যা হোক, তখন মেয়ে মহলে টম ক্রুজ হিট। খাতার পাতায়, জ্যামিতি বাক্সের ফাঁকে দিল মে চাক্কু ! ছেলেরা চেঁচায় , “ আয়া হায় মওসম পেয়ার কা , গায়া জামানা ইন্তেজার কা” আর মেয়েরা চুপি চুপি গুনগুনায় “ টেক মাই ব্রেদ এওয়ে” । সিরিকাস অবস্থা । তা একদিন বলে বসলাম টমরে দেখলে মনে হয় ওরে কেউ চিমটা দিয়ে টেনে লম্বা করে ফেলেছে । আর যাবা কোথায় , রাম ধোলাই খাই আর কি ! পরবর্তী দশটা দিন আমার টিফিন চুরি গেল নিয়মিতই । টম অভিনয় ভালো করে না , তা তো অবশ্যই না কিন্তু তার ছবি বুখে চেপে বালিশ ভিজানোটা বড্ড বাড়াবাড়ি লেগেছিলো । এর অনেক পরে টমের ১৮ বছর বয়সের লিজেন্ড ছবিটা দেখে কিডনীর ভিতরে হার্ট এটাক খেয়ে গেলাম। মানুষ এত্ত সুন্দর হয় কি করে ? ওইদিন বান্ধবীদের মাফ করে দিলাম।
এর মধ্যে বান্ধবী আলু ( মঈনের আলু না , কবিগুরুর আলু) প্রেমে পড়লো ওয়াসিম আকরামের । সারাক্ষণ তার ভিউকার্ড নিয়া ঘুরে আর কেউ ওয়াসিম আকরামের বিরুদ্ধে কিছু বললেই ভ্যাঁ। পাকিস্তানী বলে আমি নিতান্তই তারে সান্তনা দেওয়া দেখে বিরত ছিলাম । ক্রিকেট পছন্দ করলেও সেই আমলেও একই কারনে মাততে পারিনি ইমরান নিয়ে ।পাকিস্তানী সেজান জুস ছিলো চোখের বিষ, দেশী কাপড় ছাড়া পরতাম না। বড় বোনদের মহলে এক সময় দেখলাম মেল গিবসনের অনেক বেইল। কি এক লিথাল ঊইপন দিয়ে সবার হৃদয় আমচুর করে দিয়েছেন এই ভদ্রলোক। ছবিটা দেখলাম। পছন্দ হলো না । ছবির কারনে মেলরেও ফিমেল হার্টে স্থান দিলাম না । এর বহু বছর পরে কি এক কুক্ষণে দেখলাম ব্রেভ হার্ট। ছবির যেই দৃশ্যে যুদ্ধের ময়দানে মেল শত্রুর মুখোশ উন্মোচন করে দেখে এইটা তার জিগরী দোস্ত আর তারপর দশাশই কালা পাহাড়ের মত লোকটার চোখে পানি, আমি ঐ ময়দানেই হারাইলাম হুশ, মেরা দিল খুশ! কিন্তু , তারপরেও পাগল হই নাই। উলটা আমার ফেবারেট অভিনেতা হয়ে গেলো ( এখনো আছে ) রবিন উইলিয়ামস । আমি তারে দেখে হাসি আর সবাই আমারে নিয়া হাসাহাসি করে । এই রকম বিকট চেহারার অভিনেতার জন্য আমার এত জান পেহচান কেন । কেউ যদি তার প্যাচ এডামস ছবিটা দেখে তাহলেই বুঝবে কেন। ঐ ছবির একটা কথা আমার পেশা জীবনের মূল মন্ত্র হয়ে আছে। You treat a disease, you win, you loose. You treat a person, I guarantee you, you'll win, no matter what the outcome.
