ফিরে এলাম ।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে জানার কিছু দিলাম:
কোভিড-১৯: ভয় যেমন আছে, আশাও আছে
বিশ্বব্যাপী জন স্বাস্থ্যের সর্বশেষ হুমকির নাম হলো, করণাভাইরাস রোগ ২০১৯ (Corona Virus Disease -2019)। সংক্ষেপে 'CoViD -19' (কোভিড -১৯), যা একটি মূলত শ্বাসকষ্টজনিত রোগ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, চীনের উহান শহরেই এই ভাইরাসটি প্রথম সনাক্ত হয়। তাই এর নাম কোভিড -১৯।
করোনা ভাইরাস কি?
এটি কোনো একটি ভাইরাসের নাম নয়। বরং এটি অনেক গুলো ভাইরাস মিলিয়ে একটি বৃহৎ পরিবারের নাম। এই পরিবারের ভাইরাস গুলো সাধারণ সর্দি কাশি থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত গুরুতর অসুখ, যেমন MERS-CoV এবং SARS-CoV এর জন্য দায়ী।
কোভিড -১৯, এই করোনা ভাইরাস পরিবারেরই এক নতুন সদস্য।
করোনা ভাইরাস পরিবারের সব কয়টি ভাইরাসই 'Zoonotic', অর্থাৎ এগুলো জীব-জন্তু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। যেমন MERS-CoV ছড়িয়েছিলো এক কুঁজ ওয়ালা উট থেকে মানুষে। SARS-CoV ছড়িয়েছিলো সিভেট বিড়াল থেকে মানুষে। নতুন COVID-19 ভাইরাসটি SARS-CoV-2 থেকে সৃষ্টি হয়েছে। SARS-CoV-2 এর সম্ভাব্য আধার হচ্ছে বাদুড়। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই ভাইরাসটি অন্য একটি মধ্যবর্তী প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এই মধ্যবর্তী প্রাণী কোনও গৃহপালিত প্রাণী বা বন্য প্রাণীও হতে পারে, যা এখনও সনাক্ত করা যায়নি। এখনো বেশ কয়েক ধরণের করোনা ভাইরাসের কথা আমরা জানি, যেগুলো জীব-জন্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে, মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি।
কোভিড -১৯ এবং বর্তমান পরিস্থিতি:
চীনের প্রথম ৪২৫ জন আক্রান্ত ব্যাক্তির বিস্তারিত ক্লিনিকাল বর্ণনা থেকে জানা যায়, আক্রান্তদের মধ্য (মিডিয়ান) বয়স ছিল ৫৯ বছর। রোগীদের মধ্যে ৫৬% ছিলেন পুরুষ। আক্রান্তদের মধ্যে যাদের বয়স বেশি এবং যারা আগে থেকে অন্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছিলেন (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস), তাদের মধ্যেই কোভিড - ১৯ সংক্রমণের তিব্রতা এবং মৃত্যুহার বেশি ছিল। এদের মধ্যে একজনও ছিল না যার বয়স ১৫ বছরের নিচে। এর দুটি কারণ হতে পারে - হয় কোভিড-১৯ দ্বারা বাচ্চাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, অথবা বাচ্চাদের মাঝে রোগের লক্ষণগুলি এতটাই হালকা ছিল যে তাদের সংক্রমণ সনাক্ত করা যায় নি। এই জরুরী তথ্যগুলো নিঃসন্দেহে, জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করছে, কোভিড - ১৯ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী কৌশল এবং পন্থা নির্ধারণ করতে।
বর্তমানে কোভিড - ১৯ তে মৃত্যুর হার প্রায় ২%। যদিও জার্নালে প্রকাশিত অন্য একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, সনাক্তকৃত ১০৯৯ জন কোভিড - ১৯ রোগীর মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ১.৪%। যদি আমরা ধরে নেই যে, সনাক্তকৃত কোভিড - ১৯ রোগীর সংখ্যার তুলনায়, লক্ষণহীন বা ন্যূনতম লক্ষণ যুক্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি, তবে কোভিড - ১৯ তে মৃত্যুর হার ১% এর চেয়েও কম হতে পারে।
এটি থেকে, আমরা অনুমান করতে পারি যে, কোভিড - ১৯ এ মৃত্যুর হার:
• মারাত্মক মৌসুমী ইনফ্লুয়েঞ্জা (যার মৃত্যুর হার ০.১%) বা ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী (১৯৫৭ এবং ১৯৬৮ এর মতো) এর চেয়ে বেশি হবে।
