বিস্তীর্ণ এই পাটের একটা ক্ষেতে চললো দুদিন ব্যাপী গোপন সম্মেলন। সম্মেলনে উপস্থিত হতে পেরেছিলাম আমি , দাউদ, আব্দুল খালেক (মনি), সাখাওয়াত হোসেন, ফজলুর রহমান, শরিফুল ইসলাম। এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য যশোর কলেজের নির্দিষ্ট কয়েক জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। যার একটা চিঠি ধরা পড়ে গেল যশোর ডি বি পুলিশের সেন্সরশীপ প্রসেসে। এই সূত্র ধরে মদিউদ্দিন , ফসিয়ার রহমান আর কামরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের সংবাদ পেয়ে দ্রুত "মুক্তি সনদ" অনুমোদন ও গ্রহন করে সম্মেলন শেষ করে দেওয়া হয় এবং বাকীরা যে যার মত গা ঢাকা দিতে বাধ্য হই।
আমি আর দাউদ চলে এলাম ঢাকায় বন্ধু শামসুর রহমানের আস্তানায়। সে তখন সোশাল ওয়েলফেয়ারে চাকরী করে। থাকতো পুরানো ঢাকার ২৯ খাজা দেওয়ান লেনের এক মেসে। মেসটা নিরাপদ মনে না হওয়ায় আমরা আমলিগোলায় আরেকটা মেসে চলে গেলাম। আমাদের সবার বিরুদ্ধে ডিপিআর এ কেস দেওয়া হয়েছিল যার অর্থ ছিল বিনা বিচারে আটক এবং জেল। আমি এবং দাউদ আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় একদিন তোহা সাহেবের পুরনো ঢাকার বাসায় সাক্ষাত করলাম। খুব বেশি কথা হলো না।তবে তোহা সাহেবের কমুনিজমের দর্শনের চেয়ে আমাদের কাছে যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বেশ স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ডিস্প্যারিটি শব্দটা ছিল একটি বহুল উচচারিত শব্দ। বিশেষ করে ইত্তেফাক পত্রিকায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ডিস্প্যারিটি বা বৈষম্যগুলো তুলে ধরা হতো। চাকরী, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রের বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের যুব সমাজকে দারুন ভাবে নাড়া দিতো। কিন্তু আমরা এটাকে বৈষম্য বলে মেনে নিতে রাজি ছিলাম না। আমরা এটাকে বলতাম পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষন , যার একমাত্র সমাধান হলো পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা!
আমাদের সূচনা বলা যায় ১৯৬০ সাল হতে। যশোর এম এম কলেজের পুরোনো হোস্টেল। এর পাচিলের পশ্চিম পাশের রাস্তার অপর দিকে নাভারন মেসে থাকতো দাউদ, শাহজাহান, রশিদ, মহিউদ্দিন, ফসিয়ার প্রমুখ। যশোর কলেজের কিছু ছাত্র। এই মেসে চলতো আলোচনা। আলোচনায় অংশগ্রহনকারী আমরা সবাই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাপন্থী ছিলাম।
আত্মগোপন থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লুকিয়ে থেকে আমরা তখন সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছিলাম। ইতমধ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষনা করেছেন। এই সময়ে একদিন যশোরের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. মোশাররফ হোসেন গোপনে খবর পাঠালেন যে, আমাকে এবং দাউদকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠিয়েছেন।
ঢাকায় দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট দিন ক্ষণে আমরা পুরনো পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে উপস্থিত হলাম। বঙ্গবন্ধু তার ভীষন ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের আলাদা করে পাশের কামরায় নিয়ে গিয়ে কথা বললেন !
ঃ " তোমাদের কর্মসূচী ফাঁস হলো কি করে? "
আমরা ডি বি পুলিশের সেন্সরশীপের কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু আরও সতর্ক হওয়ার উপদেশ দিলেন।
আমরা এক পর্যায়ে ৬ দফার সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুললাম !
বঙ্গবন্ধুঃ ৬ দফা টফা কিছু না। সব আসলে এক দফা । [ ১৯৬৬ সাল]
আমিঃ ১ দফা অর্জনের জন্য যে সংগঠন দরকার তার ব্যবস্থা কোথায় ?
তিনি বিস্তারিত কিছু বললেন না। শুধু বললেন ............... [ পরবর্তী কোন পর্বে প্রকাশিতব্য]
এই ছোট্ট ঘটনাটার বর্ননা এখানেই শেষ ।
লক্ষনীয় বিষয় ২ টি।
১। আমাদের মত ছাত্রদের সংগঠিত একটা বিষয় যা কোন বড় আকারের রাজনৈতিক বিষয় ছিল না, ছোট হয়েও বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি । তিনি আমাদের মত নাম গোত্রহীন ছাত্রকে ডেকে জানতে চেয়েছেন এবং শুনতে চেয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা।
২। ৬ দফার আসল উদ্দেশ্য ছিলো স্বাধীনতা অর্জন তা তিনি আমাদের সামনে উচচারন করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেননি।
বাংলা এবং বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তাঁর নিঃশঙ্ক চিত্তে যে এতটুকু পরিমান সংশয় ছিল না, এটা তারই প্রমাণ।
[আমরা যেন সত্য ইতিহাসকে চিনতে শিখি, বুঝতে শিখি, জানতে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলি। লেখাটি গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক ,স্বাধীনতা যুদ্ধে ৮ নং সেক্টর ( যশোর,কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ এবং খুলনা , ফরিদপুরের কিছু অংশ) এর একজন মুক্তিযোদ্ধার নিজ জবানীতে বর্নিত।
জনস্বার্থে পুনঃপোস্ট । এই ইতিহাসের টুকরো টুকরো বর্ননা চলতে থাকবে । ]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৫৫