নানা কারণে ২০১৩ সামু ব্লগ থেকে মোটামুটি দুরেই ছিলাম। অনেক বেশি ছিলাম ফেসবুকে, টুইটারে, এবং অন্যান্য সোশাল আর নিউজ মিডিয়ায়। অবশ্যম্ভাবী হিসেবেই ২০১৩ এক চিরস্মরণীয় বছর হয়ে আছে আমার জন্য। তবে ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের কারণেই সেটা।
২০১৩ এর শুরুতে মূলত ৫ই ফেব্রুয়ারীর পর থেকে জীবন একেবারেই আমূল বদলে গেলো। নিজের কাজ কর্ম, পড়ালেখা, ঘর সংসার সব ফেলে শাহবাগের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। একেবারে পরিবার শুদ্ধ। অনেক ব্যাপারে অনেক বেশি আশা জাগানিয়া ছিল শাহবাগ এ ছুটে আসা মানুষ গুলো। এরপর জল গড়িয়েছে অনেক দূর।
শাহবাগ যেমন মানুষ এর অনেক দিনের আশা , দাবী, ক্ষোভ, চাওয়া, স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে, তেমন ভাবে আশাহত , স্বপ্নভঙ্গও করেছে।
শাহবাগের কাছে আমার ব্যক্তিগত চাওয়া ছিল ঃ
১। যুদ্ধাপরাধীদের সকলের দল, মত নির্বিশেষে অপরাধ অনুযায়ী প্রযোজ্য শাস্তি নিশ্চিত করা। এটি সফল ভাবেই হয়েছে তবে এখনো অনেক কিছু বাকি রয়েছে।
২। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে জড়িত সাক্ষী, উকিল, বিচারকদের লজিস্টিক সাপোর্ট এবং নিরাপত্তা বিধানে সরকারকে সজাগ ও বাধ্য করা । এই ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থই ধরে নিয়েছি। কারণ কারো নিরাপত্তাই সরকার সেইভাবে দেয়নি। ফলে, অনেকেই খুন হয়েছেন।
৩। বাংলাদেশের সব কয়টি রাজনৈতিক শক্তিকে বুঝিয়ে দেওয়া যে এই দেশে জামাত শিবিরের মত একটা ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন কোন ভাবেই রাজনীতি করতে পারবে না । পাশাপাশি জামাত শিবিরের রাজনীতির নামে সন্ত্রাসের আশ্রয় স্থল , মানে অন্যান্য পলিটিকাল পার্টি এবং ব্যবসা বাণিজ্য , বন্ধ করে দেওয়া। এই ব্যাপারেও তেমন সাফল্য আসেনি।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জামাত শিবিরকে অফিশিয়ালি নিষিদ্ধ বা ত্যাগ, কোনটাই করেনি। আবার ইদানিং শাহবাগ জামাত শিবিরের প্রতিষ্ঠান, পণ্য বর্জনের আন্দোলন না করে পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের আন্দোলনে নেমেছে। প্রশ্ন জাগে, আগে নিজের ঘর সাফ নাকি পড়শীর টাট্টিখানা?
অনেক বেশি খুশি হতাম যদি শাহবাগ জামাত শিবিরের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজে নামত। মানুষকে বুঝাতো ওদের ব্যবসা বাণিজ্যের টাকা খরচ হয় যে বোমা গুলো, আগুন গুলো গত দেড় বছর ধরে পুলিশ, সাধারণ মানুষ, বাচ্চা, গর্ভবতী মা মারছে, সেইগুলোর যোগাড়ে।
৪। মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়াও অন্য অনেক সমস্যা নিয়ে শাহবাগে কথা বলতে চেয়েছে। এই ব্যাপারে তখন বলা হয়েছিল, ফোকাস দরকার। বাংলা পরীক্ষার দিন ইংরেজি দেই না - জনপ্রিয় করে তোলা হলো। মূলত জামাত শিবির বি এন পি পন্থী লোকজনের তীব্র প্রচার, যুদ্ধাপরাধীদের উপর থেকে ফোকাস সরিয়ে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টাকে ঠেকানোর জন্যই এই নীতি নেওয়া হয়। কিন্তু, আরেকটা জিনিস মাথায় রাখা উচিত ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থায় দেশের মন্ত্রী, আমলা , কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কারো বিরুদ্ধেই সাধারণ জনতা প্রশ্ন, জবাবদিহিতা, অভিযোগ কিছুই করতে পারে না। এখানে জনতার ক্ষমতা কেবল মাত্র ৫ বছর পর পর এমন কাউকে ভোট দেওয়া যাকে সে নিজে পছন্দ/নমিনেট পর্যন্ত করেনি।
