পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার অন্যতম হচ্ছে রূপলাল হাউজ। সরকারিভাবে এই স্থাপনাটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পদ ঘোষণা করার পরও তা দীর্ঘকাল ধরে বেদখল হয়ে রয়েছে।
ইতিমধ্যেই রূপলাল হাউজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মালিকের নামে ( জামাল হাউস, আনোয়ারা হাউস ইত্যাদি) সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই দাবি এই অংশটি তাদের। এ বিষয়ে তাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
জানা গেছে মালিকানার বিষয়ে তারা আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে জাতীয় জাদুঘর স্থাপিত যে সাইনবোর্ডটি ছিল তা ইতিমধ্যেই অপসারণ করা হয়েছে।
ভবনটির নিচতলার পুরোটাই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে। রূপলাল হাউজকে ঘিরে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে জনতা কৃষি পণ্য বিপণন কেন্দ্র, বৈশাখী বাণিজ্যালয়, আরাফাত ট্রেডার্স, মেসার্স ঢাকা-বাংলা আড়ৎ, রাশেদ বাণিজ্যালয়, ইউনাইটেড ট্রেডার্স প্রভৃতি। ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয় থেকে লিজ নিয়ে ব্যবসা করছেন এবং ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করছেন।
অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে এখন যারা এই ভবনে বসবাস করছেন তারা অনেকেই জানেন না এক সময় এর নাম ছিল রুপলাল হাউজ। বর্তমানে এ ভবণের বিভিন্ন স্থানে কিছু বিজিবি সদস্য নিজ নিজ পরিবার পরিজনসহ বসবাস করছে। তারা পোস্তগোলাস্থ ১২৪৩ নং খুঁটির সদস্য এবং কমান্ডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রনাধীন। উক্ত ভবনে বসবাসকারীদের কোন ভাড়া পরিশোধ করতে হয় না।
এদিকে রুপলাল হাউজের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার আলী খান নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলেন, রুপলাল হাউজ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পদ। আর এ ভবনের মতো ঢাকার আরো অন্যান্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ চলছে। অচিরেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) এবং হেরিটেজ কমিটির সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, রুপলাল হাউজও ঢাকার একটি ঐতিহ্য। রুপলাল হাউসের যথাযথ সংরক্ষন প্রয়োজন। প্রয়োজন মেরামতের। অনাকাংখিত স্থাপনা গুলো ভেঙ্গে দিয়ে মুল বাড়িটি আবার মেরামত করলেই ফিরে পাবে রুপলাল হাউজের পুরোনো সেই রুপ।
তিনি বলেন, আমি মনে করি প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে যেন ভবন মালিককে একটি ক্ষতিপুরণ দেয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী এলাকা আছে। আমাদের দেশেও এটি করা সম্ভব। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব।
পুরান ঢাকার ১৫ নং ফরাশগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ১৮২৫ সালে আরমেনিয়ান জমিদার আরাতুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৩৫ সালে রূপলাল দাস এবং তার ভাই রঘুনাথ দাস বাড়িটি কিনে নেয়। এরপর থেকে বাড়ির নাম হয় রূপলাল হাউজ।
রূপলাল দাস ছিল একজন ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন এবং সেই সময় স্কলারশিপ পেয়েছিলেন ১০ টাকা। জানা যায় তিনি একজন সঙ্গীত অনুরাগীও ছিলেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার যতটুকু অংশগ্রহণ ছিল তার চেয়ে বেশি তিনি খরচ করতেন সঙ্গীতের পিছনে। সেই সময়ে রূপলাল হাউসে নিয়মিত সংগীতের আসর হতো। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালী উল্লাহ খান এবং লক্ষী দেবীসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রূপলাল হাউজে সংগীত আসরে নিয়মিত আসতেন।