• কিন্তু MERS-CoV (যার মৃত্যুর হার ৩৬%) এবং SARS-CoV (যার মৃত্যুর হার ৯-১০%) এর চেয়ে কম হবে।
কোন করোনা ভাইরাস কত তাড়াতাড়ি এবং কত দক্ষতার সাথে শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তার ওপর ভিত্তি করে সেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী কৌশল এবং পন্থা নির্ধারণ করতে হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, একজন কোভিড - ১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তি, আনুমানিক ২ জনকে কোভিড - ১৯ তে সংক্রমিত করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত, এই সংখ্যাটিকে, আমরা ১ এর নিচে নামিয়ে আনতে না পারব, ততক্ষন পর্যন্ত সম্ভবত কোভিড - ১৯ সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কোভিড - ১৯ তে আক্রান্ত হওয়ার পর, প্রথম কয়েকদিনে লক্ষণ/উপসর্গ গুলো খুব কম থাকে। কিন্তু সেই সময়, আক্রান্ত ব্যাক্তির মুখের ভেতরে এবং গলার উপরি ভাগে এই ভাইরাসের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি থাকে। যার ফলে, ঐ প্রথম কয়েকদিনে, একজন কোভিড - ১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তি খুব সহজেই একজন অনাক্রান্ত ব্যাক্তিকে সংক্রমিত করতে পারেন।
কোভিড -১৯ এর প্রসার রোধে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কয়েকটি দেশ সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে, এই ধরনের বিধিনিষেধগুলি, ভাইরাসের বিস্তারকে কমিয়ে দিতে সহায়তা করতে পারে। তবে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, প্রয়োজনে আরও কিছু বিধি নিষেধ পালনের জন্য, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন সামাজিক দূরত্ব, বাড়িতে স্বেচ্ছা নির্বাসন, যে কোনো জন সমাগম স্থগিত করা, যখন সম্ভব বাসা থেকে অনলাইনে কাজ করা ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে, কোভিড -১৯ মোকাবেলায়, একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির জন্য জোরেশোরে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আশা করা হচ্ছে, এই বছরের মে-জুন মাসেই এর প্রথম ট্রায়াল হবে।
কোভিড -১৯ কিভাবে ছড়ায়:
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যাক্তির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অথবা হাঁচি-কাশির সময় যে ছোট ছোট কণিকা (ড্রপলেট) বের হয়, তার মাধ্যমে সরাসরি ছড়ায়।
অনেক সময় ঐ ড্রপলেটগুলো আক্রান্ত ব্যাক্তির আসে পাশের জিনিসপত্রের উপরও পরে। সেই জিনিসপত্র যদি একজন অনাক্রান্ত ব্যাক্তি ধরেন, এবং তার পরে, হাত না ধুয়ে সেই হাত যদি তার নাকে, মুখে, চোখে দেন, তাহলেও সেই অনাক্রান্ত ব্যাক্তি কোভিড -১৯ তে আক্রান্ত হতে পারেন।
কোভিড -১৯ এর প্রতিরোধ:
১. ঘন ঘন এবং নিয়মিত হাত ধুতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৯০% মানুষ সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয় না - অনেক সময়ই হাতের বুড়ো আঙ্গুল এবং আঙ্গুলের মাথা গুলো বাদ পরে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ভিডিও লিংক আছে, সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয়ার উপরে:
https://youtu.be/3PmVJQUCm4E
২. কাজের জায়গাতে অথবা সামাজিক অনুষ্ঠানে, সহকর্মী, বন্ধু, রোগী, বা ক্লায়েন্ট এর সাথে করমর্দন, কোলাকুলি, এবং গালে চুমু (যেটি পশ্চিমা বিশ্বে, বন্ধু মহলে বেশ প্রচলিত) দেয়া থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে।
৩. হাঁচি কাশি দিচ্ছে এমন কারো কাছ থেকে কম পক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
৪. অকারণে নিজের চোখ, নাক এবং মুখে হাত দেয়া বন্ধ করতে হবে।
