার নতুন কর্মস্থল হলো চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে।
আমি মেজর জিয়া বলছিঃ
ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা যখন ব্যর্থ হত তার ফলশ্রুতিতেই ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে বাঙালীদের উপরে নেমে আসে ভয়াল রাত, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মিলিটারীরা অন্যান্য রাজনৈতিকদের গ্রেফতার কিংবা খুন করার চেষ্টা করলে অধিকাংশ নেতাই আত্মগোপন করেন।
এরকম একটি অরাজক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে সেটি ছিলো ভয়াবহ। বলাই বাহুল্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য সেখানেই অস্তমিত হবার জোগাড় হয়েছিলো। কিন্তু তখনি যোগ্য নেতা হিসেবেই ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় মাত্র ৩৫ বছরের জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কাউরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যদিও একদিন পরেই ২৭ মার্চ তিনি শেখ মুজিবুরের পক্ষে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
"This is Shadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman on behalf of Bongabondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bangalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours."
জিয়াউর রহমান ও তার বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে পুরোভাগে ছিল, জিয়া চট্টগ্রামে সামরিক ও EPR ইউনিট থেকে সব বাঙালি সৈন্য সংগ্রহ করে একটি পদাতিক ইউনিট আয়োজন করে, তার কমান্ডে তারা কয়েকদিনের জন্যে চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী শহরের দখল বজায় রাখেন। এবং চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলকে সেক্টর ১ হিসেবে ব্যবহার করেন এবং তার হেড কোয়াটার ছিলো সাব্রুম ত্রিপুরা। যেটি পরবর্তীতে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় স্থানান্তর হয়। এবং এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্ত্বে নতুন করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
এপ্রিলের শুরুতেই কুড়িগ্রামের রউমারীতে প্রথম প্রতিষ্ঠিত ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন তিনি যেটি জেড ফোর্স নামেই বেশি বিখ্যাত ছিলো। এবং ঐ মাসেই তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়ে যে জেড ফোর্স ১ম ৩য় এবং ৮ম রেজিমেন্টের বাছাই করা সৈন্যদের দিয়ে সাজানো হয়েছিলো সেটি প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর উপরে।
১৬ই ডিসেম্বার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে, শেখ মুজিব এসে ক্ষমতা গ্রহন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপুর্ন অবদান এবং দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্যে সরাসরি শেখ মুজিব কতৃক দেশের জীবিতদের মধ্যে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ পদক বীর উত্তম লাভ করেন।
ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান আবারো কর্নেল পদে কমিশন লাভ করেন এবং কুমিল্লায় একটি ব্রিগ্রেডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এর কয়েকমাস পরেই জুন মাসে তিনি ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং যেটি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হিসেবে শেষ হয়।
রাজনীতিবিদ জিয়াঃ
১৫ ই আগস্ট বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন বাংলাদেশে অরাজকতার জন্যে অনেকটা দায়ী এবং তারই কুফল হিসেবে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সৈন্যের দ্বারা স্বপরিবারে নিহত হন। এবং বাকশালের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খল অবস্থায় পদত্যাগ করেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ এবং ২৫ আগস্ট তার স্থলাভিষিক্ত হন জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ তার অধিনের সেনাদের জিয়াউর রহমানের কমান্ড মেনে চলতে আদেশ দেন এবং জিয়াউর রহমান ঐ একই দিনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে কমিশন লাভ করেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর মধ্যেই বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হতে থাকে বিদ্রোহ করার জন্যে। অবস্থা সব থেকে বেশি খারাপ হয় যখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়েত জামিলের আন্ডারে আওয়ামী মন্ত্রী সভার চার ক্যাবিনেট মন্ত্রী কেন্দ্রীয় জেল খানায় নিহত হন, এবং ৩ নভেম্বার ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে তার কাছ থেকে জোর করেই পদত্যাগ পত্র সাইন করিয়ে নেয়। কিন্তু অপর দিকে তৃতীয় একটি পক্ষে বান ঘরানার কিছু নেতার সহযোগিতায় কর্নেল তাহের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান কে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন, যার নাম দেয়া হয় সিপাহী জনতা বিপ্লব। যদিও তাহেরের ভূমিকা এখনো পরিষ্কার নয় কিংবা প্রমানিত হয় নি যে তিনি আসলে কি চেয়েছিলেন।
যদিও ৭ই নভেম্বরের সিপাহি জনতা বিপ্লব জিয়াউর রহমানকে তুলে দেয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার চুড়োয়। এবং যাকে আমি কাকতাল ছাড়া আর কিছুই বলবো না। এবং সেটি শেষ পর্যন্ত এই দেশের জন্যে কতোটা সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে সেটিও লিখবো সামনে।
আজ এই পর্যন্তই, এরপরে আমরা জিয়াউর রহমানের অর্জন, কিভাবে তিনি হত্যার শিকার হলেন। এবং কারা দায়ী ছিলো, তার মৃত্যুর বিশদ প্রভাব। এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের আরো অসংখ্য জিনিস সম্পর্কে জানবো। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়ার অবদানগুলো একবারে এমনিতেও শেষ করা সম্ভব ছিলো না। ধন্যবাদ সবাইকে কষ্ট করে এতক্ষণ পড়ার জন্যে।
ফেবু নোট হতে সংগ্রহীত ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:১৮