১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন ঢাকায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাদের সন্মানে নাচ গানের আসর কোথায় হবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউজের মধ্যে। এতে অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হয় রূপলাল হাউজ। সেই সময়ে ৪৫০০০ টাকা ব্যয়ে রূপলাল হাউসের আধুনিকীকরণ করা হয়। জানা যায়, সেই সময় বিদেশীরা ঢাকায় আসলে রূপলাল হাউজে কক্ষ ভাড়া করে থাকতেন। সেই যুগে কক্ষপ্রতি ভাড়া ছিল ২০০ টাকা।
১৮৯৭ সালে বড় ধরনের ভুমিকম্প হলে বাড়িটি অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর বাড়িটির অনেক অংশ প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। রূপলাল হাউজের একপাশে সুন্দর বাগান ছিল যা ‘রঘুবাবুর বাগান’ এবং একপাশে একটি পুল ছিল যার নাম ছিল শ্যামবাজার পুল। কালের বিবর্তনে অযন্তে অবহেলায় এইগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর নদীকে ঘিরে বাজার গড়ে উঠে যার নামকরণ করা হয় শ্যামবাজার। বাড়ির ভিতরের অংশে ইউরোপিয়ান অফিসার এবং ব্যবসায়ীরা থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে নদীর অংশটি ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে উঠে ফলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে তারাও জায়গাটি ত্যাগ করেন।
রূপলাল হাউজের সর্বশেষ মালিক রূপলালের পৌত্র যোগেন্দ্র দাস এবং তারকনাথ দাস। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর দাস পরিবার সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। শেষ হয় রূপলাল হাউজের এক পর্বের ইতিহাস। তবে এখানেই শেষ নয়।
১৯৪৮ সালে বাড়িটি সরকারী সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সিদ্দিক জামাল নামে একজন দাবি করেন যে তিনি দাস পরিবার থেকে ১৯৭১ সালে রঘুনাথের অংশটি কিনে নিয়েছেন। সেই সুবাদে তিনি ২য় তলায় বসবাস শুরু করেন। তারই সুত্র ধরে সিদ্দিক জামালের মৃত্যুর পর তার ছেলে দাউদ জামাল ১৯৭৩ সালে ভারতে চলে যান। এরপর নুরজাহান ও তার স্বামী দাবী করেন যে, এই অংশটি তাদের এবং তারা বর্তমানে বাড়িটির দখলে আছেন। তারা এখানে গত তিরিশ বছর ধরে বসবাস করছেন।
রূপলাল দাসের অংশটিতে প্রিন্স করিম আগাখান প্রিপারেটরী স্কুল চালু হয় ১৯৫৮ সালে। ১৯৭৩ সালে তা কলেজে উন্নীত করলে মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তা গুটিয়ে ফেলা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার রক্ষীবাহিনীর জন্য বাড়িটি রিক্যুইজিশন করে। রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তির পর ১৯৭৬ সালে রূপলাল হাউজকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
বলা হয়ে থাকে, তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্থাপত্য এই রূপলাল হাউস। বাড়িটি ইংরেজী “ই” আকৃতিতে তৈরি। রূপলাল হাউজের ডিজাইন করেছিলেন কলকাতার মার্টিন কোম্পানি।
ইউরোপিয়ান নির্মাণ কৌশলে নির্মিত এই বাড়ির র্দৈঘ্য ৯১৪৪ মিটার। প্রস্থ ১৮৩০ মিটার। দোতলা বাড়িটির দুটি ব্লকে বিভিন্ন সাইজের ৫০টি কক্ষ আছে। ঠিক মাঝখানে কাঠের নৃত্য মঞ্চ। স্থাপত্য নকশায় এ ভবনটিতে যথেষ্ট বৈচিত্র্য এবং কারুকাজ বিদ্যমান।
রূপলাল হাউস তার রুপ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই আর এখন এর অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানে স্থানে ভেঙ্গে পড়েছে। মেরামতের কোন উদ্যোগ নেই। ছাদে কার্নিশে এবং অন্যান্য স্থানে বটগাছ গজিয়েছে। কিন্তু বসবাসকারীরা এখনো নির্বিঘ্নে বসবাস করে যাচ্ছে। চারিদিকে অসংখ্য দোকান পাঠসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে মুল ভবনকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।