তারমানে, কে নমিনেশন পাবে, সংসদে যাবে কি যাবে না, গেলে কি নিয়ে কথা বলবে, কোন ব্যাপারে কি বলবে, কোন আইনে কি থাকবে, বাজেটে কি ব্যাপারে কি হবে, অন্য দেশের সাথে কি সম্পর্ক হবে, মানে জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ - দেশ এবং দেশের জনতার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা জনতার নেই।
কোন সাংসদকে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। পলিসি মেকার সাংসদ ও আমলারা যদি এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয় যেইটা দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী, তাকে আটকানোর কোন সিভিল পদ্ধতি নেই। সাংসদ যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট পান, সেই গুলো রক্ষা না করলে পরবর্তী নির্বাচনের আগে তাকে ধরার সুযোগ নেই।
সংসদে না গিয়ে মাসের পর মাস বেতন ভাতা তুলে নিলে আটকানোর সুযোগ নেই। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে জনতার ট্যাক্সের টাকা অপচয় করলে কিংবা বিল বাকি রেখে কেটে পড়লে, ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলে তাকে জনতা সরাসরি কিছু করতে পারে না।
সংসদে না গিয়ে হরতাল করে মানুষ মেরে ফেললে, অর্থনীতি ধ্বংস করে দিলে আইনত আটকানোর সুযোগ নেই। হরতাল এখন আর কেউই চায় না। বদমাইশ , লুইচ্চা ছাড়া। কিন্তু হরতাল নিষিদ্ধ হচ্ছে না। যেহেতু কথা না শুনলে গলায় ছুরি ধরে শোনানোর কুসংস্কৃতি তৈরী হয়েছে।
ফলে, জনতা তার সমস্ত সমস্যা, দাবী, প্রয়োজন, ক্ষোভ নিয়ে শাহবাগে এসেছিল। তাদের নিজেদের কথা গুলো নিজেরাই বলতে এসেছিল। যেহেতু সাংসদরা জনতার কথা বলে না। এমন কি মিডিয়ারাও বলে না। তারাও কারো না কারো পকেটের মিডিয়া। কোন না কোন পক্ষের কিন্তু জনতার বিপক্ষের মিডিয়া।
শাহবাগের উচিত ছিল মানুষকে তার কথা গুলো বলতে দেওয়া। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কয়েক ঘন্টা ফাঁসি চাই না চিল্লায়ে জনতার অভিযোগ অনুযোগ নিয়ে আলোচনা করলে এমন কিছু সমস্যা ছিল না। এক দুই ঘন্টা এইটা হইতেই পারতো। যেহেতু অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ ছিল। এই ব্যাপারে শাহবাগের অবহেলা আমাকে কষ্ট দিয়েছে।
৫। সব শেষে , আকাশ কুসুম কল্পনার মতই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে শাহবাগ থেকে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরী হবে। আমরা একদল সত্যিকারের শিক্ষিত, প্রচন্ড বুদ্ধিমান তবে প্রচন্ড দেশপ্রেমিক কিছু নেতা নেত্রী পাবো যারা প্রচলিত দলগুলোর বাইরে একটা ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করবেন। আমরা যারা ভোট দেওয়ার মত যোগ্য নেতা পাই না। যারা দল কানা হয়ে কোন দলের সর্বপ্রকার জনতার স্বার্থবিরোধী অপরাধের পরেও তাদেরকে ভোট দেওয়ার মত অপগন্ড , মূর্খ নই, তারা হয়ত একটা নতুন দল পেতাম ভোট দেওয়ার। এইটা অসম্ভব কিছু না। পাশের দেশ এ দিল্লীতে কেজরীওয়াল আর আম আদমী পার্টি করে দেখিয়েছে।
যদিও এমন কিছু হয়নি এখনো। তারপরেও এইটা সত্যি যে শাহবাগ দেখিয়ে দিয়েছে এমন কিছু "হতে পারে"। আমি ভাবতে চাই এখন এইটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজ নয়ত কাল।
দেশে নামে ৪১টা দল থাকলেও দল মূলত দুইটাই। দুই দল দিয়ে কখনো গণতন্ত্র হয় না। একটা শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষ দরকার যাতে কেউই দানব হয়ে উঠতে না পারে। একটা শক্তি দরকার যারা সত্যি সত্যি গণতন্ত্রের চর্চা করে । যারা জনতাকে দেশের প্রতিটা সিদ্ধান্তে যুক্ত রাখবে। যেখানে দেশের নির্বাহী, আইন ও বিচার আর প্রশাসনের শুরুটা হবে বটম আপ। মানে গ্রাম--> ইউনিয়ন--> উপজেলা --> জেলা--> বিভাগ --> জাতীয় - এই ধারায় বিল তৈরী হবে, যাচাই বাছাই হবে, সব শেষে সংসদে পাশ হবে।
