" এই যে ! আমার লম্বা মেয়েটা ! ঘুম কি ভাঙলো ?"
আমার খুব সুন্দর একটা নয় , মোট তিনটা নাম আছে । একেবারে আকিকা দিয়ে আড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত নাম । তারপর ও এই দুষ্টু নামটায় , এই আলতো ডাকটায় এমন আদর ছিলো , আমি অনেক আগে ঘুম ভেঙে গেলেও মটকা মেরে পড়ে থাকতাম , শুধু আব্বুর অপেক্ষায় ।
আব্বু আর ডাকে না অমন করে ।
কেউ কি ডাকবে এতটা আদর নিয়ে ?
---------------------------------------------
আমার খুব জ্বর হতো ।আব্বুকে একদিন না দেখলেই জ্বর । ডাক্তার সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত নিয়েও বের করতে না পেরে , শত শত ওরাসিন কে খাইয়েও জ্বর বন্ধ করতে না পেরে বলে দিলো ," আপনার মেয়ে আপনাকে না দেখে থাকতে পারে না । এইটা মানসিক শক এর প্রতিক্রিয়া।"
আব্বু হতভম্ব তাকিয়ে ছিলো । এই এত্তটুকুন মেয়েটা কি এমন ভালোবাসলো যে না দেখলেই জ্বর! আব্বুকে এখনো তেমন করেই ভালোবাসি । এখনো একদিন না দেখতে পেলে , কোথাও গেলে , কেমন যেন সব কিছু অসহ্য লাগতে শুরু করে । হয়ত সারাদিন কথাই হলো না ।হয়ত অফিস নিয়েই পড়ে আছি । তবু আব্বু বাসায় থাকা মানে মনের ভিতর একটা কথা প্রজাপতির মত উড়তে থাকা , "আছে তো ! এই তো আশে পাশেই আছে । "
এমন তুমুল জ্বরে একবার আমি যশোরে , আব্বু ঢাকায় । আব্বু ছুটি চাইলো , বস দেবে না । সোজা চাকরী ছাড়ার দরখাস্ত বসের পিয়নের হাতে ফেলে দিয়ে যশোর চলে এলো , অফিসে পিয়ন তখন পাগলের মত খুঁজছে - স্যার , আপনার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে , কাগজটা নিয়ে যান দয়া করে । কে শোনে কার কথা ! সন্ধ্যা নাগাদ আব্বু যশোরে । বাড়িতে ঢুকে কারো সাথে কোন কথা নাই , এমন কি মামণির সাথেও না । আমাকে বুকের ভিতর জাপটে ধরে জানালার পাশে , গাল ভিজে যায় ফোটায় ফোটায় । কালা পাহাড়ের মতন দশাসই লোকটাকে ৩০ বছরে আর একবার মাত্র কাঁদতে দেখেছি , দাদী যেদিন মারা গেলো ।
কেউ কি এমন করে কাঁদবে আমার জন্য ?
---------------------------------------------------
ইস্কুলে একটা শিউলি গাছ ছিলো । ক্লাস রুমের পাশেই । তখন পড়ি ক্লাস টু কি থ্রিতে । গাছটা ক্লাস থ্রি আর ফোরের মাঝামাঝি মাঠে । বড় ক্লাসের মেয়েরা চলে এলে ছোটরা আর ফুল কুড়াতে পারে না ।তাই সোয়া সাতটার ভিতর ইস্কুলে যেতাম । গায়ে সোনা রোদ । পরনে নীল জামা । পিঠের উপর ডাকাতের মত মোটা এক ব্যাগ । পায়ে কালো জুতো । সাদা ধবধবে মোজা । টুক টুক করে হেঁটে চলেছি ।পকেটে সুঁই আর সুতো । গুন গুন করে গাইছি , " ও আমার বাংলা মা তোর ।" অথবা "রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়ালো "। মন খুব ফুরফুরে থাকলে , " সোম বারে পাখিটির ডিম ছিলো দুটি " কিংবা " ফিঙে নাচে ঝিঙ্গে পাতায়" । দুষ্টু মুডে থাকলে ," তোমরা বলো সন্ধ্যে হতেই যদি ভোঁ ভোঁ করে মশা " ।
কোন মতে ক্লাসে ব্যাগটা রেখেই ছুট ছুট । উর্মিকে খুব হিংসে কারন ওর বাড়িটা ইস্কুলের মাঠের ঠিক পিছনে ! রেহনুমার মা ওকে ঠিক সাতটায় ইস্কুলে দিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করতে যায় । নীতুর বাবা অনেক দূরে চাকরী করে । কখনো সাতটা দশের পরে আসাও হয় না তাই ! আমি কিছুতেই ওদের আগে পৌঁছাতে পারি না । সাদা কমলায় স্বপ্নের মতো মাটিতে লুটায় আমার ফুল । আমি ওদের মালায় গাঁথবো বলে সুঁই সুতো নিয়ে হেঁটে যাই শরতের মেঘ ভরন্ত সকালে । সাদা মেঘ , ছাই রঙা মেঘ , গোলাপি , লালচে আর কতকটা শিউলি বোটার মত কমলা ।
খুব ইচ্ছে করে । এক এক করে ফেলে দেব কমলা বাহুল্য । আমার সাদা খুব প্রিয় । শুধু সাদা পাপড়ি গুলো নিয়ে এক এক করে গাঁথবো সুতোয় । মুহুর্তের পর মুহুর্ত পার হয়ে একটা অকল্পনীয় সুন্দর , নিখাঁদ , পবিত্র মালা হবে । একটা নয়, দুটো । নীতু, রেহনুমা আর উর্মিরা অনেক আগেই মালা নিয়ে ঢুকে পড়ে জগতের ক্লাস রুমে । আমার কেবলই দেরী হয়ে যায়!
আমি আঙ্গুলে সুঁই ফুটিয়ে রক্তাক্ত বসে থাকি। এখনো । কেউ কি ফিরিয়ে দেবে সেই শিউলি ফুল ?
দেহলিতে কপট কিঙ্কর
দেবসভায় দেবারি দরাশে
রই অন্তরীন অন্তরে একা
দেহী গ্রাসে তমসা তরাশে !
ছায়া নীরে মুকুলিত মৃদুল জটা
স্বপনে দহিত দুহিতা নিবিলো ছটা
আরশে আশা দলে উত্তর
সওয়ালে সিঁদুর প্রকাশে
গৃহী ভস্মে সুলুক বিস্তর
দহিতা মগন সকাশে !
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৩১