৫. হাঁচি কাশির সময় কনুই দিয়ে, অথবা এক বার ব্যবহার যোগ্য টিসু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে, এবং অন্যদেরও ঢাকতে বলতে হবে। ব্যবহারের পরে টিসু আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিতে হবে, যাতে অন্য কারোর সংস্পর্শে সেটি না আসে।
৬. করোনা ভাইরাস গুলো সাধারণ রান্নার তাপমাত্রায় (৭০° সেন্টিগ্রেড) বেঁচে থাকতে পারে না। সুতরাং, একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে, কাঁচা বা অল্প রান্না করা খাবার এড়ানো উচিত। কাঁচা মাংস, কাঁচা দুধ, কাঁচা ডিম বা কাঁচা মাছ রান্না করার সময়ও সাবধান হতে হবে।
৭. শরীর খারাপ লাগলে বাড়ীতে থাকতে হবে।
৮. কিন্তু জ্বর, কাশি এবং শাসকষ্ট থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, বা হেল্পলাইন থাকলে সেখানে ফোন করতে হবে।
কোভিড -১৯ এর লক্ষণ এবং উপসর্গ:
• একটি ব্যাপার আমাদের মনে রাখা খুব জরুরি। তা হলো - কোভিড -১৯ তে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষেরই লক্ষণ এবং উপসর্গ খুব হালকা হয়। আবার কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে।
• প্রায় ৮০% রোগী কোনো চিকিৎসা ছাড়াই পুরোপুরি সেরে উঠেন।
• সব চেয়ে বেশি যেই উপসর্গ গুলো দেখা যায় তা হলো: জ্বর, ক্লান্তি, শুকনো কাশি। কারো কারো সর্দি, গলা ব্যথা, শরীরে ব্যথা, এবং ডায়রিয়াও হতে পারে।
• কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে, যেমন যাদের বয়স বেশি এবং যারা আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এর মতো কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছেন, এটি কঠিন রূপ নিতে পারে।
• তবে যদি জ্বর, কাশি এবং শাসকষ্ট থাকে, তার বয়স যাই হোক না কেন বা অন্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা না থাকলেও, তাকে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
• অসুস্থ ব্যাক্তি যেই দেশে আছেন, সেখানে যদি কোনো কোভিড - ১৯ হেল্পলাইন থাকে, তাহলে সরাসরি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে, হেল্পলাইনে ফোন করতে হবে। এবং তাদের নির্দেশ মতো কাজ কাজ করতে হবে।
কোভিড -১৯ এর চিকিৎসা:
আক্রান্ত দেশগুলোতে, ডাক্তাররা কোভিড -১৯ এর লক্ষণ এবং উপসর্গের চিকিৎসার সাথে সাথে, প্রয়োজনে বিভিন্ন এ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যেমন - লোপিনাভির – রিটোনাভির, ইন্টারফেরন -১β, আরএনএ পলিমেরেজ ইনহিবিটর রেমডেসিভির, ক্লোরোকুইন এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষুধ, ব্যবহার করছেন। পরবর্তীতে, সফল গবেষণা সাপেক্ষে, হয়তো আরও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন হবে।
পরিশেষে, আমাদের সবারই মাথায় রাখতে হবে যে, এই সংক্রামক ব্যাধিগুলো আগেও এসেছে, আবারও আসবে। এর জন্য আমাদের তৈরী থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সেই তৈরিটা যেমন ব্যাক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে হতে হবে, তেমনই জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও হতে হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে, ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়াদেরও বিশ্বায়ন হয়েছে। কারোর একার পক্ষে, বা কোনো একটি দেশের পক্ষে এই বিপদ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আমরা যত তাড়াতাড়ি এটি বুঝবো, তত তাড়াতাড়ি মানবজাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবো।
লেখক:
ডাক্তার মনিকা বেগ,
চিফ, এবং গ্লোবাল কোঅর্ডিনেটর,
এইচ এই ভি/ এইডস সেকশন,
জাতি সংঘ সদর দপ্তর