এমন একটা দল যারা নিশ্চিত করবে, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যাকে চায়, সেই নমিনেশন পাবে, বেচা বিক্রির মাধ্যমে নয়।
যারা নিশ্চিত করবে, নিজ নিজ এলাকার মানুষের মৌল চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, গঠনমূলক বিনোদন) মেটানোর কাজে প্রতিটা গ্রাম প্রধান, ইউনিয়ন প্রধান, উপজেলা প্রধান এবং জেলা প্রধান তার নিজ নিজ এলাকার আয়, ব্যয়, উন্নয়ন পরিকল্পনা, আর বাজেট করবেন। সরকারী এবং বিরোধী দলীয় উভয় সংশ্লিষ্ট সাংসদ এই প্রধানদের সাথে সংযুক্ত থেকেই পরিকল্পনা করবেন। ভোটের আগেই আগামী ৫ বছরের পরিকল্পনা ডিটেইল জানাতে হবে। তার উপরে ভোটার সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কাকে সরকারে চান আর কাকে বিরোধী দলে।
নতুন এই দলটি নিশ্চিত করবে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাংসদ এবং কর্মকর্তারা কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন কিনা তার রিপোর্ট দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে কি হলো , কি হলো না, না হলে কেন হলো না, যাতে হয় তার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেওয়া হচ্ছে - এই জবাবদিহিতা করতে হবে প্রতি মাসে । বিরোধী দলের সাংসদকেও জবাব দিতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার ভূমিকা কি ছিল।
সত্যি যদি এমন হয় যে সরকারের প্রতিটা প্রজেক্টে বিরোধী দলীয় সাংসদকেও দায়িত্ব দিতে হবে এবং কাজ যদি ঠিক মত না হয় তাহলে দুইপক্ষকেই জবাবদিহি করতে হবে - তাহলে আর যাই হোক বা না হোক, সংসদে না গিয়ে বেতন ভাতা তোলা আর হরতাল করে মানুষ মারা বন্ধ হয়ে যাবে।
জগতের সকল চাকুরী ব্যবসাতে যদি কাজ না করলে বেতন বন্ধ হয়ে যায়, লস করলে জবাব দিতে হয়, তাহলে সংসদে নয় কেন? ৯০ দিনের নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া উচিত। একদিন অনুপস্থিত থাকলে সাংসদদের ঐদিনের বেতন কেটে রাখতে হবে।
এমন একটা রাজনৈতিক দল কি পাবো? গণতন্ত্রের নামে ভন্ডামি বন্ধ করার জন্য আর তো কোন উপায় নাই!
২০১৩ তে হারিয়েছি অনেক বরেণ্য ব্যক্তিকে। অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বছরের শেষে এসেও ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুই ছিল হাইলাইট। তাই অন্য তেমন ঘটনা নিয়ে আলোড়িত হতে পারিনি। এর মাঝে বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রী , সাধারণ জনতার সাফল্য ছিল অনেক। আবার হরতাল অবরোধ এর নামে হত্যাও ছিল অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আমার বাংলাদেশী পরিচয়ের অনেক বৈশিষ্ট্য থাকলেও যেমন মুক্তিযুদ্ধ ছাপিয়ে যায় অন্য সব কিছু, তেমন করেই ২০১৩ সালের বাংলাদেশ এ শাহবাগ ছাপিয়ে গেছে সকল ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বপ্ন, আশা, ক্ষোভ, বেদনা, আন্দোলন।
তাই সব মিলিয়ে ২০১৩ এক অনন্য বছর। প্রজন্ম একাত্তরের মত এখন আমি যেন প্রজন্ম শাহবাগ ।
সকলের শান্তি আর মঙ্গল কামনা করছি। শুভ নববর্ষ। ২০১৪ ভালো যাবে না, কিন্তু মনে প্রাণে দোয়া করি বছরটা মৃত্যুর মিছিলে না হারাক!
( ২০১৪ সালের নির্বাচনের নামে নাটক সম্পর্কে কিছু বলছি না, ওটা না হয় পরবর্তী পোস্টে)