এইভাবেই একান্ত কুঠুরীর শুন্য দেওয়ালে মনের খেয়ালে কেটে যাচ্ছিল দিন। হঠাৎ এক ঘন ঘোর রাত্তিরে দেখা পাইলাম এক যুবকের । চেহারায় কঠিন আর কোমলের আশ্চর্য মিশেল। কি যেন মাদকতা মাখা । প্রথম ছবি কোনটা দেখেছিলাম এখন আর মনে নাই । তবে মনে আছে যে ছবির কারনে তার নাম সবার মুখে মুখে ফিরতো । দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের হলোকাস্টের ছবি শিন্ডলার্স লিস্ট । বহুবার বহুভাবে পড়া হলো ছবিটা সম্পর্কে কিন্তু দেখবো দেখবো করে দেখাই হলো না । আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সে ছবি আজও দেখিনি , ঘটা করে দেখবো বলে । দেখিনি হয়ত ভালোই হয়েছিলো কারণ ছবিতে ফাইন্সের চরিত্র ভিলেইনের। আর সত্যি কথা বলতে আমার আগ্রহের মূল কারন তখন লিয়াম নেসন।
ডে লুইস এর দা ক্রুসিবল তখন আমার দেখা অন্যতম সেরা ছবি । মেল এর মতই লিয়ামও আমার প্রিয় অভিনেতার তালিকায় অনেক উপরে । লিয়ামই আমাকে র্যালফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতো। তা হলো না । বরং আমি লিয়াম ডে লুইস, নেসন, জনি ডেপ এর ভালো ভালো ছবি নিয়ে মাতলাম। মাঝে বেশ কয়টা বছর পড়ালেখা, মুভি কেনার ঝামেলার কারনে তেমন করে ছবি দেখা হয়নি। যদিও দা ইংলিশ পেশেন্ট নিয়ে বহুত মাতামাতি হয়ে গেছে । ট্রেইলার দেখেছি, ছবি দেখিনি। ছেলেটাকে দেখে কেমন জানি লাগে । তাই দেখা দেখি বাদ দিয়ে পড়ালেখা করি। মেডিকেলের ঝুট ঝামেলা শেষ হলো। বাসার কেবলে নিয়মিত রাত জেগে ছবি দেখা শুরু করলাম। বোনের বাসায় হোম থিয়েটার এলে সেই উপভোগ বাড়লো। জনি ডেপ আপুর ও পছন্দ। তুমুল ছবি দেখা চলছে। এর মধ্যে ঘুরে ফিরেই র্যালফকে দেখি আর কেমন জানি লাগে । ওর মুভি দেখি না কিন্তু মাঝে মাঝেই ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে ওর ছবি দেখি। নাহ, দেওয়ালে পোস্টার পড়ে না কিন্তু পিকচার ফোল্ডারের একটা নির্দিষ্ট ফোল্ডার র্যালফের ছবি দিয়ে ভরে উঠতে থাকে। সাইলেন্স অফ দা ল্যাম্বস , গথিকা ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় দেখা হলো ফাইন্সের রেড ড্রাগন। একটু ধাক্কা খাইলাম। এমন কিছু আহা মরি ছবি না কিন্তু তারপরেও কয়েক বার দেখলাম। কিশোরীদের মত উচাটন মন নিয়েই দেখলাম।
এর কিছুদিন পর দেখলাম সেই ভয়াবহ ছবি। দি কন্সট্যান্ট গার্ডেনার । আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো । র্যালফের প্রতি যত ভালো লাগা আর টান চুপে চাপে পাথর চাপা ছিলো হঠাৎ যেন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গেলো। ছবিটার প্রতিটা দৃশ্য, গল্প, ভালোবাসা সব কিছু মিলিয়েই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলাম। মাত্রই জনস্বাস্থ্য নিয়ে, আন্তর্জাতিক সংস্থা আর তাদের বিভিন্ন পলিসি, সেবার নামে ব্যবসা, সাহায্যের নামে ব্যবসা নিয়ে পড়া শেষ করেছি। কেনিয়ার স্লাম গুলোতে এন জি ওর নামে , সেবার নামে , যক্ষার ওষুধের ক্লিনিকাল ট্রায়াল আর তাই নিয়ে ব্যবসা, রাজনীতি, খুন – প্লটটা বুকের খুব কাছে নাড়া দিলো। সবারই এই ছবি দেখা উচিত খালি এর গল্পের কারনে। তবে ঐ সিরিয়াস অংশটুকুর বাইরে র্যালফের আর তার বউ টেসার ( মামি খ্যাত র্যাচেল ওয়াইজ) ভালোবাসার দৃশ্যগুলো মনের ভিতর গেঁথে গেলো। এই একটা ছবি দেখতে গিয়ে আমি তিন বার বন্ধ করে উঠে গেছি কান্না থামাতে না পেরে। এফোড় ওফোড় করা একটা ছবি দেখতে দেখতে এই প্রথম মনে হলো আমি এই রকম ভালোবাসাই চাই। ঠিক এই রকম। এবং এর সাথে সাথে স্বীকার করে নিলাম যে হ্যাঁ, হাত পা ভেঙে কারো জন্য যদি অযৌক্তিক অস্বাভাবিক ভালোবাসা গড়ে ওঠে যার সাথে বাস্তব জীবনের কোন সম্পর্কই নেই , থাকতে পারে না সে হলো র্যালফ ফাইন্স। সেই বছরই মেইড ইন ম্যান হাটানে জেনিফার লোপেজকে চুমু খেতে দেখে যখন বুকে রীতিমত ব্যথা অনুভব করলাম তখন বুঝলাম, “ওয়াক্ত কে সাথ সাথ খেয়ালত ভি বদল জাতি হায়” ।
এর পর আর কি ? খুঁজে খুঁজে তার সমস্ত ছবি দেখা । উইদারিং হাইটস, ওনেগন, দা এন্ড অফ দা এফেয়ার। চলছে চলবে । এখন উচাটন হয়ে খুঁজছি “দা বেবি অফ ম্যাকন”। আমাদের লাল সালুর সাথে মিল আছে মনে হলো। কিন্তু সে ছবি নাকি এতই বিতর্কিত যে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ দেবেন নাকি খুঁজে আমার র্যালফ কে?